রাকিবুল হাসান নাঈম:
রান্নাঘরকে বলা হয় একটি সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার দর্পণ। রান্নাঘরে কী রান্না হচ্ছে, দস্তরখানায় কী খাবার পরিবেশন হচ্ছে, তা দেখে আপনি বুঝে যাবেন তাদের আর্থসামাজিক খতিয়ান। আজকের লেখায় আরবসমাজের রান্নাঘরের একটি লোভনীয় চিত্র তুলে ধরব। যদিও প্রথমদিকে তাদের খাবার ছিল মরুভূমির মতোই শুষ্ক, বিস্বাদ ও খসখসে, কিন্তু শাম ও ইরাকে ইসলামিক বিজয়ধারা শুরু হবার পর আরবদের খাবার ম্যানুতেও উন্নতি ঘটে। বিকাশ ঘটতে শুরু করে রন্ধনশিল্পের। রান্নাঘরে, কবিতায়, সাহিত্যে, গল্পে সেই রন্ধনশিল্প ঝকমকিয়ে উঠে।
কামালুদ্দিন দামিরির (মৃ. ৮০৮হি/১৪০৫খৃ) মতে, ‘বনু উমাইয়া যুগ থেকে আরবদের রন্ধনশালার বিকাশ ঘটে। এই বিকাশ শুরু হয় হজরত মুআবিয়া রাজি.-এর হাত ধরে। তিনি খাবার ও পানীয়ের ক্ষেত্রে বিলাসী জীবন যাপন করেছেন। এই ধারা বজায় রেখেছেন তার পরের খলিফারাও।’
আরবদের দস্তরখানা
আরবদের অধিকাংশই মরুভূমির শুষ্ক পরিবেশে বাস করতো। তাই তাদের খাবারের তালিকায় তেমন বৈচিত্র ছিল না। চারপাশের গাছপালা ও প্রাণীরাই ছিল তাদের খাবারের মূল উপাদান। এরমধ্যে সবচে প্রসিদ্ধ খাবার—ছারিদ। রুটি টুকরো টুকরো করে প্রথমে ঝোলে ভেজানো হয়। তার ওপর রাখা হয় মাংস। এই প্রণালি কাঠ, কয়লা দিয়ে জ্বাল দেয়া হয়। হয়ে যায় ছারিদ।
আরবদের খাবারের নামগুলো প্রায় একই তালের হতো। আবু মানসুর সাআলিবি (মৃ ৪২৯হি/১০৩৯ খৃ) ‘ফিকহুল লুগাহ ওয়া সিররুল আরাবিয়া’ গ্রন্থে বলেন, আরবদের খাবারের নামগুলো হতো فعيلة এর মাপে। যেমন—সাখিনাতুন, আসিদাতুন, হারিরাতুন, হারিসাতুন, মাদিরাতুন। মাদিরাতুল বলা হয় টক দই দিয়ে মাংস রান্না করাকে। হারিরার সংজ্ঞায় মাজদুদ্দিন ইবনে আসির (মৃ. ৬০৬হি/১২০৯ খৃ) ‘আন-নিহায়া ফি গারিবিল হাদিস ওয়াল আছার’ গ্রন্থে বলেন, ‘হারিরা হলো—আটা, চর্বি এবং পানি জ্বাল দিয়ে তৈরী একজাতীয় স্যুপ। খাবার এবং ওষুধের বইপত্রে হারিরার কথা বলা হয়েছে।’ লিসানুল আরবে খাজিরা বানানোর রেসিপি দিয়েছেন ইবনে মানজুর (মৃ. ৭১১হি/১৩১১খৃ)। তিনি বলেন, ‘প্রথমে মাংস ছোট ছোট করে কেটে পাতিলে নেয়া হয়। তারপর অনেক পানি এবং লবন দিয়ে জ্বাল দেয়া হয়। তারপর তাতে দেয়া হয় আটা। এরপর জ্বাল দিয়ে ঘন করে পরিবেশন করা হয় খাজিরা। খাজিরা বানাতে হলে মাংস লাগবেই। এই রেসিপিটাই যদি মাংস ছাড়া রান্না করা হয়, সেটা হয়ে যাবে আসিদা।’
মাংস পেলে আরবদের আর কিছুই লাগতো না। ‘মুহাজারাতুল উদাবা’ গ্রন্থে রাগেব ইস্পাহানি (৫০২হি/১১০৮খৃ) বলেন, ‘এক আরবীয় লোককে রুটি এবং মাংস দেয়া হলো। সে মাংস খেয়ে রুটিটি ফেলে দিলো।’ ইবনে কুতাইবা দিনাওয়ারি (২৭৬হি/৮৮৯খৃ) ‘উয়ুনুল আখবার’ গ্রন্থে লিখেন, ‘এক আরবীয় লোককে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনারা মাংস খান, রুটি খান না কেন?’ লোকটি বললো, ‘মাংস হজম হয়, রুটি হজম হয় না।’ দিনাওয়ারি আরও লিখেছেন, আরবরা সবচে বেশি পছন্দ করতো হাড়যুক্ত মাংস।
তবে এই খাবারগুলো ছিল ধনবান লোকদের। গরিবরাও কখনও পেলে খেতো। মূলত আরবরা যা পেত, জীবন ধারণের জন্য তাই খেতো। বলা হয়, ক্ষুধা সবচে সুস্বাদু মশলা। ক্ষুধার সঙ্গে সবকিছু ভালো লাগে। উয়ুনুল আখবারে উল্লেখ করা হয়েছে, এক শহুরে গ্রাম্য ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কী খাও। লোকটি বললো, ‘যা পাই, তাই খাই।’
তবে তাদের পছন্দ নয়, এমন খাবার তারা কখনও খেতো না। এরমধ্যে অন্যতম ভেড়ার মাথা। তারা চোখ, থুথনি, জিভ সবই খেতো, কিন্তু মগজটা খেতো না। বনু আসাদের এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মরুভূমিতে তাদের খাবার কী? সে বলেছিল, ‘আমাদের খাবার সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে সুস্বাদু। এতে রয়েছে—গম, করলা, মর্টল ফল, উদ্ভিদ, ট্রাফল, ইঁদুর, সাপ ইত্যাদি। এরচে মজাদার খাবার আমাদের নিকট নেই।’
কখনও খাবারের নামে গোত্রের নামকরণ করা হতো। হয়ত ওই গোত্র ওই খাবারটা বেশি খেতো। যেমন, মুজাশি ইবনে দারেম গোত্রকে ‘খাজিরা’ বলে ডাকা হতো। কুরাইশকে ডাকা হতো ‘সাখিনা’ বলে। কবি সাহাবি হাসসান ইবনে সাবেতের কবিতায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
রাসুল এবং সাহাবিদের খাবার
রাসুল সা. কিছু খাবার পছন্দ করতেন। কিন্তু তিনি খাদ্যপ্রেমী ছিলেন না। আনাস ইবনে মালেক রাজি. বলেন, ‘রাসুল সা. তরমুজ এবং তাজা খেজুর পছন্দ করতেন। কখনও দুটো মিলিয়ে খেতেন।’ ইবনে হাজার আসকালানি ফাতহুল বারিতে দুর্বল সনদে বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুল সা. ডান হাতে নিতেন তাজা খেজুর, বামহাতে নিতেন তরমুজ। তারপর তরমুজ দিয়ে খেজুর খেতেন। তার নিকট সবচে পছন্দের ফল ছিল এটাই।’ ইবনে হাজার তরমুজ বলে যেটা উদ্দেশ্য নিয়েছেন, সেটাা হলুদ তরমুজ। হেজাযে যেটাকে বলা হয় খরবুজ। এখানে সবুজ তরমুজ উদ্দেশ্য নয়। ইমাম আহমদের বর্ণনায় খরবুজের কথাটিই প্রাধান্য পায়। তিনি আনাস রাজি. থেকে সহিহ সনদে বর্ণনা করেন, ‘আমি রাসুলকে খেজুর এবং খরবুজ মিলিয়ে খেতে দেখেছি।’
আরবদের নিকট খাবার কেবল ক্ষুধা নিবারণ এবং আয়েশের জন্য ছিল না, বরং তারা খাবার চিকিৎসা এবং সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যও ব্যবহার করতো। যেমন তারা মেয়েদের মোটা করার জন্য খেজুর এবং অন্যান্য ফল খাওয়াতো। ইমাম আমের শাবি (৬২৬হি/১২২৯খৃ) বলেন, ‘সুস্বাস্থ্য নারীদের অলংকার।’ তাই ইমাম ইবনে মাজা হজরত আয়েশা রাজি. থেকে বর্ণনা করেন, নবিজির ঘরে পাঠানোর জন্য আমার মা আমাকে মোটা করার চিকিৎসা করালেন। তাজা খেজুর খাবার পর আমি মোটা হয়ে যাই।
প্রথম যুগের আরবদের মতো সাহাবায়ে কেরামও বেশি খেতেন না। তারা রান্নায় তেমন পারদর্শীও ছিলেন না। দিনাওয়ারি আনাস ইবনে মালেক রাজি. থেকে বর্ণনা করেন, ‘আমি দেখেছি, ওমর রাজি.-কে এক সা’ খেজুর দেয়া হলো। তিনি তা নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত খেয়েছেন।’
খোলাফায়ে রাশেদিনের পরের লোকদের খাবার
দিনাওয়ারি লিখেছেন, উমাইয়াদের যুগে আরবদের রান্নাঘরের বিকাশ শুরু হয় আমির মুআবিয়া রাজি.-এর হাত ধরে। ‘মুরুজুয যাহাব’ গ্রন্থে মাসউদি (৩৪৬হি/৯৫৭খৃ) লিখেন, ‘মুআবিয়া প্রতিদিন পাঁচবার খাবার খেতেন। সর্বশেষ খাবারটি হতো ভারী খাবার। এরপর তিনি গোলামকে বলতেন, খাবারগুলো নিয়ে যাও। আল্লাহর কসম, এখনও আমি তৃপ্ত হইনি, কিন্তু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’ ইবনে কাসির (৭৭৪হি/১৩৭২খৃ) ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে লিখেন, ‘মুআবিয়া যখন শামে আমির হয়ে এলেন, তখন তিনি দৈনিক সাতবার খাবার খেতেন। সাতবারেই মাংস থাকতো। মিষ্টি এবং ফলমূলও থাকতো অনেক।’
ইসলামি ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি মুআবিয়া, যিনি অতিরিক্ত ওজনের কারণে বসে খুতবা দিতেন। তার দস্তরখানায় উপস্থিত থাকতো চিকিৎসক, তিনি তাকে বলে দিতেন, কোনটা উপকারী, কোনটা ক্ষতিকর। কিন্তু মুআবিয়া ছিলেন ভোজনরসিক; চিকিৎসকের নির্দেশনা তিনি সবসময় মানতে পারতেন না।
ইসলামের শুরুর যুগে ভোজনরসিকদের নাম উল্লেখ করেছেন মাসউদি। এরমধ্যে দুজন খলিফা—সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিক এবং হিশাম ইবনে আবদুল মালিক। দুজন রয়েছেন গভর্নর—আব্দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ এবং হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ। ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’তে সুলাইমান ইবনে আবদুল মালিক সম্পর্কে যাহাবি লিখেন, ‘তিনি ছিলেন ভোজনরসিক। বলা হয়, একবার তিনি ৪০টি মুরগি খেয়েছিলেন। আরেকবার একটি ভেড়া, ছয়টি মুরগি এবং ৭০টি ডালিম খেয়েছিলেন।
আব্বাসি শাসনামলে খাবার তৈরির ক্ষেত্রে বিলাসিতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। রান্নাঘরে তাদের কারো কারো খরচ আজ আমাদের কিছু আরব মন্ত্রণালয়ের বাজেটের কাছাকাছি ছিল। খলিফা রশিদের ম্যানুতে প্রতিদিন ত্রিশ জাতের খাবার অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তিনি এতে দৈনিক ১০ হাজার দিরহাম ব্যয় করতেন, যা আজকের হিসেবে প্রায় ১২০০০ মার্কিন ডলার। ইবনে খাল্লিকান লিখেন, যখন খলিফা রাশিদ তার চাচাতো বোন জুবায়দাহ বিনতে জাফরকে বিয়ে করেছিলেন, তিনি বিয়ের ভোজে পঞ্চাশ মিলিয়ন দিরহাম, যা আজকের হিসেবে প্রায় ৬৮ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। তার ছেলে খলিফা মামুনের দৈনিক ব্যয় ছিল ছয় হাজার দিনার, যা বর্তমানে প্রায় এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার টেবিলে কখনও ৩০০ ধরনের খাবার থাকতো। আব্বাসীয় খলিফাদের ঐতিহাসিক ইবনে তাইফুর আল-মারওয়াজি ‘কিতাবু বাগদাদ’ গ্রন্থে জাফর বিন মুহাম্মদ আল-আনমাতির একটি বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, একদিন মামুনের মধ্যাহ্নভোজে আমি উপস্থিত ছিলাম। তখন টেবিলে ৩০০ ধরনের খাবার ছিল।
অন্যদের খাওয়ানো
