লেখক: মুনশি মুহাম্মাদ কিন্দিল
ভাষান্তর: মাহদি হাসান
‘খলিফার কাছে যেতেই আপনি তাকে হত্যা করবেন।’
প্রিয় বন্ধু এবং হিতাকাঙ্ক্ষী আবু ইসহাক নির্দ্বিধায় কথাটি বলে ফেললেন।
আবু মুসলিম অবাক কণ্ঠে বললেন, ‘কী বলছ, খলিফাকে হত্যা করব!’
আবু ইসহাক বললেন, ‘আল্লাহর কসম, যদি এমনটি না করেন তবে সেখান থেকে আপনি আর বেরিয়ে আসতে পারবেন না।’
আবু ইসহাক যেন স্পষ্ট পড়তে পারছিলেন চোখের সামনে খুলে রাখা ভবিষ্যতের পাতা। তার অস্থির হৃদয়ে থেকে থেকে হানা দিচ্ছিল প্রবল ভীতি। আশঙ্কা হচ্ছিল তার, হয়তো এ যাত্রাই আবু মুসলিম খোরাসানিকে নিয়ে যাবে তার মৃত্যুর দিকে। আবু মুসলিম কোনো দুর্বল চিত্তের নাম নয়। আবু মুসলিম সেই শার্দূলের নাম, বহু যুদ্ধে যার রয়েছে অসীম সাহসিকতার দৃষ্টান্ত। যার উন্মুক্ত তরবারির নিচে কচুকাটা হয়েছে হাজারো শত্রু। আবু মুসলিম বিশ্বাস করতেন, এর প্রতিদানে তার ভাগ্যললাটে আছে কেবল একটিই শাস্তি। তরবারির আঘাত। আর তার কারাগার হবে কবর। তবুও তিনি খলিফা আবু জাফর মানসুরের মুখের উপর তরবারি উত্তোলনের দুঃসাহস দেখান কী করে?
সময় কত দ্রুতই না বদলে যায়। এককালে যে ছিল খেলাফতের সবচেয়ে আস্থাভাজন সেনাপতি, আজ সে এক বিদ্রোহী। নিষ্ঠুর ভাগ্য তাকে নিয়ে যাচ্ছে এক নির্মম পরিণতির দিকে। খলিফার দূত আসার পর থেকেই উড়ে গেছে তার রাতের ঘুম। অস্থিরতা তাকে নিতে দিচ্ছে না কোনো সিদ্ধান্ত। অথচ এর আগে ভেবেছিলেন, তিনি পারবেন পুরো পৃথিবীকে তার তরবারির সামনে দমিয়ে দিতে। খলিফার দূত প্রথমে এসে কথা বললো খুবই কোমল এবং মিষ্টি স্বরে। কিন্তু যে আবু মুসলিম চোখের সামনে শত শত মানুষের রক্তপাত দেখেছেন, কথার মাধুর্যতা তাকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি।
তাই তিনি দূতকে বললেন, ‘তোমার মনিব খলিফার কাছে ফিরে যাও। আমি তাঁর সাক্ষাতে কিছুতেই আগ্রহী নই।’
খলিফার দূত শান্তস্বরে বললেন, ‘আপনি কি খলিফার বিরোধিতা করার দৃঢ় সংকল্প করেছেন? আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি, এমনটি কখনোই করবেন না।’
দূতের কাছে ছিল আরেকটি চিঠি। আবু মুসলিমের আনুগত্য থেকে নিরাশ হয়ে গেলে এই চিঠি দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তাকে। তাই এবার সে ক্রূর কণ্ঠে বলল, ‘খলিফা আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, যদি আপনি তার কাছে যেতে অস্বীকার করেন অথবা বিদ্রোহ করেন তবে তিনি আপনার তালাশে এবং নিজ হাতে আপনার শিরচ্ছেদের প্রচেষ্টায় কোনো কমতি করবেন না। আপনি যদি সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তবে তিনিও সমুদ্রে ঝাঁপ দিবেন। আগুনে লাফিয়ে পড়লে তিনিও তাতে নেমে পড়বেন। নিজ হাতে আপনার শিরচ্ছেদ না করে ক্ষ্যান্ত হবেন না তিনি। তার হাত থেকে আপনাকে বাঁচাতে পারে কেবলই মৃত্যু।’
আবু মুসলিম চমকে গেলেন। এই প্রথম এমন ভয়ানক হুমকির মুখোমুখি হলেন তিনি। কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘খলিফা নিজেই কি এ কথা বলেছেন?’
খলিফার দূত সম্মতিসূচক মাথা ঝুঁকিয়ে আবু মুসলিমকে রেখে যায় হতভম্ব অবস্থায়। সারারাত ধরে তিনি ভাবতে থাকেন খলিফার এই কঠোর হুমকি নিয়ে। প্রথম পত্রের কোমলতা আর দ্বিতীয় পত্রের রুঢ়তা নিয়ে মেলাতে থাকেন হিসাব। ভাবতে থাকেন, এ দুইয়ের মাঝে কোনো উত্তরণের পথ খুঁজে পাবেন কী না? তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে থাকে ইতোপূর্বে আবু জাফর মানসুরের সাথে তার সাক্ষাতের মুহূর্তগুলো। প্রতিবারই তাকে কোনো না কোনো নতুন আঘাত নিয়ে ফিরতে হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোতে হত্যার হুমকি ছিল না। এবার কি তবে ঘনিয়ে এল তার শেষযাত্রা?
পরদিন ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই একান্ত আস্থাভাজন বন্ধু আবু ইসহাককে খবর পাঠালেন তিনি। আবু ইসহাক উপস্থিত হতেই তাকে পাঠিয়ে দিলেন খলিফার কাছে দূত বানিয়ে। আশা ছিল তার মাধ্যমে সুদূরে অবস্থিত আব্বাসীয় প্রাসাদে চলতে থাকা ঘটনার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা তিনি পাবেন। কিন্তু আবু ইসহাক ফিরে আসে এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের পরোয়ানা নিয়ে। আবু মুসলিম খোরাসানির প্রতি আব্বাসীয় খলিফার প্রশংসা এবং হুমকি মিশ্রিত কথা তার মস্তিস্কে তৈরী এক জটিল মাকড়সার জাল। আবু ইসহাকের মুখে সব শুনে আবু মুসলিম খোরাসানি হয়ে পড়েন চূড়ান্ত হতাশ। নিভু নিভু করে জ্বলতে থাকা সর্বশেষ আশার প্রদীপটিও এইমাত্র আত্মহুতি দিল বুঝি কালো ভবিষ্যতের অন্ধকার কূপে। এরপর আবু মুসলিম আর আবু ইসহাক একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। যেভাবে শেষ বিদায়ের সময় দুই পরম বন্ধুর আখিদ্বয় কেঁপে কেঁপে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু ঝরতে থাকে, তেমনি করে অশ্রু ঝরাতে থাকে তাদের দুইজোড়া চোখ।
নিয়তির লিখন মেনে নিয়ে আবু মুসলিম খোরাসান থেকে যাত্রা শুরু করেন রায় শহরের উদ্দেশ্যে। যেখানে খলিফা মানসুর অবস্থান করছে। সাথে উপহার-উপঢৌকনে ভরপুর এক বিরাট কাফেলা। হয়তো এতসব আয়োজন দেখে খলিফা মানসুরের হৃদয়কোণে দয়ার প্রস্রবণ সৃষ্টি হতে পারে। সাথে সৈন্যদলও আছে। হয়তো তা দেখে খলিফা মানসুর চিন্তিতও হতে পারেন। আবু মুসলিম আছেন কাফেলার অগ্রভাগে। তার মুখে ঝুলে আছে এক অখণ্ড নীরবতা। মননে আর মস্তিষ্কে ভেসে বেড়াচ্ছে কোনো এক কবির বলে যাওয়া পংক্তি।
মৃত্যুর সাথে চলে না মানুষের কোনো কৌশল
মৃত্যু করেছে বহুজাতির কৌশলের দাফন।
রায় নগরীতে যাওয়ার পথ যেন ফুরোতেই চায় না। ক্রমশই পথের ফিতা কেউ যেন টেনে লম্বা করে দিচ্ছে। চারদিকে সৈন্যের বেষ্টনী দেখে আবু মুসলিম কিছুটা নিরাপদ বোধ করেন। মগ্ন হয়ে যান অতীত স্মৃতি রোমান্থনে। যে অতীতের আকাশে জ্বলজ্বল করে আছে তার যত গর্বিত বিজয়গাঁথা। যে শহর, জনপদগুলো তিনি বনু উমাইয়া শাসকদের থেকে বিজিত করেছিলেন, সেগুলোর পাশ দিয়েই অতিক্রম করছে তার কাফেলা। আবু মুসলিম তখন এক তরতাজা যুবক। এ সময় তার সাক্ষাৎ হয় আব্বাসীয় নেতা ইবরাহিম ইবনু মুহাম্মাদের সাথে। ইবরাহিমের মনের সুপ্ত অভিপ্রায় ছিল বনু উমাইয়ার শাসন থেকে নিস্কৃতি লাভ। ধীরে ধীরে তার সেই সুপ্ত আশা সংকল্পে রূপ নিতে থাকে। এমনই এক সময়ে তিনি পান আবু মুসলিমের দেখা। প্রথম দেখাতেই ইবরাহিম আবু মুসলিমের দুঃসাহসিক মনোভাব আঁচ করে ফেলেন। নিজ মিশনের এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন করেন তাকে। বানিয়ে দেন দলনেতা। অন্য আব্বাসীয়রা যার অনুসরণ করেছে।
এরপরই শুরু হয় কালো পতাকার নীচে আবু মুসলিম খোরাসানির বিজয়যাত্রা। বনু উমাইয়ার খলিফা এবং প্রশাসকদের অত্যাচারে জনগণ তখন অতিষ্ঠ। কবে তাদের পতন ঘটবে এ নিয়েই ছিল তাদের রোজকার প্রার্থনা। আবু মুসলিম খোরাসানি পারস্যকে নিয়ে নেন তার হাতের মুঠোয়। বনু উমাইয়ার শেষ খলিফার মারওয়ান ইবনু মুহাম্মাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অস্তমিত উমাইয়া খেলাফতের সূর্য। ইতিহাসের আকাশে পতপত করে উড়তে থাকে আব্বাসীয় খেলাফতের কালো পতাকা। তারপর থেকে আবু মুসলিম খোরাসানি বহাল থাকেন আব্বাসি খেলাফতের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে। কিন্তু আবু জাফর মানসুরের আগমনের পর পালটে যায় সবকিছু।
ফিরে আসি আবু মুসলিমের যাত্রাপথে। পথিমধ্যে বিশ্রাম নিতে থেমে যায় কাফেলা। তখন আবু মুসলিমের তাঁবুতে আগমন করে এক জ্যোতিষী। সহযাত্রীরা বলে এই লোক ভবিষ্যতের খবর প্রদানে খুবই পারঙ্গম। মুসলিম ঠোঁটে উপহাসের তিক্ত হাসি ঝুলিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করনে, ‘আমার কোথায় মৃত্যু হবে, তা কি বলতে পারবে?’ প্রশ্ন শুনে জ্যোতিষী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবু মুসলিমের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনার মৃত্যু হবে রোমে।’ আবু মুসলিম হেসে উঠেন। খলিফার সঙ্গে তার মাদায়েন শহরে দেখা হওয়ার কথা চূড়ান্ত হয়েছে। তাই মনে মনে বলতে থাকেন, ‘মাদায়েন থেকে রোম বেশি দূরে নয়।’ জ্যোতিষীর কথায় খুব বেশি আস্থা না হলেও তাকে মোটা অংকের পুরস্কার ঠিকই প্রদান করেন।
আবু মুসলিম খোরাসানি আর আবু জাফর মানসুরের প্রথম দেখা হয়েছিল খোরাসানে। তখন উমাইয়া খেলাফতের পতন ঘটেছে। আবুল আব্বাস সাফফাহ বসেছেন খেলাফতের মসনদে। আবু জাফর মানসুরকে নিযুক্ত করেছেন পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত। এরপর থেকে দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বীতা বেড়েছে ক্রমশই। আবু জাফর মানসুর আবু মুসলিম খোরাসানিকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীই জ্ঞান করেছেন। এরই মাঝে যায় ঘটে যায় কিছু ঘটনা। যা তাদের শীতল সম্পর্কে আরও জল ঢেলে দেয়। হজের আমির হওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তাদের দুজনের মধ্যে। এদিকে মানসুরের ফুফু আমিনার প্রতি আবু মুসলিমের অনুরাগের কথাও কানে আসে মানসুরের। যা তাকে করে তোলে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। আবু মুসলিম জানতেন আবু জাফর মানসুর তাঁর শেষ দেখে ছাড়বে। সেই সমাপ্তির প্রহর হয়তো খুব কাছেই। আবু মুসলিমের হৃদয়ের অন্দরে ক্রমেই খেলে যাচ্ছে আশা-নিরাশার ঢেউ।
রায় শহরের প্রধান ফটকে অপেক্ষমাণ আব্বাসি খেলাফতের অভিজাত ব্যক্তিবর্গ। শহরের প্রাচীরের উপর পতপত করে উড়ছে আব্বাসিদের কালো পতাকা। বাগদাদ, বসরা, কুফা থেকে এই অভিজাত ব্যক্তিগণ এসে হাজির হয়েছেন রায় নগরীতে। এমনকি খলিফা মানসুরও রাজধানী ছেড়ে এসে মাদায়েনে অপেক্ষা করেছেন আবু মুসলিমের জন্য।
অভিজাত ব্যক্তিগণের মাঝে উপস্থিত ছিলেন ইসা ইবনে মুসা। যিনি খলিফা মানসুরের মামা এবং আবু মুসলিমের বন্ধু। আবু মুসলিম অন্তরে প্রবল ভয় নিয়ে ইসাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-ওহে ইসা, তোমার কি মনে হয় খলিফা আমার সঙ্গে প্রতারণা করবেন?
