Friday, August 28, 2020

মুখোমুখি হুসাইন ও ইয়াযিদ : কী ঘটেছিল কারবালায় ?

রাকিবুল হাসান:

অন্তিম শয্যায় শায়িত হজরত মুআবিয়া রাদি.। তার পাশে বসে আছে ইয়াজিদ। এই অন্তিম মুহূর্তেও তিনি ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত। তিনি তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে নিজের ছেলে ইয়াযিদকে মনোনীত করে গেছেন। এই মনোনয়নে সন্তুষ্ট নন সাহাবিগণ। তারা হজরত মুআবিয়া রাদি.কে বুঝিয়েও এ সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেননি। সিরিয়া ও ইরাকের জনগণ ইয়াযিদের বায়াত গ্রহণ করেছে। সাহাবিগণ যখন দেখলেন হজরত মুআবিয়ার রাদি. প্রচেষ্টায় বড় একটি অংশ ইয়াযিদের বায়াত গ্রহণ করেছে, তখন তারা মুসলমানদের পারস্পরিক বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করার জন্য বাধ্য হয়ে ইয়াজিদের বায়াত মেনে নিয়েছেন। কিন্তু মদীনাবাসী, বিশেষ করে হজরত হুসাইন, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাদি. এ বায়াত মেনে নিতে পারেননি। তারা নির্বিঘ্নে প্রচার করতে লাগলেন, ‘ইয়াযিদ মুসলমানদের খলিফা হওয়ার অযোগ্য।’

হজরত মুআবিয়া রাদি. ছেলের হাত চেপে ধরলেন। তার আয়ু ফুরিয়ে আসছে। বেহেশত থেকে সোনার তশতরি নিয়ে উপস্থিত মৃত্যুর ফেরেশতা। ইয়াযিদ বললো, ‘বাবা, কিছু বলবেন?’
হজরত মুআবিয়া রাদি. বললেন, ‘একটা কথা।’
ইয়াযিদ কৌতূহলী, ‘কী কথা?’
হজরত মুআবিয়া বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে ইরাকবাসী হজরত হুসাইনকে তোমার বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করবে। যদি এমন হয়-ই, তুমিও যদি তার মোকাবেলায় বিজয়ী হও, তাহলে হুসাইনকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে। রাসূল সা. এর পরিবার-পরিজনকে সর্বদাই সম্মান প্রদর্শন করবে। সব মুসলমানদের ওপর তাদের অধিকার রয়েছে।’
ইয়াযিদ বাবার হাত আলতো চেপে মাথা নাড়লো। মৃত্যুশয্যায় করা বাবার অসিয়ত সব ছেলে মানতে চায়। ইয়াযিদ মনে মনে বললো, আমি আপনার অসিয়ত মানতে চেষ্টা করবো। তবে পারবো কিনা এই নিশ্চয়তা দিতে পারি না।

হজরত মুআবিয়া রাদি. এর ইন্তেকালের পর খেলাফতের আসনে বসলো ইয়াযিদ। আসনে বসেই মদীনার গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে উকবার কাছে একটি চিঠি পাঠালো। চিঠিতে সে লিখলো—’হজরত হুসাইন, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাদি. এর ওপর বায়াতের জন্য চাপ সৃষ্টি করুন। আমার বায়াত চাই। এ ব্যাপারে তাদেরকে ছাড় দিবেন না।’

ওয়ালিদ নিজেও জানে এটা সহজ কাজ না। সে তার পূর্বের গভর্নর মারওয়ান ইবনে হাকামকে ডাকলো পরামর্শের জন্য। মারওয়ান বললো, হজরত মুআবিয়ার মৃত্যু সংবাদ এখনো মদীনায় পৌঁছেনি। তাদেরকে বায়াত গ্রহণের জন্য ডেকে আনুন। গ্রহণ করলে ভালো কথা। গ্রহণ না করলে সোজা হত্যা করা হবে।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের এবং হজর হুসাইন রাদি. মসজিদে বসে ছিলেন।। তাদের নিকট বৈঠকের খবর নিয়ে এলো আব্দুল্লাহ ইবনে আমর। এই অসময়ে বৈঠক ডাকার কথা শুনে তাদের খটকা লাগছে। ইবনে যুবায়ের রাদি. হুসাইন রাদি.কে বললেন, ‘নিশ্চয়ই খটকা আছে।’
হুসাইন রাদি. বললেন, ‘শুধু খটকা না, মারাত্মক খটকা। আমার মনে কী হচ্ছে জানো?’
‘কী’
‘মনে হচ্ছে—হজরত মুআবিয়া রাদি. ইন্তেকাল করেছেন। ওয়ালিদ চাচ্ছেন, তার মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হবার পূর্বেই ইয়াযিদের বায়াত গ্রহণের জন্য চাপ দিবে।’
‘হুম। তাই হবে। তাহলে বৈঠকে যাব না?’
‘যাবো। তবে প্রোটেকশন নিয়ে। আমাদের কয়েকজন যুবক সঙ্গে নিয়ে যাবো। তাদেরকে বাইরে রেখে ভেতরে বৈঠকে ঢুকবো।’

ঘরে ঢুকেই হজরত হুসাইন রাদি. সালাম দিলেন। ভেতরে ওয়ালিদ এবং মারওয়ান একসঙ্গে বসে আছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে দুজনের মনোমালিন্য কেটে গেছে। হুসাইন রাদি. বললেন, ‘আগে আপনাদের দুজনের মনোমালিন্য ছিলো। এখন দুজনের মনোমিলন দেখে খুশী হলাম।’
ওয়ালিদ মুচকি হেসে হুসাইন রাদি. এর দিকে ইয়াযিদের পত্রটি বাড়িয়ে দিলো। হুসাইন রাদি. হজরত মুআবিয়া রাদি. এর ইন্তেকালে শোক প্রকাশ করলেন। তারপর পত্রটি ওয়ালিদের সামনে রেখে বললেন, ‘গোপনে ইয়াযিদের বায়াত গ্রহণ করাটা শোভনীয় দেখায় না। তারচে বরং ভালো—আপনি সবাইকে সমবেত করে ইয়াযিদের চিঠি পড়ে শুনান। যা হবার জনতার সামনেই হবে।’
ওয়ালিদ বললেন, ‘তবে তাই হবে।’
মারওয়ান বললো, ‘উহু। তা হবে না। হুসাইন এখান থেকে বেরিয়ে গেলে তাকে ধরা যাবে না। তাই যা হবার এখানেই হবে।’
ওয়ালিদ নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকালো। মারওয়ান বললো, ‘বায়াত না হওয়া পর্যন্ত তাকে আটকে রাখুন। তাতেও কাজ না হলে হত্যা করুন।’
আঁৎকে উঠলেন ওয়ালিদ। যেন ভয় পেলেন খুব। কাঁপা কাঁপা স্বরে তিনি বললেন, ‘পুরো পৃথিবীর রাজত্ব দিলেও এর বিনিময়ে আমি হুসাইনকে হত্যা করতে পারবো না। কেয়ামতের দিন তার হত্যার দায়িত্ব যার কাঁধে পড়বে, তার রক্ষে নেই।’

পরিস্থিতি ঘোলাটে দেখে রাতারাতি মদীনা ত্যাগ করলেন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের এবং হজরত হুসাইন রাদি.। তারা গিয়ে উঠলেন মক্কায়। তাদের দুজনের মদীনা ত্যাগের খবর পেয়ে ইয়াযিদ ভাবলো, দুজন হাতছাড়া হয়েছে ওয়ালিদের অযোগ্যতা এবং দুর্বলতার কারণে। তাই সে ওয়ালিদকে পদচ্যুত করে আমর বিন সাঈদকে মদীনার নতুন গভর্নর নিযুক্ত করলো। আর পুলিশ অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিলো আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাদি. এর ভাই আমর ইবনে যুবায়েরকে। আগে থেকেই দু’ ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। তাই আমর তার ভাই আব্দুল্লাহকে গ্রেফতার করতে দ্বিধাবোধ করবে না।

কুফায় হজরত মুআবিয়ার মৃত্যুসংবাদের সঙ্গে আরেকটি খবর পৌঁছলো। হজরত হুসাইন, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর এবং আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাদি. এর মতো বড় সাহাবিগণ ইয়াযিদের বায়াত প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সবার মাঝেই একটা গুঞ্জরন শুরু হয়েছে। সুলাইমান ইবনে সারদ খুযায়ীর ঘরে কয়েকজন বিশিষ্ট লোক জমাও হয়ে গেলেন। তারা ইয়াযিদের হাতে বায়াত হতে সন্তুষ্ট নয়। কুফাবাসীর পক্ষ থেকে তারা হুসাইন রাদি. এর কাছে একটি চিঠি লিখলেন—’আমরা ইয়াযিদের হাতে বায়াত হতে রাজি নই। আপনি এই মুহূর্তে কুফায় চলে আসুন। আমরা সবাই আপনার হাতে বায়াত গ্রহণ করবো। কুফায় ইয়াযিদের নিযুক্ত গভর্নর নুমান ইবনে বশীরকে বহিষ্কার করে দিবো।’

প্রথম চিঠি লেখার দুদিন পর তারা ইয়াযিদ সম্পর্কে তাদের অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরে আরেকটি চিঠি লিখলেন। হুসাইন রাদি. এর নিকট প্রতিনিধি দলও পাঠালেন। হুসাইন রাদি. কুফাবাসীর ক্রমাগত চিঠি এবং প্রতিনিধি দল দেখে কুফায় যেতে উদ্বুদ্ধ হলেন। তবে কুফাবাসীরা ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় এটা জানতেন তিনি। সত্যিটা জানার জন্য তিনি তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকীলকে কুফায় পাঠালেন একপ্রকার গোয়েন্দা হিসেবেই। তার হাতে কুফাবাসীদের প্রতি একটি চিঠিও লিখে দিলেন। চিঠিতে তিনি লিখলেন—’সালামুন আলাইকুম। আপনাদের চিঠি আমার হাতে পৌঁছেছে। আপনাদের অস্থিরতা আমি অনুধাবন করতে পারছি। আমার বিশ্বস্ত চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে আপনাদের কাছে পাঠালাম। তিনি সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আমাকে জানাবেন। তিনি যদি আমাকে আসার জন্য বলেন, তাহলে আমি সাথে সাথেই চলে আসবো।’

কুফায় পৌঁছে সর্বপ্রথম মুখতারের গৃহে অবস্থান করেন মুসলিম ইবনে আকিল। বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ এখানেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন। তার কাছে যেই আসতেন, তাকেই তিনি হুসাইন রাদি. এর চিঠি পড়ে শুনাতেন। কুফায় কিছুদিন অবস্থান করে তিনি বুঝতে পারলেন, এখানের সাধারণ মুসলমানগণ ইয়াযিদের হাতে বায়াত হতে মোটেই আগ্রহ নয়। বরং হুসাইন রাদি. এর হাতে বায়াত হতে আগ্রহী। তাই তিনি হুসাইন রাদি. এর খেলাফতের ওপর বয়াত নেয়া শুরু করলেন। অল্প কদিনেই কুফার আঠারো হাজার মুসলমান বায়াত গ্রহণ করলো।

মুসলিম ইবনে আকিল ভাবলেন, হুসাইন রাদি. কুফায় আগমন করলে অবশ্যই গোটা ইরাকবাসী তার হাতে বায়াত গ্রহণ করবে। হিজাজের লোকেরা তো প্রথম থেকেই তার অনুসারী, শুভাকাঙ্ক্ষী। তাই আশা করা যায়, ইয়াযিদের নাগপাশ থেকে খেলাফত মুক্ত হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে সঠিক খেলাফত। তিনি হুসাইন রাদি.কে কুফায় আগমনের আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখলেন।

কুফায় গমনের প্রস্তুতি নিলেন হুসাইন রাদি.। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তে কেউ নিশ্চিন্ত নয়। সাহাবিগণ, সাধারণ লোকজন সবাই তাকে বারণ করছেন কুফায় যেতে। ওমর বিন আবদুর রহমান বললেন, ‘আপনি এমন শহরে যাচ্ছেন, যে শহর ইয়াযিদের নিয়ন্ত্রণাধীন। সেখানের আমির, কর্মচারী সবাই ইয়াযিদের অনুগত। তাদের হাতে বাইতুল মাল। মানুষ অর্থের পূজারী। আমার আশঙ্কা, যারা আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারাই আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।’ হুসাইন রাদি. বললেন, ‘আমি আপনার পরামর্শের প্রতি খেয়াল রাখবো।’

হজরত ইবনে আব্বাস রাদি. এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শুনলাম কুফায় যাচ্ছেন?’
হুসাইন রাদি. বললেন, ‘আজকালের মধ্যেই রওয়ানা হবো ইনশাআল্লাহ।’
‘আল্লাহর দোহাই—আপনি যাবেন না ওখানে।’
‘তারা আমাকে আহ্বান করেছে।’
‘যারা আপনাকে আহ্বান করেছে, তারাই তো ইয়াযিদের নিয়ন্ত্রিত। তাদের আহ্বান যুদ্ধের দিকে যাবার আহ্বান।’
‘চাচাতো ভাই পরিস্থিতি লিখে পাঠিয়েছে। সব ঠিক আছে।’
‘আমার আশঙ্কা—এরা আপনার সঙ্গে প্রতারণা করবে।’
‘আমি ইস্তেখারা করে সিদ্ধান্ত নিবো।’

দ্বিতীয়দিন আবার এলেন ইবনে আব্বাস রাদি.। অস্থিরতা প্রকাশ করে বললেন, ‘আপনার কুফা গমন নিয়ে আমার অস্থির লাগছে। কুফাবাসীরা পীড়াপীড়ি করলে বলুন আগে আমির এবং রাজকর্মচারীদের বের করে দিতে। আর যদি মক্কা ত্যাগ করতেই হয়, তাহলে ইয়ামান চলে যেতে পারেন। সেখানে আপনার বাবার অনেক ভক্ত রয়েছেন।’
হুসাইন রাদি. দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘ ভাই ইবনে আব্বাস! আমি জানি আপনি দয়ালু উপদেশদাতা। কিন্তু আমি কুফা গমনের সংকল্প করে ফেলেছি। এই সংকল্প বাতিল করতে আগ্রহী নই।’
ইবনে আব্বাস রাদি. বললেন, ‘একান্তই যদি যেতে চান, তাহলে আমার একটি অনুরোধ। আপনার স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে যাবেন না।’

হুসাইন রাদি. ৬০ হিজরির তিন অথবা আটই জিলহজ মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। মক্কার গভর্নর আমর বিন সাঈদ তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করলো। তিনি বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে চললেন।

ইয়াযিদের কাছে কয়েকটি চিঠি পৌঁছলো। চিঠিগুলো পাঠিয়েছে কুফার তার কয়েকজন সমর্থক। এদের মধ্যে অন্যতম আব্দুল্লাহ ইবনে মুসলিম, আম্মারাহ ইবনে ওয়ালিদ, আমর বিন সাদ প্রমুখ। সবকটি চিঠির মর্ম প্রায় এক। কুফার গভর্নর নুমান ইবনে বশির নবি পরিবার এবং তার সমর্থকদের প্রতি ক্ষাণিক দুর্বল। মুসলিম ইবনে আকিল হুসাইন রাদি. এর হয়ে বায়াত নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নুমান কঠোর হতে পারছেন না। তিনি বলছেন, ‘আল্লাহর আনুগত্যে আমি নিজেকে দুর্বল ও ভীতু মনে করি। আল্লাহর নাফরমানির কাজে আমাকে সাহসী বলার চেয়ে ভীরুতাই আমার কাছে উত্তম।’ এই পরিস্থিতিতে কুফায় ইয়াযিদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য দরকার কাঠোর কাউকে। নুমান ইবনে বশীর ভীত। অথবা ইচ্ছে করে দুর্বলতা প্রকাশ করছেন।

হজরত মুআবিয়া রাদি. এর বিশেষ পরামর্শদাতা সারজুনের সঙ্গে আলাপ করে আব্দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে কুফার নতুন গভর্নর নিয়োগ দিলেন ইয়াযিদ। নিয়োগপত্রে বলে দিলেন, ‘অতিদ্রুত কুফায় পৌঁছে মুসলিম বিন আকিলকে গ্রেফতার করে হত্যা করো। অথবা তাকে কুফা থেকে বহিষ্কার করে দাও।’

কুফায় এসেই শহরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ডাকলো আব্দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ। তাদেরকে কঠোর ভাষায় বললো, ‘বাইরে থেকে এসে যারা শহরে অবস্থান করছে, ইয়াযিদের বিরোধিতা করছে, তাদের সবাই তালিকা আমাকে দিবে। কেউ যদি তালিকা করতে না পারে, তাহলে তাকে দায়িত্ব নিতে হবে, কেউ ইয়াযিদের বিরোধিতা করবে না। যে দায়িত্ব গ্রহণ করবে না, তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই। আমরা তাকে হত্যা করবো। যার ঘরে ইয়াযিদবিরোধী লোক পাওয়া যাবে, তাকে দরজার সামনেই শূলে চড়ানো হবে। তার সবকিছু বাজেয়াপ্ত করা হবে।’

এতদিন মুখতার ইবনে উবায়দার ঘরে অবস্থান করছিলেন মুসলিম ইবনে আকিল। ইবনে যিয়াদের উপরোক্ত নির্দেশনার পর তার আশঙ্কা হলো তার অবস্থান কেউ জানিয়ে দিতে পারে। তাই তিনি এবার আশ্রয় নিলেন হানী ইবনে ওরওয়ার ঘরে। গোয়েন্দা মারফত ইবনে যিয়াদ জেনে গেলেন বিষয়টা। হানীকে গ্রেফতার করা হলো। তার ওপর চালানো হলো অবর্ণনীয় নির্যাতন। কিন্তু তিনি আকিলকে ইবনে যিয়াদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। বললেন, ‘আমাকে হত্যা করলেও আকিলকে আপনার হাতে তুলে দিবো না।’ এদিকে ইবনে যিয়াদের বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ বিদ্রোহের পর আহত হয়ে গ্রেফতার হলেন মুসলিম ইবনে আকিল। তিনি তখন নিঃসঙ্গ। তার সঙ্গে কেউ ছিল না। তার সঙ্গে যে হাজার হাজার লোক এসেছিলো বিদ্রোহ করতে, ইবনে যিয়াদের এক ধমক, সামান্য প্রলোভনেই তারা সরে পড়েছে। তবে গ্রেফতার করার সময় মুহাম্মদ ইবনে আস বলেছে, ‘আপনার কিচ্ছু হবে না। আমি নিরাপত্তা দিচ্ছি।’

মুসলিম ইবনে আকিল কাঁদছিলেন। মুহাম্মদ ইবনে আস তাকে বললো, তুমি কাঁদছো কেন?
ইবনে আকিল বললেন, ‘আমি নিজের জন্য কাঁদছি না। কাঁদছি হুসাইন রাদি. এবং তার পরিবারের জন্য। আমার চিঠি পেয়ে তিনি কুফা উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। কিন্তু তাকে জানাতে পারলাম না—আগের মতো আর কিছুই নেই। সব পরিবর্তন হয়ে গেছে। তিনি এখানে এলেই গ্রেফতার হয়ে যাবেন।’
ইবনে আস বললো, ‘আমি চেষ্টা করবো তোমাকে বাঁচাতে।’
ইবনে আকিল বললেন, ‘মনে হয় না আমাকে বাঁচাতে পারবে। তবে তোমাকে একটা আবেদন করতে চাই।’
ইবনে আস বললো, ‘কী সেই আবেদন?’
ইবনে আকিল ইবনে আসের হাত ধরে বললো, ‘হুসাইন রাদি. এর কাছে দ্রুত লোক পাঠিয়ে তাকে কুফার বর্তমান অবস্থা জানাবে। তাকে বলবে, তিনি যেন ফিরে যান। কুফাবাসীদের চিঠিতে তিনি যেন প্রতারিত না হন।’
ইবনে আকিল বললো, ‘আমি এ আবেদন পূরণ করবোই।’

মুহাম্মদ ইবনে আস হুসাইন রাদি. কে চিঠি লিখে বার্তাবাহকের হাতে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। হুসাইন রা দি. তখন ‘যিয়ালা’ নামক স্থানে পৌঁছেছেন। দূত এসে চিঠি হুসাইন রাদি. এর হাতেই দিলো। চিঠি পড়ে তিনি বললেন, ‘যা নির্ধারিত, তা ঘটবেই। আমি আল্লাহর কাছে উম্মতের বিপর্যয় থেকে পানাহ চাই।’ কিন্তু তিনি মদীনার দিকে প্রত্যাবর্তন করলেন না। সামনে এগুতে লাগলেন আগের মতোই।

মুহাম্মদ ইবনে আস ইবনে আকিলকে নিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের দরবারে প্রবেশ করলো। ইবনে আস বললো, ‘মুসলিম ইবনে আকিলকে আমি নিরাপত্তা দিয়ে আপনার নিকট এনেছি।’
ইবনে যিয়াদ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো, ‘তোমাকে নিরাপত্তা দেয়ার অধিকার দিয়েছে কে? তাকে গ্রেফতার করতে পাঠিয়েছি নাকি নিরাপত্তা দিতে?’
ইবনে আস উত্তর দিতে পারলেন না। চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ইবনে যিয়াদ নির্দেশ দিলো—’মুসলিমকে রাজপ্রাসাদের ছাদে নিয়ে যাও। সেখানে বসে তার মস্তক দ্বিখণ্ডিত করো। তারপর তাকে নিচে ফেলে দাও।’
ইবনে যিয়াদের নির্দেশ পালন করা হলো। শহীদ হলেন মুসলিম ইবনে আকিল।

হুসাইন রাদি.কে কুফা গমন থেকে বিরত রাখার জন্য সবাই চেষ্টা করছেন। কিন্তু কারো চেষ্টা সফল হচ্ছে না। নিজের সিদ্ধান্তের ওপর পাহাড়ের মতো অটল হয়ে আছেন তিনি। এবার হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর রাদি. তার ছেলেকে দিয়ে হুসাইন রাদি. এর কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন—’আপনাকে আবেদন করছি, চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মক্কায় ফিরে আসুন। আমি বিপদের আশঙ্কা করছি। ভয় করছি—আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে শেষ করে দেয়া হবে। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছি। সামনে অগ্রসর হবেন না। ওয়াসসালাম।’

ছেলের হাতে চিঠি পাঠিয়ে তিনি গেলেন ইয়াযিদের নিযুক্ত মক্কার গভর্নর আমর ইবনে সাঈদের কাছে। তাকে বললেন, হুসাইনের জন্য একটি ‘নিরাপত্তা সনদ’ লিখে দিন। লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দিন—হুসাইন রাদি. মক্কায় ফিরে এলে তার সঙ্গে সদাচারণ করা হবে। আমর ইবনে সাঈদ সনদপত্র লিখে দিলেন। নিরাপত্তার প্রমাণস্বরূপ আব্দুল্লাহ ইবনে জাফরের সঙ্গে তার ভাই ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদকেও পাঠিয়ে দিলেন। ‘নিরাপত্তা সনদ’ নিয়ে তারা দুজন হুসাইন রাদি. এর সঙ্গে দেখা করলেন। কিছুতেই তিনি ফিরে যেতে রাজি হলেন না।
আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর রাদি. জিজ্ঞেস করলেন, ‘কুফাবাসী প্রতারণা করতে পারে। তবুও কেন যাচ্ছেন?’
হুসাইন রাদি. বললেন, ‘আমি রাসূল সা.কে স্বপ্নে দেখেছি। তিনি আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নের জন্যই কুফায় যাচ্ছি।’
আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর রাদি. জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্বপ্নটি কী? কী সেই নির্দেশনা?’
হুসাইন রাদি. বললেন, ‘এই স্বপ্নের কথা কাউকেই বলিনি। বলবোও না। আমি এটা গোপন রেখেই আমার রবের নিকট চলে যাবো।’

স্বপ্নের কথা শুনে আর কোনো কথা বললেন না আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর রাদি.। হুসাইন রাদি. এগিয়ে চললেন। হাজের নামক স্থানে পৌঁছে কুফাবাসীর কাছে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিতে তার আগমনের খবর, কুফাবাসী তাকে যে উদ্দেশ্যে ডেকেছে, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রাণপণ চেষ্টার কথা ছিলো। কিন্তু কাদেসিয়ায় পৌঁছে পত্রবাহক কায়েস ইবনে যিয়াদের পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলো। তাকে ছাদ থেকে মাটিতে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হলো।

‘সায়ালাবিয়া’ পৌঁছে হুসাইন রাদি. খবর পেলেন মুসলিম ইবনে আকিলকে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। ‘যায়ালা’ পৌঁছে শুনতে পেলেন, ইবনে আকিলের কাছে পাঠানো তার দুধভাই আব্দুল্লাহ ইবনে লাকিতকেও হত্যা করা হয়েছে। হুসাইন রাদি. দেখলেন—এতদিনের আশঙ্কাগুলো এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন কুফার পরিবেশ এখন তার সম্পূর্ণ প্রতিকূলে। তিনি তার সঙ্গীদের বললেন, ‘কুফাবাসী আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আমার অনুসারীরা আমার বায়াত থেকে ফিরে গেছে। এখন তোমরা চলে যেতে পারো। কারো দায়িত্ব নিজের ওপর নিতে চাই না।’

এই ঘোষণার পর পথ থেকে যুক্ত হওয়া মানুষগুলো চলে গেলো। হুসাইন রাদি. এর সঙ্গে থেকে গেলো কেবল তারাই, যারা তার সঙ্গে মক্কা থেকে এসেছে।

ইবনে যিয়াদ হুসাইন রাদি. কে গ্রেফতার করার জন্য হুর ইবনে ইয়াজিদের নেতৃত্বে এক হাজার অশ্বারোহী পাঠালো। তারা এসে হুসাইন রাদি. এর শিবিরের সামনে শিবির স্থাপন করলো। হুর ইবনে ইয়াযিদ বললো, ‘আপনাকে ইবনে যিয়াদের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত ছাড়বো না।’
হুসাইন রাদি. বললেন, ‘এরচেয়ে মৃত্যু উত্তম।’
হুসাইন রাদি. সঙ্গীদেরকে বললেন, সাওয়ারি প্রস্তুত করে ফিরে চলো। এখানে আর থাকতে হবে না। কিন্তু হুর ইবনে ইয়াযিদ বললো, ‘এখন কারো ফিরে যাবার উপায় নেই।’
ক্ষুব্ধ হয়ে হুসাইন রাদি. বললেন, ‘তুমি কী চাও?’
হুর ইবনে ইয়াযিদ বললো, ‘আপনাকে ইবনে যিয়াদের কাছে পৌঁছে দিতে।’
হুসাইন রাদি. অস্বীকার করে বললেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে কখনোই যাবো না।’
হুর ইবনে ইয়াযিদ কসম খেয়ে বললো, ‘আমিও আপনাকে ছাড়বো না।’

হুর ইবনে ইয়াযিদ বিকল্প এক প্রস্তাব দিলো হুসাইন রাদি.কে। বললো, ‘আমাকে আপনার সঙ্গে লড়াই করতে বলা হয়নি। বলা হয়েছে, আপনাকে কুফায় না পৌঁছিয়ে যেন চলে না যাই। আপনি একটি কাজ করতে পারেন।। আপনি এমন একটি রাস্তা ধরুন, যেটি কুফারও নয়, মদীনারও নয়। এরপর আমি ইবনে যিয়াদকে পত্র লিখবো। আপনি ইয়াযিদ বা ইবনে যিয়াদকে পত্র লিখবেন। এতে হয়তো আল্লাহ এমন ব্যবস্থা করে দিবেন, যে আপনাকে কষ্ট দেয়া বাঁচতে পারি।’ প্রস্তাবটা গ্রহণ করেন হুসাইন রাদি.। তিনি কাদেসিয়ার পথ ধরে বাম দিকে যেতে থাকেন। হুরও তার পেছনে পেছনে যেতে থাকে।

