আবদুল্লাহিল বাকি:
ইসলামের ইতিহাস মানেই ঈমান, আমল, আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠা ও নবীদের প্রতি অটুট বিশ্বাসের ইতিহাস। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে কখনোই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্যের শৃংখল ভেঙে ফেলার ঘোষণা আসেনি। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যাপকভাবে দায়বদ্ধ ছিল আল্লাহর প্রেরিত দীনের কাছে। ব্যক্তিজীবনেও এর প্রভাব ছিল গভীর। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে মুসলিম পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে জীবন-যাপন করার পরও, কিছু কিছু মানুষ অবিশ্বাসের অন্ধকারে পা বাড়ায়। জীবনে ঠাঁই দেয় নাস্তিকতা, জানদাকা, অজ্ঞেয়বাদ প্রভৃতি।
এটা মূলত একটা মানসিক ও সামাজিক ব্যাধি, নিছক বুদ্ধিবৃত্তিক কোন প্রকল্প নয়। প্রত্যেক সভ্যতার অন্ধকার এক কোণে নাস্তিকতার দেখা মেলে। অবিশ্বাসীদের কোন স্থান নেই ইসলামে। তবুও শিরোনামে ‘মুসলিম ইতিহাস’ বলা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে; ব্যক্তির বিশ্বাসকে সামনে রেখে নয়।
প্রত্যেক সভ্যতায় নাস্তিকতার দেখা মিললেও, প্রকার ও ধরণে বিস্তর ফারাক দেখা যায়। সেই সভ্যতার প্রকৃতি খোদ নাস্তিকতার মধ্যেও ক্ষীণভাবে প্রভাব বিস্তার করে। পাশ্চাত্য সভ্যতার নাস্তিকতার নিনাদ আমরা শুনতে পাই নীটশের জবানিতে, যখন তিনি বলেন— “ঈশ্বর মৃত্যুবরণ করেছে।” এই নাস্তিকতার ধরণ যতটা উদ্ধত, তারচেয়ে ঋজু স্বরে গ্রীক সভ্যতা উচ্চারণ করেছে— “দেবালয়ে অবস্থানরত উপাস্যরা মারা গিয়েছে।” অন্যদিকে আরব সভ্যতায় যারা নাস্তিক হয়ে গিয়েছে, তাদের মাঝে দেখা যায়, তারা কখনোই এক আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেনি। বরং অস্বীকার করেছে নবুয়ত ও রিসালাত এবং এর কার্যকারিতা।
আরব সভ্যতায় আল্লাহ অস্তিত্বের ধারণা এতটা আবশ্যকীয় একটা উপাদান ছিল যে, ধর্ম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যও এটাকে কেউ অস্বীকার করতে পারত না। ধর্মের শৃংখল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তারা অস্বীকার করতো নবুওয়াত ও রিসালাতের কার্যকরিতা। আল্লাহ এবং বান্দার মাঝে হেদায়েতের বাণী প্রচার মাধ্যম ছিলেন নবী রাসূলগণ। তাদেরকে অস্বীকার করলে, সহজ হয়ে যেত আল্লাহর আনিত বাণী প্রত্যাখ্যান করা। এভাবেই তারা নবুওয়াতের অস্বীকারের মাধ্যমে আল্লাহর শৃংখল থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করে নিত।
মুসলিম বিশ্বে গ্রীক, পারস্য, ভারত, রোমানের জ্ঞান-বিজ্ঞান যখন আরবি ভাষায় অনূদিত হতে লাগল, তখন থেকেই মুসলিম ইতিহাসে নাস্তিকতা ও জানদাকার সিলসিলা শুরু হয়। তবে মুসলিম খলিফা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা খুঁজে খুঁজে জিন্দিকদেরকে বের করতে থাকে। তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় অনেককে। তাদের মধ্যে রয়েছে আরবের বিখ্যাত সাহিত্যিক ইবনে মুকাফ্ফা, যিনি পন্ডিত বিদ্যাপতির ‘পঞ্চতন্ত্র’ অনুবাদ করেছিলেন ফার্সি থেকে।
তবে নাস্তিকদের দমনের ক্ষেত্রে শাসকদের মাঝে যতটা না ধর্মীয় কারণ কার্যকর ছিল, এর চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক কারণ। এজন্যই আমরা দেখতে পাই, রাষ্ট্রের বিষয়ে বিদ্রোহমূলক কথা বলে না, এমন নাস্তিকদেরকে সাধারণত গ্রেফতার করা হতো না। যেমন ইবনে রাওয়ান্দী। তিনি মুসলিম সভ্যতায় প্রসিদ্ধ একজন নাস্তিক। রাষ্ট্রের বিষয়ে নাক না গলিয়ে নিজের মতো তিনি লিখে গিয়েছেন। অথচ তার লেখালেখি ও চিন্তাধারা ইবনে মুকাফ্ফার থেকেও মারাত্মক। কিন্তু ইবনে মুকাফ্ফা বিদ্যমান রাষ্ট্র বিষয়ে বিদ্রোহমূলক মন্তব্য প্রদান করতেন। তাছাড়া তার অনূদিত ‘কালিলা ওয়া দিমনা’ গ্রন্থটিকে সুলতান স্বাভাবিক উপদেশ হিসেবে না নিয়ে রাষ্ট্রের বিষয়ে নাক গলানো হিসেবে দেখেছেন।
