Sunday, September 25, 2022

‘বাড়ছে প্রাইভেট হেফজখানার গুরুত্ব’ : গরিবদের সুযোগ কমছে

রাকিবুল হাসান নাঈম:

বর্তমানে নানা কারণেই বাড়ছে প্রাইভেট হেফজখানার গুরুত্ব। খরচের পরিমাণ বেশি হলেও অভিভাবকরা এসব হেফজখানাকেই সন্তানদের জন্য নিরাপদ ও উপকারী ভাবছেন। সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, প্রাইভেট মাদরাসায় সাধারণ মাদরাসার তুলনায় শিক্ষা, আবাসন ব্যবস্থা এবং তত্ত্বাবধানের মান বেশি হবার কারণে অভিভাবকদের আগ্রহ দিনদিন বাড়ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই ধরনের প্রাইভেট হেফজখানা আছে। এক. যারা সম্পূর্ণ অনুদানমুক্ত। কেবল ছাত্রদের বেতনেই চলে। দুই. যারা অনুদান গ্রহণ করেন কিছু কিছু। ব্যাপকভাবে কালেকশন করেন না। প্রথম ধরণের মাদরাসায় একমাত্র সচ্ছল পরিবারের সন্তানরাই পড়তে পারে। আর দ্বিতীয় ধরণের মাদরাসায় পড়তে পারে অপেক্ষাকৃত কম সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা।

খরচ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে

বেতন, সার্ভিস চার্জ, খাবার সব মিলিয়ে প্রাইভেট হেফজখানার খরচ এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। পরিচালকরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে খরচ এখন আরও বেড়েছে। এই খরচ কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।

যাত্রাবাড়ির কুতুবখালিতে মাদরাসাতুল কোরআন আল ইসলামিয়া মাদরাসাটি পরিচালনা করেন হাফেজ মাওলানা তাওহিদ বিন আলী লাহোরী। মাদরাসাটি প্রাইভেট, ভাড়া বাড়িতে তার অবস্থান। এখানে হেফজখানার ছাত্রদের মাসিক খরচ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। তাওহিদ বিন লাহোরী ফাতেহকে বলেন, ‘বর্তমান চড়ামূল্যের বাজারে এই টাকাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু এরচে কম টাকা নিলে সেবার মান ঠিক থাকছে না। ছাত্রদের নির্বিঘ্নে পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে খরচ হয় প্রচুর।’

এ মাদরাসায় সাধারণত অনুদান নেয়া হয় না। ছাত্রদের বেতনেই চলে। তাই কেউ ভর্তি হতে এলে খরচ কূলাতে পারবে কিনা, জেনে নেয়া হয়। তবে অসচ্ছল আলেমের সন্তান হলে মাসিক খরচ কিছুটা কম রাখা হয় বলে জানান বিন লাহোরী।

মুহাম্মদপুরের আসসুন্নাহ কমপ্লেক্সে হেফজখানার ছাত্রদের মাসিক খরচ পাঁচ হাজার টাকা। তবে মাদরাসাটি কিছু কিছু অনুদান নেয়। ফলে এখানে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, যারা আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার খরচ বহন করতে পারবে, তারাও পড়তে পারে। এখানকার হেফজখানার প্রধান শিক্ষক হাফেজ মাওলানা খাইরুল আমিন ফাতেহকে বলেন, ‘নির্ধারিত পাঁচ হাজার থাকলেও অনেকেই আড়াই কিংবা তিন হাজার দেয়। যেহেতু টুকটাক অনুদান নেয়া হয়, তাই এ ছাড়টুকু দেয়া যাচ্ছে। নতুবা দেয়া যেতো না।’

এছাড়া কাজলার মাদরাসাতুল ইতকানে হেফজখানার একজন ছাত্রের মাসিক খরচ সাড়ে সাত হাজার টাকা। মাদরাসাটি কোনো অনুদান গ্রহণ করে না। এখানকার হেফজখানার প্রধান শিক্ষক হাফেজ জহিরুল ইসলাম ফাতেহকে বলেন, ‘অনুদান সম্পূর্ণ নিষেধ। আমাদের লিফলেটেও এ নিষেধাজ্ঞা লিখে দেয়া হয়েছে। সুতরাং, সব খরচ ছাত্রদের বেতন থেকেই বহন করতে হয়। ফলে বেতন একটু বেশিই।’ খরচ বহনের সামর্থ্য আছে কিনা জেনেই ছাত্রদের ভর্তি নেয়া হয় এখানে।

মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসার মাসিক খরচ সাধারণের ক্ষমতার বাইরে। জানা গেছে, মাদরাসাটির খরচ ব্যয়বহুল। ভিআইপি হলে প্রতিমাসে খরচ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। আর সাধারণ হলে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা।

প্রাইভেট হেফজখানার গুরুত্ব কেন বাড়ছে

আসসুন্নাহ কমপ্লেক্সের হেফজখানার প্রধান শিক্ষক খাইরুল আমিন বলেন, ‘অভিজ্ঞতায় যতটুকু দেখলাম, অভিভাবকরা ভালো একটা আবাসন ব্যবস্থাপনা চান। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ-মধ্যবিত্তরা। তারা নিশ্চিত করতে চান, আমার সন্তান ভালো একটা পরিবেশ পাচ্ছে, খাবার পাচ্ছে। প্রাইভেট হেফজখানাগুলো ভালো আবাসনব্যবস্থা দিচ্ছে, খাবার দিচ্ছে। ফলে এ ধরণের মাদরাসার প্রতি অভিভাবকদের আগ্রহ বাড়ছে। যেমন আমাদের ক্লাসরুম, ঘুমানোর রুম দেখলে সবারই ভালো লাগবে। দৈনিক খাবার দিচ্ছি পাঁচবেলা। তিনবেলা খাবার এবং দুই বেলা নাস্তা। অভিভাবক এ বিষয়গুলো খেয়াল করেন খুব।’

রাজধানীর প্রসিদ্ধ একটি মাদরাসার পরিচালক বলেন, প্রাইভেট হেফজখানার পড়াশোনা গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। পড়াশোনা দিয়েই মূলত হেফজখানাগুলো আলো ছড়াচ্ছে। যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হিফজ প্রতিযোগিতা এর বাস্তব প্রমাণ। প্রাইভেটের হাফেজরাই কিন্তু এসব প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়ে সম্মান বাড়াচ্ছে নিজের, দেশের। ফলে অভিভাবকরা এদিকেই বেশি ঝুঁকছে।

সাউদা বিনতে জামআহ রা. আন্তর্জাতিক বালিকা মাদরাসার পরিচালক মাওলানা ইসমাঈল হাসান ফাতেহকে বলেন, ‘প্রাইভেট হেফজখানাগুলো একটা লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। ফলে পড়াশোনায় তারা বেশি নাম করছে। নিবিড় তত্ত্বাবধান, সঠিক গাইডলাইন এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাঠদান—এসব হেফজখানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মাদরাসায় হেফজ শেষ করতে একটা ছেলের যে সময় লাগে, প্রাইভেট মাদরাসায় হেফজ করতে তারচেয়ে কম সময় লাগে। পাশাপাশি সঠিক তত্ত্বাবধানের কারণে, পড়াশোনার সার্বিক মান ও ইয়াদ থাকে বেশি। তাই অভিভাবকরা এখন প্রাইভেট মাদরাসা নিজেদের সন্তানদের জন্য ভালো মনে করেন।’

তাওহিদ বিন লাহোরির মাদরাসায় পড়াশোনা করছে কাতারপ্রবাসী আলেম মাওলানা নাজমুল হাসানের ছেলে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘আগে আমার ছেলে হোমনাতে এক মাদরাসায় পড়তো। গত তিন বছরে তার কোনো উন্নতিই হয়নি। মনে হয় কোনো লক্ষ্য নেই। কিন্তু ছেলেকে এখন প্রাইভেটে ভর্তি করিয়েছি। তিনমাসেই পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারছি। এখন ভাবছি, আরও আগে যদি এ মাদরসায় ভর্তি করাতাম, তাহলে আরও ভালো হতো।’

নারীদের জন্য প্রাইভেট হেফজখানা

অভিভাবকরা তাদের মেয়েকে হাফেজ বানানোর জন্য প্রাইভেট মাদরাসাকেই প্রথমে রাখেন বলে জানান সাউদা বিনতে জামআহ রা. আন্তর্জাতিক বালিকা মাদরাসার পরিচালক মাওলানা ইসমাঈল হাসান। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘নারী হেফজখানায় ছাত্রীদের চাপ খুব বেশী। কিন্তু মাঝেমধ্যে শিক্ষিকা সঙ্কটে পড়তে হয়। কারণ, যারা হাফেজ হচ্ছে, তাদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অনেকের স্বামী তাদেরকে পড়াতে দেয় না। কেউবা নিজেই মাদরাসা খুলছে। আমরা আমাদের নিজস্ব শিক্ষিকা দিয়ে পড়াচ্ছি।’

এখানে ছাত্রীদের মাসিক খরচ সাত হাজার টাকা। এর কমে কাউকে সুযোগ দেয়া যায় না জানিয়ে পরিচালক বলেন, ‘মাদরাসা যেহেতু অনুদানমুক্ত, ভাড়া বাসায়, ফলে খরচ সব ছাত্রীদের বেতন থেকেই মেটাতে হয়। ১০ জনের খাবার রান্না করলে একজন বেশি খাওয়ানো যায়। কিন্তু ১০ জনের জায়গায় ১১ জন ঘুমানো যায় না। তাই ভাড়া বাসা হলে খরচ কমে কাউকে সুযোগ দেয় যায় না।’

গরিবদের জন্য এসব হেফজখানায় পড়া দুঃসাধ্য হয়ে গেলো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই। তাদের সামর্থ্য নেই এই খরচ কূলানোর। কিন্তু গরিব ঘরের সন্তানরাই কিন্তু মেধার স্বাক্ষর রাখে বেশি। আমি পরীক্ষা করে ভালো পেলে সুযোগ দেই। যেন আমাদের টাকাটা বৃথা না যায়।’

তবে নারীদের জন্য কিতাবখানা অনেক থাকলেও হেফজখানা এখনও বেশ অপ্রতুল। শিক্ষিকা সঙ্কট এর বড় কারণ বলে উল্লেখ করেন মাওলানা ইসলমাইল হাসান।

The post ‘বাড়ছে প্রাইভেট হেফজখানার গুরুত্ব’ : গরিবদের সুযোগ কমছে appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a7%9c%e0%a6%9b%e0%a7%87-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%ad%e0%a7%87%e0%a6%9f-%e0%a6%b9%e0%a7%87%e0%a6%ab%e0%a6%9c%e0%a6%96%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment