রাকিবুল হাসান নাঈম:
বিশ্বজুড়ে হালাল পণ্যের কদর বাড়ছে। কদর বাড়ছে বাংলাদেশেও। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের অংশ বাড়াতে হালাল সনদ প্রদানের ক্ষমতাও বিস্তৃত হচ্ছে। এতদিন শুধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ সনদ প্রদান করেছে। গেল বছর থেকে হালাল পণ্যের সনদ দিচ্ছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। যদিও বিএসটিআইয়ের হালাল সনদ নিয়ে আপত্তি আছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে হালাল মার্কেট থেকে বাংলাদেশ আয় করেছে ১ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এরমধ্যে ৭০ শতাংশই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। দিনদিন বিশ্ব বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে হালাল সনদ অনেকটা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠছে এবং ক্রমাগত এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বের ফাইনান্স সেক্টরের ৬ শতাংশ শেয়ার রাখছে গ্লোবাল ইসলামিক ফাইনান্স। এর মূল্যমান ১.৯৯ ইউএস ট্রিলিয়ন ডলার। আর প্রতি বছর ১৪ শতাংশ করে বাড়ছে এই হার।
হালাল সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান
এতদিন শুধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ সনদ প্রদান করলেও গেল বছর থেকে হালাল পণ্যের সনদ দিচ্ছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। বিএসটিআই আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মিলে কাজ করতো। এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ডেপুটি-ডিরেক্টর ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী ফাতেহকে বলেন, ‘এতদিন আমরা বিএসটিআইয়ের সঙ্গে মিলে কাজটা করতাম। তারা আমাদের কমিটিতে ছিলেন। আমরা সর্বপ্রথম লক্ষ্য করতাম, পণ্যটিকে বিএসটিআই বাজারজাতের অনুমোদন দিয়েছে কি না। তারা যদি বাজারজাতের অনুমোদন দিত, তখন আমরা পণ্যটিকে হালাল সনদের বিবেচনায় আনতাম। অন্যথায় আমরা হালাল সনদ দিতাম না।’
তবে গেলো বছর নিজেরাই হালাল সনদ প্রদানের উইং খুলে বিএসটিআই। ইতোমধ্যে বিএসটিআই দুই পর্বে হালাল সনদ দিয়েছে। এ মাস থেকে তৃতীয় পর্বের সনদ প্রদান শুরু হবে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির সার্টিফিকেশন মার্কস উইংয়ের উপপরিচালক কে. এম. হানিফ। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘এ মাসেই আমাদের তৃতীয় পর্বের হালাল সনদ প্রদান শুরু হবে।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশন থাকতে বিএসটিআই কেন হালাল সনদ প্রদানের উদ্যোগ নিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু পণ্যের মান সনদ দিচ্ছি। পাশাপাশি আমরা যদি হালাল সনদ প্রণয়ন করি, তা হলে কোনো প্রতিষ্ঠান একই জায়গা থেকে দুটি সনদ পেয়ে যাবে; তাদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। ফলে দেশি এবং আন্তর্জাতিক উভয় বাজার সুফল পাবে। একটা পণ্য হালাল কিনা সেটি বিদেশিদের দেখার যেমন অধিকার রয়েছে আমাদেরও তেমন রয়েছে, আমরাও দেখব।’
হালাল সার্টিফিকেট বোর্ডে কারা কারা থাকেন
বিএসটিআইয়ের হালাল সার্টিফিকেট বোর্ডে ১৪ কমিটির সদস্য রয়েছেন। এরমধ্যে খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষি অধিদপ্তর, পানি সম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা রয়েছেন। শরিয়া দিকটি দেখার জন্য রয়েছেন দুজন শরিয়া এডভাইজর।
সার্টিফিকেশন মার্কস উইংয়ের উপপরিচালক রিয়াজুল হক ফাতেহকে বলেন, আমাদের শরিয়া বোর্ডে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক, তামিরুল মিল্লাতের শিক্ষক, কওমি শিক্ষাবোর্ডের আলেমগণ। প্রতি পর্বে আমরা নির্ধারণ করি, কারা বিষয়গুলো দেখবেন। মূলত যারা এক্সপার্ট, তাদেরকেই নিয়োগ দেই।
বিএসটিআইয়ের হালাল সার্টিফিকেট বোর্ডে মুফতি স্বল্পতার অভিযোগ করেছেন ইফার ডেপুটি-ডিরেক্টর ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘হালাল সার্টিফিকেট দেওয়ার অথরিটি তারা না। তারা পণ্যের গুণগত মান দেখবে, যেটা এতদিন করে এসেছে। তাদের বোর্ডে তেমন মুফতি নেই। দরকার হলে কাউকে ডেকে আনে। এভাবে তো চলে না।’ পক্ষান্তরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ডে দক্ষ মুফতিরা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কয়টি পণ্যে হালাল সনদ দেয়া হচ্ছে
বর্তমানে মোট পাঁচ জাতীয় পণ্যে হালাল সনদ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেশন মার্কস উইংয়ের উপপরিচালক কে. এম. হানিফ। পণ্যগুলো হলো:
১. খাদ্যপণ্য ও পক্রিয়াজাত পণ্য।
২. প্রাণীসম্পদ। এরমধ্যে মাংসজাতীয় জিনিসগুলো রয়েছে।
৩. মৎসজাতীয় পণ্য।
৪. প্রক্রিয়াজাত পঁচনশীল পণ্য।
৫. প্রসাধনী ও ফার্মাসিউটিক্যাল জাতীয় পণ্য।
কী প্রক্রিয়ায় হালাল সনদ দেয়া হয়
যেসব প্রতিষ্ঠান হালাল সার্টিফিকেট নিতে চায় তাদেরকে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন বা বিএসটিআই এর ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার থেকে ফরম নিতে হয়। ফরমে বর্ণিত আনুষঙ্গিক ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়।
ডকুমেন্ট জমা দেয়ার পর দুই স্তরে তদন্ত করা হয় বলে জানিয়েছেন বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেশন মার্কস উইংয়ের উপপরিচালক রিয়াজুল হক। তিনি ফাতেহকে বলেন, প্রথমে আমরা ডকুমেন্টস চেক করে কোম্পানিতে গিয়ে প্রাথমিক সার্ভে করি। কোনো কমতি দেখলে পুণরায় সব ঠিক করে আবার ডকুমেন্টস জমা দিতে বলি। দ্বিতীয়বার ডকুমেন্ট জমা দেবার পর আমরা কোম্পানিতে যাই, সবকিছু পর্যবেক্ষণ করি বিশেষজ্ঞ টিম নিয়ে। তারপর সচিত্র প্রতিবেদন কমিটির সামনে উপস্থাপন করি। কমিটি অনুমোদন দিলে সার্টিফিকেট দিয়ে দেই।
একই প্রক্রিয়ায় হালাল সনদ দেয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন। নিজেদের ল্যাবে সবকিছু পরীক্ষা করে তারা হালাল সার্টিফিকেট দেন বলে জানিয়েছেন ইফার ডেপুটি-ডিরেক্টর ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী।
দেশি প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
বাংলাদেশে যে দুটি প্রতিষ্ঠান হালাল সনদ দিচ্ছে, তারা উভয়ে আলাদাভাবে আন্তর্জাতিক হালাল সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে। সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি থাকলে ব্যবসায়ের সুবিধা। অনেক দেশ এখন হালাল সনদ চায়।
ওআইসির অধীন হালাল সনদ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্মিক (SMIIC)-এর স্বীকৃতি পেয়েছে বিএসটিআই। প্রতিষ্ঠানটির সার্টিফিকেশন মার্কস উইংয়ের উপপরিচালক রিয়াজুল হক ফাতেহকে বলেন, ‘আমরা স্মিকের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আমাদের কমিটিতে যে ১৪ জন সদস্য রয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে স্মিকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারা স্মিক-স্বীকৃতি অডিটর।’
আর ইসলামিক ফাউন্ডেশন স্বীকৃত মালয়েশিয়া ভিত্তিক হালাল সনদ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জাকিমের। জাকিম ইফার হালাল সনদ প্রদানকারী টিমকে মনিটরিং করে বলে জানান ইফার ডেপুটি-ডিরেক্টর ড. আবু সালেহ পাটোয়ারী। তিনি আজ (৫ সেপ্টেম্বর) ফাতেহকে বলেন, ‘আজও জাকিম আমাদের টিমের সব সদস্যের শিক্ষাগত যোগ্যতার যাবতীয় ডকুমেন্টস চেয়েছে। আজ পাঠাচ্ছি।’
জাকিম ছাড়াও সৌদি, তুরস্ক এবং ইন্দোনেশিয়ার হালাল সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চিঠি চালাচালি হচ্ছে বলেও জানান ইফার এই ডেপুটি-ডিরেক্টর।
স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের দাবি আলেমদের
তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের অধীন না থেকে হালাল সনদ প্রদানকারী স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন আলেমরা। তারা বলছেন, কেবল হালাল সনদ প্রদানের জন্যই আলাদা প্রতিষ্ঠান করা হোক। প্রতিষ্ঠান সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি। হালাল পণ্যের ক্রমবর্ধমান এই বাজারে এটা জরুরী বলেও জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ বিমানের খাদ্যসেবা (কেটারিং) দিচ্ছে যে প্রতিষ্ঠান, ২০১৫ সাল থেকে সে প্রতিষ্ঠানের হালাল সনদ দিচ্ছেন মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ। তিনি ফাতেহকে বলেন, বিভিন্ন দেশ এই প্রতিষ্ঠানকে হালাল সনদ দেখাতে বললো। তখনও বাংলাদেশে সনদ দেয়া শুরু হয়নি। তারা ইফার কাছে যায়। ইফা তাদেরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। আমি সার্ভে করে তাদেরকে হালাল সনদ দেই। সনদটা দুই বছরের জন্য দেই। দুবছর পরপর রিনিউ করি। সর্বশেষ দুতিনমাস আগে সনদ দিয়েছি।’
তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানকে সনদ দেবার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হালাল সনদের জন্য আমার কাছে ভীড় জমাতে থাকে। হালাল সনদ দেওয়ার জন্য অনেকে বিভিন্ন লোভতুর অফারও করতে থাকে। তখন আমি সনদ দেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেই। তাদেরকে বলি, ইফার কাছে যেতে।
হালাল সনদের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, সনদের জন্য মানুষ পাগল হয়ে যায়। অনেক লোভাতুর অফার দেয়। মন্ত্রণালয়ের অধীনে তাই এটা থাকা ঠিক না। তাদের বোর্ডে সেই দক্ষ আলেমও থাকে না। তাই আমার দাবি, সরকার হালাল সনদ প্রদানের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করুক। যেমন জাকাত বোর্ডে দেশের বিজ্ঞ আলেমগণ রয়েছেন, তেমনি হালাল সনদ প্রদানকারী বোর্ডও বিজ্ঞ আলেমদের রাখতে হবে।কিংবা সরকার না করলেও বেসরকারী কোনো প্রতিষ্ঠানও করতে পারে।’
The post বাংলাদেশে হালাল সার্টিফিকেশনের অগ্রগতি কতদূর? appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b2-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a6%bf%e0%a6%ab%e0%a6%bf/
No comments:
Post a Comment