মুসলিম ইতিহাসে নাস্তিক জিন্দিকরা অত্যন্ত গৌণ। অন্যদিকে তাদের অনেকেই গুমনাম থেকে জ্ঞান চর্চা করত এবং নিজস্ব আকিদা বিশ্বাস প্রচার করত; যেমন, ইখওয়ানুস সাফা সংঘ। তাদের দলে কারা ছিল, ইতিহাসে লিপিবদ্ধ নেই। শুধু তাদের লিখিত বইয়ের খণ্ডগুলো এখনো রয়ে গেছে। অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করে, তাদের দলের সদস্যদের নির্ধারণ করে। তাও সেটা পরিপূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য নয়। এসব কারণে নাস্তিকদের নাম মুসলিম ইতিহাসে ততটা দেখা যায় না। তাই এখানে এমন কয়েকজন নাস্তিকের কথা তুলে ধরব, যারা নাস্তিকতার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।
ইবনে রাওয়ান্দী: যুগের প্রসিদ্ধ নাস্তিক
উমাইয়া সালতানাতের শেষ দিকে ইসলামী বিশ্বে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপস্থিতিতে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। সামাজিক জীবনে এর গভীর প্রভাব পড়ে। আব্বাসি যুগের প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে নতুন ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের সূচনা হয় মুসলিম বিশ্বে। ইসলামী জ্ঞান ও শাস্ত্রগুলোর পাশাপাশি চিন্তাগত জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও উৎকর্ষ ঘটে এই সময়ে। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরী শতকে আরব বিশ্বে নাস্তিকতার ধারা শুরু হয়। আবুল হুসাইন আহমাদ বিন ইয়াহিয়া বিন ইসহাক রাওয়ান্দী ছিলেন তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধ নাস্তিক।
ইবনে রাওয়ান্দীর প্রসিদ্ধ পুস্তক ছিল ‘আয-যামাররাদ’। এই গ্রন্থে তিনি ইসলামের অন্যতম একটি রুকন- নবুওতের প্রতি দুর্বীনিত প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। নবী-রাসূলগণ তার মতে মন্ত্র-তন্ত্রের যাদুকর ছাড়া আর কিছু নন। নবুওত সম্পর্কে এই গ্রন্থে তিনি বলেছেন, “নবী যা বুঝেন, সাধারণ মানুষ কেন তা বুঝবে না? নবী যদি ইলহামের মাধ্যমে বুঝতে পারেন, তাহলে সাধারণ জনগনও ইলহামের মাধ্যমে বুঝবে।” তার মতে, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেই দীন নিয়ে এসেছেন মানুষের কাছে—তা আকলের বিরোধী। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে নামাজ, হজে পাথর নিক্ষেপ, কাবাঘর প্রদক্ষিণ করা ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন। বিশ্বজগৎকে ঘিরে মানুষের জ্ঞানের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন— “মানুষ নিজেই এসব সম্পর্কে ভাবতে পারে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সামগ্রিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে এসব সম্পর্কে। এই জ্ঞানের জন্য আম্বিয়াদের কোন প্রয়োজন নেই।”
তার কল্পিত আকলকে মানদণ্ড বানিয়ে তিনি ইসলামী শরিয়ার সমালোচনা করেছেন, আকলকে স্থান দিয়েছেন নকলের উপরে। আল্লাহর নবীর নামে যেসব মোজেজার ঘটনা সাব্যস্ত হয়ে আছে ইতিহাসে ও হাদিসে, সেগুলো খণ্ডন করার বৃথা প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি। বদরের যুদ্ধের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “তোমাদের ইতিহাস অনুযায়ীই, ফেরেশতারা সংখ্যার আধিক্য সত্বেও শক্তির দিক থেকে দুর্বল। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের শক্তি ও তাদের শক্তি মিলে কেবলমাত্র সত্তরজন মানুষকেই হত্যা করতে পারলো। এর বেশি নয়।” এরপর নিয়ে আসেন তিনি ওহুদ যুদ্ধের প্রসঙ্গ। বলেন— “ওহুদের দিবসে ফেরেশতারা কোথায় ছিল, যখন পেছন ফিরে যাচ্ছিলেন নবী?”
এমন ঈমানবিধ্বংসী ও কুফুরি কথা বলার পরও, তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্দী করা হয়েছে অথবা শাস্তি দেওয়া হয়েছে—এমন কোন কথা ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় না। ৩০০ হিজরীতে আশি বছর বয়সে তিনি মারা যান।
ইবনে রাওয়ান্দী শুরুতে মুতাজিলা ছিলেন। পরবর্তীতে হয়ে যান শিয়া। এরপর একেবারেই বের হয়ে যান ধর্ম থেকে। তার গ্রন্থাবলীর উপর অনেকেই খণ্ডনমূলক গ্রন্থ লিখেছেন। যেমন, খাইয়াত লিখেছেন ‘আন-ইনতিসার ওয়ার-রদ আলা ইবনি রাওয়ানদি আল-মুলহিদ’।
চিকিৎসক আবু বকর রাযী: আল্লাহর প্রতি ঈমান, নবী-রাসূলকে অস্বীকার
আবু বকর রাযীকে মুসলিম ইতিহাসের প্রথম সারীর একজন চিকিৎসক ও রসায়নবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু তার জীবনের আরেকটা দিক আছে, যে সম্পর্কে সাধারণত আলোকপাত করা হয় না। সেটা হল তার চিন্তাগত ও দার্শনিক দিক। নবুওয়াত-তত্ত্ব নিয়ে তার বক্তব্যগুলো দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি নবুওয়াতে মোটেও বিশ্বাস করতেন না। কিছু ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেচনাকে সামনে রেখে তিনি নবুওয়াতের সমালোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। তার যুক্তি ও বক্তব্য অনেকটা ইবনে রাওয়ান্দীর মতই। তিনি বলেছেন— “ভাল-মন্দ জানা ও বোঝার জন্য আকলই যথেষ্ট। সুতরাং এখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-রাসূল প্রেরণের কোনই আবশ্যকীয়তা নেই।” তবে আবু বকর রাযী আর ইবনে রাওয়ান্দীর মধ্যে কিছু জায়গায় ভিন্নতা আছে। নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকেই ইবনে রাওয়ান্দী আকলের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন। সেখানে টেনে আনেন না আল্লাহর কথা। অন্যদিকে আবু বকর রাযী বলেন— “আমরা আকলের মাধ্যমেই জানতে পারি আল্লাহর পরিচয়। সুতরাং নৈতিকতা ও আল্লাহর পরিচয় জানার জন্য আর নবুওয়াতের জরুরত থাকে না। তাছাড়া নবুওয়াত হল বুদ্ধি-বহির্ভূত একটা ধর্মীয় কতৃত্ব।”
এখানেই থেমে থাকেনি আবু বকর রাযী। আবু হাতেম রাযীর সাথে বিতর্কের সময় অন্যান্য বিবেচনার উপর নির্ভর করে নবুওয়াতের বিষয়ে আপত্তি করার ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছেন। আবু বকর রাযী বলেছেন— “কিভাবে আল্লাহ কিছু মানুষকে কিছু মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিতে পারেন? এই বিভক্তির কারণে কি সাম্যের লঙ্ঘন হয় না?” আবু হাতেম রাযী তার এই কথার জবাবে বলেছিলেন— “প্রত্যেক জাতি, ধর্ম, দেশ ও গোত্রে স্তরভেদ ও কিছু মানুষের উপর কিছু মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত ও স্বাভাবিক একটা বিষয়। এখানে অসম্ভাব্যতার কিছু নেই।”
আবু বকর রাযী প্রভাবিত ছিলেন গ্রীক দর্শনে। বিশেষভাবে প্লেটোর জ্ঞানতত্ত্ব ও শিক্ষাদর্শন দ্বারা তিনি প্রভাবিত ছিলেন। প্লেটোর অনুসরণে তিনিও বলেছেন— “শিক্ষা হলো মানুষের মাঝে প্রাকৃতিকভাবে যে যোগ্যতা রয়েছে, সেটার পরিস্ফুটন। প্রত্যেক ব্যক্তির যদিও জ্ঞান ও মেধার তারতম্য আছে, তবুও সবাই ইজতিহাদ ও কর্মের মাধ্যমে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।”
আবু বকর রাযীর বেশ কিছু গ্রন্থে নবুওয়াত-তত্ত্ব সম্পর্কে অস্বীকারমূলক কথাবার্তা আছে। যেমন ‘মাখারিকুল আম্বিয়া’। সেখানে তিনি নবী-রাসূলগণের শরীয়তের পার্থক্য দেখিয়ে, এর অকাট্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। বলেছেন তিনি— “রাসূলদের পারস্পারিক কথাই মতভেদে পরিপূর্ণ। মুসা বলেন, আল্লাহর কোন পুত্র নেই। ঈসা বলেন, আমি আল্লাহর পুত্র। মোহাম্মদ বলেন, আমি সবার মতোই আল্লাহর একজন বান্দা। অন্যদিকে মোহাম্মদ বলেন, ঈসাকে হত্যা করা হয়নি বরং তাকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বলে, ঈসাকে ক্রুসে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আল্লাহ হলেন একজন। যদি নবুওয়াত সত্যি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হত, তাহলে নবীদের মাঝে এত মতবিরোধ কেন।”
নবুওয়াতের সমালোচনা থেকে আবু বকর রাযী সকল ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন। তার কোন গ্রন্থে সরাসরি আল্লাহর একত্বকে অস্বীকার করার উদৃতি পাওয়া যায় না। কিন্তু আল্লাহর অস্তিত্বের যে দাবি, অর্থাৎ নবী-রাসূলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের হেদায়েত প্রদান—সেটা অস্বীকার করেন তিনি। তার মতে, হেদায়েতের জন্য আকলই যথেষ্ট। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, তিনি তার এই চিন্তাধারাগুলো প্রকাশ্যেই প্রচার করতেন, লিখতেন বইপত্র। নাস্তিকতামূলক বক্তব্যের দরুন তাকে কখনোই ইসলামী সালতানাতের শাস্তিতে পড়তে হয়নি—যা খুবই আশ্চর্যজনক।
সকল কিছুর উপর বিতৃষ্ণ দার্শনিক.. আবুল আলা মাআররী
“যদিও আমি এসেছি শেষ যামানায়
কিন্তু এমন কিছু নিয়ে এসেছি—
যা আনতে পারিনি পূর্ববর্তীরা”
এটা আবুল আলা মাআররীর একটি কবিতা। আরেকটি কবিতায় তিনি বলেছেন—
“ঈসা এসে বাতিল করে দিয়েছেন ধর্ম। মোহাম্মদ এসেছেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে। বলা হয়, এরপর নাকি আরেকটা আসমানী ধর্ম আসবে। এভাবেই মানুষ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে।”
আবুল আলা মাআররী তার বিভিন্ন কবিতায় নবুয়তের বিষয়ে আক্রমণ করেছেন। তিনি মনে করেন, শরীয়ত মানুষের মাঝে হিংসা ও শত্রুতা বৃদ্ধি করে। নবুয়ত সৃষ্টি করে যুদ্ধবিগ্রহের। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন— “শরীয়ত আমাদের মাঝে শত্রুতা বৃদ্ধি করেছে। রোমান নারীদেরকে দাসি বানানো বৈধ করে দিয়েছে আরবদের জন্য। এগুলো হতে পেরেছে একমাত্র নবুওয়তের মাধ্যমে।”
সাহিত্যিক তহা হুসাইন ‘তারিফুল কুদামা বি-আবিল আলা’ গ্রন্থে তার কবিতা সম্পর্কে বলেছেন— “আবুল আলা মাআররীর কবিতা থেকে যতটুকু বোঝা যায়, তিনি সকল ক্ষেত্রে আকলকে মানদণ্ড মানতেন। এজন্য তার মাঝে নাস্তিকতা ও সংশয়বাদের একাংশ পরিলক্ষিত হয়। যদিও তিনি নিছক আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি ঈমান রাখতেন। তার এমন কিছু কবিতা রয়েছে, যা থেকে বোঝা যায়, তিনি ধর্ম থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। সকল ধর্মের তুলনা করে সবগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিয়েছেন।”
আবুল আলা মাআররী যেসব বিষয়ের মধ্যে সন্দেহ পোষণ করতেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো পুনরুত্থান। এছাড়াও তিনি ছিলেন নিরামিষভোজী। বৈধ গোশত আহার করাকে তিনি হারাম মনে করতেন। এক্ষেত্রে তিনি ভারতীয় দর্শনে প্রভাবিত হয়ে থাকবেন। কারণ, গৌতম বুদ্ধের মত তিনিও বলতেন— “জীবহত্যা মহাপাপ”।
তিনি একদিকে অন্ধ ছিলেন, অন্যদিকে শেষবার বাগদাদ থেকে ফিরে আসার পর, আর কখনোই ঘর থেকে বের হননি। চুপচাপ বসে থাকতেন। এক কবিতায় তিনি বলেছেন— “আমার ছাত্ররা চায়, আমি একটু মুখ খুলি। কিন্তু নিশ্চুপ থাকতেই আমি অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।” নাস্তিক হলেও তিনি দুনিয়ার ভোগ বিলাসে ডুবে যাননি অথবা সুলতানের দরবারে যাননি টাকা পয়সার জন্য। নিজের জীবনকে তিনি পদে পদে কষ্ট দিতেন। আর তার সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা একমত যে, তিনি একজন দুনিয়াবিমুখ নাস্তিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পাশ্চাত্যের এক সাহিত্য-সমালোচক বলেছেন, তার লিখিত ‘রিসালাতুল গুফরান’ থেকেই ইতালির বিখ্যাত সাহিত্যিক দান্তে ‘ডিভাইন কমেডি’ গ্রন্থটি লেখার প্রেরণা পেয়েছেন।
তাকেও নাস্তিকতা প্রচারের দায়ে, আব্বাসি খিলাফতের পক্ষ হতে গ্রেফতার করা হয়নি। মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন, আমার কবরের উপর যেন লেখা থাকে— “এটা আমার উপর আমার পিতার অপরাধ। আমি কারো প্রতি অপরাধ করিনি।”
এই বাক্যের অর্থ হলো, তিনি মনে করতেন— বিয়ে করা, সন্তান জন্ম দেয়া সেই সন্তানের উপর পিতার অবিচার। কারণ, এর দরুন সেই সন্তান দুনিয়াতে অনেক দুঃখ কষ্ট ও বেদনার সম্মুখীন হয়। এগুলোর মূল কারণ আবুল আলা মাআররী মনে করেন পিতা। তাই তিনি কখনোই বিয়ে করেননি এবং কোন নারীর সাথে মিলিত হননি।
তারা ছাড়াও ইসলামী ইতিহাসে আরো কয়েকজনের ব্যপারে নাস্তিকতার অভিযোগ ছিল। কিন্তু তা ততটা স্পষ্ট না, কিছু কিছু লেখা ও বক্তব্যের ব্যাখ্যাসাপেক্ষিকতার দরুণ। বিচ্ছিন্নভাবে ইসলামী সালতানাতে নাস্তিকতার অস্তিত্ব থাকলেও ব্যপক চর্চা ও প্রসার কখনোই ছিল না। নাস্তিকতার বিস্তৃতি হয় মুসলিম বিশ্বে, মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ও শাহ রেজা খান প্রমুখ ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে। সুন্নি বিশ্বে নাস্তিকতা প্রসারিত হয় মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের মাধ্যমে আর শিয়া বিশ্বে শাহ রেজা খানের মাধ্যমে। মুসলমান শিক্ষিতদের মধ্য থেকে পাশ্চাত্য চিন্তা-ভাবনায় প্রভাবিত একটা শ্রেণী গড়ে উঠে। নাস্তিকতার বিস্তৃতি হলেও মুসলিম সমাজে সামগ্রিকভাবে পাশ্চাত্যের মত নাস্তিকতার প্রসার হয়নি। কারণ, মুসলিম বিশ্বের ব্যক্তি মাত্রই পরিবার ও সমাজের সাথে সংযুক্ত। এটা ব্যক্তির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
বর্তমানে বিশুদ্ধ ঐশি জ্ঞান ও সঠিক পদ্ধতিতে জ্ঞানের চর্চার মাধ্যমেই নাস্তিকতার বিস্তার রোধ করা সম্ভব।
তথ্যসূত্র:
১. শামসুদ্দিন ইবনে খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল আয়ান ওয়া আনবাউ আবনাইয যামান
২. আবদুর রহমান বাদাভী, মিন তারিখিল ইলহাদ ফিল ইসলাম
৩. তহা হুসাইন, তারিফুল কুদামা বি-আবিল আলা
The post মুসলিম ইতিহাসে নাস্তিকতার ধারা appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%87%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%87-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a6%a4%e0%a6%be/
No comments:
Post a Comment