মুনশী নাঈম:
বাংলাদেশের নারী হাফেজরা অংশ নিচ্ছেন আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায়। শতাধিক দেশকে পেছনে ফেলে হয়ে উঠছেন নাম্বার ওয়ান। পুরো বিশ্বের সামনে তখন ভেসে উঠছে লাল-সবুজের পতাকা। বাংলাদেশের কপালে এসব হাফেজরা একে একে যুক্ত করছেন গৌরব ও গর্বের রঙিন পালক। তারা বলছেন, আমরা যখন সব দেশের প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে বিজয়ী হই, আমাদের নামের আগে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের নাম। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে লাল-সবুজের পতাকা। সবার চোখে থাকে জল। অদ্ভুত ঈর্ষা নিয়ে বিদেশিরা তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশি পতাকার দিকে।
সীমানা নেই নারী হাফেজদের
কোনো সীমানা নেই নারী হাফেজদের। তারা তাদের সুরের ডানায় ভর করে উড়ে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তর। শুধু উড়ে বেড়ানোই নয়, সব দেশের উচ্ছে তুলে ধরেন দেশের পতাকা। নিজের সবটুকু শ্রম দিয়ে ছিনিয়ে আনেন বিজেয়ের বরমাল্য।
হাফেজা ফারিহা তাসনিম ২০১৩ সালের ১৭ মে জর্দানের রাজধানী আম্মানে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল গার্লস হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রায় ৪৩টি দেশের হাফেজাদের পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ফারিহা মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসার ছাত্রী। একই মাদরাসার ছাত্রী হাফেজা রাফিয়া হাসান জিনাত ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘ফাতেমা বিনতে মোবারক’ আন্তর্জাতিক পবিত্র কোরআন প্রতিযোগিতায় ৮৩টি দেশের মধ্যে নবম স্থান অর্জন করেন। ২০১৬ সালে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন। এছাড়াও মাদরাসাটির আরও বিভিন্ন হাফেজা বিভিন্ন দেশে প্রতিযোগিতা করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে: হাফেজা শিফা হোসাইন (জর্ডান), আয়েশা বিনতে ইসলাম (ইরান), খাদিজাতুল কুবরা (ইরান)। খাদিজাতুল কুবরা এ বছরও ইরান প্রতিযোগিতায় অংশ করার জন্য নির্বাচিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাদরাসাটির পরিচালক হাফেজ নেসার আহমদ আন নাছিরী। তিনি জানান, গতকাল (১৯ সেপ্টেম্বর) ইসলামী ফাউন্ডেশন বায়তুল বায়তুল মুকাররমের বাছাইয়ে খাদিজা ইরানের জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
নেসার আহমদ আন নাছিরী আরও জানান, খাদিজাতুল কুবরার মা-ও বিশ্বজয়ী হাফেজা কারিয়া। তার নাম শামসুন্নাহার সিদ্দিকা। তিনি মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় ৭ বার তিনি চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ২০০৪ সাল থেকে টানা ২০০৯ সাল পর্যন্ত। সর্বশেষ ২০১৬ সালে। এর আগে ১৯৯৮ সালে হয়েছিলেন দ্বিতীয়। ইরানেও গিয়েছেন একবার।’
এদিকে ২০১৭ সালে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ৬৫টি দেশের নারী হাফেজদের পেছনে ফেলে ৫ম স্থান অর্জন করেন কারি সালামাত উল্লাহ পরিচালিত মারকাজুল হাফেজা ইন্টারন্যাশনাল হিফজ মহিলা মাদরাসার ছাত্রী হাফেজ আবিদা সুলতানা লিমা।
আন্তর্জাতিক হেফজ প্রতিযোগিতা বেশ সাফল্য দেখাতে পেরেছে ওয়ারীর সাউদা বিনতে জামআহ রা. আন্তর্জাতিক বালিকা মাদরাসার ছাত্রীরা। ২০০৭ সালে লিবিয়ায় অনুষ্ঠিত কোরআন প্রতিযোগিতায় ৯৬ টি দেশের প্রতিযোগিকে পেছেনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করেন এ মাদরাসার শিক্ষার্থী হাফেজ সাজেদা খাতুন। পরে ২০০৯ সালে জর্দানে অনুষ্ঠিত কোরআন প্রতিযোগিতায় তিনি ২য় স্থান অর্জন করেন। সাজেদা খাতুন ২০১৮ সালে ইরানে অনুষ্ঠিত কোরআন প্রতিযোগিতায় ৪র্থ স্থান অর্জন করেন।
