মওলবি আশরাফ :
দুঃস্বপ্নপীড়িত দাঁড়কাক
অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের তৃতীয় বড় শহর, বোহেমিয়া রাজ্যের রাজধানী, বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগে ১৮৮৩ সালে ৩ জুলাই ফ্রানৎস কাফকার জন্ম। কাফকার পরিবার ছিল জার্মানভাষী ইহুদি। বাবা হারমান কাফকা ও মা য়ুলি কাফকা একটা দোকান চালাতেন। তাদের দোকানের প্রতীক ছিল kavka— চেক ভাষায় যার অর্থ দাঁড়কাক। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের ছিলেন। ফ্রানৎস কাফকা ছিলেন তার ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। কাফকা জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডক্টরেট লাভ করেছিলেন, এইজন্য তাকে সবাই ‘ডক্টর কাফকা’ বলে সম্বোধন করত। একবছর আদালতে প্র্যাকটিসও করেন। এরপর এক বিমা কোম্পানিতে বছর খানেক কাজ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘শ্রমিক-দুর্ঘটনা বিমা’-তে যোগদান করেন।
দুপুর দু’টোয় অফিসের কাজ শেষ হয়ে গেলে ফাঁকা সময়টুকুতে, তারপর রাত দশটা থেকে গভীর রাত অবধি সময়ে কাফকা সাহিত্য চর্চা করতেন। একচল্লিশ বছরের জীবনে মাত্র নয়টি পূর্ণাঙ্গ গল্প, চল্লিশটির মতো পূর্ণাঙ্গ রচনা, তিনটি অসমাপ্ত উপন্যাস আর কিছু ডায়েরি-চিঠি লিখে রেখে যাওয়া এই লেখক বিশ শতকের বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখকের তকমা পেয়ে গেছেন। ১৯০১ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সাহিত্যে নোবেলজয়ী ১০৯ জনের মধ্যে ৩২ জন তাদের লেখায় কাফকার প্রভাব আছে স্বীকার করেছেন। তার লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছোটগল্প রচনা হয়েছে আড়াই লাখের বেশি, আর পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি লেখা হয়েছে উপন্যাস। এটি তো কেবল যারা স্বীকার করেছেন, তাদের হিসাব।
কাফকার লেখা পড়ার জন্য পাঠকের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি বা পড়াশোনার প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্বব্যাপী কাফকার জনপ্রিয়তার এটা অন্যতম কারণ। দ্রুতই ঢুকে পড়া যায় তার লেখায়। কিন্তু কাফকার ওই সহজ-সরল স্বাভাবিক গদ্য আসলে একটা ধোঁকা— আপাতচোখে তার লেখা যতটা সহজ ও স্পষ্ট, তার লেখার বিষয়বস্তু ততটাই জটিল, অস্বচ্ছ, অনিশ্চিত ও প্যাঁচালো। তার লেখায় আছে প্রচুর মেটাফোর ও মেটাফোরিক্যাল প্যারাডক্স— সেসব অর্থের স্বচ্ছতার বদলে দেয় মহাঅনিশ্চয়তা। একারণেই আলবেয়ার কামু বলেন— It offers everything and confirms nothing.
মাত্র ষোলো বৎসর বয়সে যিনি নিটশে, কিয়ের্কগার্দ, স্পিনোজা ও ডারউইন পড়ে শেষ করে ফেলেন, তারপর প্রভাব গ্রহণ করেন গ্যোয়েটে, ফিওদর দস্তভয়েস্কি, হাইনরিখ ফন ক্লাইস্ট, চার্লস ডিকেন্স, গুস্তাফ ফ্লবেয়ার, নিকোলাই গোগোল, হারমান মেলভিল, অ্যাডগার অ্যালান পো, সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও প্লেটোর মতো বাঘা-বাঘা লেখক-দার্শনিকদের, তার লেখায় সেসবের ছাপ পড়া তো খুবই স্বাভাবিক। কাফকার শিল্পভাবনা ও চেতনাজগতের এই সমুদ্র-গভীরতাই তামাম সাহিত্যসমালোচকদের হয়রান করে ছেড়েছে। আজ অবধি কেউই পারেনি কোনো সহজ সমাধানে পৌঁছুতে। কেউ তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন অস্তিত্ববাদ, কেউ অ্যাবসার্ডিটি; কেউ খুঁজে পেয়েছেন বাস্তববাদ, আবার কেউ পেয়েছেন পলায়নপরতা। আর এইজন্যই ইংরেজিতে নতুন এক শব্দ তৈরি হয়েছে— আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথের ঢঙে কোনো কাজ করাকে বলি ‘রাবীন্দ্রীক’, তেমনই কেউ যদি হতবুদ্ধি, উদ্ভট বা দুঃস্বপ্নপীড়িতরকমের জটিলতায় পড়ে, তাকে বলা হয়— ‘কাফকায়েস্ক’।
আপাত স্বচ্ছতার আড়ালে পাঠককে বিমূঢ় ও হতবুদ্ধি করে দিয়ে কাফকা পাঠকের বুদ্ধি, ধৈর্য ও জ্ঞান পরীক্ষার জন্য এক কিসিমের খেলা করেছেন। একই ঘটনা ঘটিয়েছেন তার ‘রূপান্তর’ (The Metamorphosis) উপন্যাসিকাতে। এর কোনো ব্যাখ্যা না কাফকা দিয়ে গেছেন, না পরবর্তী সময়ে অন্যকেউ সর্বজনস্বীকৃত ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পেরেছেন। এই উপন্যাসিকা পড়বার পর আক্ষরিক অর্থেই আমরা সবাই হয়ে যাই কাফকায়েস্ক!
জটিলতায় না গিয়ে সাধারণ এক ব্যাখ্যা দাঁড় করালেই কি হয় না— অনেকটা এমন : গ্রেগর সামসা একজন ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান, এক সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখে সে পোকা হয়ে পড়ে আছে, অথচ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় চাপে আগেও তার ব্যক্তিগত কোনো জীবন ছিল না, পোকা হওয়াই যেন তার নিয়তি ছিল। এমন ব্যাখ্যাই হরহামেশা করতে দেখা যায়। যেহেতু প্রত্যেকের বোধ আলাদা, তাই একে ‘ব্যাখ্যা হয় নাই’ বলা সম্ভব না, কিন্তু খুবই সরলীকরণ হয়ে যায়। আমরা যদি কাফকার অন্যান্য লেখার সাথে তুলনা করি, বোঝা যায় এই উপন্যাসিকাতেও তিনি পাঠককে ধাঁধায় ফেলেছেন, কাফকায়েস্ক করে ফেলেছেন। রূপকের আশ্রয়ে তার বর্ণনাকে যদি সাদামাটা চোখে দেখি, তাহলে আর লেখার ভারত্ব থাকে না। কাফকা হয়ে যান গৌণ লেখক। অথচ সাহিত্যপাঠ তখনই গিয়ে সত্যিকারের আনন্দ দেয়, যখন লেখকের মনোভাবে ব্যক্তিচিন্তা আরোপ করে তাকে মহৎ থেকে মহত্তর করা যায়। আর সেই জন্যেই আমার এই প্রয়াস।
ঈশ্বর মৃত, বললেন ক্ষুধার্ত শেয়াল
নানা রকম মন্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা কিছু আশার আলো দেখতে পাই। যেমন বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ডক্টর আলিয়া ইজেতবেগোভিচ তার ‘প্রাচ্য পাশ্চাত্য ও ইসলাম’ বইতে লিখেন : ‘অনেকেই বিশ্বাস করেন কাফকাকে বোঝা যেতে পারে শুধু ধর্মীয় রূপক হিসাবে। কাফকা নিজেও বলেছেন তিনি তার চিন্তাভাবনা ও জিজ্ঞাসাগুলোকে এক ধরনের প্রার্থনা হিসাবে দেখেছেন।’
কাফকা গবেষক ও অনুবাদক মাসরুর আরেফিন বলেন : ‘কাফকার সাহিত্যকর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়েছে অগুনতি রকমের।… তার পরও যতগুলো কাফকা-ব্যাখ্যা হয়েছে, মোট ১৯ রকম মূলধারা আছে, যেমন অস্তিত্ববাদী ব্যাখ্যা, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণবাদী ব্যাখ্যা, মার্কসিস্ট ব্যাখ্যা, মেটাফিজিক্যাল ব্যাখ্যা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যাখ্যা, অ্যাবসার্ড সাহিত্যিক ব্যাখ্যা, এক্সপ্রেশনিস্ট ব্যাখ্যা, সামাজিক ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক ব্যাখ্যা, ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা, দার্শনিক ব্যাখ্যা, নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, আত্মজৈবনিক ব্যাখ্যা, আইনি ব্যাখ্যা, ইত্যাদি ইত্যাদি, এর মধ্যে আজও অন্যতম জোরালো ব্যাখ্যা হিসেবে, মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার সূত্রের নিরিখে কাফকা-ব্যাখ্যা এবং অস্তিত্ববাদী দর্শনের আলোকে কাফকা ব্যাখ্যার পাশাপাশি টিকে আছে কাফকা-সাহিত্যের ধর্মীয় ব্যাখ্যা।’
প্রথম ও দ্বিতীয়বার উপন্যাসিকাটি পড়ে আমি কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারিনি। তৃতীয় দফা যখন Reading with Reflection সহকারে পড়ি, আমার আগ্রহের কেন্দ্র ছিল এর ধর্মীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করানো। কিন্তু ধর্মের কোনদিক— ইতিবাচক না নেতিবাচক? ইজেতবেগোভিচের বক্তব্যে ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও আমি এর নেতিবাচক দিকই খুঁজে পেয়েছি কেবল। অথচ কাফকা আক্ষরিক অর্থে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ছিলেন না, যদিও তার বিশ্বাস স্পষ্ট না, কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কোনো দিকেই ঠেলে দেওয়া যায় না। কাফকা জন্মগতভাবে ইহুদি ছিলেন, এবং সারাজীবন ইহুদি জাতীয়তাবাদী ধারণা লালন করেছিলেন। সময়কালটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ইউরোপ। ইহুদিরা তখন জায়োনিস্ট মুভমেন্টে সফলতা দেখতে শুরু করেছে, আরবভূমি দখল করে কল্পিত রাষ্ট্র বাস্তবায়নের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ১৯১২ সালের এমন এক সময়ে কাফকা লিখলেন— এক সকালে গ্রেগর সামসা নানা আজেবাজে স্বপ্ন দেখার পর জেগে ওঠে দেখল সে তার বিছানায় পড়ে আছে এক বিশাল পোকায় রূপান্তরিত হয়ে… কোন দিকে ইঙ্গিত করে এই বয়ান? অ্যাবসার্ড কিছু? উঁহু, খুবই স্পষ্টত আমি এখানে একজনের চিন্তার ছায়া খুঁজে পাই, তিনি আর কেউ নন— ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণাকারী ফ্রেডরিখ নিটশের।
নিটশের ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা কোনো যেনতেন ব্যাপার নয়, শত-শত বছরের ইউরোপের চিন্তার পাটাতনে ছিল এক বিধ্বংসী আঘাত, যে-আঘাতের ফলে চিন্তার কাঠামো আমূল বদলে যায়। যে ঈশ্বরকে নিটশে মৃত বলেছেন, তিনি সর্বমঙ্গলময় সত্যিকারের ঈশ্বর নন, তিনি ঠুঁটো জগন্নাথ, ইউরোপীয় পরাশক্তির হাতে-গড়া নৈতিকতার ঈশ্বর। এই ঈশ্বর সারা পৃথিবী জুড়ে সভ্যতার নামে সন্ত্রাসীপনা আর লুটতরাজে উৎসাহ যোগান, কেবল পরাশক্তিধরের স্বার্থ দেখেন, মজলুমের আর্তি তার কানে সান্ধ্য ভাষা। বর্তমান পরাশক্তি আমেরিকার মুদ্রার গায়ে যে লেখা থাকে In God We Trust, ট্রাস্টের এই ঈশ্বরও সেই একই ঈশ্বর। প্রসঙ্গত অ্যালান মুওরের গ্রাফিক নভেল ‘ওয়াচমেন’র একটি সংলাপ মনে পড়ে যায়, সেখানে আমেরিকার এক রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির মুখে আমরা শুনি এই কথারই পুনরাবৃত্তি যেন— ‘আমি বলিনি পৃথিবীতে অতিমানব বলে কিছু আছে, আমি বরং বলেছি ঈশ্বর বলে একজন আছেন, এবং তিনি আমেরিকান!’
এই ঈশ্বরই ব্রিটিশ ফরাসি দিনেমার ও হিস্পানিওলাদের দুনিয়া জুড়ে মানুষকে গোলাম বানানোর বৈধতা দিয়েছে, এই ঈশ্বরই আমেরিকাকে মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানে গণতন্ত্র ও নারী স্বাধীনতার অজুহাতে সবধরনের সন্ত্রাস ও নৃশংসতায় সাবাশি জুগিয়েছে। এই ঈশ্বরকে খ্রিষ্টের ঈশ্বরের নামে প্রচার করা হয়, আদতে সে কৃত্রিম, রাজনীতিবিদদের উর্বর মস্তিষ্কজাত। নিটশে নিজেও তাই বলেন, ‘ঈশ্বরের খ্রিষ্টীয় ধারণা পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ধারণাগুলোর একটি।’
কাফকা যেন ঠিক এই কথাই বলছেন, নিটশে যেভাবে ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করেছেন, সেভাবেই এক সকালে ধুম করে দেখা যাবে গোটা খ্রিষ্টীয় ঈশ্বরের ধারণা গ্রেগর সামসার মতো পরজীবী পোকা হয়ে গেছে।
নিটশের সাথে কাফকার পরম্পরা ঠিক কোথায়? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না কাফকা যে একজন জায়োনিস্ট মুভমেন্টের সমর্থক ছিলেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও তিনি তার বাগদত্তাকে চিঠিতে আশা দেখিয়েছিলেন ফিলিস্তিনে গিয়ে এক রেস্তোরাঁ খোলার, সেখানে বউ হবে রাঁধুনী আর তিনি ওয়েটার। যদিও কাফকার শেয়াল ও আরব গল্পে ভিন্ন এক চিত্র দেখি। গল্পটিতে কথক একজন বিদেশি। একদল শেয়াল এসে তাঁর কাছে আরবদের থেকে মুক্তি চায়। বিদেশিকে বলে আপনিই আমাদের মসিহ (Messiah), আপনিই কেবল পারবেন নোংরা আরবদের থেকে আমাদের বাঁচাতে। ঠিক এমন সময় একজন আরব সেখানে উপস্থিত হন। শেয়ালদের বলে, ওখানে একটা মড়া উট পড়ে আছে। এ শোনামাত্রই সবগুলো শেয়াল তাতে ঝাপিয়ে পড়ে। গল্পে শেয়াল শব্দ দিয়ে যে ইহুদিদের বুঝিয়েছে, এতে কোনো অস্পষ্টতা নাই। এবং বিদেশিকে ‘আপনিই আমাদের মাসিহ’ বলা তখনকার ইহুদিদের হন্যে হয়ে উদ্ধারকর্তা খুঁজে বেড়ানোর অবস্থাই আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। ফিলিস্তিন দখলের জন্য ইহুদিরা যাকেই সামনে পাচ্ছিল নিজেদের দলে ভেড়াবার চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু ইহুদিবিরোধী এই স্যাটায়ার কাফকার রূপান্তর লেখার প্রায় সাত বছর পরে লেখা, ততদিনে হয় তিনি জায়োনিস্টদের প্রতি আশা হারিয়েছিলেন, অথবা গল্পটি আত্মসমালোচনার আদলে লিখেছিলেন। অন্যদিকে রূপান্তর লেখার মাত্র দুই মাস আগে লিখেছিলেন ‘রায়’ শিরোনামের একটি গল্প, দু’টো গল্পেরই থিম খুব কাছাকাছি, বলা যায় দু’টোই খ্রিষ্টীয় ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করে লেখা। রায় গল্পের ব্যাখ্যায় বলা হয় খ্রিষ্টধর্ম ইহুদিধর্মেরই পুত্র, বাবা পুত্রের প্রতি তাকে অশ্রদ্ধা ও অযত্নের অভিযোগ হানে, তারপর তাকে মরে যেতে বলে, পুত্র সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করে। ঠিক এই ছাঁচে আমরা যদি রূপান্তরকে পর্যালোচনা করি, তাহলে আশা করি একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারব।
পরজীবী দৈত্যাকার পোকা
আমাদের ব্যাখ্যায় বেশি কিছু নয়, ঘটনাকে একটু উলটে দিতে হবে কেবল, গ্রেগর সামসাকে নায়কের বদলে বানাতে হবে খলনায়ক। একটু বিস্তারিত বলি। ধরে নিই গ্রেগর সামসা সামন্তবাদী ধর্মব্যবস্থার প্রতীক, যে নিজেকে রাষ্ট্রের পরিচালক ভাবে, রাষ্ট্রের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েছে (খ্রিষ্টীয় ধারণার ইসামসিহের সবার পাপের বোঝা মাথায় নেওয়ার মতো), এবং সারাক্ষণ দৌড়ঝাঁপের মধ্যে থাকে। তো এক সকালে দেখা গেলো সে পোকার মতো পরজীবী হয়ে পড়েছে, জনমতে তার আর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নাই। এই যে হাজার বছরের ভিত্তি, তা একেবারে মাটির নীচ থেকে সরে গেছে। যারা এতদিন সেই ধর্মব্যবস্থার ফল ভোগ করে এসেছে, কেমন হবে এখন তাদের আচরণ?
সেই ধর্মব্যবস্থা নিজেও কিন্তু তখনো বুঝে উঠতে পারেনি কী থেকে কী হয়ে গেছে। ‘সে আশা করতে লাগল ডাক্তার ও তালাওয়ালা— এদের মধ্যে যথার্থ পার্থক্য না টেনেই— দুজনের কাছ থেকেই চমৎকার ও বিস্ময়কর সফলতার।’ ডাক্তার বা সংস্কারক তাকে চিকিৎসা করে তার পুরানো আসনে পুনর্বহাল করতে পারবে, নাকি তালাওয়ালা তার প্রকৃতরূপ ফাঁস করে দিবে, কিন্তু আদতে কোনোটাই ঘটে না। দরজা খুলে সামনে আসার পর সব দূর-দূর করে হটে যায়। তার এই রূপান্তর প্রথম দিকে নেতিবাচক মনে হলেও আস্তে আস্তে দেখা যায় কেউ আর আমলে নিচ্ছে না, বরং এতদিন যারা তার ওপর নির্ভর ছিল খুব দ্রুতই নির্ভরতা কাটিয়ে উঠছে। সেই ধর্মব্যবস্থার মনে তখনো এই আকুতি— ‘যে-কেউই কাজ করতে করতে সাময়িক অক্ষম হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তখনই তো তার অতীতের সেরা কাজগুলো মনে করার সঠিক সময় আর সেই সঙ্গে এমনটা ভাবারও যে, পরে যখন সমস্যা আর থাকবে না, তখন কোনো সন্দেহ নেই আরও বেশি শক্তি ও মনোযোগ নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে কাজে।’ কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তার কোনো জল্পনাই সত্যি হচ্ছে না, তার পোকা হওয়াকে কেউ গুরুত্ব তো দিচ্ছেই না, তার অতীতও মনে রাখছে না।
অপরিপক্ব এক শ্রেণি অবশ্য কোমলপ্রাণ ছিল তার প্রতি। বিশ্বাস হারিয়েছে বটে, তবু ‘আপন’ বলে মনে করে। ছোটবোন গ্রেটার গ্রেগরের সহায়ক হওয়া এরই রূপক। কিন্তু শেষতক সে-ও পিছিয়ে পড়ে। ‘আমাদের অবশ্যই একে বিদায় করতে হবে।’ বলে তার বোন। এমনকি বাবাকে সে জানায়— ‘এ কেবল পোকা, আমাদের পরিবারের কেউ নয়।’ উপন্যাসিকার শেষে যখন সবাই গ্রেগরের মৃত্যুর খবর পায়, তারা তাদের বুকে, স্বস্তিতে, ক্রুশচিহ্ন আঁকে, তারপরে দেখা যায় ছোটবোন খুবই সুশ্রী ও সুগঠন তরুণী হিসেবে পুষ্পিত হয়ে উঠেছে। মানে গ্রেগর সামসা বা তথাকথিত ধর্মব্যবস্থার নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া গোটা পরিবার সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য কোনো নেতিবাচক ফল তো আনেনিই, উলটো রহমত এনেছে যেন। দেখা যায় সবকিছু আগের চেয়ে সুন্দর ও ঝলমলে হয়ে উঠেছে।
উপন্যাসের এই ব্যাখ্যায় যদিও ইউরোপের খ্রিষ্টীয় ধর্মব্যবস্থাকে নেতিবাচকরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু গত একশ বছরে কাফকার সাধের ইহুদিরাষ্ট্রও আমরা দেখেছি, পরাশক্তি হবার পর প্রত্যেকেই বোল পাল্টে নিজের মতো ঈশ্বর বানিয়ে নিয়েছে। ঈশ্বর এখনো ভুল মানুষের হাতে আছেন। কিন্তু আমরা আশা হারাইনি, আমরা এখনো স্বপ্ন দেখি— এক সকালে গ্রেগর সামসা জেগে উঠে দেখব সে পোকা হয়ে পড়ে আছে!
সহায়ক সূত্র :
১) ফ্রানৎস কাফকা : গল্পসমগ্র/ মাসরুর আরেফিন
২) রূপান্তর/ কবির চৌধুরীর ভূমিকা
৩) ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’ ও শূন্যতার অভিশাপ/ মুসা আল হাফিজ
৪) আমি জরথুস্ত্র বলছি/ ফ্রেডরিক নিটশে/ সালেহ মাহমুদ রিয়াদ
৫) ফ্রানৎস কাফকা: সাহিত্যের মহাকাশে চির উজ্জ্বল ধূমকেতু/ আহমাদ ইশতিয়াক
৬) প্রাচ্য পাশ্চাত্য ও ইসলাম/ আলিয়া ইজেতবেগোভিচ
The post কাফকার রূপান্তর: এক সকালে গ্রেগর সামসা appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%ab%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b0%e0%a7%82%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%b0-%e0%a6%8f%e0%a6%95-%e0%a6%b8%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%87/
No comments:
Post a Comment