Friday, August 28, 2020

সফট শিয়াইজম: মুসলিম দেশগুলোতে ইরানের সাংস্কৃতিক প্রভাব

রাগিব রব্বানী:

শিয়া মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত বর্তমান ইরান রাষ্ট্র মুসলিম দেশগুলোতে নানাভাবে নিজেদের আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে আসছে তথাকথিত সেই ‘ইসলামি’ বিপ্লবের পর থেকেই। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে এ প্রভাব ও আধিপত্য ধরে রাখলেও অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে তাদের আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার কায়দা ভিন্ন। অনুন্নত ও অপেক্ষাকৃত কম শক্তিধর মুসলিম দেশগুলোতে সাংস্কৃতিক নানা তৎপরতার মধ্য দিয়ে জনমনে ইরানি শাসনব্যবস্থা ও শিয়াইজমের প্রতি একধরনের প্রভাব তৈরি করে। এবং এই প্রভাব তাদের নানামাত্রিক কর্মকাণ্ডে সিমপ্যাথি হিসেবে ব্যবহার করে।

প্রধানত ইরানি দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে এই কাজগুলো আঞ্জাম দেওয়া হয়। আর রেডিও তেহরান, পার্স টুডে, ইরান মিরর ইত্যাদি মিডিয়ার সাহায্যে শিয়া মতবাদ এবং ইরানের বর্তমান শাসননীতি ও আধিপত্যবাদকে ইসলামের রঙচঙ মাখিয়ে উপস্থাপন করা হয়। ফলে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর নাগরিকেরা স্বভাবতই ইরানের প্রতি একধরনের সহানুভূতি পোষণ করতে শুরু করেন নিজেদের ভেতর।

ইরান নিজেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র দাবি করলেও ইসলামের মূল স্প্রিরিট ও চেতনার সঙ্গে যোজন যোজন দূরত্ব রয়েছে তার। শিয়া মতাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত এ শাসননীতি বিগত কয়েক দশক ধরে মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর কল্যাণ চিন্তায় বাধা হয়ে দাঁড়ানো ছাড়া ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি কখনো। নিজেদের মতাদর্শ ও আধিপত্যের ভিতকে আরও মজবুত করতে মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি অধ্যুষিত দেশগুলোতে সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার রেখেছে। পাশাপাশি অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও জারি রেখেছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম।

এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও আলেম লেখক-সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদের সঙ্গে। তিনি বলেন, অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দেশ যেগুলো, তারা নিজেদের আধিপত্যবাদকে বিস্তৃত করতে অপেক্ষাকৃত ছোট ও দুর্বল দেশগুলোতে নানাভাবে নিজেদের সাংস্কৃতিক তৎপরতা জারি রাখে। এটা পশ্চিমা দেশগুলো যেমন করে, চীন জাপান ও ভারতও করে। পশ্চিমা দেশগুলো খ্রিষ্টবাদের প্রচারে আর ভারত হিন্দুত্ববাদের বিস্তৃতি সাধনের জন্য সাংস্কৃতিক তৎপরতা চালায়, যেটা প্রায়শই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় এবং হচ্ছে। একইভাবে ইরানও অপেক্ষাকৃত দুর্বল মুসলিম দেশগুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বেশ তৎপর। সেই সুবাদে আমাদের বাংলাদেশেও তাদের কার্যক্রম আছে।

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ জানান, সাংস্কৃতিক তৎপরতায় তৎপর থাকে মূলত ইরানি দূতাবাস। দূতাবাসের অধীনে জেলা ভিত্তিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে। সেখানে ইরানি কালচার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে একটা ইতিবাচক ধারণা গেঁথে দেওয়া হয়। নানাধর্মী আয়োজন-অনুষ্ঠান ও প্রোগ্রাম করা হয়। এগুলোতে ইসলামের লেভেল লাগিয়ে শিয়া মতাদর্শ ও ইরান রাষ্ট্রকে মহান করে দেখানো হয়। ইরানি কার্যক্রম মূলত ইসলামি কার্যক্রম—এমন একটা ম্যাসেজ দেবার চেষ্টা করা হয়।

ফলে হয় কী, সাধারণ মানুষ শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে একটা বিরোধ আছে জানলেও, সেই বিরোধকে তারা মনে করে হানাফি-আহলে হাদিস বিরোধের মতো সেরেফ মাযহাবি বিরোধ। এখানে যে আরও ভয়ংকর ব্যাপার জড়িত, ঐতিহাসিকভাবে নানা অপকর্ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অনুঘটক হয়ে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ বিনষ্টে কলকাঠি নেড়ে এসেছে যে এই শিয়া মতবাদের অনুসারীরা, সেসব ব্যাপারে সাধারণ মানুষ একদম গাফেলই থেকে যান। পাশাপাশি ইরানকে মনে করেন, মুসলিম উম্মাহর কল্যাণকামী একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। তাই ইরানি নানাবিধ কর্মকাণ্ডে অবচেতন মনেই তারা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যান।

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, এই সমর্থন এবং সম্মতির জন্যই সাংস্কৃতিক এই তৎপরতা চালায় ইরান। তিনি বলেন, জেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে এসবের বাইরে সুন্নি মুসলমানদেরকে শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী করে তোলার একটা প্রক্রিয়াও চালু ছিল একসময়, এখন সেটা আছে কিনা ঠিক জানি না। এই প্রক্রিয়ায় রাজধানীর মিরপুরের বিহারি পট্টিতেও বেশ অনেক মানুষকে শিয়া মতাদর্শে দীক্ষিত করার অভিযোগ আছে।

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ আরও বলেন, একসময় ইরানি ফিল্ম প্রদর্শনের মহড়া চলত বাংলাদেশে। যুগের পরিবর্তনের কারণে এখন হয়তো সেটা নেই, কিন্তু নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন জায়গায় ইরানি ফিল্ম প্রদর্শনের ব্যবস্থা করত ইরানি দূতাবাস বা ইরান সংশ্লিষ্ট যেকোনো গোষ্ঠী। এমনকি বিটিভিতেও একটা সময় বাংলা ডাবিং করে ইরানি ফিল্ম প্রদর্শিত হতো।

তিনি বলেন, ফিল্মের মাধ্যমে যদিও শিয়া মতাদর্শের প্রচার সরাসরিভাবে হতো না, কিন্তু এমনকিছু বিষয়ের সন্নিবেশ থাকত ফিল্মের গল্প ও দৃশ্যে, ইরান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি একধরনের মোহ ও পক্ষপাতিত্ব তৈয়ার করে দিতো দর্শকদের মনে। ইরানের আধিপত্যবাদের সম্মতি উৎপাদনে এই ফিল্ম প্রদর্শনও ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।

এ ছাড়া ইরানি দূতাবাস থেকে বহুমুখী তৎপরতা চালানো হয়। এর মধ্যে নিউজ লেটার বিলি করা অন্যতম একটা উদ্যোগ ছিল। বাংলাদেশের তরুণ শ্রেণির সাংস্কৃতিক ক্ষুধা নিবারণে ফিল্ম প্রদর্শন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে ইরানি কর্তৃপক্ষ। ফলে তরুণদের একটা অংশ কট্টর মুসলিম পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে অন্ধভাবে ইরানের সমর্থন দিতে ব্যস্ত থাকে। এই সমর্থন ও সম্মতি উৎপাদনই সাংস্কৃতিক তৎপরতা চালানোর মূল লক্ষ্য ইরানের। সবদিক বিবেচনা করলে ইরান বেশ ভালোভাবেই সফলতা অর্জন করছে তার এই লক্ষ্যে।

The post সফট শিয়াইজম: মুসলিম দেশগুলোতে ইরানের সাংস্কৃতিক প্রভাব appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b8%e0%a6%ab%e0%a6%9f-%e0%a6%b6%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%9c%e0%a6%ae-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a6%97%e0%a7%81-2/

No comments:

Post a Comment