Thursday, September 22, 2022

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব-বিদ্বেষ: শিক্ষকরা বলছেন ‘আশঙ্কাজনক’

মুনশী নাঈম:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) প্রতি তিনজন নারী শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন পর্দা করার কারণে বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হন এবং তিনজনের মধ্যে একজনেরও বেশি শিক্ষার্থী বিরূপ মন্তব্যের শিকার হন বলে একটি জরিপে উঠে এসেছে। চলতি বছরের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন বিভাগের মেয়ে শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে আসে। এ জরিপ পরিচালনায় ছিলেন প্রটেস্ট সেল এগেইনস্ট হিজাবফোবিয়া ইন ডিউ নামক একটি সংগঠন।

জরিপে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা দুই মাস ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হিজাবোফোবিয়া (হিজাবভীতি) নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছি। এ প্রক্রিয়ায় আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যা জানতে পেরেছি তা থেকে বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব-নিকাব পরার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিকাব পরা অধিকাংশ ছাত্রী কখনো না কখনো অপমান, উত্ত্যক্ত, হেনস্তা বা বুলিংয়ের শিকার হন। সহপাঠী, সিনিয়র-জুনিয়র, কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের কেউ কেউ হিজাব ও নিকাব পরা ছাত্রীর প্রতি বিরূপ আচরণ করেন।

জরিপে একটি প্রশ্ন ছিল, হিজাব-নিকাবের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বা হলে আপনি কোনো বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছেন কি না। জরিপে অংশ নেওয়া ২২১ জন ছাত্রীর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৭৩ জন, ‘না’ বলেছেন ১৪৮ জন। আরেকটি প্রশ্ন ছিল, হিজাব-নিকাবের কারণে কোনো শিক্ষক, কর্মচারী বা সহপাঠীর বিরূপ মন্তব্যের শিকার হয়েছেন কি না। এর উত্তরে ‘না’ বলেছেন ১৪১ জন ও ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৮০ জন।

ঢাবিতে হিজাব-নিকাবের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়

ঢাবিতে হিজাব-নিকাবের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় সেমিস্টারে পর্দা করায় ভাইভা বোর্ডে মুখ না খোলার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগের এক ছাত্রীকে ভাইভাতে অনুপস্থিত দেখানো হয়। ভাইভা বোর্ডের সদস্যরা চেহারা দেখতে চাইলে পর্দা (নিকাব) করার কারণে ওই শিক্ষার্থী তাতে অসম্মতি জানায়। ফলে ওই শিক্ষার্থীকে ভাইভাতে অনুপস্থিত দেখায় ভাইভা বোর্ড। এবং একই কারণে আগের সেমিস্টারের ভাইভাতেও উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত হয় ওই শিক্ষার্থী।

এর আগে ২০১৬ সালে হিজাব পরে ক্লাসে আসার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. আজিজুর রহমান। তিনি বলেছিলেন, হিজাব খুলে ক্লাসে আসলে হাজিরা দেয়া হবে, নতুবা হাজিরা দেয়া হবে না। এ ঘোষণার পর বেশ কয়েকটি ক্লাসে ছাত্রীটির ক্লাসে উপস্থিতি দেননি ওই শিক্ষক। এ ঘটনায় কয়েকজন ছাত্রী প্রতিবাদ করলে তাদেরও ক্লাস থেকে বের করে দেন ওই শিক্ষক। ২০১৫ সালেও আজিজুর রহমান বোরকা পরে আসার কারণে নাবিলা ইকবাল নামে তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে ক্লাস থেকে বের করে দেন।

‘বিষয়টি ‍আশংকাজনক এবং নৈতিকাতবিরোধী’

জরিপ প্রসঙ্গে আকর্ষণ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী ফাতেহকে বলেন, তিনি এই জরিপ সম্পর্কে জানেন না। এই জরিপ তিনি পড়েননি।’ জরিপ না পড়লেও এই অধ্যাপক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ড্রেসকোড নেই। বোরকা পরে যেমন আসতে পারে, অন্যান্য পোশাক পরেও আসতে পারে। তাতে বাধা দেয়ার অধিকার করও নেই। যারা এসব নিয়ে কথা বলে, তারা নৈতিকাতবিরোধী কাজ করে। এর বেশিকিছু বলব না।’

ক্যাম্পাসে পর্দা করতে বাধা দেয়ার বিষয়টিকে আশংকাজনক বলে মন্তব্য করেছেন ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপিক কাজি ফারজানা আফরিন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘যে শিক্ষক ক্লাসে পর্দা সহ্য করতে পারে না, কিংবা পর্দা নিয়ে কটাক্ষ করে, তারা মূলত রুটলেস-শেকড়হীন। তারা নীতি-নৈতিকতা ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। তাদের কথা কানে নেয়া যাবে না।’ পর্দা প্রসঙ্গে এই শিক্ষিকা বলেন, ‘ছাত্রীরা ক্যাম্পাসে থাকুক কিংবা ক্লাসে থাকুক, তাকে পর্দা করতেই হবে। এটাতে ছাড় নেই।’

হিজাবোফোবিয়া বন্ধ চায় শিক্ষার্থীরা

শিক্ষার্থীরা বলছেন, হিজাব ও নিকাব নিয়ে যেন কোনো বিদ্বেষমূলক আচরণ, বাজে মন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সহ্য না করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্রীকে হিজাব খুলতে যেন কোনো শিক্ষক বাধ্য না করে। এর পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন এমন ব্যবস্থা নেয় যাতে একজন ছাত্রীকে তার চেহারা দেখানো ছাড়াও বৈজ্ঞানিকভাবে সনাক্ত করা যায়। সেটি সম্ভব না হলে অন্তত একজন ম্যাডাম দ্বারা সেই ছাত্রীকে সনাক্ত করা হয়। তাও যেন কোনোমতেই একজন ছাত্রীকে গাইরে মাহরাম শিক্ষকের সামনে চেহারা খুলতে বাধ্য না করা হয়। তার ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ন না করা হয়। ক্লাসে যেন হিজাব নিকাবের কারণে কোনো ছাত্রীকে বের করে দেওয়া, বাজে কথা বলা না হয়। পর্দার কারণে যেন কোনো বৈষম্য দেখানো না হয়। একই দাবি হলের ক্ষেত্রেও।

হিজাবোফোবিয়া বন্ধের দাবি জানিয়ে এন্ট্রোপলজি বিভাগের শামসুন্নাহার বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হিজাব ও নিকাব পরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং যে বা যারা হিজাব ও নিকাব পরার কারণে কাউকে অপমান করবে, বিদ্রুপ-তাচ্ছিল্য করবে, বৈষম্যমূলক আচরণ করবে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি প্রদর্শন করবে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। এটাই আমাদের প্রাণের দাবি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আশফিকা তারান্নুম বলেন, হিজাব পড়াকে যখনি আমি আফগানি ও তালেবানি পোশাকের সাথে তুলনা করব তখন এটা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। আমরা যে অসাম্প্রদায়িকতার নামে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছি সবার মনে এটাই সবচেয়ে বড় সহিংসতা। আমার দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি যখন থাকবে তখন আমি বোরকা পরব, আমার বান্ধবী সিঁদুর-শাখা পরবে, কেউ সেলাওয়ার-কামিজ পরবে।

The post ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব-বিদ্বেষ: শিক্ষকরা বলছেন ‘আশঙ্কাজনক’ appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%a2%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%be-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%9f%e0%a7%87-%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%9c%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment