ওমর আলফারুক:
শায়িরে ইসলাম আল্লামা ইকবালের নামে অনেক ভ্রান্ত জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। ইকবালকে কাফের ফতোয়া দেয়ার ব্যাপারটিও তেমনি এক কিংবদন্তি। ইকবালের কাফের হওয়ার ব্যাপারে যে ভুল দাবিগুলো করা হয়, সেগুলো হলো:
এক. শিকওয়া লেখার কারণে তাকে কাফের ফতোয়া দেয়া হয়।
দুই. দেওবন্দিরা সেই ফতোয়া দিয়েছিল।
তিন. জওয়াবে শিকওয়া লেখার পর দেওবন্দিরাই আবার তাকে আল্লামা উপাধি দেয়।
মজার ব্যাপার হলো, এই তিনটি দাবির কোনোটিই সত্য নয়। অথচ ইতিহাসের এমনতর ভুল বয়ানগুলো আমাদের অঞ্চলে প্রবাদের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
ইকবালের কুফরির ব্যাপারে যে অসার দাবিগুলো করা হয়; শিকওয়া প্রকাশের পরের বছর ১৯১২ সালে ‘শমা আওর শায়েরি’ আবৃত্তির র্পূবে ইকবালের দেয়া বক্তব্যেই সেসবের অন্তঃসারশূন্যতা একরকম প্রমাণিতই হয়ে যায়।
কবিতাপাঠের র্পূবে ওই বক্তৃতায় তিনি বলেন , ‘গেল বছর আমি শিকওয়া লিখি; শিকওয়া হচ্ছে আল্লাহর প্রতি কতিপয় অনুযোগ। কতেক সমালোচক আমার শিকওয়াকে অপছন্দ করে তাকে প্রথাবিরোধী দুঃসাহসকিতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। খোদার নামে এমন শিকওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে আমার মনেও দ্বিধা ছিল। আমিও ভাবতাম কাজটা কি ঠিক হলো? কিন্ত সেই শিকওয়া যখন তুঙ্গর্স্পশি জনপ্রিয়তা পেল, আর চর্তুদিক থেকে অজস্র প্রশংসাপত্র আসা শুরু হলো তখন আমার নিজের দ্বিধা দূর হলো। মানুষের এই ভালোবাসা প্রমাণ করে তাদের ভেতরের জমে থাকা অব্যক্ত নালিশগুলোই আমার সে কাব্যে ব্যক্ত হয়েছে। বিপুল গ্রহণযোগ্যতা দেখে মনে হলো আমার শিকওয়া হয়তো আল্লাহরও পছন্দ হয়েছে।
ইকবালের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে—যারা মনে করেন শিকওয়া প্রকাশের পর অতিমাত্রায় অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় বাধ্য হয়ে তার জবাবে ইকবাল ‘জওয়াবে শিকওয়া’ লিখেন—তাদের দাবিও খারিজ হয়ে যায়। প্রথম কথা হলো—শিকওয়া এতটাই সমাদৃত হয়ছিল যে, এর জবাব লেখার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। দ্বিতীয় কথা হলো—শিকওয়া প্রকাশের পরের বছর লেখা ‘শমা আওর শায়েরি’কে ইকবাল নিজেই শিকওয়ার জবাব বলে আখ্যায়িত করেছেন। তৃতীয় কথা হলো—শিকওয়া লেখার প্রায় পোণে দুই বছর পর জওয়াবে শিকওয়া লেখা হয়। অথচ ‘শমা আওর শায়েরি’ লেখা হয় এর পরের বছরই। তাই ‘জওয়াবে শিকওয়ার’ ব্যাপারে প্রচলিত বয়ান যে ভিত্তিহীন—তা তো বলাই বাহুল্য।
তা ছাড়া ‘জওয়াবে শিকওয়া’ লেখার প্রেক্ষাপটও ছিল সর্ম্পূণই ভিন্ন। তখন বলকান যুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধের জন্য চাঁদা তুলতে হবে। যেহেতেু ‘শিকওয়া’ বিপুলভাবে সমাদৃত হয়ছিল, তাই ধারণা করা হয়েছিল এর দ্বিতীয় র্পব বের হলে সাহায্য তোলা সহজ হবে। তাই কবি জওয়াবে শিকওয়া লেখায় হাত দেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে —’শিকওয়ার’ সমালোচনার জবাবে নয়; বরং শিকওয়ার জনপ্রিয়তাই ‘জওয়াবে শিকওয়া’ লেখার নেপথ্য কারণ। অবশ্য জওয়াবে শিকওয়াতে যে কথাগুলো ইকবাল বলছেনে, সেগুলো চার-পাঁচ বছর যাবৎ তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবশে এবং লেখনীতে আগে থেইে বলে আসছিলেন।
