Monday, September 19, 2022

ভারতীয় মাদরাসাগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মাধ্যমিক : কী ভাবছে বাংলাদেশের আলেম সমাজ?

ইজাজুল হক, রাকিবুল হাসান:

শিক্ষার্থীদেরকে এসএসসি লেভেল পর্যন্ত জেনারেল সিলেবাস পাঠদান এবং এসএসসি লেভেলের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সার্টিফিকেট নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা। গতকাল ১৮ আগস্ট দেওবন্দের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে পাশাপাশি অন্যান্য মাদ্রাসাগুলোকেও বিষয়টি আমলে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। দেওবন্দের এই সিদ্ধান্তের পর তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশেও। প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো যেহেতু সবক্ষেত্রেই দেওবন্দের অনুসরণ করে থাকে, এই ক্ষেত্রে তার অনুসরণ করবে কিনা। বাংলাদেশের আলেমদের মধ্যেও তৈরী হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন, দেওবন্দসহ ভারতের কওমি মাদ্রাসাগুলোর এই পদক্ষেপ বাংলাদেশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে না। কেউ বলছেন, প্রভাব ফেলবে। কেন্দ্রীয়ভাবে বেফাক কিংবা হাইয়া যদি এই কাজ না করে, তাহলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। পাশাপাশি সরকারি হস্তক্ষেপের বিষয়টি আরও প্রবল হতে পারে।

ভারতের শিক্ষার্থীরা কোন বোর্ডে পরীক্ষা দেবে

জানা গেছে, বাংলাদেশের উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওপেন স্কুলিং (এনআইওএস)। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই মূলত মাদ্রাসাগুলো এসএসসি লেভেলের পরীক্ষায় অংশ নেবে। ইতিমধ্যেই এনআইওএসের সঙ্গে একটি সমঝোতাও হয়ে গেছে। এই প্রকল্পের পেছনে রয়েছে ভারতের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রকল্প রয়েছে। এটি সর্বশেষ সংযোজন। এই প্রকল্পের নাম ‘জমিয়ত ওপেন স্কুল’।

এর আগে ২২ অক্টোবর ২০২০ অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মজলিসে আমেলার সিদ্ধান্ত মতে—২৫ নভেম্বর ২০২০ এনআইওএস-এর অধীনে মাদ্রাসা-শিক্ষার্থীদের এসএসসি লেভেল পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া বিষয়ক পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এনআইওএস-এর অধীনে মাদ্রাসা-শিক্ষার্থীদের এসএসসি লেভেল পর্যন্ত পড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শুক্রবার জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রধান কার্যালয়ের মাদানি হলে জমিয়ত ওপেন স্কুল উদ্বোধন করা হয়। এতে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাবেক প্রধান মাওলানা কারি উসমান মনসুরপুরি সাহেব। এতে উত্তর প্রদেশ ও দিল্লির ১০০ মাদ্রাসার মুহতামিম ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দায়িত্বশীলরা অংশ নেন।

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য মতে, মাদ্রাসা-শিক্ষার্থী ও ফাজেলদের জেনারেল শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম—জমিয়ত ওপেন স্কুল। এ প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের এসএসসি লেভেল পাশ করার জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলবে। এর মাধ্যমে ওই শিক্ষার্থীর জন্য অধিক উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথ খুলে যাবে। একজন শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে ধর্মীয় দায়িত্বগুলো আগের চেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে সম্পাদন করতে পারবে।

কিভাবে পরীক্ষায় অংশ নেবে

এনআইওএস সাধারণত বছরে দুইবার এসএসসি লেভেলের পরীক্ষা নেয়। প্রতিটি মাদ্রাসা নিজেদের সুবিধামতো ব্যাচ তৈরি করে একবার বা দুইবার পরীক্ষায় অংশ নেবে। পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফরম ফিলাপসহ এ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ মাদ্রাসার পক্ষ থেকে সম্পাদন করা হবে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষই শিক্ষার্থীদের নার্সিং করে পরীক্ষার জন্য পূর্ণ প্রস্তুত করে তুলবে। জমিয়ত ওপেন স্কুল থেকে ইতিমধ্যেই দুই হাজার মতো শিক্ষার্থী চলতি শিক্ষাবর্ষে (২০২১-২২) দুইবার পরীক্ষায় অংশও নিয়ে ফেলেছে এবং ব্যাপক সাফল্যও এসেছে। জমিয়ত ওপেন স্কুলের টার্গেট হলো—২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ হাজার মাদ্রাসা-শিক্ষার্থীকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে এসএসসি লেভেল পাশ করানো। জমিয়ত কোটি টাকার বৃত্তির প্রজেক্টও চালু করেছে।

এনআইওএসের নির্ধারিত সিলেবাস আয়ত্ব করার কৌশল নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। প্রত্যেক মাদ্রাসায় নির্দিষ্ট শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে জমিয়ত ওপেন স্কুল। প্রতিটি মাদ্রাসায় একজন কো-অর্ডিনেটর থাকবেন। আবার প্রতি জেলায় একজন কো-অর্ডিনেটর থাকবেন। মাদ্রাসাগুলো পরীক্ষার্থীদের জন্য দৈনিক ২ ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় বের করবে। এনআইওএসের নির্ধারিত অ্যাপস থেকে ভিডিও লেকচার শুনিয়ে ছাত্রদের পাঠদান করা হবে। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা তাদের তত্ত্বাবধান করবেন এবং পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করবেন। জেলা কো-অর্ডিনেটর মাদ্রাসাগুলো সমন্বয়, উন্নয়ন, অগ্রগতি তদারকি করবেন। সবকিছু সম্পন্ন হবে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায়। সরকারি কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ থাকবে না।

কেন্দ্রীয় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে কারা আছেন?

জমিয়ত ওপেন স্কুলের কেন্দ্রীয় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে রয়েছেন: ১. মাওলানা মুফতি আবুল কাসিম নুমানি, মুহতামিম, দারুল উলুম দেওবন্দ। ২. মাওলানা মাহমুদ আসআদ মাদানি, সভাপতি, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। ৩. মাওলানা মুফতি সাইয়্যেদ মুহাম্মদ সালমান মনসুরপুরি, নাজেমে আলা, দীনি তালিমি বোর্ড, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। ৪. মাওলানা মুহাম্মদ সালমান বিজনুরি, দারুল উলুম দেওবন্দ। ৫. জনাব ড. পিএ এনামদার, সভাপতি, এমসিএ সোসাইটি, পুনে। ৬. জনাব কামাল ফারুকি, সদস্য, মুসলিম প্রিন্সল ল বোর্ড। ৭. প্রফেসর আখতারুল ওয়াসে, সভাপতি, মাওলানা আযাদ ইউনিভার্সিটি, যুদপুর। ৮. মাওলানা শিব্বির আহমদ নদভি, মুহতামিম, মাদ্রাসা লিল-বানাত, বেঙ্গলুর। ৯. মুফতি আহমদ দেওলা, সভাপতি, তাহাফফুজে মাদারিস, গুজরাট। ১০. মাওলানা আবদুল কাদের, সেক্রেটারি, জমিয়তে উলামা, আসাম। ১১. মাওলানা কলিমুল্লাহ কাসেমি, সেক্রেটারি, জমিয়তে উলামা, উত্তর প্রদেশ। ১২. হাফেজ পীর শিব্বির সাহেব, সভাপতি, জমিয়তে উলামা, তেলেঙ্গানা। ১৩. মুফতি শামসুদ্দিন বাজলি কাসেমি, সেক্রেটারি, জমিয়তে উলামা, কর্নাটক। ১৪. মুফতি সাইয়েদ মুহাম্মদ আফফান মনসুরপুরি, সভাপতি, দীনি তালিমি বোর্ড, উত্তর প্রদেশ। ১৫. মাওলানা হাকিমুদ্দিন কাসেমি, জেনারেল সেক্রেটারি, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। ১৬. হাফেজ মাওলানা নদিম সিদ্দিকি, প্রেসিডেন্ট, জমিয়তে উলামা, মহারাষ্ট্র। ১৭. জনাব হাজি মুহাম্মদ হারুন সাহেব, সভাপতি, জমিয়তে উলামা, মধ্যপ্রদেশ। ১৮. মাওলানা নিয়াজ আহমদ ফারুকি, সেক্রেটারি, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ।

এ বিষয়ে প্রকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা মাওলানা মাহমুদ মাদানি বলেন, ‘আমাদের আকাবিররা সরকারি মাদ্রাসা বোর্ডের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের উদ্বেগগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণিত হয়েছে। আসাম সরকারের সাম্প্রতিক কার্যক্রম তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা মাদ্রাসায় সরকারি হস্তক্ষেপ মানব না। আধুনিক শিক্ষার জন্য আমরা আমাদের নিজস্ব পথ বেছে নিয়েছি। এটি আমাদের চাহিদা পূরণ করছে এবং আমাদের স্বতন্ত্র সিলেবাসেও কোনো হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না।’

মাওলানা মাদানি আরও বলেন, ‘আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষকের পাশাপাশি একজন ভালো দীনপ্রচারকেরও দরকার আছে। মূলধারার জ্ঞানের অভাবে তারা সমাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তাই জমিয়ত ওপেন স্কুলের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা দিয়ে তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে।’

কী ভাবছে বাংলাদেশের আলেম সমাজ?

দেওবন্দের অনুসরণে বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাতেও এসএসসি লেভেল পর্যন্ত জেনারেল সিলেবাস পাঠদান এবং এসএসসি লেভেলের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সার্টিফিকেট নেয়া সময়ের দাবি বলে মনে করেন হাটহাজারী মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী। ফাতেহকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মাদরাসাগুলো যদি দেওবন্দের অনুসরণ করে থাকে, তাহলে এই বিষয়টিরও অনুসরণ করতে হবে। কারণ, দেওবন্দ সবসময় সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়। আমি নিজেও চাই, বাংলাদেশের মাদরাসাগুলোতে জেনারেল শিক্ষাটাকে চালু করা হোক। এটা এখন সময়ের দাবি।

তবে বর্তমান কওমি মাদরাসার সিলেবাসের সঙ্গে এসএসসি লেভেল পর্যন্ত জেনারেল সিলেবাস পাঠদান করানো সম্ভব না বলে মন্তব্য করেন কুমিল্লা মাদরাসায়ে আশরাফিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হাফেজ মাওলানা মুফতী শামছুল ইসলাম জিলানী। তাহলে কিভাবে সম্ভব জানতে চাইলে তিনি ফাতেহকে বলেন, পড়াতে হলে সিলেবাস সমন্বয় করতে হবে। আমাদের সিলেবাসটাকে নতুন করে গোছাতে হবে।’ তবে সরকারের অধীনে এসএসসি এবং এইচএসসি স্তরের মান যদি কওমি মাদরাসাতেও দেয়া হয়, তাহলে বিপত্তি ঘটবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জেনারেল শিক্ষাটা দরকার। কিন্তু সরকারি বোর্ডের অধীনে যেন এ পরীক্ষা দেয়া না হয়। বরং হাইয়া-বেফাকের মুরুব্বীরা বসে সিলেবাসটাকে আরেকটু সাজাতে পারেন জেনারেল বিষয়গুলো সমন্বয় করে। তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা জেনারেল শিক্ষাটাও পেল। কিন্তু এমন যেন না হয়, আমাদের কোনো ক্লাসে এসএসসির বই ঢুকিয়ে সেই ক্লাসকে এসএসসির মান দেয়া হলো। তাহলে আলিয়া মাদরাসার মতো পরিণতি হবে ছাত্রদের। এই পরীক্ষা দিয়ে মাদরাসার পড়া শেষ না করেই অনেকে ভার্সিটি-কলেজে চলে যাবে।’

তবে অনেকে অনেক মতামত দিলেও বিষয়টি নিয়ে ভাবছে না বাংলাদশে কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া। বেফাকের মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের ফাতেহকে জানান, দেওবন্দ তাদের দেশের সরকারের চাপে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন, মাদরাসা হিন্দি শেখাতে হবে বলে চাপ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাংলা শেখাতে হবে বলে কোনো চাপ নেই। সুতরাং এসএসসি লেভেল পর্যন্ত জেনারেল সিলেবাস পাঠদান বিষয়টিও একই রকম। দেওবন্দের সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বে না। মুরুব্বীরা এখনই বিষয়টি নিয়ে ভাববেন না।’

মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের বলেন, ‘বেফাকের ক্লাস এইট পর্যন্ত সিলেবাস আছে। এরমধ্যে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আছে সিলেবাসের পূর্ণাঙ্গ নিজস্ব বই। সিক্স, সেভেন, এইট এই তিনটি ক্লাসের বাংলা, অংক এবং ইংরেজি আছে, বাকি বিষয়গুলোর নিজস্ব বই বেফাকের নেই। এখন সিলেবাসভুক্ত বইগুলো পরিমার্জন করা হচ্ছে। আমাদের গবেষক টিম কাজ করছেন।’ বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, ‘আমাদের রচিত বইগুলো শতভাগ মানহীন এটা বলা যাবে না। বলতে পারেন, কিছু কিছু জায়গায় দুর্বলতা আছে। এগুলো পরিমার্জন করা হচ্ছে, পুননিরীক্ষা করা হচ্ছে। ঠিক হয়ে যাবে।’

The post ভারতীয় মাদরাসাগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মাধ্যমিক : কী ভাবছে বাংলাদেশের আলেম সমাজ? appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a7%9f-%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a7%8b%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%85%e0%a6%a8%e0%a7%8d/

No comments:

Post a Comment