২০১৭ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় ৭০টি দেশের প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ৪র্থ স্থান অধিকার করেন একই মাদরাসার ছাত্রী হাফেজ খাদিজা বিনতে আহসান মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ। ২০১৮ সালে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে অনুষ্ঠিত ১৩তম আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় ৫ম স্থান অধিকার করেন একই মাদরাসার ছাত্রী হাফেজ তাফরিহা বিনতে তাবারক। একই মাদরাসার ছাত্রী ওয়াহিদা হাফসা ২০১৯ সালে ১০তম স্থান অধিকার করেন দুবাই আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায়।
কথা হয় সাউদা বিনতে জামআহ রা. আন্তর্জাতিক বালিকা মাদরাসার পরিচালক মাওলানা ইসমাঈল হাসানের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘তার মাদরাসার হেফজখানায় ১৩০ জন ছাত্রী রয়েছে। এরমধ্যে ৫০ জন ছাত্রী হাফেজ। আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হলে আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক নির্বাচিত হতে হয়। এবারও তার মাদরাসার ছাত্রীরা বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগিতার প্রাক-বাছাইয়ে অংশ নিচ্ছে। তিনি আশা করছেন, এবারও তার মাদরাসা থেকে কেউ না কেউ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিবে।’
সাফল্য আসছে, জটিলতা কাটছে না
বিদেশের মাটিতে দেশের নাম উজ্জ্বল করলেও এসব হাফেজদের জাতীয় স্বীকৃতি নেই বলে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে বিভিন্ন জটিলতার মুখে পড়তে হয় বলে জানান শিক্ষকরা। সাউদা বিনতে জামআহ রা. আন্তর্জাতিক বালিকা মাদরাসার পরিচালক মাওলানা ইসমাঈল হাসান বলেন, ‘বাইরে যেতে বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়েও বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। সরকার যদি প্রতিযোগিদের সব ব্যবস্থাপনা নিজে করে দিত, তাহলে প্রতিযোগীদের জন্য সুবিধা হতো। দিনশেষে বিদেশের মাটিতে তারা কিন্তু বাংলাদেশের পাতাকাকেই উর্ধ্বে তুলে ধরে।’
হাফেজ নেসার আহমদ আন নাছিরী ফাতেহকে বলেন, ‘অন্যান্য দেশের হাফেজ যখন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হন, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের সঙ্গে দু’জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। একজন হাফেজদের কাগজপত্র রেডি করেন, আরেকজন বিদেশের মাটিতে তাদের সঙ্গে থাকেন। তাদের খাবার-দাবার, এমনকি প্রতিযোগিতার কোন দিন কোন পোশাক পরবে, তাও কর্মকর্তা নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু আমাদের এখানে উলটো। বিদেশে যাওয়ার জন্য যখন নির্বাচিত হয়, ভিসার কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই পড়াশোনা লাটে ওঠে।’
আক্ষেপ করে নেসার আহমদ আন নাছিরী বলেন, ‘হাফেজরা যখন বাইরের দেশে যেতে চায়, ভিসা-টিকিট নিয়ে তাদের দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। পড়াশোনায় তারা মন দিতে পারে না। পরে তারা যখন বিজয়ী হয়ে দেশে ফেরে, বিমানবন্দরে তাদের জন্য সামান্য সংবর্ধনাও দেওয়া হয় না। অথচ বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের একজন হাফেজ যখন বিজয়ী হয়, তার নাম কিংবা তার মাদ্রাসার নাম বলা হয় না। বলা হয় বাংলাদেশের কথা। তাই সরকারকে উদ্যোগী হয়ে দেশের নাম মহিমান্বিত করা হাফেজদের স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ছাত্র কেন দৌড়াদৌড়ি করবে। সরকার এর দায়িত্ব নেবে।’
শিক্ষকরা বলছেন, দেশকে যারা এমন ঈর্ষণীয় উচ্চতায় নিয়ে যান, তাদের জাতীয় স্বীকৃতি সময়ের দাবি। জাতীয় স্বীকৃতি ও সহযোগিতা পেলে আরও অনেকেই কুরআন প্রতিযোগিতায় উদ্বুদ্ধ হবে। আমাদের হাফেজদের যেহেতু আন্তর্জাতিক অঙ্গন স্বীকৃতি দিচ্ছে, তাদের এখন জাতীয় স্বীকৃতি প্রাপ্য।
The post আন্তর্জাতিক হেফজ প্রতিযোগিতা : বাংলাদেশি নারীদের ঈর্ষণীয় সাফল্য appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%b9%e0%a7%87%e0%a6%ab%e0%a6%9c-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%af%e0%a7%8b/
No comments:
Post a Comment