যায়েদ মুহাম্মদ:
সঙ্গীত বা নাশীদ কোনটাই শোনার অভ্যাস নাই। তবু হঠাৎ হঠাৎ কোনো উপলক্ষে সঙ্গীত শোনা হয়ে যায়। সঙ্গীতের সঙ্গে একধরনের স্মৃতিমুগ্ধতার ব্যাপার আছে। কোনো সঙ্গীত একান্ত প্রিয় হয়ে উঠলে তার সঙ্গে অনেক কিছুই জড়িয়ে পড়ে। অনেক বছর আগে একবার সমুদ্র দেখতে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। প্রায় পুরো সফরই জুনায়েদ জামশেদের ‘ম্যায় তো উম্মাতি’ শুনে কাটিয়েছি। সফর থেকে ফেরার পর যখনই গজলটা শুনি, সমুদ্র দেখার সুখস্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এর কয়েকদিন পরই জুনায়েদ জামশেদ মারা যান। সঙ্গীতের সঙ্গে তখন দুঃখস্মৃতিও যুক্ত হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে একটা গজলের সঙ্গে সমুদ্র দেখার আনন্দস্মৃতি আবার প্রিয়শিল্পীর বিয়োগব্যথা—দুটোই স্মৃতিকাতর করে তুলতো।
গত কয়েকদিন ধরে মুহাম্মদ আল মুকিতের নাশিদগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছি। মুকিতের কন্ঠের সঙ্গে শূন্যতা ও বিদায়ের সুর মিশে আছে। তাকমীলের পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় নিয়মিত মুকিত শুনতাম। তখন ভেতরে ভেতরে প্রবল হতাশাবোধ কাজ করত। পরীক্ষার মত একটা ক্লান্তিকর বিষয়ের বাইরেও চিন্তার বিষয় ছিল—অদূর ভবিষ্যত; তাকমিলের পরীক্ষার পরপরই আসন্ন করণীয়। আমার সহপাঠীদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাগুলোর তাখাসসুসে ভর্তি হয়ে গেছে। তাদের চোখেমুখে এখনো স্বপ্ন-সম্ভাবনার উজ্জ্বল আলো আর প্রশান্তির ছায়া। আমি যা করব ভেবে রেখেছি, সেক্ষেত্রেও কোনো সুবিধা করতে পারছিলাম না। দু এক জায়গায় সুযোগ থাকার পরও এড়িয়ে গেছি। সহপাঠীরা একেকজন তাদের নতুন প্রতিষ্ঠানের বিবিধ গল্প শোনাচ্ছে। আমি কিছুটা হতাশা, কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যেই মুকিতের গজল শুনতে শুরু করে দিই।
আমাদের তাকমিলের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল গতবছর এপ্রিলে। কিন্তু হঠাৎ করেই মহামারীর ভয়াবহ প্রকোপে সবকিছু স্থির হয়ে গেল। একাডেমিক অর্থে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রস্তুতি ছেড়েছুড়ে আসতে হল গ্রামে; বাবা-মা, ভাইবোনের কাছে। মহামারী অদ্ভুত আতঙ্ক ছড়িয়ে দিলেও বাড়িতে কিছুটা নিশ্চিন্তবোধ করছিলাম৷ যদিও ঠিক কোনো কাজেই মন বসছিল না। একদিকে মহামারীকে ঘিরে নানা দুশ্চিন্তা আরেকদিকে পরীক্ষাও গলায় কাঁটার মত ঝুলে আছে। নতুন কোনো কাজ শুরু করব সে ভরসাও পাচ্ছিলাম না। কখন আবার পরীক্ষার ডাক এসে পড়ে। সবকিছুর পরও মহামারীর সবচে উজ্ব্বল স্মৃতি—পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘসময় থাকা। বৈশ্বিক একটা অজুহাতে দিনের পর দিন কর্মহীন কাটিয়ে দেয়া। কোনো ছুটি বা ঠুনকো অজুহাতেরও প্রয়োজন হয়নি। মহামারীর সবচেয়ে ভাল দিক বোধহয় এটাই। এর আগে একজন মাদরাসা শিক্ষার্থী হিসেবে আমার এমন দায়মুক্ত ছুটি কাটানোর সুযোগ হয়নি।
