Wednesday, September 23, 2020

মহান মহীরূহ : জীবনের খণ্ড খণ্ড গল্প

রাকিবুল হাসান:

আল্লামা আহমদ শফি রহ. যখন হাটহাজারি মাদরাসায় আসেন, তখন তার বয়স চৌদ্দ-পনের হবে। নাহবেমির পড়েন। পড়ালেখায় খুব বেশী মনোযোগী। মেজাজ সুফিয়ানা। সবসময় উবু হয়ে থাকতেন কিতাবের পাতায়। এমনকি আসরের পরও। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। অপরিচ্ছন্নতা তাঁর ধাতে সইতো না। গল্পটা তারও কয়েক বছর পরের।

হযরত তখন সতেরো সুন্দর তরুণ। চেহারায় শুভ্র লাবণ্য। মাথায় সবসময় থাকতো রুমাল। দেখলেই যে কারো মনে পবিত্রতার অনুভূতি জাগতো। হেদায়াতুন্নাহু কিংবা কাফিয়া পড়েন। লজিং থাকেন রবিপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে এক বাড়িতে। রেল লাইন দিয়ে হেঁটে যেতে হতো লজিং বাড়িতে। প্রতিদিন হযরত এই রেল লাইন ধরে হেঁটে যান। হযরত টের পেলেন–তার যাওয়ার সময় একটি মেয়ে প্রতিদিন রেল লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আনমনা। দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ। বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর। তিনি পাত্তা দিতেন না। রুমাল মুখের উপর আরেকটু টেনে দিয়ে চলে যেতেন। একদিন মেয়েটি আচমকা পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বললো, ‘প্রতিদিন কেন এই সময় আপনার পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি বুঝেন না?’ হজরতের দৃষ্টি নির্বিকার। চোখে পাথর বিস্ময়, লজ্জারাঙা আভা। হযরত মেয়েটিকে কিছু বললেন না। পথ কাটিয়ে মাদরাসায় চলে এলেন।

মাদরাসায় এসে শাহ আব্দুল ওয়াহহাব সাহেব রহ. এর রুমে গিয়ে কেঁদে দিলেন। শাহ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছো কেনো? হযরত বললেন, ‘লজিং বাড়ি যাবার পথে একটি মেয়ে আমাকে উত্যক্ত করে। আমি আর লজিং বাড়িতে যাবো না।’ এই ছেলের কথা শুনে শাহ সাহেব হতবাক। এত কম বয়সে এত বড় তাকওয়া! তার দৃষ্টি জুড়িয়ে গেলো। ভেতর থেকে তিনি দোয়া করলেন, ‘এই ছেলে একদিন অনেক বড় হবে, নিশ্চয়ই।’

তখন বোর্ডিং যিম্মাদার ছিলেন মাওলানা আবদুল হামেদ সাহেব রহ.। শাহ সাহেব আহমদ শফিকে বললাম, ‘আজ থেকে তুমি বোর্ডিংয়ে খাবে। লজিং বাড়ি যেতে হবে না। আমি মাওলানা হামেদ সাহেবকে বলে দিব।’ এই বলে তিনি হযরতের হাত ধরে বোর্ডিংয়ে নিয়ে গেলেন। বোর্ডিং প্রধান হামেদ সাহেবকে বললেন, ‘এই ছেলেকে চিনে রাখো। আজ থেকে যতদিন সে এই মাদরাসায় পড়বে, ততদিন বোর্ডিংয়ে তার খাবার চালু থাকবে। বন্ধ হবে না। তারপর নিয়ে গেলেন দারুল ইকামার রুমে। দারুল ইকামা প্রধানকে বললেন, এই ছেলের যে রুম পছন্দ, তাকে সে রুমেই থাকতে দেন।’

এর কিছুদিন পর দেওবন্দ চলে যান আহমদ শফি রহ.। একদিন দেওবন্দ থেকে আহমদ শফির চিঠি আসে শাহ সাহেবের কাছে। তিনি চিঠি খুলে দেখেন আহমদ শফি লিখেছে, ‘হযরত! হুসাইন আহমদ মাদানি আমাকে খেলাফত দিয়েছেন।’ চিঠি পড়ে তার চোখে জল এসে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে দু হাত তুলে পরম করুণাময়কে তিনি বললেন, আমি সুদৃষ্টিতে যা কামনা করেছিলাম, তুমি তা-ই পূর্ণ করে দিলে মালিক। লাজ রাখলে তোমার বান্দার শুভদৃষ্টির!’

মাওলানা আবদুল ওহহাব সাহেব ছাত্রদের তরবিয়তি মজলিশে বলতেন, ‘এটা আমার আহমদ শফি। দেখো যেখানে যায় প্রধান বক্তা, নয়তো সভাপতি, কোথাও সদরুল মুদাররিসিন। আল্লাহ তাকে বড় করেছেন। আমি যে শুভদৃষ্টি দিয়েছিলাম, হুসাইন আহমদ মাদানি তা সত্যায়ন করেছেন।’

হযরত মাওলানা আমিনুল হক রহ. বলতেন, শাহ আব্দুল ওয়াহহাব সাহেব রহ. খুবই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী মানুষ ছিলেন। ছিলেন হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. এর খলীফা। আহমদ শফী রহ. সেদিনই শাহ সাহেবের দূরদর্শী ও বিচক্ষণ দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিলেন। এবং সেদিনের সুদৃষ্টি ও সুনজরই আহমদ শফীকে আজকের শাইখুল ইসলাম বানিয়ে দিয়েছে।

আল্লামা আহমদ শফি রহ. তখনো হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম হননি। তবে ওয়াজ-মাহফিলগুলোতে বাতিলের বিরুদ্ধে কথা বলেন উচ্চকণ্ঠে। বাতিল দলগুলো ছিলো তার প্রতি ক্ষেপা এবং ক্ষুব্ধ। গল্পটা যে সময়ের, রফিক সাহেব নানুপুরী সাহেব তখন হেদায়া প্রথম বর্ষে পড়েন।

হযরত রাওজান এলাকায় গিয়েছিলেন বয়ান করতে। বয়ান শেষে ফিরবার সময় সত্বর ঘাটে একদল বেদআতী হযরতের পথ আটকায়। যারা পথ আটাকালো, তাদের মূর্তি ভয়ংকর। হাতে অস্ত্রশস্ত্র। কেউ বলে মেরে ফেল। কেউ বলে মেরে ফেলতেই হবে। খুব বেড়ে গেছে! হযরত বললেন, আমাকে তো মেরে ফেলবেই। শেষ ইচ্ছে হিসেবে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়তে চাই। খুব সংক্ষিপ্ত করে। দীর্ঘ করবো না। তারা রাজি হয়ে নামাজের অনুমতি দিলো।

নামাজ শেষ করে হযরত দেখলেন হত্যা করতে আসা দলের লোকজন পরস্পরে ঝগড়া লেগে গেছে। তারা কেউ বলছে হুজুরকে মেরে ফেল। কেউ বলছে হুজুরকে মারা যাবে না। মতানৈক্যের কারণে শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না। সহি সালামতে হযরত মাদরাসায় ফিরে এলেন।

আল্লামা আহমদ শফি রহ. পারতপক্ষে ক্লাস মিস দিতেন না। যেখানেই প্রোগ্রামে যেতেন, ক্লাসের আগেই ফিরে আসতেন। এই গল্পটি শুনিয়েছেন তার গাড়ির এক ড্রাইভার।

ড্রাইভার বলেন, আমি তখন কক্সবাজারে। হযরতের সঙ্গে রাতে প্রোগ্রামে গিয়েছি। ভোর পাঁচটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে হযরত আমাকে ডেকে দিয়ে বললেন, ৭ টা বাজে হাটহাজারী ফিরে ক্লাস করতে হবে। গাড়ি তৈরী করো। আমি অবাক। কক্সবাজার থেকে হাটহাজারি কম করে হলেও পাঁচ ঘণ্টার পথ। দু’ঘন্টায় কিভাবে যাবো? তবুও আল্লাহর উপর ভরসা করে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। পথে গ্যাস নেয়ার জন্য গাড়ি থামাতেই হযরত বললেন, গ্যাস লাগবে না। চলো। আমি আবার গাড়ি টানতে লাগলাম। আশ্চর্য, ৭টা বাজার দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেলাম মাদরাসায়!

ছাত্ররা ক্লাসে দেরি করে এলেও হযরত রেগে যেতেন। রাগের একটা গল্প শুনিয়েছেন মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ আযহারী। তিনি বলেন, একদিন হযরত ক্লাসে ঢুকে দেখেন অনেকে নেই, অনেকে মাত্র আসছে। আমি ক্লাসেই ছিলাম। তিনি এই এলোমেলো দৃশ্য দেখে রাগত স্বরে বললেন, আজ পড়াব না। ছাত্ররা সবাই ক্ষমা চাইলে হযরত বললেন, এক শর্তে ক্ষমা করতে পারি। আগামীকাল সবাই মাথা মুণ্ডন করে আসবে। ক্লাসে ৮০০ ছাত্র। সবাই মনে করলো এমনিতেই মাথা মুণ্ডাতে বলেছেন। তাই কেউ মাথা মুণ্ডায়নি। একমাত্র আমি মাথা মুণ্ডিয়েছি। পরদিন ক্লাসে এসে হযরত বললেন, তোমাদেরকে মাথা মুণ্ডাতে বলেছিলাম। একজন ছাড়া আর কেউ মুণ্ডায়নি। আমার সব দোয়া এই একজনই নিয়ে যাবে। ছাত্ররা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলে তিনি বললেন, যা হবার, তাতো হয়েই গেছে। এখন কান্না করলে লাভ হবে না।

এই গল্পটি শুনিয়েছেন রফিক সাহেব নানুপুরী সাহেব। তিনি বলেন, আমি হাটহাজারিতে জামাতে দাহম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি। তখন হযরতের কাছে তেমন আসা যাওয়া হতো না। ভয় করতো। আমাদেরকে নাহবেমির পড়াতেন হযরত মাওলানা কাসেম সাহেব দা.বা.। প্রতিদিন পেছনের পড়া নিতেন। সামনের সবক দিতেন। পেছনের পড়া নেয়ার কোন নির্দিষ্ট দিন ছিলো না। তাই নাহবেমির কিতাব এমনভাবে পড়েছি যে পুরো কিতাব মতনসহ মুখস্থ করে ফেলেছি। সেই যে মুখস্থ করেছি, আলহামদুলিল্লাহ! এখনো মুখস্থ আছে।

একদিন কাসেম সাহেব দা.বা. হযরতের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি ছাত্রদের খুব যত্ন করে পড়িয়েছি। যাকে যেখান থেকেই জিজ্ঞেস করেন, উত্তর দিতে পারবে। কেউ বাঁধবে না।’

আমরা কয়েকজন হযরতের রুমে গেলাম। হযরত কিতাবের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশ্ন করলেন। আমরা ঠিকঠাকভাবে সব উত্তর দিলাম। হযরত খুশী হয়ে আমাদের প্রত্যেককে ৫ টাকা করে পুরষ্কার দিলেন। এই পাঁচ টাকা তখন অনেক কিছু। আমরা টাকাগুলো নিজেরা খরচ করিনি। একদিন সকালে হুজুরদের তৃপ্তি ভরে নাস্তা করিয়েছিলাম।

রফিক সাহেব নানুপুরী আরেকটি গল্প শুনিয়েছেন।

হযরতের সঙ্গে কিছু মাহফিলের প্রোগ্রামে খাদেম হিসেবে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আাসা যাওয়ার পথে কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। সারাক্ষণ জিভ নাড়াতেন। যিকর করতেন–আল্লাহ! আল্লাহ!

একবার হযরতের সঙ্গে পোগ্রামে গিয়েছিলাম। আসা যাওয়ার পথে আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেন নি। শুধু বাতুয়া নামক একটি জায়গা এসে বললেন, এখানে শেরে বাংলাকে মারা হয়েছিলো। তারপর আবার চুপ, আবার যিকর।

হাটহাজারি বাসস্ট্যান্ড নেমে হযরতকে বললাম, মাদরাসায় যাবার জন্য রিকশা নেই? হযরত বললেন, দরকার নেই। চলো হেঁটেই যাবো।

আজকাল দেখি বক্তাগণ গাড়ি কিংবা বিমানে সফর করার জন্য মাহফিল আয়োজকদের বিরক্ত করেন। হযরতকে কখনো এমনটি করতে দেখিনি।তাওয়াযু এবং বিনয়ের ঔজ্জ্বল্য ফুটে থাকতো চোখে মুখে। মানুষের কল্যানে হেঁটে চলা, বলে চলা। নিজের জন্য কিছুই না। বাস স্ট্যান্ড থেকে রিকশায় যাবেন মাদরাসায়, তাও না। সফর-ক্লান্ত; তবুও হেঁটেই চলে এসেছেন।

কিছু নীরব মানুষ থাকেন। যারা কথা খুব কম বলেন। কথা না বলে কাজে প্রমাণ দেন। আল্লামা আহমদ শফি রহ. ছিলেন এইরকম নীরব কর্মপ্রত্যয়ী মানুষ। দূরদর্শী মানুষ। পরিস্থিতি অনুযায়ী কথা বলতেন। উম্মাহর কল্যানে যা করার তাই করতেন। মিটিংয়ে নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতেন না।

প্রবেশপত্রে বেফাকের ছবি লাগানোর আলোচনাটি অনেক দিনের। বেফাকের এক মিটিংয়ে কেউ বললো, হাটহাজারি হযরত ছবি পছন্দ করেন না। কেউ বললো, হযরতকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হোক। হযরতকে জিজ্ঞেস করা হলে হযরত বললেন, প্রথমে মুফতি আবদুস সালাম সাহেব রাজি ছিলেন না। পরে পরীক্ষামূলকভাবে ছবি যুক্ত করা হলে উপকারই হয়েছে।

উত্তরটা সেদিন সবারই খুব ভালো লেগেছিল। অনেকেই বলেছিলেন হযরত ছবি পছন্দ করেন না। কিন্তু হযরত নিজের পছন্দ অপছন্দের গুরুত্ব দেননি। যা উপকারী–তার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

জাকারিয়া হাসনাবাদী দুটি গল্প শুনিয়েছেন।

ক. আমার মসজিদের একজন মুসল্লি, তার সঙ্গে আমার বন্ধুর মতোই আচরণ। একদিন এসে বললো, তায়াল্লুক মাআল্লার জন্য কার সঙ্গে সম্পর্ক করতে পারি? আমি তাকে আল্লামা আহমদ শফি রহ. এর কাছে নিয়ে গেলাম। সে সময় বিয়ের আকদ চলছিলো। হযরতকে বললাম, আমার একজন মুসল্লী নিয়ে এসেছি। আপনার সঙ্গে সম্পর্ক করতে চায়। হযরত বললেন, শুক্রবারে নিয়ে এসো। সেদিন আরো অনেকেই বায়াত হবে।

শুক্রবারে এসে সম্পর্ক পাকাপোক্ত করে গেলো। তারপর একদিন আমার কাছে এসে বলল, ‘হযরতের কাছে সম্পর্ক করার পর অন্তরে যে প্রশান্তি অনুভব করছি, তার তুলনা হয় না।’ অথচ আমার মুসল্লি বন্ধুটি ছিলো বেদআতী। হযরতের সঙ্গে সম্পর্ক করার পর আলোকিত পরিবর্তন এসেছে তার জীবনে। বিদআতের সামান্য ছোঁয়াও তার জীবনে নেই।

খ. আমরা পড়তাম বাবুনগরে। হাটহাজারী মাদরাসার দশ সালা অনুষ্ঠানে আমাদের দিয়ে কাজ করাতেন৷ আমরা হাটহাজারির ছাত্র না হওয়া সত্বেও। আমার মনে পড়ে–দশ সালা অনুষ্ঠানে একটি স্মারক বের হয়। স্মারকের জন্য ৮০ পৃষ্ঠার আকাবীরদের জীবনী লিখি। হযরত বলতেন, আমি অনুলিখন করতাম। আমার সঙ্গে কাজ করতো হারূন আাযিযী। হযরতের নির্দেশনায় কাজটি করতে পেরে আমিও দারুণ আনন্দিত ছিলাম। হযরত বলতেন, এত কষ্ট করে আকাবীরদের জীবনী লিখছো, আল্লাহ বরকত দেবেন তোমাদের।

দশ সালা অনুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরী হয়ে গেছে। এমন এক সকালে হযরত মঞ্চে উঠলেন। তার পেছনে পেছনে উঠলেন জুনায়েদ বাবুনগরী এবং খিলগাঁও মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা নুরুল ইসলাম। মঞ্চে উঠেই হযরতের চোখে জল নেমে এলো। হয়তো হযরত অস্থির ছিলেন–এতবড় আয়োজন কিভাবে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবেন। তখন জুনায়েদ বাবুনগরী এবং নুরুল ইসলাম সাহেব সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, হযরত! আপনার কোন চিন্তা নেই। আমরা যেহেতু আছি, ইনশাআল্লাহ! সব আয়োজন সব আপ্যায়ন সুন্দরভাবে হবে।

স্মৃতিচারণটি করেছেন আল্লামা আহমদ শফী রহ. এর খলিফা মাওলানা ইউসুফ আমতলী। তিনি ১৯৮৮ সালে হাটহাজারী মাদরাসায় দাওরা পড়ছেন এবং হযরতের কাছে নাসাঈ শরীফ পড়েছেন।

তিনি বলেন, হযরতকে আমি শুরুতেই শাইখ বানাইনি। শুরুতে আমি ছিলাম মুফতিয়ে আযম হযরত মাওলানা ফয়জুল্লাহ সাহেবের কাছে। তিনি ইনতেকাল করার পর যাই হযরত আবদুল কাইয়ুম সাহেবের কাছে। তারপর যাই আবদুল ওয়াহহাব সাহেবের কাছে। তিনি আমাকে বায়াত করেননি। বলেছেন, যিনি মুফতিয়ে আযমের কাছে ছিলেন, তাকে আমার বায়াত করানোর দরকার নেই। তিনি ইনতেকালের পর যাই হযরত মাওলানা হামেদ সাহেব এর কাছে। তিনি যখন অসুস্থ, আমি জিজ্ঞেস করলাম এখন কার কাছে যাবো। হামেদ সাহেব বললেন, আহমদ শফী সাহেব হুজুরের কাছে।

আমি আহমদ শফী সাহেব হুজুরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। বললাম, হামেদ সাহেব রহ. আমাকে আপনার হাতে বায়াত হতে বলে গিয়েছেন। তখন আহমদ শফী সাহেব হুজুরও আমাকে বয়াত করাননি। বরং ছয়টি কাজ দিয়েছেন।

১. সকাল বিকাল ৬ তাসবীহ। ২. ফাস আনফাসের যিকির । ৩. তাহাজ্জুদের সময় ১২ তাসবীহ । ৪. ইসমে যাতের, যিকির । ৫. মোরাকাবা । ৬. যিকরে খফী।

দীর্ঘ ছয়মাস হযরত আমাকে মেহনত করালেন। দুই হাজার ছয় সালের কথা এইসব। একদিন হযরত মাওলানা আবদুর রহিম সাহেবের মাধ্যমে আমাকে ডাকলেন। হযরত তখন দুই তলায় থাকতেন। আমি রুমে ঢুকার পর হযরত আমাকে এজাজত দিলেন।

এই গল্পটি মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলিপুরীর।

তিনি বলেন, বেশ ক’বছর আগে হযরত আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি হাটহাজারি মাদরাসায় হযরতের সামনে উপস্থিত হলাম। হযরত বললেন, হাটহাজারি মাদরাসার ভর্তি ফরম পুরা করো। আমি পুরো করলাম। এরপর বললেন, ভর্তি ফি আদায় করো। আমি করলাম। দাওরায়ে হাদিসের সবকে বসতে পুরো বছরের জন্য নির্দিষ্ট একটি টাকা মাদরাসায় জমা দিতে হয়। তা-ও দিলাম। এরপর তিনি বললেন, আজ বুখারির সবকে বসো।

আমি বুখারির সবকে বসে গেলাম। হযরত যখন বুখারির সবক পড়াতে এলেন, আমাকে বললেন, একটি হাদিস পড়ো। আমি হাদিস পড়ার পর তিনি ক্লাসের দেড় হাজার ছাত্রকে সাক্ষী রেখে বললেন, তোমরা সাক্ষী থাকো। আমি তাকে সিহাহ সিত্তা পড়ানোর সনদ দিলাম। আর পাশাপাশি আমি তাকে আমার খেলাফতও দিলাম।

হযরতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার কোনো যোগ্যতা বা গুণ আমার ছিলো না। হযরত নিজেই নিজের উদ্যোগে আমাকে তার ঘনিষ্ঠ করে নিয়েছিলেন। তার বিশেষ কারণ মনে হয় এটা–হজরত বাতিলের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, আমিও কথা বলতাম। এটাই তার দৃষ্টি কেড়েছিল।

১০

এই গল্পটি শুনিয়েছেন মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ আজহারি।

২০১১ সালে মক্তব খোলার জন্য বিল্ডিং ভাড়া নেই। রমজানের পর শুরু হবে। আমি হযরতের কাছে বায়না ধরলাম, আপনাকে ছাড়া আমি মাদরাসা শুরু করব না। আপনাকে দিয়েই শুরু করব। হযরত তারিখ দিলেন ১১ সেপ্টেম্বর, বুধবার। ঘটনাক্রমে যে বুধবারে আমাকে তারিখ দিয়েছিলেন হযরত, একই বুধবারে হাটহাজারী মাদরাসারও সবকের ইফতিহাহ। হযরতের একান্ত সচিব মাওলানা শফিউল আলম বললেন, হযরত আসতে পারবেন না। হাটহাজারিতে সবকের ইফতিতাহ সকাল দশটায়। কিন্তু হযরত বললেন, কেফায়াতের মাদরাসায় আমি বুধাবারেই যাব। তাকে বলে দাও।

আমি ভাবছি, হাটহাজারির সবক ফেলে হযরত আসবেন না হয়তো। আমাকে অবাক করে দিয়ে হযরত এলেন। হাটহাজারীর ১০ টার সবক পড়িয়ে দিলেন ফজরের পর। তারপর ছুটে এলেন আমার মাদরাসায়। মক্তবে সবকের ইফতিতাহ করে যোহরের পর বয়ান করলেন ব্যবসায়ীদের। সেদিন বয়ানে উপস্থিত ছিলে ২৫০ জন ব্যবসায়ী। হযরত খুশি হয়ে বললেন, এত ব্যবসায়ীর মজলিসে আগে কখনো কথা বলিনি।

হযরত সেদিন রোজা ছিলেন। বিকেলে ইফতারের আগেই হযরত ফিরতি ফ্লাইটে চড়েন। আমরা হযরতের সঙ্গে ইফাতর দিয়ে দেই। হযরত বলছিলেন, আরও কিছু সময় থেকে যেতে পারলে ভালো লাগতো।

১১

বেফাক কেন্দ্রীক কিছু স্মৃতিচারণ করেছেন বেফাকের বর্তমান মহাপরিচালক মাওলানা যুবাযের আহমদ চৌধুরী। তিনি বলেন, আমি তখন নতুন বেফাকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেব আমাকে আল্লামা আহমদ শফি রহ. এর কাছে নিয়ে গেলেন। সাক্ষাৎ শেষে হযরত আমাকে বললেন, ‘কাজ করে যান। দোয়া করি আপনাদের জন্য।’ আমি তখন বললাম, ‘শুধু দোয়ায় পোষাবে না। মাথায় একটু ফু দিয়ে দেন, যেন সঠিকভাবে কাজ করতে পারি।’ হযরত মুচকি হেসে আমার মাথায় ফু দিয়ে দিলেন। এরপর যখনই দেখা হয়েছে, হযরত আমার পুরো শরীরে হাত বুলিয়ে ফু দিয়ে দিতেন।

হেফাজত ট্রাজেডির দু’বছর পর হযরত প্রথম যখন ঢাকায় এলেন, হযরতের সঙ্গে দেখা করার জন্য ফরিদাবাদ মাদরাসায় গেলাম। সঙ্গে মাওলানা মনিরুজ্জামান সাহেব। আমি মাওলানাকে বললাম, হযরত বেফাকের চেয়ারম্যান। এতদিন পর ঢাকায় এলেন আর বেফাকে আসবেন না, তা হতে পারে না। আমি তাকে বেফাকে আসতে দাওয়াত দিব। মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেব দেওবন্দ সফরে থাকায় আমি তখন বেফাকের ইনচার্জ মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছিলাম। ফরিদাবাদ যখন পৌঁছি, আসর হয় হয়। নামাজ পড়ে রুমে এসে দেখি হযরত সাদা গেঞ্জি পড়ে বসে নাস্তা করছেন। তার সামনে দূরত্বে বসে আছে বড় বড় আলেমগণ। কেউ হযরতের সঙ্গে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না।

নাস্তা শেষ হলে আমি এগিয়ে গিয়ে মুসাফাহা করে বললাম, ‘আমি অমুক, বেফাকের অমুক দায়িত্বে আছি। আপনি তো বেফাকের বাপ। ঢাকা এলেন আর বেফাকে আপনার সন্তানরা কী কাজ করছে, না দেখেই চলে যাবেন? অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও বেফাকে যেতে হবে।’ আমার এমন কথা শুনে সবাই তো কেমন কেমন করছে। না জানি হযরত কী বলবেন। হযরত আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, আমি হযরতের দিকে। এরপর তিনি তার খাদেম শফিকে ডেকে বললেন, ডায়রিতে লিখো আমি বেফাকে যাব। সত্যিই হযরত বেফাকে এলেন, এক ঘণ্টা সময় কাটালেন।

একবার বেফাকের একজন দায়িত্বশীল আমাকে দিয়ে হযরতের কাছে কিছু বলাতে চাচ্ছিলেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, তাই। আমি বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম। হযরতকে বললাম, ‘আগের তুলনায় বেফাক ভালো চলছে এখন। আবদুল জব্বার সাহেবের সময় বেফাক পিছিয়ে পড়েছিল।’ এতটুকুই। হযরত কিভাবে যেন বুঝে ফেললেন কথাটা আমার না, পাশে বসে থাকা মাওলানার। হযরত তখন শুধু বললেন, ‘আবদুল জব্বার সাহেব যা করে গেছেন, তার জাযা আল্লাহর নিকট পাবেন। আপনারা তার শুকরিয়া আদায় করুন। গীবত করা জায়েয নেই। আপনাদের কাজটুকু আপনারা করুন।’

 

The post মহান মহীরূহ : জীবনের খণ্ড খণ্ড গল্প appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a7%80%e0%a6%b0%e0%a7%82%e0%a6%b9-%e0%a6%9c%e0%a7%80%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%96%e0%a6%a3%e0%a7%8d%e0%a6%a1-%e0%a6%96/

No comments:

Post a Comment