Thursday, September 1, 2022

আলিয়া বন্ধ আগেই, আসামে এবার কওমি মাদরাসা বন্ধ করছে বিজেপি সরকার

রাকিবুল হাসান নাঈম:

উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যের সরকারি আলিয়া মাদরাসা বন্ধের পর এবার কওমি মাদরাসা বন্ধের তোড়জোড় শুরু করেছে বিজেপি সরকার। গত এক মাসেই তিনিটি মাদরাসা বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন। মাদরাসার ছাত্রদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি গ্রেফতার করা হচ্ছে ইমাম ও শিক্ষকদের। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, এখন অবধি ৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই মাদরাসার ইমাম ও শিক্ষক।

এর আগে ২০২০ সালে মাদরাসা শিক্ষা আইন পরিবর্তন করে রাজ্য সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত মাদরাসাগুলোকে সাধারণ স্কুলে পরিণত করে আসাম সরকার। সে সময় আসামের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। এরপর ২০২১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। এর এক বছর পরেই ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই আইনের বৈধতার স্বীকৃতি দেন গুয়াহাটি হাইকোর্ট। মুসলমান সমাজের একটা অংশ ও বিরোধীরা এই আইন এবং রায়ের বিরোধিতা করলেও তাতে কোনো লাভ হয়নি। ফলে আসামে সরকারি মাদরাসা স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ইতিহাস বলে, আসামে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা শুরু হয় ১৭৮০ সালে। রাজ্য মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে, ‘২০০৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, শিক্ষার উঁচু মানের কারণে অ-মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা বড় সংখ্যায় মাদরাসায় পড়তে আসছে।

গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে মাদরাসাগুলো

নানান অভিযোগে গ্রেফতার করা হচ্ছে আসামের কওমি মাদরাসার শিক্ষক ও মসজিদের ইমামদের। পাশাপাশি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে মাদরাসাগুলোও।

৩০ আগস্ট বুলডোজর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় বনগাঁও জোগিঘোপা থানার অন্তর্গত কাবাইটারী গ্রামে অবস্থিত মারকাজুল মাআরিফ মাদরাসা। এর আগে ২৬ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় মাদরাসার শিক্ষক মুফতি হাফিজুর রহমানকে। মাদরাসাটি ভাঙা হবে শুনে একদিন আগের রাত থেকেই স্থানীয়দের সহযোগিতায় মাদরাসা খালি করার কাজ শুরু করেন কর্তৃপক্ষ। মাদরাসাটি ভেঙ্গে ফেলার পেছনে যুক্তি হিসেবে বনগাঁও জেলার পুলিশ সুপার স্বপ্ননীল ডেকা বলেন, মারকাজুল মাআরিফ মাদরাসায় আগুন বা ভূমিকম্প মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা নেই যা দুর্যোগের সময় ব্যবহার করা যেতে পারে। কাঠামোগতভাবে দুর্বল এবং মানব বাসস্থানের জন্য অনিরাপদ হওয়ার কারণে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ মাদরাসায় শিক্ষার্থী ছিল ২২৪ জন।

৩০ আগস্ট, রাজ্য সরকার বারপেটা জেলার ঢাকালিপাড়া এলাকায় শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান মাদরাসা ভেঙে দেয়। মাদরাসা ভাঙার কারণ হিসেবে জেলা প্রশাসক লচিত কুমার দাসের বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি দেশবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত। আমরা তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে এসে সম্পত্তি যাচাই-বাছাই করে দেখি, মাদরাসাটি সরকারি জমিতে নির্মিত। তাই আমরা অবিলম্বে এটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এর আগে ৪ আগস্ট আসামের মরিগাঁও এলাকায় জামিউল হুদা মাদরাসাটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি গ্রেফতার করা হয় মাদরাসার মুহতামিম মুফতি মোস্তফাকে। মাদরাসা ভাঙার কারণ হিসেবে পুলিশ সুপার অপর্ণা জানান, মরিগাঁওয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন এবং ইউএপিএ আইনের অধীনে জামিউল হুদা মাদরাসা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই মাদরাসায় ৪৩ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়ন করত, বর্তমানে বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে তাদের।

গোয়েন্দাদের হাতে কওমি মাদরাসার তালিকা

চলতি মাসের মধ্যভাগে পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল ভাস্কর জ্যোতি মোহন্ত ও গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে থাকা হীরেন নাথ কওমি মাদরাসা বোর্ড অল আসাম তনজিম কওমি মাদরাসার সচিব মাওলানা আবদুল কাদিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে সব কওমি মাদরাসার তালিকা চাওয়া হয়। মোহন্ত বলেন, বৈঠকে তনজিম কওমির পক্ষ থেকে তাঁদের হাতে বেসরকারি মাদরাসার একটি তালিকা তুলে দেওয়া হয়।

এই প্রসঙ্গে জ্যোতি মোহন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘আমরা আসামের সব মাদরাসার একটি চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করার চেষ্টা করছি। এটি একটি কঠিন কাজ, কারণ এমন অনেক মাদরাসা আছে, যারা নথিভুক্ত নয়।’

ইমাম-শিক্ষক নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশন

কথিত জঙ্গিবাদী জুজুর কারণে ইমাম-শিক্ষক নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আসামে। বাইরের রাজ্য থেকে কোনো ইমাম বা মাদরাসার শিক্ষক আসামে এলে তাকে আগে পরীক্ষা করবে পুলিশ। তারপর তাকে নিয়োগ দেয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা জানিয়েছেন, বাইরের রাজ্য থেকে আসা কোনো ব্যক্তি আসামের মসজিদের ইমাম বা মাদরাসার শিক্ষক হতে চাইলে তাদের কাগজপত্র এবং অতীত কাজকর্ম খতিয়ে দেখবে পুলিশ। এরপর তাদের অনলাইন নথিভুক্তিকরণ হবে। এজন্য আসাম সরকার একটি পোর্টাল খুলবে, যেখানে অন্য রাজ্যের ইমাম বা শিক্ষকদের নাম–ঠিকানা নথিভুক্ত করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন কিছু মানসম্পন্ন নীতিমালা (স্ট্যাডার্ট অপারেটিং প্রসিডিউর-এসওপি) মেনে চলব। আসামের কোনো গ্রামের মসজিদে কোনো বহিরাগত যদি ইমাম হতে চান, তবে এলাকাবাসীকে তার দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করতে সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে হবে। পুলিশি যাচাই-বাছাই (পুলিশ ভেরিফিকেশন) শেষে তাকে ইমাম নিযুক্ত করা যাবে। ‘আসাম মুসলিম সোসাইটি’কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আমাদের সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।’

রাজ্যের কারও এই ভেরিফিকেশন লাগবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই নীতিমালা আসামের বাসিন্দাদের ওপর প্রযোজ্য হবে না। যারা আসামের বাসিন্দা তাদের এমন নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে না। তবে যারা রাজ্যের বাইরে থেকে এসেছেন তাদের অবশ্যই বিস্তারিত ব্যক্তিগত তথ্যরাজ্যের তথ্যপুঞ্জিতে যুক্ত করতে হবে।’

সুপ্রিমকোর্টে যাবেন আজমল

কওমি মাদরাসা বন্ধের এই তৎপরতা ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) মুসলমানদের টার্গেট করে করছে বলে মন্তব্য করেন এআইইউডিএফ সভাপতি মাওলানা বদরুদ্দিন আজমল। তিনি বলেন, ‘এই মাদরাসাগুলো দরিদ্রদের শিক্ষিত করে। এর মধ্যে বেশ কিছু মাদরাসা ২০-৩০ বছর ধরে অর্থ সংগ্রহের পর করা হয়েছে। আর তারা একদিনে বুলডোজার দিয়ে সব চূর্ণ করে দেয়। রাজ্যে লক্ষাধিক স্কুল রয়েছে। যদি সেখানের কোনও ব্যক্তি অপরাধী বলে প্রমাণিত হয়, তবে সেই গ্রেপ্তার হয়। মাদরাসার ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত, শুধু অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা উচিত।’

মাদরাসার বিরুদ্ধে এই ধংসযজ্ঞ বন্ধ না হলে তিনি সুপ্রিমকোর্টে যাবেন উল্লেখ করে বলেন, ‘রাজ্যের মাদরাসার বিরুদ্ধে আসাম সরকারের বুলডোজার অভিযান আমরা মেনে নিতে পারি না। এটা বন্ধ করা উচিত। প্রয়োজনে, আমরা এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট বা অন্য কোনও আদালতে যাবো।’

তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, হিন্দুস্তান টাইমস, স্ক্রল ইন, ফার্স্টপোস্ট, দ্য হিন্দু

The post আলিয়া বন্ধ আগেই, আসামে এবার কওমি মাদরাসা বন্ধ করছে বিজেপি সরকার appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a7-%e0%a6%86%e0%a6%97%e0%a7%87%e0%a6%87-%e0%a6%86%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%87-%e0%a6%8f%e0%a6%ac%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment