মুজাহিদুল ইসলাম :
ইসলামি ইতিহাসের রহস্যময় ব্যক্তি ইবনে রাওয়ান্দী। তিনি বিভিন্ন আলোচনা ও লেখনীতে তার বেপরওয়া চিন্তাকে ঔদ্ধত্যের সাথে প্রকাশ করেছেন। যা ইতিহাসের হাসির খোরাক হিসেবে সকলের বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই রহস্যপুরুষের আদর্শ ও তার কারণ, তার সমালোচক ও সমর্থক এবং বিশাল রচনাসম্ভারের প্রতি কিছু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এ লেখায়।
ইবনে রাওয়ান্দীর আদর্শ
সকলের নিকট আহমদ বিন ইয়াহইয়াহ রাওয়ান্দী নামে পরিচিত মো’তাজিলি মতাদর্শের অনুসারী এ বহুরুপী মানুষটির জন্মের নির্ধারিত কোনো তারিখ ঐতিহাসিকগণ দিতে পারেননি। ইরাকি ইতিহাস-গবেষক আব্দুল আমীর ইবনে রাওয়ান্দীর জীবনী রয়েছে এমন ৭৪ বই পর্যালোচনার পর এই তথ্য প্রদান করেন। তবে তিনি বাগদাদে আগমনের পূর্বজীবন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ঐতিহাসিক যাহাবি তার উল্লেখযোগ্য তিনজন শিক্ষক ইসা বিন হায়সাম (মৃ: ২৪৫) আবু ইসা ওররাক (মৃ: ২৪৭) ও আবু হাফস হাদদাদের (মৃ: ২৫২) কথা উল্লেখ করেছেন। তাদের প্রত্যেকেই মো’তাজিলি দর্শনের দিকপাল ছিলেন।
মো’তাজিলি দর্শনের সাথে ইবনে রাওয়ান্দীর সম্পর্ক হিরো হতে জিরোর মতো। প্রথমে তিনি ছিলেন এ আদর্শের নিবেদিত কর্মী। তাদের সমর্থনে বইপত্রের রচয়িতা। কিন্তু আদর্শবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে মতাদর্শ হতে বিতাড়িত করা হয়। তার প্রতিপক্ষ আবুল হুসাইন খায়য়াত বলেন, ‘তিনি আমাদের অনুসারী ছিলেন। আমাদের মজলিসে আসা-যাওয়া করতেন।’ মো’তাজিলা থেকে ইবনে রাওয়ান্দীর বিতাড়ন প্রসঙ্গে খায়য়াত তার রচিত বইয়ে বলেন, ‘মু’তাজিলারা তাকে বিতাড়িত করেছে। কারণ, তিনি হাসান বিন আলী ও আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সমালোচনা করতেন। তিনি তার বইয়ে রাসূলদের সমালোচনা, বিশেষ করে মুহাম্মাদ সা. এর সমালোচনায় বিশেষ অধ্যায় বরাদ্দ রাখেন।’
ইবনে রাওয়ান্দীর সমালোচনা
মো’তাজিলিরা তাদের সমালোচকদের কোনোভাবে সহ্য করতো না। হোক না তারা তাদের আত্মীয়। আদর্শচ্যুতির মাত্রানুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতো। খোদ ইবনে রাওয়ান্দীর চাচা ও ভাই মো’তাজিলি ছিল। তবুও বিতাড়ন বন্ধ করা যায়নি। মো’তাজিলি নেতা সামামাহ খলিফা মামুনের নিকট তাদেরই অনুসারী আসামের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কিন্তু আলী রা. এর প্রতি কিছুটা ঝুঁকে যাওয়াতে তাদের একনিষ্ঠ কর্মবলয় থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়। ইবনে রাওয়ান্দীর বিশিষ্ট তিন শিক্ষক মো’তাজিলির দিকপাল হওয়া সত্বেও তাদের দ্বারা কাফির ফতওয়ার লকব পান। যাদের দ্বারা তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত।
মো’তাজিলা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তিনি তার জ্ঞানগরিমার সবকিছু মো’তাজিলাদের বিপক্ষে ব্যয় করেন। আবুল হাসান আশআরী ও খায়য়াত বলেন, ইবনে রাওয়ান্দী মো’তাজিলিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে রাফিদীদের আস্থা অর্জন করেন। তাদের নিয়ে কিতাব রচনা করেন। চারপাশের যুবকদের তার চিন্তা দ্বারা প্ররোচিত করেন। তাদের মাঝে ধীরে ধীরে কুফর ও নাস্তিকতা বেশ জোরালোভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করে।
দ্বিধাগ্রস্থ দৃৃষ্টিভঙ্গি ও তার সমালোচক চরিতকারদের মতে ইবনে রাওয়ান্দী কখনো এক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর স্থির থাকতে পারেননি। তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিকট তাদের দর্শানুসারে অর্থের বিনিময়ে বই লিখে দিতেন। ঐতিহাসিক সাফাদী ইবনুল কাসের সূত্রে বলেন, ‘ইবনে রাওয়ান্দী চারশত দিরহামের বিনিময়ে ইহুদিদের জন্য ইসলামের খণ্ডনে “বাছিরাহ” নামক কিতাব রচনা করেন। অর্থ নেয়ার পর আরো দুইশত দিরহাম না দেয়া পর্যন্ত ইসলামের খণ্ডন যথাযথভাবে না করার হুমকিও দেন।’ ঐতিহাসিক ইবনুল মুরতাযা বলেন, ‘তিনি ইহুদি, খ্রিস্টান এবং অগ্নিপূজকদের জন্য কিতাব রচনা করেছেন। বলা হয় ত্রিশ দিনারের বিনিময়ে রাফিদীদের ইমামতের জন্য বই রচনা করেছিলেন।’
মো’তাজিলি ব্যক্তিরাই ইবনে রাওয়ান্দীর প্রতি বিরাগভাজন হয়ে তার অতিরঞ্জিত সমালোচনা করেছেন এমন নয়, বরং আশআরি, হাম্বলি, যাহেরি, শিয়া ইমামিয়্যাহ ও ইসমাইলিয়্যাহগণ তাদের শত মতভিন্নতা সত্বেও তাকে নাস্তিক বলতে একমত পোষণ করেন। অনুসন্ধানী ঐতিহাসিক ইবনু হাজার তাকে প্রসিদ্ধ খোদাদ্রোহী বলে অভিহিত করেছেন। যাহাবির মতো ব্যক্তি বলেন, ‘আমার কিতাবে তাকে অভিসম্পাত দেয়ার জন্য উল্লেখ করেছি।’ ইবনুল জাওযি ইসলামের তিনজন নাস্তিকের মধ্যে ইবনে রাওয়ান্দীর কথা উল্লেখ করেন।
ইবনে রাওয়ান্দীর সমর্থক
অবশ্য ইবনে রাওয়ান্দী ও তার অনুসারী নাস্তিক খেতাবপ্রাপ্তদের পক্ষাবলম্বনেরও লোক আছে। কেউ কেউ তাদেরকে নাস্তিক্যবাদের অভিধা হতে মুক্ত করার প্রয়াস নিয়েছেন। যেমন ইবনু আসাকির, তাজুদ্দিন সুবকি এবং আব্দুল আজিজ মায়মানি ও মাহমুদ শাকির। ইবনু খাল্লিকান ইবনে রাওয়ান্দীকে বিখ্যাত আলিম ও যুগের সেরা ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার বইপত্রকে অভিশপ্ত বললেও তার কোনো ধরনের নাস্তিকতার কথা তিনি উল্লেখ করেননি। যদিও ইবনু কাছিরসহ অন্যান্যরা খাল্লিকানের এ অবস্থানের সমালোচনা করেছেন। তার এই অবস্থানের জন্য অনেকে তার দরিদ্র ও মানসিক বিকারগ্রস্থতার দাবি করেন। কেউবা নতুন মতাদর্শ দ্বারা নেতৃত্বের আসন পাওয়ার কথা তুলে ধরেন। তাছাড়া মো’তাজিলিদের থেকে বিতাড়ন তার ভেতর অসহিষ্ণু্তার আগুনও জ্বালিয়ে দেয়।
ইবনে রাওয়ান্দীর লিখনী
ইবনে রাওয়ান্দী তার “যামরাদ” কিতাবে বলেন, ‘প্রাচীন আরবের কবি আকসামের কবিতা সূরা কাওসারের প্রথম আয়াত হতে উত্তম। তাছাড়া কোরআনের আয়াতের ভেতর বেশ দ্বান্দ্বিক অর্থ রয়েছে। কুরআনের ‘শয়তানের চক্রান্ত দুর্বল’ আয়াতের সমালোচনা করে বলেন, দুর্বল হয় কিভাবে! অথচ শয়তান আদমকে বেহেশত থেকে বের করেছে।’
ইবনে রাওয়ান্দীর ধর্ম ও তওবা
বিভিন্ন যুগের মতো ইবনে রাওয়ান্দীর যুগেও প্রতিপক্ষকে ভিন্ন ধর্মের লোক হিসেবে চিহিৃত করার প্রবণতা দেখা দেয়। ইবনু নাদিমের ফিহরিস্ত গ্রন্থের কোনো কোনো নুসখার মতে তার দাদার নাম মুহাম্মাদ হওয়া সত্বেও তাকে কেউ কেউ ইহুদির দালাল বলে দাবি করেন। বিভিন্ন চরিতকার, যেমন যাহাবি তার কিতাবে উল্লেখ করেন, ‘তিনি বলেন কোরআনে ভুল আছে। ইহুদিরা বলে, তার পিতা তাওরাত বিকৃত করেছে। তারা মুসলিমদের ইবনে রাওয়ান্দী থেকে সাবধান করেন। যাতে তিনি মুসলিমদের কুরআনকে বিকৃত না করেন। সাফাদী বলেন, তার পিতা ইহুদি ছিলো। পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। কোনো কোনো ইহুদি মুসলিমদের বলতো, তার পিতা যেমন আমাদের তাওরাতকে বিকৃত করেছেন, তেমনি ইনি যেন তোমাদের এই কিতাবকে নষ্ট না করেন।’
বলা হয়, মো’তাজিলিরা তার বিরুদ্ধে সুলতানের নিকট বিচার দিলে তিনি পালিয়ে কুফার জনৈক ইহুদির নিকট আশ্রয় নেন। এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে নাদীম বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করেন, ইবনে রাওয়ান্দী তার সবকিছু থেকে মৃত্যুর সময় তাওবাহ করেন এবং অনুতাপ প্রকাশ করেন।
ইসলামবিরোধী বিভিন্ন আচরণে তিনি কীভাবে প্রশাসনের হাত থেকে ছাড়া পেলেন, সে প্রসঙ্গে ইবনু আকীল বলেন, ‘আমার বিস্ময় কেন তাকে হত্যা করা হল না!’ খায়য়াত বলেন, ‘সুলতান ইবনে রাওয়ান্দীকে দরবারে ডেকে নেন, সেখানে তিনি তারবারীর ভয়ে তাওবার কথা প্রকাশ করেন।’ অধিকাংশ ইতিহাস-গ্রন্থানুসারে, ইবনে রাওন্দি ২৯৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
ইতিহাসের এ ব্যক্তি এক আদর্শ গ্রহণ করে তা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। তার প্রতিপক্ষ তাকে খোদাদ্রোহী ও নাস্তিক আখ্যা দিয়েছে। তবে মূলধারার বলয়ের প্রতি ইনসাফ ও বিচ্ছিন্ন অংশের প্রতি দয়াদ্রতার দৃষ্টির আলোকেই ইতিহাসের পাঠ হওয়া চাই। যেমন ইবনে রাওয়ান্দীর কঠোর সমালোচক তার সমসাময়িক এক সময়ের সহকর্মী খায়য়াত বলেন, ‘আপনি যদি বিভিন্ন মতবাদের লোকদের একে অপরের প্রতি ঘৃণার চর্চা করতে দেখেন, তখন আপনি চুপ থাকুন।’
The post ইবনে রাওয়ান্দী : ইসলামি ইতিহাসের রহস্যময় নাস্তিক appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%87%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%87-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%93%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%80-%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%bf-%e0%a6%87%e0%a6%a4-2/
No comments:
Post a Comment