Friday, August 28, 2020

শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক: সালাহুদ্দীন আইয়ুবির অবস্থান

আবদুল্লাহিল বাকি:

১.

বর্তমানের শিয়া সুন্নির দ্বন্দ্ব ও সংঘাত আমরা দেখছি, তাতে ইতিহাসকে উপস্থাপন করা হচ্ছে খণ্ডিতভাবে। শিয়া ও সুন্নি—উভয় দলের রক্ষণশীল ও একরোখা অংশটি হয়ে উঠছে এই খণ্ডিত ইতিহাসের ইন্ধন। ইরাকে কয়েক বছর আগে উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে যে রক্তারক্তি ও লড়াই চলেছে, সেটাকে কোনমতেই সমর্থন করে না ইসলাম।

শিয়া সম্প্রদায়ের কিছু লোকের চোখে, সুন্নিরা হয়ে উঠেছে ওয়াহাবী নাসেবী, নবী বংশের শত্রু। তাই ইসলামী ইতিহাসের প্রথম হিজরী থেকেই তাদের প্রতিশোধ নিতে শিয়ারা বদ্ধপরিকর।

অন্যদিকে সুন্নি সম্প্রদায়ের কিছু লোকের চোখে, সব শিয়ারা হয়ে উঠেছে রাফেজী বাতেনী। প্রকাশ্যে যারা ইসলামকে স্বীকার করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে লালন করে কুফুরী।

এই প্রচন্ড বিদ্বেষ অন্ধ ঘৃণার মুখে তারা হয়তো ভুলে বসে আছে, ইসলামী ইতিহাসের প্রকৃত লড়াই শিয়া সুন্নির পারস্পারিক লড়াই নয়। দুই দলের মাঝে যদিও চিন্তাগত, আকিদা ও ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক ফারাক রয়েছে, তবুও দুজনই একই শত্রুর চক্ষুশূল। তারা সম্মিলিতভাবে সেই শত্রুর প্রতিরোধে এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সে শত্রু তাদের মাঝে শত্রুতা বাধিয়ে দেয়। এর অর্থ এই নয় যে, শিয়াদের মধ্যে আকিদাগত ভ্রান্তি নেই, সে তো অবশ্যই আছে ; তবে সব শিয়া সমানভাবে ভ্রান্ত, এই বক্তব্যেও বাড়াবাড়ি আছে।

আমরা বর্তমানে যে দ্বন্দ্বমুখর সময়ে বসবাস করছি, সেটা সালাহুদ্দীন আইয়ুবির যুগের সাথে অনেক দিক থেকেই মিল রাখে। সেই যুগের মুসলমানদের নেতা হিসাবে, এই দিকটি তিনি কীভাবে সামাল দিয়েছেন, সেটা এই প্রবন্ধে তুলে ধরার প্রয়াস পাব। বর্তমান যুগে কট্টর শিয়া ও সালাফীরা সালাহুদ্দীন আইয়ুবির অবস্থানকে যেভাবে পাঠ করেছেন, সেটার অসম্পূর্ণতাও উঠে আসবে এই লেখায়। বলে রাখা ভালো, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শিয়াদের বিষয়ে তিনি আশায়েরী আকিদা পোষণ করতেন, ফলে তিনি তাদের ভ্রান্তি বিষয়ে মোটেই নমনীয় ছিলেন না; তবে প্রায়োগিকভাবে যথেষ্ট সতর্কতার সাথে নেতৃত্ব ও কৌশল প্রণয়ন করেছেন।

তার সময়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাগদাদের খেলাফতের বিপরীতে তখন ফাতেমি সাম্রাজ্য খেলাফত ঘোষণা করে বসেছিল। আকিদা ও ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল পূর্বের ধারা থেকে। এমনকি মিশরের সুন্নিদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল তাদের কারণে। সহি বুখারী পাঠ করলে অন্যায় বলে গণ্য হতো সরকারিভাবে। এতকিছুর পর‌ও সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তাদের সাথে যে আচরণ করেছিলেন, সেটা ছিল সম্পূর্ণ কৌশলগত, যুগোপযোগী। তখন পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসছিল ক্রুসেডার শত্রুর দল, আর পূর্ব থেকে হামলা করার জন্য উদ্যত হয়ে রয়েছিল মঙ্গোলিয়ান সৈন্যবাহিনী। তাই এই দুই শত্রুর মাঝখানে, তিনি অতিরিক্ত কোনো শত্রু তৈরি করতে চাননি।

২.

