রাকিবুল হাসান নাঈম:
‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৌলিক আরবি ও ইসলামী শিক্ষা প্রসারে আমাদের দেশে মসজিদভিত্তিক মক্তব ব্যবস্থা একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু কালপরিক্রমায় শহরকেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষিত পরিবারগুলোতে আগের মতো এর গুরুত্ব নেই। তবে সচেতন মুসলিম মা-বাবারা সব সময় সন্তানের ইসলামের মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে চান। তাদের জন্য ইসলামিক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো হয়ে উঠছে ভরসার মাধ্যম।’
কথাগুলো বলছিলেন লালমাটিয়ার ওয়েটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রিন্সিপাল সৈয়দা বদরুন্নেছা ইসলাম। চলতি বছরের মে মাসে ওয়েটন স্কুলের অর্ধশত শিক্ষার্থীর হাফেজ হবার গল্প বেশ সাড়া ফেলেছিল গণমাধ্যমে। সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, ইসলামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলকে ধর্মীয় শিক্ষায় একটি নতুন উদ্যোগ বলা যেতে পারে। ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকেই এই স্কুলগুলোর প্রতি উচ্চশিক্ষিত পরিবারগুলোর আগ্রহ দিনদিন বাড়ছে। সন্তানকে মক্তবে পড়ানোর বদলে তারা ঝুঁকছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দিকে।
হাফেজ হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্ররা
যেসব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামিক শিক্ষাটা দিতে চান, তাদের মধ্যে অধিকাংশ স্কুলেরই হিফজ শাখা রয়েছে। এরমধ্যে চলতি বছর সাড়া ফেলেছে ওয়েটন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। ক্যামব্রিজ কারিকুলামের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটিতে জেনারেল সাবজেক্ট এর পাশাপাশি আরবি ভাষা এবং ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে পাঠদান করা হয়৷ স্কুলটিতে প্রতি সেকশনে সর্বোচ্চ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫ জন এবং হিফজ ক্লাসে শিক্ষক ও ছাত্রের অনুপাত সংখ্যা ১:৪। চলতি বছর হিফজ সম্পন্ন করেছেন এই স্কুলের অর্ধশত শিক্ষার্থী। হাফেজ হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৩ জন মেয়ে শিক্ষার্থীও রয়েছেন। হাফেজ হতে প্রতিজন শিক্ষার্থীর ২ থেকে আড়াই বছরের মতো সময় লেগেছে। এর মধ্যে কয়েকজন শিক্ষার্থী মাত্র এক বছরেই কুরআনের হাফেজ হয়েছে।
স্কুলের প্রিন্সিপাল সৈয়দা বদরুন্নেছা ইসলাম ফাতেহকে বলেন, ‘মূলত ক্লাসের স্বাভাবিক পড়াশোনা নিশ্চিত করে এর পাশাপাশি কোরআন হিফজের এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। কোরআন হিফজে আগ্রহীদের জন্য প্রতিদিন ভোরবেলা থেকেই রুটিন শুরু হয়। কোরআন হিফজের জন্য প্রতিদিন ফজর নামাজের পর দুই ঘণ্টা সময় পান শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও রমজান মাস ও শীতকালীন ছুটিসহ বিভিন্ন ছুটিতে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা কোরআন হিফজে সময় দেন বলে জানান তিনি।
২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এভেরোস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। এতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি রয়েছে ইসলামিক স্টাডিজ, অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ এবং হিফজুল কুরআন। প্রতিষ্ঠানটির এডমিন আরিফুল হাসান মীর সাগর ফাতেহকে বলেন, এ কয় বছরে তাদের স্কুল থেকে ৬০ জন ছাত্র-ছাত্রী হাফেজ হয়েছে। আগামি কয়েক মাসের মধ্যে আরও ৫০-৬০ জন হাফেজ হবেন।’ এই স্কুলে ছাত্র রয়েছে প্রায় দুই হাজার।
বেসিক আরবি বাধ্যতামূলক
ইসলাম বেইজড মিডিয়ামগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই বেসিক আরবি একটা স্তর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক। যেমন, এভেরোস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ক্লাস ফোর পর্যন্ত আরবি শেখা বাধ্যতামূলক।
স্কুলের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, লেকহেইড গ্রামার স্কুলে ক্লাস ওয়ান থেকে সেভেন পর্যন্ত সেকেন্ড লেঙ্গুয়েজ হিসেবে আরবি ল্যাঙ্গুয়েজ পড়ানো হয়। কিন্তু এইট থেকে টেন পর্যন্ত আরবি নেই।
সামাওয়াত ইসলামিক স্কুলে আরবি এবং ইসলামিয়াত ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত বাধ্যতামূলক। এরপর ও লেভেলে বিষয়টি ঐচ্ছিক; কেউ চাইলে বিষয়টি পড়তে পারে, চাইলে নাও পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন স্কুলের এডমিন মাকসুদা বেগম। তিনি জানান, ‘স্কুলটিতে ১৬০ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। শিক্ষক রয়েছেন ৩০ জন।’
আলেমদের তত্ত্বাবধানেও হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম
বিগত কয়েকে বছর ধরে আলেমদের তত্ত্বাবধানেও হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। ঢাকার উত্তরায় প্রবীণ ও নবীন আলেমদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিক্ষাবোর্ড EDEXCEL-এর শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ‘নর্থ পয়েন্ট স্কুল ঢাকা’। স্কুলটির সিলেবাসে আরবি ও হিফজুল কোরআনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ কারণে দ্বীনদার পরিবারের সন্তানদের এখানে ভর্তির জন্য আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর হামিদুর রহমানসহ উত্তরার বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসার চিন্তাবিদ গবেষক আলেমদের পরামর্শ ও সহযোাগিতায় ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে প্রতিষ্ঠানটি তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, জেনারেল কারিকুলামের মধ্যে কোরআনিক এরাবিক অন্তর্ভুক্ত। প্রথম শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত নিয়মিত এই সাব্জেক্টের লেসন নিলে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে নিজেই পবিত্র কোরআনের ইংরেজি অনুবাদ করতে পারবে। ছোট থেকেই তাওহিদের তালিম, দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় দোয়া, নামাজের নিয়ম এবং বিষয়ভিত্তিক হাদিস পড়ানো হয়। সন্তানের মেধা-মননে ইসলামিক তাহজিব-তামাদ্দুনের সক্রিয় প্র্যাকটিস করানো এবং একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে স্কুলটি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
শনির আখরায় ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তইরুল কুরআন মডেল মাদরাসা। এটি একটি আরবী ও ইংলিশ মিডিয়াম এ পরিচালিত মাদরাসা। এখানে আন্তর্জাতিক মানের হিফজের পাশাপাশি Play থেকে Standard 5 ( English-Medium ) সিলেবাস এ পরিচালিত হচ্ছে। মাদরাসাটির প্রতিষ্ঠাতা হাফেজ মাওলানা সাব্বিহুর রহমান বলেন, ‘এখানে স্কুলের ছাত্ররাই আসছে বেশি। যারা হয়ত মাদরাসায় পড়ত না, তারা এখানে ইংলিম মিডিয়ামের কারিকুলাম দেখে আসছে।’
ইসলামিক ইংলিশ মিডিয়ামের দিকে ঝোঁক কেন বেশি
ইংলিশ মিডিয়ামে মক্তব শিক্ষাটার অভাব পূর্ণ হওয়ার কারণে অভিভাবকরা এদিকে ঝুঁকছেন বলে মনে করেন সৈয়দা বদরুন্নেছা ইসলাম। তার মতে, সচেতন মুসলিম মা-বাবারা সব সময় সন্তানের ইসলামের মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে চান। জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাটাও গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন দেখবেন আপনার সন্তান স্কুলে পড়ছে, আবার হাফেজ হয়ে তারাবিও পড়াচ্ছে, আপনি আগ্রহী হবেন না?’
এ প্রসঙ্গে আরিফুল হাসান মীর সাগর বলেন, জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাটাও অভিভাবকরা দিতে চান। অনেকে শুধু মাদরাসায় পড়াতে চান না, সঙ্গে জাগতিক শিক্ষাটাও দিতে চান। ইংলিশ মিডিয়ামগুলো দুটো শিক্ষাই একসাথে দিচ্ছে। ফলে অভিভাবকরা এদিকে ঝুঁকছেন বেশি।
The post ‘ইসলামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’ : ধর্মীয় শিক্ষায় নতুন উদ্যোগ appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%bf-%e0%a6%87%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%b6-%e0%a6%ae%e0%a6%bf%e0%a6%a1%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%ae-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%95/
No comments:
Post a Comment