তারা শুধু নিজেরাই খেতেন, এমন নয়, জনগণকেও খাওয়াতেন। আবু ইসহাক আল-সাবে ‘কিতাবুল ওজায়ের’ গ্রন্থে বলেন, আব্বাসীয় মন্ত্রী ইবনে আল-ফুরাতের দুটি রান্নাঘর ছিল; একটি ব্যক্তিগত এবং অন্যটি জনসাধারণের জন্য। প্রতিদিন এতে জনসাধারণের জন্য নব্বইটি ভেড়ার মাথা, ত্রিশটি ছাগল এবং কয়েকশ মুরগি রান্না করা হতো।
‘তারিখুল ইসলাম’ গ্রন্থে যাহাবি লিখেছেন, পারস্যের রাজা আমর বিন লাইস সাফফার বলেছেন, ‘আমার রান্নাঘরে প্রতিদিন ৬০০ উট জবাই হয়।’ তার ভাই ইয়াকুব বিন লাইস বলেন, আমরের রান্নাঘরের একটি পাতিলে চারটি ছাগল চড়ানো যেতো।
মাসউদি লিখেন, আব্বাসি যুগে খাবারের প্রতিযোগিতাও হতো। তাতে উপস্থিত থাকতেন মামুন, মুতাসিম।
অন্য সভ্যতা থেকে গ্রহণ
আরবদের রান্নাঘর রোম এবং পারস্য থেকে বেশ উপকৃত হয়েছে। দিনাওয়ারি আসমাঈ থেকে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন—একবার খাবার নিয়ে রোম এবং পারস্যের দুজন ব্যক্তির মাঝে বিবাদ হলো। তারা মিমাংসার জন্য এক আরব শায়খকে ধরলো, যিনি খলিফার দরবারে খাবার খেয়েছেন। তিনি বললেন, ‘রোমানরা নিয়ে এসেছে ভাজা-পোড়া, পারস্যরা নিয়ে এসেছে ঠাণ্ডা এবং মিষ্টি।’ এরথেকে প্রতীয়মান হয়, শামিদের রান্না রোমানদের দ্বারা প্রভাবিত। আর মিষ্টি তো পারস্যের ঐতিহ্য। তাই অধিকাংশ আরবীয় মিষ্টিগুলোর নামে ফারসি শব্দ পাওয়া যায়।
অন্যদের খাবার নিজেদের মধ্যে প্রচলনের ব্যাপারে আরবদের আগ্রহ ছিল। কিসরার দস্তরখানায় ‘ ফালুজ’ মিষ্টি দেখতে পান কুরাইশ নেতা আব্দুল্লাহ বওন জাদআন (৫৯২খৃ)। ফালুজ আটা, পানি এবং মধু দিয়ে তৈরী। কুরাইশ নেতা মিষ্টির রেসিপি এবং এবং পারস্যের একজন মিষ্টির কারিগর সঙ্গে করে মক্কায় নিয়ে আসেন। মিষ্টি বানিয়ে মানুষকে খাওয়ান। কবি উমাইয়া ইবনে আবি সালত (৫হি/৬২৭ খৃ) তার এক কবিতায় এই মিষ্টির গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন।
ইবনে ফকিহ হামাদানি (৩৬৫হি/৯৭৭খৃ) কিতাবুল বুলদানে ইমাম শাবি থেকে একটি বর্ণনা এনেছেন, তার থেকে বুঝা যায়, খোরাসান এবং পারস্যের লোকেদের মধ্যে রান্নার দক্ষতা বেশি ছিল। রান্নায় সবচে চতুর ছিল হেরাতবাসী, মার্ভবাসী ছিল রুটি বানাতে উস্তাদ, আর ইস্পাহানের অধিবাসীরা ছিল মিষ্টি বানাতে সবচে বেশি পারঙ্গম।
উমাইয়াদের যুগে রান্নাঘরের বিকাশ শুরু হলেও আব্বাসি যুগে তা উন্নতির চূড়ায় পৌঁছে। তারা চিকিৎসকদের দিয়ে এ বিষয়ে বই লেখায়। তাতে উঠে আসে স্বাস্থকর খাবারের গুণ, খাবার গ্রহণের নিয়মাবলী। ইবনে নাদিম ‘আল ফাহারসাত’ গ্রন্থে রান্নাবিষয়ক ১২টি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, বইগুলো লেখা হয়েছিল দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শতাব্দীতে, খলিফাদের আগ্রহে।
খাদ্য স্বাস্থ্যবিধি
খাদ্য তৈরির পরিবেশ এবং এর কর্মীদের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তারা ছিলেন যথেষ্ট সতর্ক। তারা বাবুর্চিকে তার নখ কাটতে, ক্রমাগত তার হাত ধুতে এবং তার হাঁড়ি কয়েকবার ধৌত করতে বাধ্য করতেন। আলাউদ্দিন গাজৌলি লিখেন, তাদের একজন দীর্ঘ সময় ধরে তার হাত ধৌত করতেন এবং বলতেন, হাতের নিয়ম হল, খাবারের সময় পরিমাণ হাত ধৌত করা।
স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণে অফিসিয়াল সংস্থাও ছিল, যারা পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারটি তদারকি করতো। এমনই এক সংস্থার পরিচালক ছিলেন জালালুদ্দিন শাইযারি (৫৯০ হি / ১১৯৪খ্রি)। তিনি পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক একটি বই লিখেন, ১৫ অধ্যায়ে। তাতে তিনি বলেন, রান্নাঘরের ছাদ উঁচু করা উচিত এবং চুলার ছাদে চওড়া চিমনি স্থাপন করা উচিত, যেখান থেকে ধোঁয়া বের হবে। এতে মুসলমানদের কোনো ক্ষতি হবে না।
তিনি লিখেছেন, যে রুটি বানায়, সে যেন তার পা, হাঁটু বা কনুই দিয়ে আটার খামিরা না করে। এতে খাবারের অপমান হয় এবং তার এসব অঙ্গ থেকে ঘাম পড়তে পারে। পাশাপাশি সে যেন হাতে মোজা পড়ে, কপালে সাদা কাপড় বাঁধে, যেন ঘাম না পড়ে। নাকে লাগবে মাস্ক, যেন হাঁচি দিলে খাবারে কিছু না পড়ে। পাচকদের অবশ্যই চুল মুন্ডানো থাকতে হবে, যেন খাবারে চুল না পড়ে।
খাদ্য জালিয়াতির বিরুদ্ধে সতর্ক ছিল এই সংস্থা। কেউ খাবারে কিছু মেশাচ্ছে কিনা, খাবার তৈরীতে নির্দিষ্ট পাত্র ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা, তারা খেয়াল রাখতো। নিয়ম ছিল, খাবার হোম ডেলিভারি দিতে হলে কোনো নাবালেগ ছেলেকে পাঠাতে হবে, বয়স্ক কাউকে পাঠানো যাবে না। কারণ খাবারটা ঘরের ভেতর দিয়ে আসতে হয়। এতে পর্দার খেলাফ ঘটতে পারে।
খাবারের মাপ খুব শক্তভাবে দেখা হতো। চুলায় তন্দুর দেয়ার আগে একবার মাপা হতো, ওজন খাতায় লেখা হতো। চুলা থেকে তোলার পর আবার মাপা হতো। কারণ, কখনো কখনো মাংসের ভেতর শিশা কিংবা লোহা ঢুকিয়ে ভারি করা হতো। পরে মাপলে তা ধরা পড়ে যেতো। গরুর মাংসের সঙ্গে ভেড়ার মাংস, ভেড়ার মাংসের সঙ্গে উটের মাংস, এমন এক মাংসের সঙ্গে আরেক মাংস মেশানো নিষিদ্ধ ছিল।
রান্না বিষয়ক বই
মানুষই একমাত্র প্রাণী, যারা রান্না করে খায়। আরবসভ্যতার যুগে রান্নার বই বেশ প্রসিদ্ধি পেয়েছিল। আব্বাসি যুগের রন্ধনশিল্প নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ হাসান বাগদাদি। তার বইয়ের নাম ‘কিতাবুত তাবিখ’। বইটি কবিতার ভাষায় লেখা।
এ বিষয়ে আরও যাদের বই প্রসিদ্ধ হয়, তারা হলেন—ইবনে সাইয়ার ওয়াররাক, ইবনে মাসওয়াইহ, ইবরাহিম ইবনে মাহদি, ইবনে দায়াহ, ইবনে মানদুয়াহ, ইবনে জাযলাহ বাগদাদি, ইবনে আবি নাসর আত্তার প্রমুখ। শুধু পানীয় বিষয়ক বই লিখেছেন দার্শনিক মাসকুইয়াহ। খাবারের উপকারিতা এবং অপকারিতা নিয়ে বই লিখেছেন আবু বকর রাজি। উদ্ভিদ নিয়ে লিখেছেন ইবনে বায়তার উন্দুলুসি। এতে খাবার ও ওষুধের ১৪০০ উপাদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খাবারের আদব ও নিয়মকানুন নিয়ে বই লিখেছেন বদরুদ্দিন গাজ্জি। এতে তিনি খাবারের ৮১ টি দোষের কথা বলেছেন, যেগুলো পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।
শাম এবং মিসরে মামলুকদের আগমন রান্না বিষয়ক লেখালেখির পালে হাওয়া দেয়। কারণ, মামলুক সৈন্যরা ছিল ভোজনরসিক। তারা এখান থেকে রেসিপি নিয়ে যেতো। মামলুকদের পর উসমানি যুগ পর্যন্ত রান্না বিষয়ক এই মনোযোগ অক্ষুণ্ণ থাকে।
আমেরিকান ইন্সটিটিউট অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ কর্তৃক প্রকাশিত ইরাকি গবেষক নাওয়াল নাসরাল্লাহর গবেষণা অনুসারে, সেই সময়ে রান্নার বইয়ের প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছিল। যা নবম শতাব্দীতে বাগদাদে কাগজ এবং স্টেশনারি ব্যবসার বিকাশকে উত্সাহিত করেছিল। এই যুগে ছড়িয়ে পড়া অনেক বইয়ের মধ্যে মাত্র দশটি বই সময়ের আঘাতে টিকে আছে এবং সেগুলো বাগদাদ, আলেপ্পো, দামেস্ক, কায়রো, পশ্চিম এবং আন্দালুসিয়া থেকে এসেছে।
রান্না বিষয়ক প্রাচীন যে গ্রন্থগুলো আমাদের নিকট এসেছে, তারমধ্যে অন্যতম হলো—ইবনে সাইয়ার ওয়াররাক কর্তৃক রচিত ‘কিতাবিত তাবিখ’। বইটি আব্বাসি শাসনামলে দশম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রচিত। তবে এরমধ্যে যে রেসিপিগুলো বলা হয়েছে, তা বেশিরভাগ খলিফা, রাজকুমার এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের খাবারের জন্য। রেসিপির সঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে কবিতা এবং গল্প। উল্লেখ করা হয়েছে খাবারের স্বাস্থ্য উপকারিতা। ১৯৮৭ সালে ইবনে সাইয়ারের বইটি নিয়ে গবেষণা করেন ফিনিশ প্রাচ্যবিদ কাই আর্নবেরি এবং তার লেবানিজ সহকর্মী সাহবান। তিনি দেখান, বইটিতে ছয় শতাধিক রেসিপি রয়েছে। এগুলে ১৩০টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এতে রেসিপির সঙ্গে টেবিলে খাবার পরিবেশন, খাবারের পর হাত-মুখ ধৌতকরণ, দাঁত পরিষ্কার, রান্নাঘর পরিষ্কারের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন। ইবনে সাইয়ার তার বইয়ে ১৫ জাত রুটির রেসিপি দিয়েছেন।
মিসরে ‘কানজুল ফাওয়ায়েদ’ নামে রান্না বিষয়ক একটি বই প্রসিদ্ধি পেয়েছিল। বইটির লেখক অজানা। ইসলামিক আরবে লিখিত সর্বশেষ রান্নার বই মনে করা হয় এটিকে। এতে ৮১ প্রকার মিষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়। এতে প্রতীয়মান হয়, মিসরে তখন চিনির প্রাচুর্য ছিল। অথচ ইউরোপে তখনও চিনি একটি বিরল পণ্য, যেটি ওষুধে ব্যবহারমকরা হতো। বইটিতে ৩০ জাতীয় পানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো দিয়ে পারফিউম বানানো যায়, রান্নাঘর পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা যায়।
The post ইতিহাসের আলোকে মুসলমানদের খাদ্যব্যবস্থা appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%87%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a7%87-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%a6%e0%a7%87/
No comments:
Post a Comment