আগস্ট মাসে ঘোষণা হয়, পরীক্ষা শুরু হবে সেপ্টেম্বরের উনত্রিশ তারিখে। সেপ্টেম্বরের শুরুতেই মাদরাসায় উপস্থিত হতে হবে। আমার মাথায় তখন পরীক্ষার অদ্ভুত একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষার বোঝা মাথায় বয়ে বয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। যত দিন যাচ্ছে, অপেক্ষার ক্লান্তি ততই বাড়ছে। পরীক্ষার ঘোষণা হওয়াতে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মাদরাসায় পৌঁছার পর দেখি, আমাদের সমস্তকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। তাকমিলের রুম দখল করে ফেলেছে পরবর্তী প্রজন্ম। কোথাও আমাদের ঠাঁই নেই। যে মাদরাসায় আমরা দীর্ঘসময় ধরে পড়েছি, সেখানে আজ আমাদের সামান্যতম আশ্রয়ের জায়গা নেই। দিগ্বিদিক হতাশ হয়ে যখন ঘুরছি, তখন একটুখানি স্বস্তির সংবাদ পাওয়া গেছে। মসজিদ নির্মাণের জন্য যে আন্ডারগ্রাউন্ড বানানো হয়েছিল সেটাই আমাদের ক্ষণিকের আশ্রয়স্থল। পাকা দালানের সুড়ঙ্গের মধ্যে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। সবুজ পৃথিবীর স্বস্তিকর সামান্য আলো-বাতাসের সুবিধা আছে বটে; তবু এক বিচ্ছিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে গেলাম। সমতল থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে আমরা যখন সুড়ঙ্গে নামতাম, সত্যিকার অর্থেই মনে হত, পৃথিবী থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে যাচ্ছি এক অসীম শূন্য জগতে। বিচ্ছিন্ন জগতের এই ক্ষুদ্র সময় আমাদের জীবনে অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ; সুখ-আনন্দের অসংখ্য স্মৃতি যুক্ত হয়েছে নস্টালজিক জীবনের স্মৃতির বারান্দায়। আমাদের সহপাঠীদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার স্মৃতিগুলো মনের অলিন্দে শূন্যতার হাহাকার জাগিয়ে তোলে।
পাকা দালানের বিশাল আধুনিক সুড়ঙ্গের মধ্যে আমরা নিজেদের মত থাকতাম। পরিপূর্ণ স্বাধীন যাপন বলতে যা বোঝায়, ঠিক যেন তা-ই। কী আর পড়াশোনা, অধিকাংশই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসত। বৃষ্টির মওসুম তখনো শেষ হয়নি। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময় হলেও প্রায়ই আকাশ থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। মাটির নীচে পাকা দালানের সেই সুড়ঙ্গে বসে আমরা হঠাৎ অনুভব করি, পৃথিবীতে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, আশেপাশের কিছু ফোকর দিয়ে নেমে আসছে বিস্তৃত জলধারা। সিঁড়ির ঘরটুকো ছিল ছাদশূন্য। এক পশলা বৃষ্টিতেই হাঁটুসমান পানি জমে গেছে। সমতলে পানি জমলে পানিশূন্য করার নানা ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু এই মাটির সুড়ঙ্গ কিভাবে পানিমুক্ত করব এই নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। বালতির মধ্যে রশি ঝুলিয়ে পানি উঠানোর ব্যবস্থা করা হল। সমস্ত পানি উঠানো বেশ শ্রমসাধ্য কাজ। তবু সকলের পরিশ্রমে রাতে থাকার ব্যবস্থা পুনরায় সুসম্পন্ন করা গেল।
পরীক্ষার প্রথম দিন ভোরবেলা টের পেলাম, প্রবেশপত্র হারিয়ে ফেলেছি। রাতে কোথায় রেখেছি, কিছুই মনে পড়ছে না। ভয়ঙ্কর বিপদ; মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার শেষ বর্ষের পরীক্ষা, কোনোভাবে পরীক্ষার সুযোগ ছুটে গেলে আরো একবছর বসে থাকতে হবে। চিন্তা-দুশ্চিন্তায় আমার সমস্ত শরীর জমে বরফ হয়ে গেছে। কোনো সমাধানও মাথায় আসছে না। ফজরের পর থেকে প্রবেশপত্রের অনুসন্ধানে সময় কেটে গেল। একফোঁটাও পড়তে পারিনি। অথচ যা পড়ার কথা ছিল, সব তো এই সকালেই। ফজরের পরপরই পড়া শুরু করার সংকল্প ছিল। এর আগের রাতেই সম্ভাবনার জায়গাগুলো দাগিয়ে রেখেছি। এখন সেসব দেখে যেতে না পারলে আমার ক্ষীণ স্মৃতিশক্তির সাহায্যে কিছুই লিখতে পারব না। এক দিকে প্রবেশপত্রের কোনো সমাধান হচ্ছে না, আরেক দিকে নির্ধারিত পড়াও দেখার সুযোগ হল না—এমন দুধারী তলোয়ারের মুখে পড়ে আমার দোয়াদরুদ ছাড়া আর কোনো বিকল্প মাথায় এল না। একমনে দুআ করতে করতে দায়িত্বশীল হুজুরকে বিষয়টা জানালাম, তিনি একটা সমাধান বলে দেয়ার পর শান্তিমতই পরীক্ষা দিতে পেরেছি। সবগুলো পরীক্ষাই বিকল্প প্রবেশপত্র দিয়ে দিতে হয়েছে। পরীক্ষার অনেক পরে, যখন অতীতের সব স্মৃতি ভুলে গেছি তখন মারকাযুদ্দাওয়ার ছাত্র বন্ধু ইকরামের পবিত্র কিতাবের ভেতর পাওয়া গেছে আমার কাঙ্ক্ষিত প্রবেশপত্র।
আমাদের তাকমিলের বছর ইকরাম এসে ভর্তি হয়েছিল। ইকরাম ছিল মাদরাসাব্যবস্থার সফল তালেবুল ইলমদের একজন; যারা সুন্দর অতীত অতিক্রম করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। ইকরাম মুকিতের গজলের মুগ্ধশ্রোতা ছিল। মুকিতের প্রায়ই নাশিদ গুনগুনিয়ে গাইত। আমার কাছে আরবি নাশিদগুলো মুখস্ত রাখাই ছিল অত্যন্ত বিস্মরকর ঘটনা, সেখানে ইকরামের এমন স্বতস্ফূর্ত মেধাশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ইকরাম ছিল অত্যন্ত পড়ুয়া ধরনের তালিবুল ইলম। প্রায় সব বিষয়ে ওর পড়াশোনা ছিল। যে কোনো বিষয়ে তর্ক করার জন্য ওর কাছে পর্যাপ্ত তথ্য আর স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থাকত। সাধারণত কারো সঙ্গেই আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা জন্মায় না। ইকরামের সঙ্গে অল্পসময়েই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। পরীক্ষার আগের সময়টাতে আমি দিনরাত মুকিতের নাশিদ শুনতে শুরু করি। এই নাশিদগুলোর সঙ্গে শেষ সময়ের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যখনই বিরক্তি বা ক্লান্তি কাজ করত, আমি মুকিতের গজল শুনতাম। ইকরামও আমার সঙ্গে যুক্ত হত। ততদিনে ইকরাম মারকাযুদ্দাওয়ার নির্বাচিত তালেবুল ইলম। তার মুখ থেকে মারকাযের বিভিন্ন গল্প শোনা হত। আমাদের সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সে কি অসীম সাফল্য তার চোখেমুখে। ঈর্ষা হত এসব দেখলে। আমাদের কারোই পরীক্ষার পড়ার প্রতি আগ্রহ নেই। দিনরাত নানা ধরনের গল্প আর তর্কতেই সময় পার হয়ে যেত। মহামারীর ফলে আমাদের মধ্যে একধরেনের স্থবিরতা ও জড়তা কাজ করত। পরিশ্রম করতে গেলেই ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। আমরা জানতাম, কয়েকদিন পরই সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। কে কোথায় থাকব—তার কিছুই নিশ্চিত নয়। তবু কি এক প্রবল আবেগে আমরা পরস্পর কাছাকাছি হয়ে গল্প করতাম। পরীক্ষার এই প্রস্তুতির সময়টুকুতে, এই আধুনিক সুড়ঙ্গের পৃথিবীতে যেন এক টুকরো জান্নাত নেমে এলো; আমাদের কারো মধ্যে বিদ্বেষ-হিংসা বা রাগের ছিটেফোঁটাও থাকত না। সমস্ত সহপাঠীর হাসিমুখে চলার প্রচেষ্টা, রাগ-দুঃখ ভুলে একসঙ্গে থাকা সবই যেন আজ অলীক স্বপ্ন মনে হয়। মুকিতের গজল শুনতে গেলেই আমার সেসব আনন্দের স্মৃতি মনে পড়ে। আবার একইসঙ্গে বিদায় আর শূন্যতার যে বিপুল হাহাকার তাও বেজে ওঠে বুকের ভেতর। দিনশেষে পৃথিবীর জগতে মানুষের সম্পর্কের সূত্রে কেবল শূন্যতাই অনুভব করি। বিস্তৃত আকাশের মত হু হু শূন্যতার এক পৃথিবী আর মুকিতের ধীর-স্থির নাশীদই শেষপর্যন্ত দৈনন্দিন যাপনের একমাত্র আশ্রয় হয়ে ওঠে।
The post টুকরো স্মৃতির কোলাহল appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%9f%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%8b-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%b2/
No comments:
Post a Comment