তাহলে কাফের ফতোয়া দেয়ার ব্যাপারটা আসলে কী? ১৯২৫ সালে ‘রোজনামা জমিদার’ নামের এক পত্রিকায় ইকবালের বিরুদ্ধে কুফরির ফতোয়া ছাপা হয়। আব্দুল মাজিদ সালিক প্রণীত ‘জিকরে ইকবাল’ গ্রন্থে তার বিবরণ পাওয়া যায়। এখান থেকেইে জাভেদ ইকবালের ‘জিন্দা রোদ’সহ অন্যান্য গ্রন্থকার নিজেদেরে রচনায় এই ঘটনা যুক্ত করছেন। অবশ্য পত্রিকায় বর্ণিত বিবরণ আর এসব গ্রন্থে বর্ণিত বয়ানে বেশ তফাত আছে।
প্রথম কথা হলো এই ফতোয়া নেয়া হয়, খতিব দিদার আলির কাছ থেকে। ওই ফতোয়ায় তিনি স্পেসিফিকলি ইকবালকে কাফের বলেন নাই। এক লোক তার কাছে চিঠির মাধ্যমে জানতে চাইল—’কেউ যদি এমন এমন কবিতা লিখে সে কাফের কি না?’ এই প্রশ্নের সাথে আল্লামা ইকবালের কিছু অপ্রসিদ্ধ শের প্রশ্নর্কতা যুক্ত করে দেয়। জানা কথা—সেখানে শিকওয়ার কোনো পঙক্তি ছিল না। এই প্রশ্নের উত্তরে খতিব সাহেব লিখেন —’হ্যাঁ, যে এমন এমন কবিতা লিখে সে কাফের।’ এই ফতোয়া ‘এর মূলকপি সংরক্ষিত আছে’ এই নোটসহ ‘রোজনামা জমিদারে’ ছাপা হয়।
দ্বিতীয় কথা হলো, ফতোয়ার উল্লেখিত প্রশ্নপত্রে কোথাও ইকবালের নামটি র্পযন্ত উল্লেখ করা হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায়—ফতোয়া দেয়ার সময় খতিব সাহেবের জানার উপায় ছিল না যে, এগুলো কার শের। তাই বলা যায় যে, তিনি না জেনেইে এই ফতোয়া দিয়েছেন। তিনি হয়তো ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তার এই ফতোয়া কার বিপক্ষে যাচ্ছে।
তৃতীয় কথা হলো, ওই সময় ‘রোজনামা জমিদারের’ মালিক ও পরিচালক মাওলানা জাফর আলি খান এবং তার প্রতিনিধি বিদেশ-সফরে ছিলেন। পত্রিকার সকল দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল মাজিদ সালিক। জমিদার গ্রুপ এবং সালিক সাহেবরা ওই সময়ে ছিলেন সৌদি সরকাররে পক্ষের লোক। আর ওদিকে খতিব দিদার আলিসহ বেরেলভিরা তখন প্রবল সৌদি-বিরোধী। এ ছাড়া কুফুরের ফতোয়া দেয়ার ব্যাপারে ওই সময়ে খতিব দিদার আলি সাহেবের বেশ খ্যাতিও ছিল। অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হয় খতিব দিদার আলি সাহেবকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ছদ্মনামে ফতোয়ার ওই প্রশ্ন পাঠানো হয়। প্রশ্নে ইকবালের নাম অনুল্লেখ রাখা হয় এবং বিখ্যাত শেরের বদলে প্রশ্নে এমনসব অপ্রসদ্ধি শের উল্লখ্যে করা হয়—যেগুলো থেকে কোনোভাবেই বোঝা না যায় যে, এই কবিতাগুলো ইকবালের লেখা।
মোটকথা—ফতোয়া গ্রহণের পুরো প্রক্রিয়া র্পযালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, খতিব দিদার আলি সাহেবেরে ফতোয়ার গুরুত্ব হ্রাস এবং তাকে হাসির পাত্র বানানোর জন্য সর্ম্পূণ উদ্দশ্যে-প্রণোদিতভাবে এই ফতোয়া নেয়া হয়। এই ফতোয়া প্রকাশের পর খতিব দিদার আলি সাহেব হয়তো কোনো বক্তব্য দিয়ে থাকবেন। এসব তথ্য সংরক্ষিত না হলেও গাজি ইলমুদ্দিনের জানাজায় ইকবাল র্কতৃক খতিব দিদার আলি সাহেবকে ইমাম বানানোর মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যকার অটুট সম্পর্কেরেই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র—
১. ইকবাল : দওরে উরুজ, খরম আলি শফিক
২. আল্লামা ইকবাল আউর জমিনদার, ড. আখতারুন নিসা
৩. শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়ার ভূমিকা, হাফিজ আব্দুল মান্নান
The post কবির বিরুদ্ধে কুফরির ফতোয়া: নেপথ্য রহস্য appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a7%e0%a7%87-%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%ab%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%ab%e0%a6%a4%e0%a7%8b/
No comments:
Post a Comment