Thursday, September 22, 2022

পর্দা করায় ভাইবাতে শূন্য: ঢাবি ক্যাম্পাসে নারী সুরক্ষার অভাব

রাকিবুল হাসান নাঈম:

পর্দা করায় ভাইভা বোর্ডে মুখ না খোলার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগের এক ছাত্রীকে ভাইভাতে অনুপস্থিত দেখানোর অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, গত ১৪ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় সেমিস্টারের ভাইভা দিতে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এক নারী শিক্ষার্থী। ভাইভা বোর্ডের সদস্যরা চেহারা দেখতে চাইলে পর্দা (নিকাব) করার কারণে ওই শিক্ষার্থী তাতে অসম্মতি জানায়। ফলে ওই শিক্ষার্থীকে ভাইভাতে অনুপস্থিত দেখায় ভাইভা বোর্ড। এবং একই কারণে আগের সেমিস্টারের ভাইভাতেও উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত হয় ওই শিক্ষার্থী।

দেশের আলেম এবং সচেতন মহল বলছেন, বিষয়টি অমানবিক এবং অপ্রত্যাশিত। ঢাবির মতো এমন একটি উদার বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনা মূলত ইসলামোফোবিয়াকেই উৎসাহিত করছে।

ভুক্তোভুগী কী বলছেন?

লিখিত বক্তব্যে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী বলেন, আমি নিকাব করে ভাইভা পরীক্ষা দিতে গেলে শিক্ষকরা আমাকে নিকাব খোলা সাপেক্ষে উপস্থিতি স্বাক্ষর করতে বলেন। আমি বারবার তাদেরকে অনুরোধ করি যে, নন মাহরাম কারো সামনে আমি নিকাব খুলি না। আমি একাধিক ম্যাডামের সামনে আমার মুখ খুলে আমার পরিচয়ের সত্যতা নিশ্চিত করতে চাচ্ছি। কিন্তু শিক্ষকগণের বক্তব্য তারা আমার নিকাব খুলে চেহারা প্রদর্শন না করলে ভাইভা পরীক্ষা নিবেন না এবং উপস্থিতি স্বাক্ষর করতেও দিবেন না। আমি আবারো তাদের অনুরোধ জানাই যেন, একাধিক ম্যামের সামনে আমার চেহারা শনাক্ত করে নিকাব পরিহিত অবস্থায় আমার ভাইভা নেয়া হয়। কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং আমাকে গত ফার্স্ট সেমিস্টারসহ দুই সেমিস্টারের ভাইভাতে অনুপস্থিত করে দেন। আমি তাদের কাছে বার বার অনুরোধ করলেও তারা সাফ জানিয়ে দেয় যে আমার ভাইভা তারা আমার মুখ দেখা ছাড়া গ্রহণ করবে না।

ওই শিক্ষার্থী আরো বলেন, আমার পর্দা করা কি অন্যায়? আমি শুধু পর্দা করার কারণে ভাইভাতে উপস্থিত থেকেও কোন মার্ক পাচ্ছি না। যার ফলে এটি আমার রেজাল্টে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমি এর সুষ্ঠু সমাধান চাই।

কী বলছেন ভাইবা বোর্ডের সদস্যরা

দু’জন প্রফেসর ও দু’জন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের সমন্বয়ে গঠিত ওই ভাইভা বোর্ডের প্রধান ছিলেন বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন শামীম। অন্যান্য সদস্যরা হলেন প্রফেসর ড.ভীস্মদেব চৌধুরী, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সোহানা মেহবুব, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড.তারিক মনজুর।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ওই নারী শিক্ষার্থী মিথ্যা বলছেন বলে মন্তব্য করেছেন ভাইবা বোর্ডের সদস্য অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সোহানা মেহবুবা। তাকে ফোন করা হলে তিনি ফাতেহকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুয়ায়ী চেহারা ও কান দেখে পরীক্ষার্থীকে শনাক্ত করেই পরীক্ষায় বসতে দেয়া হয়। ঠিক অনুরূপভাবে ভাইভাতেও একই কাজ করা হয়। আমরা শনাক্ত করতে চেয়েছিলাম প্রবেশপত্রের সঙ্গে মিলে কিনা। সে নেকাব খুলতে চায়নি। সে বলেছে, নেকাব খোলা অসম্ভব। আমরা তাকে সময় দিয়ে বলেছি, নিজেকে বুঝিয়ে কিছুক্ষণ পর এসো। সে কিছুক্ষণ পর আবার ভাইবাতে আসে। কিন্তু এবারও নেকাব খোলা সম্ভব না বলে জানায়। আমরা তাকে আবার পরদিন ভাইবাতে আসার সুযোগ দেই। কিন্তু পরদিন আমরা বিকেল পর্যন্ত তার জন্য অপেক্ষা করলেও সে আসেনি।’