ফাতেমী সাম্রাজ্যের সাথে সালাহুদ্দীন আইয়ুবির সম্পর্কের সূচনাটা হয়েছিল ক্রুসেড শত্রুর মোকাবেলার প্রশ্নে। মিশরে অবস্থিত ফাতেমী শিয়া খলিফা সিরিয়ার সুন্নি শাসক নুরুদ্দিন জানকির কাছে শত্রুর মোকাবেলায় সাহায্য প্রার্থনা করেন। তখন সালাহুদ্দীন আইয়ুবিকে মিশরে পাঠানো হয়। তিনি মিশরে গিয়ে ফাতেমী সাম্রাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন এবং এই সাম্রাজ্যের পতাকা তলেই লড়াই করেছেন ক্রুসেডারদের সাথে। সেখানে গিয়ে তিনি কোনো মাযহাবী দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটান নি। মন্ত্রী হয়ে তাদের সাথে দয়ার আচরণ করেছেন। ফাতেমী খলিফা আদিদ লি-দীনিইল্লাহর ইন্তেকালের পর তিনি মিশর ও শাম অঞ্চলের সুলতান হয়েছেন।

সালাহুদ্দীন আইয়ুবির বন্ধু খাস লেখক ও তার জীবনী রচয়িতা ইবনে সাদ্দাদ ‘আন-নাওয়াদিরুস সুলতানিয়া ওয়াল মাহাসিনুল ইউসুফিয়া’ গ্রন্থে (২৮০-২৮১), এবং আবু শামাহ ‘কিতাবুর র‌ওজতাইন ফী তারিখিদ দাওলাতাইন’ গ্রন্থে— শিয়াদের সাথে সালাউদ্দিন আইয়ুবির আচরণের কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। যেখান থেকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা ও ঐক্য টিকিয়ে রাখার মানসিকতা পরিলক্ষিত হয়।

ইবনে সাদ্দাদ বর্ণনা করেছেন, “নুরুদ্দিন যানকি সালাউদ্দিন আইয়ুবী নিকট শাম থেকে একজন দূত পাঠালেন। এর মাধ্যমে আদেশ দিলেন, মিশরের মসজিদে মসজিদে যেন, আব্বাসী খলিফাদের জন্য খুতবার মধ্যে দোয়া করা হয়। আর এটা ছিল ইঙ্গিতে আব্বাসীয় খেলাফতের বায়াত গ্রহণ করা এবং ফাতেমী সাম্রাজ্য থেকে সম্পর্কহীনতার আহ্বান। কিন্তু এই অনুরোধ সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ফিরিয়ে দিয়েছেন ফিতনার আশংকায়।”

আবু শামা বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করে বলেছেন, “সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এই অনুরোধটি গ্রহণ করেননি। কারণ তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, এটা গ্রহণ করলে মিশরবাসীরা তার প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠবে। কারণ তারা বেশিরভাগই শিয়া মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত।”

সালাউদ্দিন আইয়ুবী যে ফাতেমী সাম্রাজ্যকে স্বীকার করে নিয়েছেন—বিষয়টি তেমন নয়। বরং তিনিও চেয়েছেন আব্বাসীয় খেলাফতের হাতে বায়াত হয়ে যেতে। কিন্তু পরিস্থিতির জটিলতার কারণে এই বিষয়ে তিনি ধীরস্থিরতার সাথে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।

ওই পাশ থেকে, নুরুদ্দিন যানকি বারবার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ পাশ থেকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তেমন কোনো সাড়া দিচ্ছেন না ইতিবাচক। শেষে অসুস্থ হয়ে পড়লেন ফাতেমী খলিফা আদিদ। অসুস্থতার দরুন তিনি নামাজে উপস্থিত হতে পারতেন না। এসময় শিয়াদের পরিস্থিতি অনেকটা শীতল দেখে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বায়াত গ্রহণ করে নিলেন আব্বাসী খেলাফতের হাতে। যদি ফাতেমী খলিফার সুস্থতার সময়ে আব্বাসীয় খেলাফতের হাতে বায়াত গ্রহণ করতেন, তাহলে মিশরে শিয়া সুন্নির মাঝে গৃহযুদ্ধ বেধে যেত।

সেই অসুস্থতার কিছুদিনের মধ্যেই যখন ইন্তেকাল করলেন ফাতেমী খলিফা আদিদ, তখন সালাউদ্দিন আইয়ুবী অনুশোচনায় পড়ে গিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক আবু শামা বলেছেন, “খলিফা আদিদের ইন্তেকালের পর সালাহুদ্দীন আইয়ুবি অনুশোচনার দরুন বলেছিলেন, যদি জানতাম তিনি এই অসুস্থতার মধ্যেই ইন্তেকাল করবেন, তাহলে তার অসুস্থতার সময় আমি এই সিদ্ধান্ত নিতাম না। বরং তার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করে যেতাম।”

সালাহউদ্দিন এবং আদিদের মাঝে যদিও মাযহাবগত দিক থেকে বিরাট ফারাক ছিল, তবুও মৃত্যুর পূর্বে সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে আদিদ ওসিয়ত করে গিয়েছিলেন আপন সন্তানদের ব্যাপারে। এ সম্পর্কে আদিদের পুত্র আবুল ফুতুহ বিন আদিদ বলেছেন, “আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার পিতা মৃত্যুশয্যায়। ডেকে আনলেন সালাহুদ্দীন আইয়ুবিকে। আর সোপর্দ করে গেলেন তার হাতে আমাদেরকে। তিনি সর্বদা আমাদের প্রতি যত্নবান ছিলেন এবং আমাদেরকে সম্মানের চোখে দেখতেন।” ঐতিহাসিক আবু শামাহ এটা বর্ণনা করেছেন। ইবনে শাদ্দাদ বলেছেন, “আদিদের ওসিয়ত অনুযায়ী তার পরিবারকে আপন প্রাসাদের এক স্থানে জায়গা করে দিলেন। এবং তাদের দেখাশোনার জন্য কিছু লোক নিয়োগ করলেন।” আবু শামা বলেছেন, “ফাতেমী পরিবারকে দেয়া স্থানটি ছিল প্রশস্ত এবং স্বাচ্ছন্দপূর্ণ।”

ফাতেমী খলিফা যখন ইন্তেকাল করলেন, তখন সালাউদ্দিন আইয়ুবী অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন, এমনকি ক্রন্দন পর্যন্ত করেছিলেন। তার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেছিলেন রাজকীয়ভাবে।

৩.

সালাউদ্দিন আইয়ুবী ছিলেন একজন একনিষ্ঠ সুন্নি শাসক। পালন করতেন শাফেয়ী মাযহাব। তিনি উম্মাহর ঐক্যের প্রয়াসী ছিলেন। অন্যদিকে মিশরের ফাতেমিরা ছিল কট্টর শিয়া মতবাদের সমর্থক। বাগদাদের খেলাফতে আব্বাসিয়ার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল তারা।

সারা মিশরে তখন আধিপত্য করছিল শিয়া চিন্তাধারা। তিনি ক্ষমতা প্রয়োগ করে এ চিন্তাকে প্রতিহত করতে চাইলে, তার কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিলনা। কিন্তু এতে শিয়া সুন্নির গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই ধীরস্থিরতার সাথে এই সমাজকে তিনি সুন্নি আবহে রূপান্তরিত করার প্রয়াস চালিয়ে যেতে থাকেন। প্রয়োগিকভাবে না হলেও চিন্তানৈতিকভাবে, কৌশল অবলম্বন করে তিনি এই পথে অগ্রসর হন।

এই ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম পদক্ষেপ ছিল, প্রচুর সুন্নি ধারার মাদরাসা নির্মাণ। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো, মাদরাসায়ে নাসিরিয়া, মাদরাসায়ে কামহিয়া, মাদরাসায়ে সাইফিয়া মিশর, মাদরাসায়ে ছালেহিয়া দামেস্ক, মাদরাসায়ে ছালেহিয়া কুদস।

আল-আজহার তখন প্রতাপের সাথে প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছিল ফাতেমি সাম্রাজ্য ও চিন্তাধারার। কারণ তাদের হাতেই আল-আজহার নির্মিত হয়েছে। এটাকে ভেঙে ফেলা অথবা ফাতেমীদের কর্তৃত্ব থেকে ছিনিয়ে নেয়া এতটা সহজ ছিল না। এখানে তিনি কৌশলের সাথে উদ্দেশ্য আদায় করে নিয়েছেন।

খুতবার মধ্যে খলিফার নাম উচ্চারণ করা তখনকার যুগে ছিল শাসকের বৈধতা ও কর্তৃত্বের প্রতীক। মিশরে তখন বড় একটা জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হতো আল আযহারের জামে মসজিদে। এই মসজিদে তিনি জোর করে খলিফার নামে দোয়া করার আদেশ দিয়ে দেন নি। তিনি আল-আজহার থেকে জুমার নামাজকে স্থানান্তর করে দিয়েছেন কায়রোর জামে হাকেমিতে। এভাবে প্রাথমিকভাবে আল-আজহারের চিন্তাগত ক্ষেত্রকে সংকীর্ণ করে ফেলেন তিনি। কিন্তু প্রকাশ্য বিরোধে জড়াননি।

৪.

ফাতেমীদের পক্ষ থেকে কিছু লোক বিদ্রোহ করে বসে সালাউদ্দিন আইয়ুবী বিরুদ্ধে। যুক্ত হয়ে যায় ক্রুসেডারদের সাথে। তখন সালাউদ্দিন আইয়ুবী যাদের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছিল তাদেরকেই শুধু সাজা দিয়েছিলেন। ব্যাপকভাবে সকল শিয়াদের উপরে শাস্তি প্রয়োগ করেন নি। এছাড়া আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। যারা সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তারা যে শুধু শিয়া ছিল— বিষয়টা এমন নয়। তাদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি উভয় দলই ছিল।

ইবনুল ইমাদ হাম্বলী ‘শাজারাতুয যাহাব’ গ্রন্থে (৬/৩৮৭) লিখেছেন, যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন একজন সুন্নী সাহিত্যিক ও ফকিহ। নাম উমারা বিন আলি আল-মিজহালী। সে ফাতেমীদের সময়ে তাদের গুণগ্রাহী ও ভক্ত ছিল। পরবর্তীতে যখন সালাউদ্দিন আইয়ুবীর সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সে বাহ্যিকভাবে সুলতানের গুনগান গাইত। কিন্তু ভিতরে ভিতরে লালন করত বিদ্বেষ। কামনা করত পুনরায় ফিরে আসুক ফাতেমীদের সাম্রাজ্য। তাই সে কয়েকজন শিয়া লোককে নিয়ে শলা পরামর্শ করে সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে গুপ্তহত্যা করতে মনস্থ করে। সালাউদ্দিন আইয়ুবী তাদের গোপন ব্যাপারটা জানতে পারেন। রমজান মাসে আটজন বিদ্রোহীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন।”

এছাড়াও আরো কিছু বিদ্রোহ হয়েছে সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে। সেগুলো তিনি শক্ত হাতে দমন করেছিলেন। অনেককে হত্যা করেছেন, তবে এ জন্য নয় যে, তারা শিয়া কিংবা সুন্নি। যারা ষড়যন্ত্র করেছে অথবা বিদ্রোহ করেছে তাদের বিরুদ্ধেই তিনি খড়গহস্ত হয়েছেন। কর্ম হিসেবে প্রতিফল দিয়েছেন, মতবাদ হিসেবে নয়।

৫.

এখান থেকে আমাদের সামনে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়।

ক. সালাউদ্দিন আইয়ুবী বুঝতে পেরেছিলেন, মতাদর্শগত ভিন্নতা থাকার সত্বেও মুসলমানদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন অত্যন্ত জরুরি বিষয়। এজন্যই তিনি ফাতেমী সাম্রাজ্যের অধীন মন্ত্রী হয়েই ক্রুসেডারদের বিরোধিতা করেছিলেন।

খ. ফাতেমীয় বংশের রাজত্ব শেষ হয়ে যাবার পরও তাদের প্রতি তিনি দয়া, ভালোবাসা ও অনুগ্রহ দেখিয়েছেন।

গ. কখনো যদি তাদের মোকাবেলা করার প্রয়োজন হয়েছে, তাহলে অবশ্যই মোকাবেলা করেছেন। চিন্তার মোকাবেলা করেছেন চিন্তা দিয়ে। সামরিক ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করেছেন তরবারি দিয়ে। কোনো নিরপরাধ শিয়াকে তিনি হত্যা করেননি তার বিশ্বাসের দায়ে।

ঘ. তার পূর্বের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় শিয়া প্রভাব ছিল খুব গভীর। সেখানে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছেন এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন সাধারণ মানুষের নিকট। শিয়া প্রভাব থেকে সুন্নি বলয়ে তিনি মিশর সমাজকে নিয়ে এসেছেন হিকমতের সাথে।

ঙ. সালাউদ্দিন আইয়ুবী প্রকৃতপক্ষে কর্ম ও অগ্রগতির পক্ষপাতী ছিলেন। পারস্পারিক লড়াই ও যুদ্ধবিগ্রহে তার মোটেই আগ্রহ ছিল না।

৬.

জাতি কখনো কখনো তার ইতিহাসের হাতে বন্দী হয়ে যায়। পেয়ে বসে থাকে ইতিহাসের সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতা। এই স্মৃতিকাতরতায় ইতিহাসকে টেনে আনা হয় খণ্ডিতভাবে। দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ বর্তমান প্রভাব ফেলে তাতে। মুসলিম বিশ্বে সালাফি ও শিয়া মুভমেন্টের মাঝে, আধুনিক যুগে যে লড়াই চলছে, সেখানে ইতিহাসের সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতা জড়িয়ে আছে। শুধুমাত্র খোলাফায়ে রাশেদীনের ইতিহাস নয়, মঙ্গোলিয়ান আক্রমণ, ক্রুসেড যুদ্ধ ও উসমানী খিলাফতের সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতা। কিন্তু এই বিরোধ স্বচ্ছ একাডেমিক বিরোধ নয়। কারণ, একাডেমিক বিরোধ কখনোই রক্তারক্তির পর্যায়ে চলে যায় না। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর অবস্থানকে ঘিরেও বর্তমানে দুইটি দল দুইটি পৃথক পৃথক সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতার শিকার। ইতিহাস এক ও অভিন্ন। কিন্তু দুইটি দল ভিন্ন ভিন্নভাবে এটাকে ভাবছে।

