মুনশী নাঈম:
মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে স্বভাবতই মসজিদ-মক্তবের সংখ্যা বেশি। এসব মসজিদের ইমামদের উচ্চতর দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি পাশাপাশি গণশিক্ষা, পরিবারকল্যাণ, কৃষি, মৎস্যচাষ, প্রাথমিক চিকিৎসা, বৃক্ষরোপণ, বনায়ন, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু পালন ও চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে তাদেরকে উপার্জনক্ষম এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার মতো উপযুক্ত করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে ‘ইমাম প্রশিক্ষণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এ পর্যন্ত এক লাখের কিছু বেশি ইমামকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দান করেছে সাতটি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশিক্ষিত ইমামের সংখ্যাটি পুরো বাংলাদেশের ইমামের তুলনায় খুবই কম। তারা একাডেমির স্বল্পতা ও সরকারি বাজেট স্বল্পতাকে এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির (২০০৯-১০ অর্থবছরে) চালানো এক জরিপে দেখা যায়, সারা দেশে জামে মসজিদের সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজার ৩৯৯টি। ২০১৭ সালে এসে জামে মসজিদের এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৩ লাখ। আর এসব মসজিদে একজন ইমামের পাশাপাশি কোনো কোনো মসজিদে একাধিক ইমামও (সানি ইমাম) রয়েছেন। মসজিদগুলোতে রয়েছেন একজন করে মুয়াজ্জিন। ফলে সারা দেশে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতিব আর খাদেমের সংখ্যা প্রায় দশ লাখের কাছাকাছি হবে বলে ধারণা দিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এই জরিপ মতে, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি ৪৫ বছরে দশভাগের মাত্র একভাগ ইমামকে প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছে।
কী কী প্রশিক্ষণ দিচ্ছে একাডেমি
ইমামদেরকে বেশ কয়েকটি কোর্স করাচ্ছে ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি। প্রশিক্ষণগুলো করানো হয় সরকারি খরচে। নিচে কোর্সগুলোর পরিচিতি তুলে ধরা হলো।
১. নিয়মিত ইমাম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স: কোর্সটি ৪৫ দিনের। প্রতিবছর ৫টি ব্যাচ পড়ানো হয়। প্রতি ব্যাচে থাকেন ১০০ ইমাম। সাতটি একাডেমিতে বছরে মোট ৩৫০০ ইমাম প্রশিক্ষণ নেন। এই কোর্সে পড়ানো হয় ইসলামিয়াত, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, কৃষি ও বনায়ন, প্রাণী সম্পদ পালন ও মৎস্য চাষ, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি, পরিবেশ ও সামজিক উন্নয়ন, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচিতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ও পরিচিতি। এছাড়া, উক্ত বিষয়াদির মধ্যে রয়েছে, আদর্শ পরিবার গঠন, প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, নারী অধিকার, নারী-পুরম্নষের সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ, নারী ও শিশু পাচাররোধ, এইচআইভি এইডস প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, জঙ্গি ও সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ এবং দেশের দুর্নীতি বিরোধী সামাজিক আন্দোলন, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, মদ-জুয়া ইত্যাদি। ওয়েবসাইটের তথ্যনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৮৪,৪৮৫ ইমাম বুনিয়েদি কোর্স করেছেন।
২. রিফ্রেসার্স প্রশিক্ষণ কোর্স: কোর্সটি ৫ দিনের। মূলত ৪৫ দিনব্যাপি নিয়মিত ইমাম প্রশিক্ষণ প্রদান করার পর পুনরায় ফলোআপ কর্মসূচীর আওতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামগণ প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কি ধরনের ভূমিকা রাখছে তার মূল্যায়নকরণ ও আরো দক্ষতা বৃদ্ধিকল্পে পরামর্শ প্রদানের জন্য এ কোর্স করানো হয়। এ যাবৎ ২৭,৭৯৪ জন ইমামকে এই প্রশিক্ষণপ্রদান করা হয়েছে।
৩. মানব সম্পদ উন্নয়নে ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্তকরণ: কোর্সটি ৪ দিনের। এখানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং ইমামদেরকে দেশের উন্নয়নে আর্থিক ও সামাজিক এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে যেমন-প্রজনন-স্বাস্থ্য, জেন্ডার ইস্যু, পরিবার কল্যাণ, নিরাপদ মাতৃত্ব, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যা, এইচআইভি এইডস ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শি করে গড়ে তোলার লক্ষে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ৩১,৩৪৮ জনকে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
৪. মক্তব শিক্ষক প্রশিক্ষণ: কোর্সটি ৩০ দিনের। শিশুদের মন মানসিকতার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের মনে যেন কুরআন শিক্ষার প্রতি কোনরূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়, তার প্রতি লক্ষ্য রেখে মক্তব পরিচালনা করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামগণকে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। অদ্যাবধি ১,৫৯৮ জন মক্তব শিক্ষককে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
৫. মুবাল্লিগ প্রশিক্ষণ: কোর্সটি ৩০ দিনের। এখানে মসজিদের ইমামদেরকে শেখানো হয় জনগণকে কিভাবে ইসলামের প্রচার-প্রসারের দাওয়াত দিতে হবে। বলা হয়, দেশে কিভাবে শান্তি-নিরাপত্তা বজায় থাকবে, জুমার খুতবা কিভাবে দিবে। এ যাবৎ ১,৫৯৪ জনকে মুবাল্লিগ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
৬. এলওআই বিষয়ক প্রশিক্ষণ: কোর্সটি ৩ দিনের। সুশাসন ও গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার, মানব পাচার প্রতিরোধ, সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, ইসলামের আলোকে নারী ও শিশু অধিকার, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা, দূর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, পরিবেশ সংরক্ষণ, শিক্ষা জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে ইমামদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এখানে। বর্তমান পর্যন্ত ১৫,৭০৩ জন ইমামকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
৭. জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনকরণ প্রশিক্ষণ: কোর্সটি ৩ দিনের। এখানে শেখানো হয় জন্ম নিবন্ধন কিভাবে করতে হবে, কোথা থেকে করতে হবে, এটা না করলে কি সমস্যা হতে পারে, যেমন-বিয়ের বয়স নির্ধারণ, কম বয়সে বাচ্চা হলে কি ধরনের সমস্যা হতে পারে ইত্যাদি এবং মানুষ মারা গেলে তার মৃত্যর সনদ কিভাবে কোথা থেকে নিতে হবে, না নিলে ভবিষ্যতে কি সমস্যা হতে পারে, যেমন-চাকুরীর আর্থিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া, জমি-জমির দলিল ও সম্পদ বন্টন করতে সমস্যা ইত্যাদি। এ পর্যন্ত ১৫০ জন ইমামকে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
৮. মাতৃ ও শিশু বিষয়ক প্রশিক্ষণ: কোর্সটি-৩ দিনের। এখানে নিরাপদ মাতৃত্ব, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, যৌতুক ও বাল্য বিবাহ পতিরোধ, প্রজনন স্বাস্থ্য, যৌতুক ও পরিবার কল্যান, এইচ আইভ/এইডস প্রতিরোধে করণীয়, পরিবার পরিকল্পনা, শিশু ও নারী পাচার, শিশু অধিকার, শিশুর নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে ইমামদেরকে ভূমিকা রাখার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ পর্যন্ত ৪৫০ জন ইমামকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
৯. নিরাপদ অভিবাসন প্রশিক্ষণ: কোর্সটি-৩ দিনের। এখানে বিদেশে ভ্রমণ, বিদেশে অবস্থা, চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থায়ী বসবাস, অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি সামাজিক লাভ-ক্ষতি, পারিবারিক লাভ-ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে সচেনতা ও জ্ঞানার্জন করার জন্য মূলতঃ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদেরকে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। মোট ১,০০০ জন ইমামকে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
‘একাডেমি ও সরকারি বাজেট স্বল্পতা’কে দুষছেন কর্মকর্তারা
এখানে অনেকগুলো কোর্স রয়েছে, যেগুলোতে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রথম বুনিয়াদি কোর্স করা আবশ্যক। ফলে বিভিন্ন কোর্সে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেশি হলেও মূলত কোর্স করেছেন এক লাখেরও বেশি কিছু ইমাম। দেশের মোট ইমামের তুলনায় সংখ্যাটি অনেক কম বলে স্বীকার করেছেন, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমীর সহকারী পরিচালক মোঃ মহিউদ্দিন। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘আমরা যাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি, তাদের সংখ্যা খুবই কম। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে চাইলেও সবকিছু সম্ভব হচ্ছে না।’
তবে প্রশিক্ষণের রেঞ্জ এত কম হবার পেছনে দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমীর উপ-পরিচালক মোঃ আনিসুজ্জামান। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘দেশে সাত বিভাগে আমাদের একাডেমি রয়েছে ৭টি। জেলা শহরগুলোতে একাডেমি নেই। ফলে বড় রেঞ্জে চাইলেও প্রশিক্ষণ দেয়া যায় না। জেলা শহরগুলোতে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হলে প্রশিক্ষণের রেঞ্জ আরও বাড়াতে পারব।’
বাজেট স্বল্পতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে আমাদের সীমাবদ্ধতার বড় একটি কারণ বাজেটের সীমাবদ্ধতা। বছরে ৫ টি ব্যাচ করি, প্রতি ব্যাচে ১০০ জন ইমাম থাকেন। সাত বিভাগে মোট ৩৫০০ ইমাম অংশগ্রহণ করেন। কোনো বিভাগে ৬টি ব্যাচও করা হয়। ব্যাচগুলো করানো হয় সরকারি খরচে। ফলে এর বেশি সামর্থ্য আমাদের নেই। বাজেটে এতটুকুই কুলায়।’
গোপালগঞ্জে নতুন একটি একাডেমি খোলা হচ্ছে বলেও জানান এই উপ পরিচালক। কাজ সব শেষ। এখন প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে।
The post ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি: বাড়ছে না প্রশিক্ষণের পরিধি appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%87%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%ae-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%b6%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b7%e0%a6%a3-%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%a1%e0%a7%87%e0%a6%ae%e0%a6%bf-%e0%a6%ac/
No comments:
Post a Comment