-এটা কেমন প্রশ্ন করলে তুমি? তিনি কি এর আগে কারও সঙ্গে প্রতারণা করেছেন? তিনি কোনো গাদ্দার প্রকৃতির মানুষ নন। তুমি ভয় পেয়ো না। আমি তোমার সঙ্গেই থাকব।
ইসার এ কথায় আবু মুসলিম কিছুটা প্রসন্ন হলেন। খোরাসান ত্যাগের পর প্রথমবারের মতো খাবার খাওয়ার রুচি হলো তার। আহার সেরে বিছানায় হেলান দিলেন ঘুমের জন্য। রায় নগরীতে বিশ্রাম পর্ব শেষ সবশেষে আবু মুসলিম পূর্ব ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেন মাদায়েন শহরে। শহরবাসী অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবে বরণ করে নিল তাকে। খলিফার উজির আবু আইয়ুব এসেছেন তাকে গ্রহণ করার জন্য। জানালেন, খলিফা তার সাক্ষাতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। এই বলে তাকে নিয়ে গেলেন খলিফার অবস্থানস্থলে। খলিফা প্রাসাদে অবস্থান না করে, শহরের মাঝে এক বিশাল তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছেন। সেই তাঁবু দেখে বিস্ময় ফুটে উঠে আবু মুসলিমের চোখে। আবু আইয়ুব বলেন, রোমের মিত্রদের সম্মানে খলিফা এই তাঁবুর নাম দিয়েছেন রোমিয়া। আবু মুসলিম প্রবেশ করে সেই রোমিয়া তাঁবুতে। তার অনুগত সৈনিকগণ অবস্থান নেয় তাঁবুর বাইরে। অবশেষে খলিফার কাছাকাছি পৌঁছে যান দুজন। প্রহরীরা আবু মুসলিমের তলোয়ার নিয়ে নিতে চাইলে তিনি নিষেধ করেন। আবু আইয়ুবের কথায় প্রহরীরা নিবৃত্ত হয়। অবশেষে মুখোমুখি হয় দুজন। খলিফার চেহারায় নির্লিপ্ত মনোভাব। নেই কোনো হাসি কিংবা ক্রোধের রেখা। তিক্ত সম্পর্ক এবং বিদ্বেষের দীর্ঘ দূরত্ব এ দুজনের মাঝে। উপস্থিত সকলের মুখেই চিন্তার ছাপ। পরবর্তী দৃশ্য কী হতে পারে এ নিয়ে তাদের মনে খেলে যাচ্ছে প্রবল উৎকণ্ঠা। আবু মুসলিমের মস্তিস্কে উঁকি দিচ্ছেন নানা দুশ্চিন্তা। কিন্তু খলিফা হাসিমুখে এগিয়ে এসে অবসান ঘটালেন সব উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার। আবু মুসলিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দীর্ঘ সফরে আপনি ক্লান্ত হয়ে গেছেন। যান গোসল সেরে বিশ্রাম নিন। ইনশাআল্লাহ কাল আপনার সঙ্গে আলাপ হবে।
তাদের প্রথম দেখা সম্পন্ন হলো খুব ভালোভাবেই। আবু মুসলিম প্রশান্তচিত্তেই খলিফার সম্মুখে নিজেকে অবনত করলেন। রোমিয়া তাঁবু থেকে বের হলেন। বাইরে দাঁড়ানো সবাই তাঁর জন্য করছিল অধির আগ্রহে অপেক্ষা। তাকে দেখে এবার তারা নিশ্চিন্ত হলো, খলিফা কিছুতেই আবু মুসলিমকে হত্যা করতে পারেন না।
পরদিন সকালে আবু আইয়ুব গেলেন খলিফার তাঁবুতে। দেখতে পেলেন তিনি জেগে আছেন। তাঁর চোখে মুখে ক্রোধের আভা। উজিরকে দেখতেই মানসুর তেড়ে উঠে বললেন, আপনার জন্য আমি কাল তাকে হত্যা করা থেকে বিরত থেকেছি। আল্লাহর কসম, রাতে আমার চোখে একটুও ঘুম আসেনি।
আবু আইয়ুব নিজেকে দায়মুক্ত করতে নানা কথা বললেন। তিনি চেয়েছিলেন যেন কোনো দুঃখজনক ঘটনা না ঘটে। কিন্তু আবু মুসলিম খলিফার তাঁবু থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাবে এ কথা আবু মানসুর কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। এতদিন আবু মুসলিম খলিফা না হয়েও প্রায় খলিফার মতো জীবনযাপন করে এসেছে। তাকে তিনি কীভাবে ছেড়ে দিবেন? উজিরকে ধমক দিয়ে বললেন, প্রধান প্রহরী উসমান ইবনে নাহিককে ডাকুন। ইবনে নাহিক উপস্থিত হলে তাকে বললেন, আমি যা হুকুম করি তাই করতে পারবে? ইবনে নাহিক বলল, আপনার জন্য আমার জান কুরবান। আপনার আদেশ পালনে এতটুকুও দ্বিধা করব না। মানসুর এবার বললেন, যদি বলি আবু মুসলিমকে হত্যা করতে? এ কথা শুনে উসমান ইবনে নাহিক যেন জমে গেল। তার উদ্দীপনায় পড়ে গেল ভাটা। কিন্তু খলিফার চেহারায় ক্রোধ দেখে বলল, অবশ্যই তাকে হত্যা করব। খলিফা চিৎকার করে বললেন, তাকে হত্যা না করলে আমি তোমাকেই হত্যা করে ফেলব। যাও আরও চারজন শক্তিশালী প্রহরী ডেকে নিয়ে আসো।
পরদিন আবু মুসলিম যখন খলিফার দরবারে যখন যাবেন, দেখেন তার বাহিনীর অবস্থা পুরো পালটে গেছে। তাদের কারও মাঝে নেই কোনো আন্তরিকতার চিহ্ন। অর্ধেক পড়ে আছে মাতাল হয়ে। এদিকে খলিফার গোয়েন্দারা আবু মুসলিমকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। অবশেষে বন্ধু ইসা ইবনে মুসার আবাসস্থলে প্রবেশ করলেন আবু মুসলিম। কিছুক্ষণ বসে থাকলেন সেখানে। ইত্যবসরে খলিফার এক ভৃত্য এসে আবু মুসলিমকে বলল, যদি খলিফার সঙ্গে একান্তে আলাপ করতে চান তবে এখনই আসুন। একটু পরই পারস্যের একটি প্রতিনিধি দল চলে আসবে।
আবু মুসলিম ইসাকে বললেন তার সঙ্গে যেতে। ইসা অজু ইস্তেঞ্জা সেরে আসার কথা বলে অনেকক্ষণ বিলম্ব করলেন। এদিকে খলিফার ভৃত্যটিও বারংবার পীড়াপীড়ি করছে। অগত্যা একাই তিনি খলিফা মানসুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। শেষমুহুর্তে এসে কিছু সৈনিক তার সঙ্গে যুক্ত হলো। তারা দাঁড়িয়ে রইলো তাঁবুর বাইরে। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি তাদের ছিল না। খাদেমরা বিছানা-বালিশ বিছাতে শুরু করল। যেন এখানে দীর্ঘ কোনো আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। একটু পর আবু আইয়ুব এসে আবু মুসলিমের সৈন্যদেরকে বললেন, আবু মুসলিম দ্বি-প্রহরের সময়টুকু এখানেই কাটাতে চাইছেন। তাই তোমাদের চলে যেতে বলছেন। এদিকে সেবকদের বিছানা এবং খাবারের দস্তরখান বিছানোর আয়োজন দেখে সৈন্যদের মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক হলো না। তারা ফিরে গেল খলিফার পক্ষ থেকে তাদের জন্য প্রস্তুতকৃত আরাম আয়েশের আয়োজনে। মাদায়েন শহরের স্বচ্ছ আকাশের মতো আজ কী ঘটতে যাচ্ছে তাও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। তাঁবুর ভেতরে খলিফা বসে আছেন বেশ শান্ত ও নির্বিকার ভঙ্গিতে। তিনি আবু মুসলিমকে জিজ্ঞেস করলেন, শুনেছি আবদুল্লাহ ইবনে আলির সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় আপনি দুটি তলোয়ার পেয়েছিলেন। আপনার কোমরের তলোয়ারটি সেই দুটির একটি নাকি? আবু মুসলিম সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। খলিফা হাত বাড়িয়ে তলোয়ারটি দিতে বললেন তাকে। আবু মুসলিম অনিচ্ছা বোধ করলেও সেখানে না দেয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। অতঃপর খলিফা মানসুর সেই তলোয়ারটি নিয়ে বিছানার নিচে রেখে বললেন, এটি আব্বাসি তলোয়ার, আবু মুসলিমের তলোয়ার নয়।
এ কথা শুনে আবু মুসলিমের দুশ্চিন্তা জেগে উঠল আবারো। তার চোখে দেখা গেল ভীত হরিণের উৎকণ্ঠা। বুঝতে পারলেন, তিনি খলিফার উপর বেশিই ভরসা করে ফেলেছেন। নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলার আগেই এবার খলিফা শুরু করলেন তিক্ত জবাবদিহিতার পালা। খুলে বসলেন দুজনের মধ্যকার অতীতের তিক্ত অধ্যায়। আবু মুসলিম একেক করে দিয়ে যাচ্ছিলেন নিজের জবাব। যা শুনে খলিফার ক্রোধ প্রশমিত হওয়ার বদলে আরও যাচ্ছিল বেড়ে। পরিশেষে এসে গেল তার মনোকামনা চরিতার্থ করার সময়। প্রহরিরা এসে ঘিরে ধরল আবু মুসলিমকে। আবু মুসলিম বুঝে গেলেন চলে এসেছে তার অন্তিম লগ্ন। উসমান ইবনে নাহিক তলোয়ার কোষমুক্ত করল আবু মুসলিমকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আবু মুসলিমের শীতল দৃষ্টি তাঁর বুকে ধরিয়ে দিল কাঁপন। তাই তার আঘাতটি ক্ষীণ হয়ে লাগল আবু মুসলিমের দেহে। আবু মুসলিম চিৎকার করে বললেন, আমিরুল মুমিনীন, আপনার শত্রুদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য হলেও আমাকে মুক্তি দেন। খলিফা ততোধিক চিৎকার করে বললেন, আমার সবচেয়ে বড় শত্রু তো আপনিই। এই বলে প্রহরীদের হুকুম দিলেন তাকে নিঃশেষ করে দিতে।
প্রথম প্রহরী আঘাত করল তার বাহুতে। দ্বিতীয়জন আঘাত করলে হাঁটুর গ্রন্থিতে। তৃতীয়জন আঘাত করল কোমড়ে আর চতুর্থজন ঘাড়ে। যন্ত্রনাদগ্ধ আবু মুসলিমের চিৎকার মিলিয়ে গেল তাঁবুর বাইরের দফের আওয়াজের সাথে। রক্তাক্ত দেহের সবটুকু শুষে নিল বিছিয়ে রাখা লাল গালিচা। এরপর অখণ্ড নীরবতা নেমে এল তাঁবুর ভেতর। কম্পমান খলিফা প্রশান্তমনে বসলেন তার আসনে। প্রহরীর গালিচা দিয়ে মুড়ে নিল রক্তাক্ত আবু মুসলিমের দেহ। একটু পর এসে প্রবেশ করলেন উজির আবু আইয়ুব। খলিফাকে কুর্নিশ করে বললেন, আমিরুল মুমিনীন, আজ আপনার খেলাফত সম্পূর্ণরূপে নিষ্কণ্টক হলো।
The post জার্নি টু ডেথ: আবু মুসলিম খোরাসানির মৃত্যুযাত্রা appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%9f%e0%a7%81-%e0%a6%a1%e0%a7%87%e0%a6%a5-%e0%a6%86%e0%a6%ac%e0%a7%81-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%96/
No comments:
Post a Comment