ইতিহাস ও সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতার মাঝে অনেক ফারাক রয়েছে। ইতিহাস হল, মানব জীবনের ঘটনাগুলো স্বচ্ছভাবে সংরক্ষণ এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য বিশ্লেষণ। আর সামষ্টিক স্মৃতি হল (Collective memory), ইতিহাসের আংশিক ও খন্ডিত পাঠ, যার মাধ্যমে সামষ্টিক পলিটিক্যাল ও আইডিওলজিক্যাল স্বার্থ বাস্তবায়ন করা হয়।

এখান থেকে দেখা যাচ্ছে, ইতিহাস ও সামষ্টিক স্মৃতির মাঝে দুইটি বড় ফারাক রয়েছে। প্রথমত: ইতিহাসের ক্ষেত্রে বাস্তবতা রক্ষা করা একটা মৌলিক উদ্দেশ্য। ইতিহাস স্বচ্ছ একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত। আর সামষ্টিক স্মৃতি অনেকাংশে স্বার্থপ্রণোদিত, স্বচ্ছ একাডেমিক নয়। দ্বিতীয়ত: ইতিহাসের অন্যতম স্বভাব হল নিরপেক্ষতা। পক্ষান্তরে সামষ্টিক স্মৃতি মাত্রই কেন্দ্রিকতার প্রকাশ। কারণ এর মাধ্যমে একটা সামষ্টিক পরিচয় নির্মাণ করা হয়। উদ্দেশ্য হয়, কিছু কাজের বৈধতা দেয়া।

সামষ্টিক স্মৃতি মাত্রই যে নেতিবাচক ধারাবাহিকতা—এমনটা নয়। প্রত্যেক জাতীয়, গোত্রীয়, বংশীয় অথবা ধর্মীয় সমষ্টির একটা স্মৃতিকাতরতা ও ঐতিহ্যকেন্দ্রিকতা থাকে—এটাই স্বাভাবিক। জাতির প্রাচীন পুঁথি ও মহাকাব্য এক্ষেত্রে ইন্ধনের ভূমিকা পালন করে। নেতিবাচক স্মৃতিকাতরতা তখনই হয়, যখন জাতির সঠিক ইতিহাস অথবা ইতিহাসের সঠিক বিশ্লেষণের উপর নির্মিত না হয়ে, গড়ে ওঠে কল্পনার উপর। নিজেদেরকে মর্যাদাপ্রদানেই যদি এটা সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে এটা ততটা ক্ষতিকর নয়। ক্ষতিকর হয়ে ওঠে তখন, যদি অন্যের উপর আক্রমণের জন্য বৈধতা তৈরি করে দেয় এই স্মৃতিকাতরতা।

৭.

বর্তমানে সালাফীদের সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতায়, সালাউদ্দিন আইয়ুবী চিত্র হলো—তিনি দল-মত নির্বিশেষে সকল মুসলমানের নেতা নন। তিনি একজন একাট্টা সুন্নি সালাফি শাসক। প্রথম জীবনে তিনি ফাতেমি সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছেন। এরপর ক্রুসেডারদের হাত থেকে মুসলমানদের ভূমি উদ্ধার করেছেন। কেতন উড়িয়েছেন সুন্নিয়তের; সালাফীদের সংকীর্ণ অর্থে। এমন একটা চিত্র ফুটে ওঠে সৌদি আরবের শাইখ সফর হাওয়ালি, লিবিয়ার ঐতিহাসিক আলী মুহাম্মদ সাল্লাবি প্রমুখদের লেখাঝোকায়।

শাইখ সফর হাওয়ালির একটা বক্তৃতা আছে ‘আত-তাওয়াতুউর রাফেজী মাআস সালিবিয়্যিন লিহতিলালি বাইতিল মাকদিস’ (বাইতুল মাকদিস দখল করার জন্য ক্রুসেডারদের সাথে রাফেজীদের জোটবদ্ধতা)। সেখানে তিনি বলেছেন, “রাফেজী ও বাতেনিরা যখন মিশর এবং শাম অঞ্চলে শাসন করতো, তখন তাদের সাথে ক্রুসেডারদের ভালো সম্পর্ক ছিল। শিয়ারা ক্রুসেডারদের বাইতুল মাকদিস দখলের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে। তাদের মাঝে কোন যুদ্ধ হয় নি। ফলে ক্রুসেডাররা বাইতুল মাকদিসে প্রবেশ করে, এর সম্মানহানি করেছে। হত্যা করেছে সত্তর হাজার মুসলমানকে।”

