Sunday, September 18, 2022

‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নাকি অভিভাবক প্রতিষ্ঠান’ : হাইয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন অনেক

মুনশী নাঈম:

কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি মাস্টার্স ডিগ্রি সমমানের স্বীকৃতি দেওয়ার ছয় বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। সঙ্গে ছয় বছর পার করেছে কওমি মাদরাসা ভিত্তিক সকল শিক্ষাবোর্ডের সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত শিক্ষাবোর্ড আল-হাইআতুল উলইয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ। বর্তমানে কওমি মাদরাসার ৬ টি বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের সব ক’টি দাওরায়ে হাদীস কওমি মাদরাসা এই সম্মিলিত বোর্ডে নিবন্ধিত। মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, হাইয়াতুল উলয়া সকল কওমি মাদরাসার অভিভাককের জায়গায় থাকলেও অভিভাবকের তৎপরতায় তাদের তেমন দেখা যায় না। কেবল কেন্দ্রীয় পরীক্ষা এলেই তাদের তোড়াজোড় শুরু হয়। প্রশ্ন উঠছে, হাইয়াতুল উলয়া কেবল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নাকি অভিভাবক প্রতিষ্ঠানও?

হাইয়াতুল উলয়ার ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে তাদের সব কার্যক্রম পরীক্ষা কেন্দ্রীক। তাতে হাইয়াতুল উলয়ার কমিটির তালিকা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে কওমি মাদরাসার ৬ টি বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের সব ক’টি দাওরায়ে হাদীস কওমি মাদরাসা অত্র কমিটি দ্বারা নিবন্ধিত। দাওরায়ে হাদীস (তাকমীল) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের এ প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে সনদ দেয়া হয়।’ সরকারি গেজেটে এ কমিটিকে দাওরায়ে হাদিসের সনদের শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণ এবং দাওরায়ে হাদিস সনদ বিষয়ক যাবতীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ছয় বছর পার হলেও কমিটিকে সনদের শিক্ষার মান উন্নয়ন কিংবা সনদকে কার্যকর করতে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এ নিয়ে সনদ গ্রহণকারীদের মধ্যেও একটা চাপা ক্ষোভ রয়েছে।

দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সনদ কার্যকরের উদ্যোগ নেই

তাকমিল যেহেতু মাস্টার্স সমমান, তাই তাকমিলের সনদ দিয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমফিল এবং পিএইচডি করার সুযোগ থাকার কথা। কিন্তু তাকমিলের সনদ দিয়ে তা করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের উপপরিচালক মো. রুকনুজ্জামান এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। দাওরার সার্টিফিকেট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমফিল করা যাবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’

দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সার্টিফিকেটের কার্যকারিতা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই সম্মিলিত শিক্ষাবোর্ড আল-হাইআতুল উলইয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের। মাঝেমধ্যে বোর্ডে এটা নিয়ে আলাপ হয়, কিন্তু কার্যকরী কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যলয় এবং মন্ত্রণালয় বলছে, আলাপের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করতে হবে। হাইয়া কর্তৃপক্ষ তেমন আলাপ করেননি। বিষয়টি ফাতেহের কাছে স্বীকার করেছেন আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের স্থায়ী কমিটির সদস্য হযরত মাওলানা মুফতী নূরুল আমীন।

বিদেশে উচ্চশিক্ষায় নেই কোলাবরেশন

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ একেবারেই সীমিত। তবুও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যারাই বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন, তাদেরকেই পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। সার্টিফিকেটের ইকোসিস্টেম ব্যালেন্সড না থাকা, সার্টিফিকেটের সমমান পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত না করা এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে কোলাবরেশন না থাকার কারণেই এমনটি ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চলতি বছর মিশরে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছে ইবনে আলী। জামিয়া আজহারে সানুবিয়াতে ভর্তিও সম্পন্ন করেছে। ফাতেহকে তিনি বলেন, আল-আজহারে কওমি সার্টিফিকেট দিয়ে অনার্সে সরাসরি ভর্তি হওয়া যায় না। মুআদালা নেই বলে এই ঝামেলা। তাই কওমি ছাত্রদের যোগ্যতা যাচাইয়ের বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। অর্থাৎ, ইদাদি বা মাধ্যমিক লেভেল ও সানুবি বা ইন্টার লেভেলে স্তর যাচাইয়ের পরীক্ষা দিয়ে তারপর অনার্সে ভর্তি হওয়া যায়। অথচ আজহারের সঙ্গে যাদের মুআদালা আছে ইন্টার সমমানের, তারা সরাসরি অনার্সে ভর্তির সুযোগ পায়। কওমি মাদ্রাসার সানুবিয়ার সার্টিফিকেটকে ইন্টার সমমানের করলে এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।’

এ প্রসঙ্গে মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট ও মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা মহিউদ্দিন ফারুকী ফাতেহকে বলেন, সরকার কওমি সনদকে স্বীকৃতি দিয়েছে ঠিক, কিন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোলাবরেশনে আগ্রহী নয় হাইয়াতুল উলয়ার মুরুব্বীগণ। ফলে বাইরের দেশে কোথাও এই সার্টিফিকেট শো করেও লাভ হয় না। আমার তাজকিয়া নিয়ে অনেকে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মদীনাতে যাচ্ছে। তারা যাচ্ছে আলিমের সার্টিফিকেট দিয়ে। হাইয়া কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম, একটা কমিটি গঠন করে মদীনা ইউনিভার্সিটিতে আমাদের কাগজগুলো সাবমিট করি। আমি সহযোগিতা করব। কিন্তু তারা আগ্রহ দেখাননি।

