আহমাদ সাব্বির:
১.
রাতের মধ্য প্রহর৷ চারদিকে ফিনফিনে কুয়াশা৷ হু হু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে৷ এবারের শীত জাঁকিয়ে বসেছে বেশ৷ কান পর্যন্ত চাদর তুলে দিয়ে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল তালহা৷ মোবাইলের ‘বিপ’ ধ্বনিতে ওর মনোসংযোগ বিঘ্নিত হয়৷ পাশে পড়ে থাকা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখতে পায়—আফসানা ‘হাই’ জানিয়েছে৷ তালহা অবাক হয়—এত বছর পর আফসানার মনে পড়ল তার কথা! আট বছর হল বোধহয়৷ কৈশোরের মাতাল সময়ে আফসানার সাথে পরিচয় তালহার৷ এসএসসির বছর সজীব স্যারের ইংরেজি কোচিং এ ভর্তি হয় তালহা; সেখানেই পরিচয় আফসানার সাথে৷ তারপরতো কত হাসি, কতো উচ্ছলতা; কতো স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ নির্মাণের কতো কতকথা! এই আট বছর পর আফসানার এক ‘হাই’ দেখে সব যেন চোখের সমুখে জীবন্ত হয়ে উঠলো তালহার!
তালহা রিপ্লাই দেয়—হ্যালো!
কেমন আছো?—ওপাশ থেকে জানতে চায় আফসানা৷
‘যেমন রেখেছো’ বলতে চায় তালহা; কিন্তু বলে না, ভাবে—এটা বড্ড হেয়ালী দেখাবে৷ তালহা মুঠোফোনে টাইপ করে—’ভালো৷’
একটা ছবি পাঠায় আফসানা৷ ফুটফুটে এক বাচ্চার ছবি৷ আইসক্রিম খেতে গিয়ে থুতনিতে মাখিয়ে ফেলেছে৷ পরপরই বার্তা আসে৷ জিজ্ঞাসা—’কি, কিউট না!’
— হুম৷
— আমার মেয়ে, মুসকান৷
— বাহ! তোমার মতো দেখতে হয়েছে৷
— পুরোপুরি না৷ চোখ আর ঠোঁট ওর বাবার মতো৷
— তাকে তো আর দেখিনি!
আফসানা আরেকটি ছবি পাঠায়৷ মেয়ে বাবার চোখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে৷ পাশে বসে আফসানা হাসিতে ফেটে পড়ছে৷ ছবিতে মনে হচ্ছে—আফসানার চোখ আরও উজ্জ্বল হয়েছে; হাসিটাও আগের চাইতে নির্মল৷
তালহা লেখে—’সুখী পরিবার৷’
ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসে না৷ তালহা মুঠোফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে৷ কিছু সময় পেরিয়ে গেলে তালহাই বার্তা পাঠায়—’কি হলো, চলে গেলে!’
এবার উত্তর আসে—’মা ডাকছিলো৷’
—ভালো আছেন আন্টি!
—হুম৷ তবে প্রেশার একটু বেড়েছে৷
—তা কেন! এখন তো আর মেয়েকে নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই! হিহিহি৷ হাসির ইমুজি যুক্ত করে দেয় তালহা৷
—তা নেই৷ তবে আবার কমও নেই৷
— কেন, জামাই পছন্দ না তার!
—বারে! তা কেন হবে না! সে-ই তো তার মেয়ের জন্য হাজার খুঁজে এই ছেলেকে বের করে এনেছে৷ পছন্দ হবে না কেন!
—তা তোমরা কি এখনো রংপুর না বগুড়া, সেখানেই আছো!—জানতে চায় আফসানা৷
— হুম, রংপুর৷ তবে মাস কয়েকের মধ্যেই হয়তো আব্বুর বদলির অর্ডার আসবে৷
—এবার কোথায়?
—কি জানি! তবে যশোরের কথা শুনছি৷
—তাহলে তো ভালোই৷ বাড়ির কাছাকাছি চলে আসবে।
—হুম৷ যশোর থেকে খুলনা তো ঘন্টা দেড়েকের পথ!
—আজ যাই, তালহা৷ মুসকান খুব জ্বালাতন করছে৷ খিদে পেয়েছে বোধহয়!
—ঠিক আছে৷ ছোট্ট করে রিপ্লাই দেয় তালহা৷
একটা টকটকে লাল ‘হার্ট’ ইমুজি দিয়ে আফসানা বিদায় নেয়৷ এ প্রান্তে মুঠোফোন হাতে করে তার উজ্জ্বল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে তালহা, যতক্ষণ না আলো নিভে সেখানে নিশুতির অন্ধকার নেমে আসে৷
২.
‘কি করো!’
মাস্টার্সের পেপার তৈরি করছিলো তালহা৷ থিসিসের জন্য যে টপিকটা তালহা নিয়েছে তা খুব জটিল কিছু না৷ তবু এই শেষ পর্যায়ে এসে মেলাতে পারছে না; কেমন গোল পাকিয়ে যাচ্ছে৷ তিন চার দিন যাবত একই জায়গায় আটকে আছে৷ অথচ হাতে সময় একদমই নেই৷ ভালো একটা ফিনিশিং দিতে না পারলে বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে৷ আজ বড়সড়ো একটা প্রস্তুতি নিয়ে বসেছে তালহা৷ যত রাতই হোক আজ একটা হিল্লে করেই তবে উঠতে হবে৷ টেবিলে উবু হয়ে লিখছে তালহা৷ এরমধ্যে আফসানার ওই জিজ্ঞাসা—’কি করো!’
তালহার বিরক্তি লাগে৷ ডাটা কানেকশন বন্ধ করে নেয়া উচিত ছিল৷ আবার ভেবেছে—এত রাতে কে নক করবে! এখন আবার বন্ধ করবে—সেটাও খারাপ দেখায়৷ আফসানা কি ভেবে বসে আবার! তালহা সিদ্ধান্ত নেয়—কাজ শেষ করেই তবে রিপ্লাই দিবে৷
তালহার স্মার্টফোন আবারও কেঁপে ওঠে৷ স্ক্রিনের উপর ভাসতে থাকে আফসানার বার্তা—’কি হল জনাব! কথা বলছো না যে!’
আফসানার এই কথার মধ্যে ওর সেই জেদি মনটাকে যেন দেখতে পায় তালহা৷ তার মনে পড়ে যায়—সেদিন আফসানার জন্মদিন ছিল৷ তালহাকে ও বলে দিয়েছে—তুমি না এলে কেক কাটবো না৷ সময়মতো চলে এসো কিন্তু! তোমার অপেক্ষায় থাকবো৷
তালহা বেরোতে যাবে, সুন্দর একটা পারফিউমও নিয়েছে আফসানার জন্য৷ এমন সময় তুহিন এসে হাজির তালহার বাসায়৷ সাথে তানভীর, রিপন আর মামুন৷ তালহার যাত্রাপথে তারা প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়৷ বলে—কোত্থাও যাওয়া চলবে না৷ জিয়া হলে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল চলছে৷ বহু ঝামেলার পর টিকিট ম্যানেজ করেছি৷ সন্ধ্যায় তোকে যেতে হবে আমাদের সাথে৷ তালহা তাদের বোঝায়—না গেলে বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে; আফসানার সামনে দাঁড়াবার কোন মুখ থাকবে না তার৷ কিন্তু তালহার কথা তারা বোঝে না৷ বরং টিপ্পনি কেটে বলে—কোথাকার কোন আফসানা সে তোমার কাছে ইমপর্ট্যান্ট হয়ে গেল! আমরা তোমার কিছু না! আমাদের কথার কোন দাম নাই!
তালহা দেখে—এদেরকে বোঝানো মুশকিল৷ তারচেয়ে বরং সিনেমা দেখে আসি৷ আফসানাকে একটা যেনতেন বুঝ দেয়া যাবে!
কিন্তু পরদিন কোচিং এ গিয়ে আফসানার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে টের পেয়ে যায় তালহা—যেনতেন বুঝ দেয়ার মত মেয়ে আফসানা নয়৷ কোমল-স্নিগ্ধ অবয়বের আড়ালে ভীষণ জেদি একটা চেহারা ধারণ করে চলে সে৷ সেই জেদ তাড়াতে বহু সাধনা করতে হয়েছিল সেবার তালহাকে৷
৩.
মুখে চওড়া হাসি টেনে চেয়ার ছেঁড়ে উঠে দাঁড়ায় তালহা৷ মোবাইল হাতে নিয়ে বারান্দার কোণায় রাখা ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়৷ মেসেঞ্জার ওপেন করে আফসানাকে রিপ্লাই লেখে—’এই এমনি বসে আছি৷’
—বাব্বাহ, এইটুকু বলতেই এতক্ষণ! টিপ্পনী কাটে আফসানা৷
—তোমার কোন কথার উত্তরে কী বলে আবার ফেঁসে যাই! তাই ভাবনা চিন্তা করে বলতে হয়৷—তালহাও রসিকতা করে জবাব দেয়৷
—তুমি আর পাল্টালে না!