এরপর সালাউদ্দিন আইয়ুবী সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “সালাউদ্দিন সঠিক কেন্দ্রবিন্দু থেকে তার পথ চলা শুরু করেছেন। আর সেটা হল, সকল মানুষকে কুরআন-সুন্নাহর সহি আকীদার উপর নিয়ে আসার জন্য, তিনি দেশের ভেতরের অপরাধী, মুনাফিক এবং ভ্রষ্টদেরকে হত্যা করেছেন। এরপর অগ্রসর হয়েছেন বাইরের ক্রুসেডার শত্রুকে দমন করার জন্য। শাম এবং ফিলিস্তিনের খ্রিস্টান সৈন্যদের বিরোধিতা করার বদলে তিনি আগে মিশরে গিয়ে ফাতেমীয়দের সাম্রাজ্য খতম করেছেন। এরপর খ্রিস্টানদের উপর হামলা করেছেন।”

শাইখ হাওয়ালী এখানে তুলে ধরতে ভুলে গিয়েছেন, আল-কুদসের মুসলমানরা ফাতেমীয়দের অধীনে একবার চল্লিশ দিন লাগাতার যুদ্ধ করে গিয়েছে খ্রিস্টান সৈন্যদের বিরুদ্ধে। তেমনিভাবে ফাতেমিরা তখন শুধুমাত্র মিশরের শাসন করতো, শাম অঞ্চলে নয়।

এ ধরনের খন্ডিত পাঠ ও সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতার দরুন বর্তমানের একজন সালাফি যুবক নিজের আবশ্যকীয় কর্তব্য মনে করে, আল্লাহর ভূমি থেকে বহির্গত শত্রুর আগে শিয়াদেরকে নির্মূল করতে হবে। উভয়ের শত্রু যদিও এক, কিন্তু তারা সে শত্রু মোকাবেলায় পারস্পারিক সাহায্যে রাজি নয়।

আর কট্টর শিয়ারা সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে পাঠ করে এক আধিপত্যবাদী সৈনিক হিসেবে, মুসলমানদের নেতা হিসেবে নয়। যিনি ইসলামী ইতিহাসে শিয়াদের সাম্রাজ্যটা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন। যিনি শিয়াদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে ক্রুসেডারদের সাথে হাত মিলিয়েছেন… ইত্যাদি ইত্যাদি…

এমন ধারণা পাওয়া যায়, সিরিয়ার শিয়া ঐতিহাসিক হাসান আল আমিনের ‘সালাহউদ্দিন আল-আইয়ুবী বাইনাল আব্বাসিয়্যিন, ওয়াল ফাতেমিয়্যিন, ওয়াস সালিবিয়্যিন’ গ্রন্থে। মিশরের একজন শিয়া লেখক ড. আহমদ রাসেম নাফিস সালাউদ্দিন আইউবির প্রতি বিদ্বেষবশত তার নাম দিয়েছে ‘হালাক-উদ্দিন আইয়ুবী’।

তারা এই স্বাভাবিক বিষয়টা বুঝতে পারেনি, শিয়ারা যেমন মিশরে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর শিয়া মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনি স্বাভাবিকভাবে সালাউদ্দিন আইয়ুবী মিশরের কর্তৃত্ব পাবার পর সেখানে সুন্নি প্রভাব বিস্তার করেছেন। কিন্তু কতটা প্রজ্ঞা ও ধীরস্থিরতা সাথে তিনি এগিয়েছেন, এটা তারা তুলে ধরতে ভুলে যায়। ফাতেমী সাম্রাজ্যের পতনের পর শিয়াদের সাথে তিনি যেই উত্তম আচরণ করেছেন, সেটাও তারা তুলে ধরে না। এছাড়া ক্রুসেডারদের হামলা যখন তাদের দিকে ধেয়ে আসছিল, তখন তাদের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সালাউদ্দিন আইয়ুবী। ফাতেমী খলিফারা তখন ডুবেছিল ভোগবিলাসে। জমা করে ফেলেছিল অনেক স্বর্ণমুদ্রা, ধন-দৌলত।

এই খন্ডিত অধ্যায়নের কারণে সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে শিয়া যুবকরা একজন খলনায়ক মনে করে। সুন্নী আন্দোলনের আওয়াজ উঠলেই তারা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। সুন্নিদের বিরুদ্ধে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ওঠে তারা।

সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জীবনী সম্পর্কে লিখিত যেসব ক্লাসিক গ্রন্থ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে গভীর দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, তার জীবনীকে পাঠ করা হচ্ছে খণ্ডিতভাবে। তার অবস্থানকে প্রকাশ করা হচ্ছে সরলীকরণের মাধ্যমে। জমে উঠছে নেতিবাচক সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতা। ফলে ইতিহাস এখানে ব্যবহৃত হচ্ছে কেবলই রাজনৈতিক স্বার্থে।

৮.

সালাফি এবং শিয়া—উভয় দলই সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে পাঠ করতে গিয়ে বিস্তর সংকট তৈরি করে রেখেছে। সালাফীদের পাঠের সঙ্কট হলো—

প্রথমত: সালাউদ্দিন আইয়ুবী সেই অর্থে সুন্নি ছিলেন না, যেই অর্থে কট্টর সালাফীরা সংজ্ঞা দিয়ে থাকে। তিনি ছিলেন আকিদাগত দিক থেকে আশ‌আরী। ইমাম সুয়ূতী বর্ণনা করেছেন, সালাউদ্দিন আইয়ুবী মুয়াজ্জিনকে আদেশ দিয়ে রেখেছিলেন, প্রতিরাতে মসজিদের মিম্বর থেকে আশ‌আরী আকিদা ঘোষণা দেয়ার জন্য। ইবনে শাদ্দাদ বর্ণনা করেছেন, সালাউদ্দিন আইয়ুবী সুফিদের সামা শ্রবণ করতেন।

ইমাম আবুল হাসান আল-আশ‌আরীর একটা গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো, কোন আহলে কেবলাকে তাকফির করা জায়েজ নেই ( যতক্ষণ স্পষ্ট কুফুরি না পাওয়া যায় ) । যদি সালাউদ্দিন আইয়ুবী সালাফি হতেন, তাহলে আশ‌‌আরী আকিদার বিরোধিতা করতেন। সুফিদেরকে বেদাতি বানাতেন। আর তাকফির করতেন শিয়াদেরকে ব্যাপকভাবে। এর ফলাফল দাঁড়াতো, তিনি মুসলমানদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না। এমনকি বাইতুল মাকদিস বিজয় করা কঠিন হয়ে যেত তার জন্য।

দ্বিতীয়ত: সালাউদ্দিন আইয়ুবী বোঝাপড়া হয়েছিল মূলত ইসমাঈলী শিয়াদের সাথে। ফাতেমি সাম্রাজ্য ইসমাইলী ধারার ছিল। তাদের সম্পর্কে মোহাম্মদ আবু জোহরা ‘তারিখুল মাজাহিবিল ইসলামিয়া’ গ্রন্থে (৫৩ পৃ.) বলেছেন, “আধ্যাত্মিকতা, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদিকে ঘিরে তাদের চিন্তাধারা ছিল পারস্যের নিউ প্লেটোনিক দর্শন আর হিন্দুস্তানের ব্রাহ্মণ চিন্তার কাছাকাছি।”

এমন চিন্তাধারা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বিশ্বাসের কারণে তাদের প্রতি খড়গহস্ত হয়ে ওঠেননি সালাউদ্দিন আইয়ুবী। তাদের মধ্য থেকে যারা গুপ্তঘাতক অ্যাসাসিয়ান ছিল, তাদেরকে শুধুমাত্র সালাউদ্দিন আইয়ুবী কঠিন শাস্তি দিতেন, কখনো হত্যা করতেন।

অন্যদিকে বর্তমানের শিয়ারা ব্যাপকভাবে ইমামিয়া ইসনা আশারিয়া ধারার। সালাউদ্দিন আইয়ুবির সময় কিংবা এর পূর্বে তাদের বিরুদ্ধে খুব বেশী খণ্ডনমূলক গ্রন্থ দেখা যায় না। তাদের সম্পর্কে মোহাম্মদ আবু জোহরা উপরোক্ত গ্রন্থে (৪৬ পৃ.) বলেছেন, “তাদের ব্যাপকতার মধ্যে এমন কিছু দল রয়েছে, যাদের আকিদা এতটা বিকৃত নয়, যে সেটা কুরআন কিংবা জরুরিয়াতে দীনের সুস্পষ্ট বিরোধী।”

সালাউদ্দিন আইয়ুবির যুগে ইমামিয়া শিয়ারা বসবাস করত, দামেস্ক ও হালব অঞ্চলে—যেমনটা বলেছেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে জুবায়ের এবং অন্যান্য অনেকে। তারা ছিল সালাউদ্দিন আইউবির প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। এই ধরণের শিয়াদের অনেকেই তার সৈন্যবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত‌ও ছিল।

একেবারে প্রথম দিকে যারা সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জীবনী রচনা করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমামী শিয়া ঐতিহাসিক ইয়াহিয়া বিন আবি তাই হালাবি। তিনি আইয়ুবী বংশের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। ঐতিহাসিক আবু শামার গ্রন্থে তার থেকে যেসব উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন, সেখান থেকেও এটা উপলব্ধ হয়।

৯.

বর্তমানে সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে নিয়ে শিয়াদের যেই পাঠ বিদ্যমান, তাতে গলদ আরো বেশি। তাদের অনেকেই সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে মুসলমানদের গাদ্দার ও ক্রুসেডারদের সহযোগী হিসেবে চিত্রায়ন করেছে। যেমনটা আমরা দেখতে পাই হাসান আল আমিনের গ্রন্থে। এই পাঠের গলদ ও অপবাদপ্রবণতা সূর্যের মতোই স্পষ্ট।

সালাউদ্দিন আইয়ুবী কখনোই দলগতভাবে শিয়াদের উপর নির্যাতন করেন নি। এজন্যই তার জীবনী ও স্বভাব চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে শিয়া ঐতিহাসিক ইবনে আবি তাই জীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন শিয়া ফকিহ ও নেতা। তাদের পুরো পরিবারকে হালব শহর থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলেন নুরুদ্দিন জানকি। সালাউদ্দিন আইয়ুবী এসে তাদেরকে পুনর্বাসন করেছেন। এখান থেকে বুঝা যায়, কতটা ‘কৌশলগত’ উদারতা প্রদর্শন করেছেন তিনি শিয়াদের প্রতি।

হাসান আল আমিন সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে ক্রুসেডারদের সহযোগী বলেছেন, এর চেয়ে বড় অপবাদ আর হতে পারে না। আমরা শুধু এতটুকুই বলতে পারি, সালাউদ্দিন আইয়ুবির যুগের ক্রুসেডার ও বর্তমানের প্রাচ্যবাদী ঐতিহাসিকরা সালাউদ্দিন আইয়ুবী সম্পর্কে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে হাসান আল আমিন থেকে অধিক স্বচ্ছ।

খ্রিস্টান পুরোহিত উইলিয়াম অফ টায়ার সেসময়ের একজন ঐতিহাসিক। তিনি সালাউদ্দিন আইয়ুবির সাহসিকতা, বদান্যতা ও বিচক্ষণতার বিবরণ তুলে ধরেছেন তাঁর লিখিত ইতিহাসে। যদিও তার লেখা পড়লে বোঝা যায় স্পষ্ট, বাইতুল মাকদিস মুসলমানদের হাতে চলে যাওয়ার কারণে, তিনি বেশ মনঃক্ষুন্ন।

হাসান আল আমিনের থেকেও নিরপেক্ষভাবে কয়েকজন ওরিয়েন্টালিস্ট সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জীবনীকে তুলে ধরেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম— হ্যামিল্টন গিব ‘The Life of Saladin: From the Works of ‘Imad ad-Din and Baha’ ad-Din’ গ্রন্থে, জিওফ্রে হিন্দলি ‘Saladin: Hero of Islam’ গ্রন্থে, অ্যান্ড্রু এস এহরেনক্রেটজ ‘Saladin’ গ্রন্থে।

শিয়া ও সালাফিরা সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে যেভাবে প্রান্তিক পাঠে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে—সেটা তুলে ধরা হলো। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এছাড়া ইতিহাসের আরো অনেক বিষয় আছে, যেগুলোকে বর্তমানে খণ্ডিতভাবে টেনে আনা হচ্ছে বিরোধকে দীর্ঘায়িত করার জন্য। সুন্নি ও শিয়াদের মধ্য হতে বর্তমানে এমন কয়েকজন ঐতিহাসিক সত্য বয়ান নিয়ে হাজির হচ্ছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ইরাকের ওস্তাদ আহমেদ আল কাতিব, সৌদি আরবের ড. মোহাম্মদ আল‌-আহমারি প্রমুখ। ইতিহাসের ভুল বোঝাবুঝি ও প্রান্তিক বয়ান থেকে, তারা সত্যকে তুলে আনছেন।

বর্তমানের দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ সময়ে, বিভিন্ন সুন্নি ও শিয়া দেশের শাসকগোষ্ঠীর জন্য, সালাউদ্দিন আইয়ুবির আচরণ ও কর্মপন্থা মধ্যে শিক্ষা নিহিত রয়েছে। বিরোধ, বিসংবাদ ও পারস্পারিক লড়াই বন্ধের জন্য তিনি অনুকরণীয় হতে পারেন।

The post শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক: সালাহুদ্দীন আইয়ুবির অবস্থান appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b6%e0%a6%bf%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%b8%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%95-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b2/

No comments:

Post a Comment