Sunday, September 25, 2022

হেফজখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি কাটছে না : কী করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো?

রাকিবুল হাসান নাঈম:

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসায় দুই ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগ তুলে দুই শিক্ষককে নির্যাতন করেছে কয়েকজন অভিভাবক এবং দুবৃত্তরা। যাদের বিরুদ্ধে বলাৎকারের অভিযোগ, তারা হলেন ওই মাদরাসার শিক্ষক আবু বকর ও আল আমীন। অভিভাবকদের দাবির প্রেক্ষিতে তৎক্ষণাৎ দুই শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়। তবে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, দুই শিক্ষককে যারা নির্যাতন করেছে, তাদের মধ্যে অভিভাবক ছাড়াও বাইরের লোক ছিল। ঘটনা তদন্ত ছাড়াই তারা এসে চড়াও হয়। তাদের সঙ্গে মিডিয়ার লোকও এসেছিল।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের হেফজখানাগুলো সম্পর্কে বারবার এ ধরনের অভিযোগ উঠলেও কর্তৃপক্ষ সতর্ক হচ্ছে না কেন? কী করছে মাদরাসা-নিয়ন্ত্রক-সংস্থা বেফাক এবং হাইয়াতুল উলয়া? অভিভাবকগণ বলছেন, হেফজখানার নিরাপদ কোনো মডেল দাঁড় করানো এখন সময়ের দাবি। নয়তো তারা তাদের সন্তানদের নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি নতুন নিরাপদ কোনো মডেল আদৌ দাঁড় করাতে পারছে?

তাহফিজ কর্তৃপক্ষ কী বলছেন?

তাহফিজ কর্তৃপক্ষ বলছেন, যে দুজন ছাত্র শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে, তারা কারা সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অভিভাবকরা যখন এসে আমাদেরকে জানায়, তাদের দাবির প্রেক্ষিতে শিক্ষক দুজনকে বহিষ্কার করা হয়।

মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসার পরিচালক নেসার আহমদ আন নাছিরীকে ফোন দিলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাই কথা হয় তার একান্ত কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ হাসানের সঙ্গে। নাসিরির পর মাদরাসায় বিষয়-আশয় তিনিই দেখে থাকেন। প্রতিবেদককে তিনি জানান, অভিভাবকরা আসেন আসরের পর, মাগরিবের আগে। পরিচালক তখন মাদরাসায় ছিলেন। তিনি শিক্ষক দুজনকে বহিষ্কার করেন অভিভাবকদের সামনে। বিষয়টি নিয়ে আর কথা না বলার অনুরোধও জানান তিনি। পরে তিনি মাগরিব নামাজ পড়তে চলে যান। ঠিক এসময় আরও আট-দশজন লোক মাদরাসায় ঢুকে। তাদের সঙ্গে ঢুকে সাংবাদিকও। লোকগুলো এসে শিক্ষককে মারধর করেন। সাংবাদিকরা ছবি তুলেন। আগ্রাসীভাবে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করেন।’

সাংবাদিকরা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য নেননি বলেও জানান আব্দুল্লাহ হাসান। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘একাত্তর টিভির প্রতিবেদন দেখলে বুঝবেন, শিক্ষক কিন্তু অভিযোগ স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, ছাত্ররা তাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। ধরলাম, শিক্ষক আসলেই অপরাধ করেছে, তাহলে তো আইন ছিল, আদালত ছিল, ইনভেস্টিগেশন ছিল। কোনো তদন্ত ছাড়াই অভিযোগ তুলে দেয়াও একটা ক্রাইম।’

আব্দুল্লাহ হাসান আরও জানান, স্থানীয় কমিশনার সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও উত্তেজিত লোকদের বুঝানোর চেষ্টা করছিলেন, বিষয়টি প্রশাসন দেখবে। এটা নিয়ে যেন বড় কোনো ইস্যু তৈরী করা না হয়। কিন্তু কেউ শোনেনি।

এই ঘটনার পর ৪০০ ছাত্রকে এসে অভিভাবকরা এসে নিয়ে গেছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তাও অস্বীকার করেন আব্দুল্লাহ হাসান। তিনি বলেন, কিছু অভিভাবক শঙ্কিত হয়ে তাদের ছাত্র নিয়ে গেছে। হাতেগোণা কয়েকজন।

কী করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো?

এখন প্রায়শই এ ধরনের অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন হেফজখানার উপর। মাদরাসাগুলো যেহেতু বেফাক এবং হাইয়াতুল উলয়ার অধীন, সেখানে কী হচ্ছে, মাদ্রাসার শিক্ষা পদ্ধতি, কর্মপদ্ধতি বা অন্য কোনো সংকট আছে কি না, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে সেগুলো নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব সংস্থাগুলোর। বিভিন্ন সময় এসব ঘটনায় তোলপাড় হলেও তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি সংস্থাগুলোকে।

বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মাওলানা যুবায়ের আহমাদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ফাতেহকে জানান, এ বিষয়ে বেফাকের কোনো উদ্যোগ নেই। মুরুব্বিদেরও উল্লেখযোগ্য কোনো প্রস্তাবনা নেই। তবে তার ব্যক্তিগত মতামত হলো, হেফজখানায় যারা শিক্ষক হন, তারা অধিকাংশই কেবল হাফেজ। হিফজবিষয়ক জ্ঞান ছাড়া তাদের আর কোনো জ্ঞান থাকে না। তাদের মধ্যে শিক্ষা স্বল্প বলে ম্যানার, তাকওয়া-তাহারাতও কম থাকে। ফলে এ ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা বেশি ঘটে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিগত সময়ে এসব অপরাধের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে উঠেছে, তাদের অনেকেই ছিলেন হেফজ শেষ করে মাওলানা পাশও। বেফাকের এই দায়িত্বশীল আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি। ব্যস্ত আছেন বলে ফোন রেখে দেন।

এসব অভিযোগ অনেকাংশে সত্য হলেও কোনো কোনো ঘটনা ষড়যন্ত্র করে ঘটানো হয় বলে মন্তব্য করেন জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়ার প্রিন্সিপাল ও কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাক ও হাইয়াতুল উলয়ার মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক। তিনি ফাতেহকে বলেন, অনেক জায়গায় অভিযোগ প্রমাণিত হবার আগেই অভিযুক্ত শিক্ষককে মারধর করেন অভিভাবকরা। তাদের চাপে কিংবা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে শিক্ষককে তৎক্ষণাৎ বহিষ্কারও করা হয়। পরে দেখা যায়, শিক্ষক নির্দোষ।

এই ঘটনা রোধপ্রকল্পে তাকওয়া-তাহারাতের বোধ শাণিত করার কোনে বিকল্প নেই বলে জানান হাইয়াতুল উলয়ার মহাসচিব। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পনামাফিক তাদের ছাত্রদের আবাসন ব্যবস্থাপনা সাজাতে হবে। কিভাবে ব্যবস্থাপনা করলে অপরাধের সুযোগ কমবে, সেভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। অনেকে মাদরাসাগুলো সম্পূর্ণ অনাবাসিক করে দেয়ার পরামর্শ দেন। আমি বলি, বর্তমানের আবাসিক সিস্টেমে পড়াশোনা করে ছাত্ররা যতটা উপকৃত হচ্ছে, অনাবাসিক করে দিলে তারা সেই উপকারটা পাবে না। এই উন্নতিটা বজায় থাকবে না। তাই পরিকল্পনা নিতে হবে, আবাসিক ব্যবস্থাপনাটাকেই কিভাবে সুসজ্জিত সুনিরাপদ করা যায়।’

মডেল হিসেবে সিলেটের একটি মাদরাসার চিত্রও তুলে ধরেন মাওলানা মাহফুজুল হক। তিনি বলেন, সেদিন সিলেটের জামিয়া ইসলামিয়া ফরিদাবাদ মাদরাসায় গেলাম। মাদরাসার আবাসন ব্যবস্থাপনাটা ভালো লাগলো। সেখানে শিক্ষকদের রুম ছাত্রদের রুম থেকে আলাদা। দরজাও আলাদা। শিক্ষকদের রুমের সঙ্গে ছাত্রদের রুমের কোনো সংযোগ নেই। একরুমে দুজন করে শিক্ষক থাকেন। এখানে দুজনের জায়গায় তিনজনও থাকতে পারে। এই সিস্টেমটা করা গেলে অপরাধের সুযোগ শিক্ষকরা কম পাবেন। শুধু এটা না, এমন আরও বিভিন্ন সিস্টেম করা যেতে পারে।’

The post হেফজখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি কাটছে না : কী করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো? appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b9%e0%a7%87%e0%a6%ab%e0%a6%9c%e0%a6%96%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%aa%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%9d%e0%a7%81%e0%a6%81%e0%a6%95/

No comments:

Post a Comment