সোহানা মেহবুবা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘উক্ত শিক্ষার্থী একবারও বলেনি, সে ম্যামদের চেহারা দেখাতে চায়। শিক্ষার্থী নির্ঘাত মিথ্যা বলছে।’

বিষয়টি অপ্রত্যাশিত এবং অমানবিক

ঘটনাটি অপ্রত্যাশিত বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শফিক আহমেদ। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রেসকোড সুনির্দিষ্ট নেই। এতটুকু বলা আছে, পরিচয় সুনিশ্চিত করতে হবে। এখন ভাইবা বোর্ডে যদি নারী নাও থাকতো, তাহলেও বাইরে থেকে কোনো ম্যাম এনে তাকে দিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করা যেতো। তারা বিষয়টি আরেকটু সহজ করলেই পারতো। এত জটিলতা তৈরী হতো না।’

ঘটনাটি অমানবিক বলে মন্তব্য করেছেন আলেম গবেষক ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ সাহেব। তিনি ফাতেহকে জানান, ‘ভাইবা বোর্ডে নারী সদস্য থাকা সত্ত্বেও এই ধরণের অজুহাত দেয়া মানা যায় না। তারা চাইলে, নারীকে দিয়ে ছাত্রীর পরিচয় নিশ্চিত করতে পারতো। অমুসলিম দেশে ইসলামোফোবিয়ার কারণে হিজাব এবং নিকাব দেখতে পারে না মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা শিক্ষাঙ্গনে এতটা সংকীর্ণতা লজ্জাজনক।’

ঢাবিতে হিজাব বিষয়ক জরিপ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) প্রতি তিনজন নারী শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন পর্দা করার কারণে বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হন এবং তিনজনের মধ্যে একজনেরও বেশি শিক্ষার্থী বিরূপ মন্তব্যের শিকার হন বলে একটি জরিপে উঠে এসেছে। চলতি বছরের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন বিভাগের মেয়ে শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে আসে। এ জরিপ পরিচালনায় ছিলেন প্রটেস্ট সেল এগেইনস্ট হিজাবফোবিয়া ইন ডিউ নামক একটি সংগঠন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ( টিএসসি) অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির ব্যানারে সাংবাদিকদের সামনে এসব তথ্য তুলে ধরেন সংগঠনটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার, অ্যাকাউন্ট এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের তাসফিহা তাহসিন ইমা, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী নাসিফা সিদ্দিকা ও নিশাত তামান্না।

জরিপ বিষয়ে তাহসিন ইমা বলেন, ‘আমরা দুই মাস ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হিজাবোফোবিয়া (হিজাবভীতি) নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছি। এ প্রক্রিয়ায় আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যা জানতে পেরেছি তা থেকে বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব-নিকাব পরার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিকাব পরা অধিকাংশ ছাত্রী কখনো না কখনো অপমান, উত্ত্যক্ত, হেনস্তা বা বুলিংয়ের শিকার হন। সহপাঠী, সিনিয়র-জুনিয়র, কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের কেউ কেউ হিজাব ও নিকাব পরা ছাত্রীর প্রতি বিরূপ আচরণ করেন।

জরিপে একটি প্রশ্ন ছিল, হিজাব-নিকাবের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বা হলে আপনি কোনো বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছেন কি না। জরিপে অংশ নেওয়া ২২১ জন ছাত্রীর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৭৩ জন, ‘না’ বলেছেন ১৪৮ জন। আরেকটি প্রশ্ন ছিল, হিজাব-নিকাবের কারণে কোনো শিক্ষক, কর্মচারী বা সহপাঠীর বিরূপ মন্তব্যের শিকার হয়েছেন কি না। এর উত্তরে ‘না’ বলেছেন ১৪১ জন ও ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৮০ জন।

The post পর্দা করায় ভাইবাতে শূন্য: ঢাবি ক্যাম্পাসে নারী সুরক্ষার অভাব appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a6%be-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%b6%e0%a7%82%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%af/

No comments:

Post a Comment