২০১৯ সালের ১৭ মার্চ রাজধানীর ফরিদাবাদ মাদরাসায় অনুষ্ঠিত হাইয়াতুল উলয়ার তৎকালীন চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফীর সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। সেখানে কওমি মাদরাসা-শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষাগ্রহণের প্রক্রিয়া সুগম করার লক্ষ্যে ৬ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষ একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পর সাবকমিটির আর এ বিষয়ক বৈঠকই হয়নি।

মাদানী নেসাবের সঙ্গে সংলাপ নেই

তাকমিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য ফযিলত (মেশকাত) ও সানাবিয়াতে (শরহেবেকায়া) উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক করেছে হাইয়াতুল উলয়া এবং বেফাক। কয়েক বছর পর নাহবেমিরও বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা আছে বলে জানিয়েছেন বেফাকের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের। এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আলোচনায় উঠে এসেছে মাদানি নেসাবের প্রসঙ্গটি। কারণ বেফাকের পাঠ্যক্রম এবং মাদানি নেসাবের পাঠ্যক্রম আলাদা। তাকমিল পরীক্ষায় বসতে লাগতো না আগের কোনো কেন্দ্রীয় পরীক্ষার সার্টিফিকেট। ফলে মাদানি নেসাব সমাপ্ত করে এসেও তাকমিল পরীক্ষায় বসতে পারতো শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এখন বেফাক কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলো বাধ্যতামূলক করায় জটিলতা তৈরী হয়েছে।

এক্ষেত্রে মাদানি নেসাব মাদরাসাগুলো বেফাক হাইয়ার সঙ্গে সমন্বয়ে আগ্রহী হলেও হাইয়া কিংবা বেফাক কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে কখনও কোনো সংলাপে বসেনি। মাদানি নেসাবের মাদরাসাগুলো নিজেরাই শরহেবেকায়া জামাত খুলে বেফাকের সঙ্গে সমন্বয় করছে। তবে নাহবেমির বাধ্যতামূলক করলে সমন্বয়ের আর কোনো পন্থা থাকবে না। নাহবেমির বাধ্যতামূলক করা হলে মাদানি নেসাবের শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়েব। এ বিষয়ে বেফাক কর্তৃপক্ষের ভাবনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্তৃপক্ষ মাদানি নেসাব নিয়ে আলাদা কোনো চিন্তা করছে না। তবে আমরা চাইছি, তারা তাদের সিলেবাসে একটু অদলবদল করে বেফাক বা হইয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাক।’ তবে সিলেবাস, সমন্বয় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বোর্ডের সঙ্গে মাদানি নেবাসের কোনো আলোচনা হয়নি এবং এমন কোনো উদ্যোগও নেই বলে জানিয়েছেন বেফাকের মহাপরিচালক।

পড়ালেখা নিয়েও নেই উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা

কওমি মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে মূল কিতাবের বাইরে গাইড নির্ভরতা বেড়েছে। যেকোনো কওমি মাদরাসাতে গেলেই চোখে পড়ে গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি। বছর কয়েক ধরে বোর্ড পরীক্ষার জামাতগুলোর জন্য নতুন একধরনের বই এসেছে বাজারে। বোর্ডের বিগত বছরগুলোর পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত এসব বই ব্যাপকভাবে সংগ্রহ করছেন সংশ্লিষ্ট জামাতের পরীক্ষার্থীরা। বিভিন্ন মাদরাসায় বাংলা সহায়কগ্রন্থ অধ্যয়ন একসময় কড়াভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও সে নিষেধাজ্ঞার ওপর এখন শিথিলতা এসেছে। বোর্ডে ভালো রেজাল্টের জন্য দুর্বল ছাত্রের পাশাপাশি মেধাবী ছাত্ররাও এখন সংগ্রহ করছেন পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর সম্বলিত এসব গাইড বই।

তবে গাইড বই নিষেধ করে কোনো নির্দেশনা কখনও দেয়নি বেফাক কিংবা হইয়াতুল উলয়া। কেবল পরীক্ষার সময় বলে দেয়া হয়, গাইড থেকে প্রশ্ন আসবে না। পরীক্ষার প্রসঙ্গ বাদে এমনিতে মাদরাসাগুলোতে গাইড নিষিদ্ধ করে বেফাকের কোনো নির্দেশনা দেয়া আছে কিনা জানতে চাইলে মাওলানা যুবায়ের আহমাদ বলেন, এমন কোনো নির্দেশনা বোর্ডের পক্ষ থেকে নেই। তবে বিষয়টি আমরা ভেবে দেখব। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ যদি সতর্ক হন, তারা যদি তদারকি করেন, তাহলে বিষয়টি নিযন্ত্রণ করা সম্ভব। আমরা বিষয়টি আলোচনায় তুলব।’

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

The post ‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নাকি অভিভাবক প্রতিষ্ঠান’ : হাইয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন অনেক appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b7%e0%a6%be-%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%95-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%bf-%e0%a6%85/

No comments:

Post a Comment