হুসাইন রাদি. যখন ‘নাইনওয়ি’ পৌঁছলেন, এক পত্রবাহক এসে হুর ইবনে ইয়াযিদের হাতে একটি দিলো। চিঠিতে ইবনে যিয়াদ লিখেছে—আমার এই চিঠি পাওয়া মাত্র তুমি হুসাইন এর ময়দান সংকীর্ণ করে দিবে। এমন এক ময়দানে তাকে নিয়ে যাবে, যেখানে পানির সঙ্কট। আমি এই দূতকে নির্দেশ দিয়েছি, নির্দেশ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত সে তোমার সঙ্গে থাকবে।’ পত্রপাঠ করে হুর ইবনে ইয়াযিদ হুসাইন রাদি.কে বললেন, ‘ইবনে যিয়াদ আমাকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করেছে। এখন আপনার সঙ্গে আপোষ করা সম্ভব হবে না।’

পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে সবকিছু। যোহাইর রাদি. হুসাইন রাদি.কে বললেন, ‘আমরা বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে যে বিপদ তার মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে, আমাদের যা আছে তা নিয়ে যুদ্ধ করা শ্রেয়।’ হুসাইন রাদি. বললেন, ‘আমি আগে যুদ্ধে যেতে চাই না।’ যোহায়ের বললেন, ‘আগে যুদ্ধ করতে না চাইলে আমাদেরকে ফোরাত নদীর নিকটে একটি নিরাপদ স্থানে নিয়ে চলুন। সেখানে যেতে বাধা দিলে যুদ্ধ করবো।’

হুসাইন রাদি. সঙ্গীদের নিয়ে কারবালায় পৌঁছলেন।

চার হাজার সৈন্য নিয়ে হুসাইন রাদি. এর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলো ওমর ইবনে সাদ। সে চাইতো হুসাইন রাদি. এর সঙ্গে যেন তার যুদ্ধ করতে না হয়। কিন্তু ইবনে যিয়াদ তাকে জোর করে পাঠিয়েছে। সে এসেই হুসাইন রাদি.কে জিজ্ঞেস করলো, ‘কুফায় কেন এসেছেন?’
হুসাইন রাদি. বললেন, ‘কুফাবাসীরা আমাকে ডেকে এনেছে। এখন তারা যদি আামকে প্রত্যাখ্যান করে, আমি ফিরে যেতে প্রস্তুত।’
ওমর বিন সাদ ইবনে যিয়াদের কাছে চিঠি পাঠালো—’হুসাইন রাদি. কুফা ত্যাগ করতে প্রস্তুত।’ জবাবি চিঠিতে ইবনে যিয়াদ লিখলো—’হুসাইনকে একটি প্রস্তাবই দাও। ইয়াযিদের হাতে বায়াত। বায়াত গ্রহণ করতে রাজি হলে দেখবো কী করা যায়। আরেকটি কথা—হুসাইনি কাফেলাকে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দাও।’

হুসাইনি কাফেলাকে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হলো। পানির তৃষ্ণায় যখন তারা কাতর, হুসাইন রাদি. তার ভাই আব্বাসকে পানি আনার জন্য ত্রিশজন অশ্বারোহী এবং ত্রিশজন পদাতিক সৈন্য দিয়ে পাঠালেন। ওমর বিন সাদের সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করে তারা বিশ মশক পানি নিয়ে এলো। এদিনই হুসাইন রাদি. ওমর বিন সাদকে খবর পাঠালেন, আজ রাতে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই। আলাপের সুযোগ হলে আমি কিছু প্রস্তাব দিবো।

ওমর বিন সাদ রাতে হুসাইন রাদি. এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলো। হুসাইন রাদি. তার সামনে তিনটি প্রস্তাব পেশ করলেন। এক—আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানে ফিরে যাবো। দুই—অথবা আমাকে ইয়াযিদের কাছে নিয়ে চলুন। আমি তার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবো। তিন—অথবা আমাকে কোনো মুসলিম দেশের সীমান্তে পৌঁছে দিন। আমি সেখানের সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে বসবাস করবো। প্রস্তাব তিনটি চিঠি লিখে ইবনে যিয়াদকে জানলো ওমর বিন সাদ। এই চিঠি ইবনে যিয়াদকে প্রভাবিত করলো। সে বললো, ‘এই চিঠি এমন এক ব্যক্তির, যিনি আমিরের অনুগত এবং নিজ কওমের কল্যাণকামী। আমি প্রস্তাব মঞ্জুর করলাম।’ কিন্তু শিমার বাধ সাধলো। সে বললো, ‘আপনি হুসাইনকে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ দিতে চান? আমার মনে হয় ওমর বিন সাদের ষড়যন্ত্র আছে এখানে। আমি জেনেছি সে রাতে হুসাইনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে। তবে আপনি হুসাইনকে আপনার কাছে আসতে বলতে পারেন। এরপর তাকে শাস্তি দিবেন বা মাফ করবেন।’

শিমারের নির্দেশনামতো ইবনে যিয়াদ চিঠি লিখলো ওমর বিন সাদের কাছে। এবং শিমারকে বলে দিলো, নির্দেশনা দ্রুত কার্যকর না হলে তুমি ওমরকে হত্যা করবে এবং তুমি তার স্থলাভিষিক্ত হবে। শিমার চিঠি নিয়ে মহররমের নয় তারিখ হুসাইনের কাছে পৌঁছে। এসময় হুসাইন রাদি. হালকা তন্দ্রায় স্বপ্ন দেখলেন—রাসূল সা. তাকে বলছেন, ‘তুমি শিগগিরই আমার কাছে আসবে।’

দশই মহররম ঘটে কারবালার মর্মান্তিক ট্রাজেডি। হুসাইন রাদি.কে শহীদ করে দেয়া হয়। তার মাথা কেটে নেয়া হয়। তবে মাথাটা কে কেটেছে এই নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলে সিনান ইবনে আনাস। কেউ বলে শিমার মাথা কেটেছে। তার সঙ্গে সাহায্য করেছে সিনান ইবনে আনাস। ইবনে যিয়াদের নির্দেশ ছিলো—হুসাইনকে হত্যা করে তার মৃতদেহ যেন ঘোড়ার খুর দ্বারা পিষ্ট করা হয়। ওমর বিন সাদ কয়েকজনকে নির্দেশ দিলো। নির্দেশনা পেয়ে দশজন অশ্বারোহী জঘন্য অমানবিক এই কাজটি সম্পন্ন করলো।

ইয়াযিদের সামনে রাখা হলো হুসাইন রাদি. এর মস্তক মুবারক। তার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে বললো, ‘আমি তো নির্দেশ দিয়েছিলাম হত্যা না করে শুধু গ্রেফতার করবে। হত্যাকারী ধ্বংস হোক। আমি সেখানে থাকলে হুসাইন কে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতাম।’ তবে এই কথা বলেই সে তার হাতের ছুড়িটি হুসাইন রাদি. এর দাতের উপর রাখলো। তারপর আবৃত্তি করলো একটি কবিতা। তার সারমর্ম—’আমার কওম আমার সাথে ইনসাফ করেনি। ইনসাফ করেছে রক্তপিপাসু তরবারি। তরবারি এমন ব্যক্তির শিরচ্ছেদ করেছে, যে আমাদের ওপর কঠোর ছিলো।’

কারবালার ঘটনাকে বলা যায় উহুদ যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি। হুসাইন রাদি. এর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসনে ঢুকে পড়া জালেমি ধারা ঘৃণিত হয়। চিরকালীনভাবে তারা বৈধতা হারায়। উহুদ যুদ্ধে বাহ্যিকভাবে মুসলমানরা জয় লাভ করেনি, কারবালাতেও বিজয় অর্জন করতে পারেননি হুসাইন রাদি.। তবে অনেক পরাজয় শত জয়ের চেয়েও শক্তিশালী হয়। সূরা কাওসারে আল্লাহ যেমন বলেছেন, কাফেররা নবীজিকে বলত নির্বংশ, তার নেই কোন উত্তরাধিকার— ছেলেসন্তান নেই। আল্লাহ বলেন, কাফেররাই প্রকৃত নির্বংশ, সন্তান থেকেও তাদের কেউ নেই।

উহুদের মতো কারবালাতেও পরাজিত হয়নি ইসলাম !

তথ্যসূত্র: শুহাদায়ে কারবালা, মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ.

(বিঃদ্রঃ ইসলামি ইতিহাসের এই অধ্যায়টি অতীব সংবেদনশীল। তাই লেখায় যদি কোনো বৈসাদৃশ্য, ভুল চোখে পড়ে, জানানোর অনুরোধ রইলো।

The post মুখোমুখি হুসাইন ও ইয়াযিদ : কী ঘটেছিল কারবালায় ? appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%96%e0%a7%8b%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%96%e0%a6%bf-%e0%a6%b9%e0%a7%81%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%a8-%e0%a6%93-%e0%a6%87%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bf%e0%a6%a6/

No comments:

Post a Comment