—সবাই পাল্টে গেলে কিভাবে চলে! হি হি হি৷
—তোমার হাসি বন্ধ করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
—অবশ্যই৷
—এত বছরে একবারও মনে পড়লো না আমার কথা!
তালহার হাসি পায়৷ যে কথাটা ওর নিজের জানতে চাওয়ার ছিল, আফসানা সেটাই জিজ্ঞেস করে বসলো৷
—তুমিই না নিষেধ করেছিলে ফোন দিতে! তালহা আলতো করে বলে৷
—তাই বলে একদমই খোঁজ নিবে না!
—নিয়েছি তো৷ রুমানার কাছে শুনেছি—স্বামী সংসার নিয়ে সুখে আছো৷ তোমার সুখে কাটা হতে চাই নি৷ তারপরও একটু কষ্ট করে ওপরে স্ক্রল করলে দেখতে পাবে—কতবার তোমাকে নক করেছি!
আফসানার আঙ্গুল থেমে যায় বুঝি৷ মোক্ষম আঘাত দিয়েছে তালহা৷ বেশ সময় নিয়ে আফসানা টাইপ করে—’মুসকানের আব্বু বলে—ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার৷’
—তাহলে তো সে বড় ভাগ্যবান!
—হতে পারে৷ কিন্তু আমি যে ভাগ্যাহত! আফসানার কণ্ঠে কাতরতা ঝরে পড়ে৷
—নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করলে অন্যের কি করার থাকে, বলো!
—ঈদের শপিং করলে কিছু! আফসানা পরিবেশ পাল্টাতে উদ্যোগী হয়৷
—হাহাহা৷ কথা ঘোরাচ্ছো? না, শপিং টপিং এখন আর হয় না৷ তালহা টের পেলেও পূর্বের প্রসঙ্গে আর ফেরে না৷ উল্টো প্রসঙ্গ পাল্টাতে আফসানাকে সহায়তা করে৷
—তোমার কেনাকাটা শেষ? তালহা প্রশ্ন করে৷
— মুসকানের আব্বু রোজই বলে৷ যাওয়া হচ্ছে না৷ তোমার প্রিয় রঙ তো সাদা?
—কেন, গিফট দিবে নাকি?
—এহ্, কত্ত শখ!
—কেন, তোমার বাজেট থেকে সামান্য কিছু প্রাক্তন প্রেমিককে দিলে তোমার ঈদ মাটি হয়ে যাবে না নিশ্চয়ই!
—কথাও জানো তুমি!
—সে তো তোমার অজানা নয়!
—আচ্ছা, তালহা! নতুন কারো সাথে রিলেশন হয়নি! যে দেখতে আমার চাইতে সুন্দর, আরো গুছিয়ে কথা বলে; ভালোওবাসে তোমাকে আমার চাইতে বেশি!
—না বাবা, প্রেমের নাম নাকি বেদনা! বেদনাহত আর হতে চাই না৷ কে চায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে!–তালহা রসিকতা করে জবাব দেয়৷
— হেয়ালি ছাড়ো তো! যদি আমি কাউকে খুঁজে দেই, তোমার মনের মতো, ভালবাসবে তাকে!
— হাহাহা৷ তালহা হাসি দিয়ে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চায়৷
— এ কি, তুমি হাসছো! আফসানার কণ্ঠে বিস্ময়৷
— কাজ নেই আর আমার ভালবেসে৷ তালহা তার রসালো মেজাজ ধরে রাখে৷
— তোমার সমস্যা কি জানো? সব কিছু নিয়েই রসিকতা করো! কোনোদিন সিরিয়াস হলে না তুমি৷ সেদিন সিরিয়াস হলে আমাদের ঠিকানা আজ অভিন্ন হতো৷
জবাবে কিছু বলে না তালহা৷ একজোড়া কান্নার ইমুজি পাঠায়৷ এতে করে আফসানা হয়তো ক্ষেপে গিয়ে থাকবে৷ তার নামের পাশে সবুজ বাতি আর জ্বলতে দেখা যায় না৷ তালহা মোবাইলের ডাটা অফ করে বারান্দার অন্ধকারেই বসে থাকে৷ উঠে গিয়ে লেখার টেবিলে ছড়িয়ে থাকা বিক্ষিপ্ত কাগজ পত্রের সামনে বসতে আর একদমই মন চায় না৷ তালহা বাইরের গহীন অন্ধকারের দিকে অপলক চেয়ে থাকে কেবল৷
৪.
অনেক ভাবনা চিন্তার পর তালহা মনস্থির করে—না, আফসানার সাথে আর কোন আলাপ নয়৷ এ মেয়ের জন্য জীবনে বহু ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তাকে৷ এত বছর পর নতুন করে আর কোনো ঝামেলার সম্মুখীন সে হতে চায় না৷ যা এখন অতীত, তাকে মাটি খুঁড়ে সামনে এনে কী লাভ!
তালহা মোটামুটি নিজের মনকে শক্ত করতে সমর্থ হয়৷ একবার ভাবে—চিরদিনের জন্য ব্লক মেরে দিবে! কিন্তু এই ভেবে নিবৃত্ত হয়—আমি মেসেজ না দেখলেই হলো! ব্লক মারার দরকার নেই৷ এতে হিতে বিপরীত হতে পারে৷ মাথা খারাপ মেয়েকে বেশি নাড়িয়ে লাভ নেই৷
এ ঘটনার পর প্রায় বছর খানিক অতিক্রান্ত হয়৷ মাস্টার্স শেষ করে তালহা রেজাল্টের অপেক্ষা করছে৷ দিন কাটে শুয়ে-বসে আর বই পড়ে৷ এর মধ্যে আফসানার কোন বার্তা আসে না৷ সে ও আফসানার সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করে না৷ নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে তালহা৷
একরাতে তালহা আব্বুর সাথে বসে টকশোর প্যাচাল শুনছে৷ খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে তা নয়; টকশোর এসব আলাপন তালহার কাছে খুবই বিরক্তিকর ও একঘেয়ে মনে হয়৷ আব্বুর সাথে একটা জরুরী বিষয়ে আলাপ করবে বলে তার পাশে বসা৷ কিন্তু টকশোর অনুষ্ঠান শেষ হওয়া অবধি সে সুযোগ মিলবে না নিশ্চিত৷ তালহা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এ ফালতু বকবকানি কখন থামবে সেই সময়টার৷ এরমধ্যে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে আফসানার বার্তা—’কী খবর!’ তালহা কোন আগ্রহবোধ করে না৷ খানিক পর ওর মুঠোফোন আবারো কেঁপে ওঠে৷ দেখে—’আফসানা সেন্ট এ ফটো৷’ পাশে বসে থাকা তালহার বাবা এবার কথা বলে ওঠেন—কে মেসেজ দিচ্ছে দেখছো না কেন!
তালহা মুঠোফোন হাতে তুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়৷ সিদ্ধান্তের কথা ভুলেই কিনা কে জানে! তালহা মেসেঞ্জারে গিয়ে আফসানার আইডিতে চলে যায়৷ এর মধ্যে সাত-আটটা লাইক পাঠানো হয়ে গেছে আফসানার৷ অস্থিরতা গেল না মেয়েটার!—তালহা ভাবে৷ তালহা ‘কি ব্যাপার!’ সেন্ড করে আফসানার পাঠানো ছবিতে চোখ ফেলে৷ কোন এক সমুদ্রের ঢেউয়ের সামনে আফসানা আর তার মেয়ে মুসকান হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে৷ আফসানার চোখে প্রকাণ্ড এক সানগ্লাস; বেখাপ্পা লাগছে৷
‘ব্যাপার আবার কি!’—আফসানা লেখে৷
—তা এতদিন কোন গহ্বরে লুকিয়ে ছিলে? তালহা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলতে চায়৷
—গহবরে-টহ্বরে না৷ ছবি পাঠাইছি দেখো নাই!
—হুম৷ দেখলাম তো! কিন্তু কোথায় এটা?
—আমরা তো এখন সৌদি থাকি; জেদ্দা৷ আমার বাসা থেকে লোহিত সাগর একদম কাছে৷ পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ৷ রাতে সমুদ্রের গর্জনে ঘুমোতে পারি না৷
নিজের সুখের আগুনে ওকেও যেন পোড়াতে চাইছে আফসানা৷
—হুম৷ ভালো৷ ছোট্ট জবাব লেখে তালহা৷
—আচ্ছা, বাই! ঘুমিয়ে পড়ো৷ খুব ঘুম পাচ্ছে আমার৷ ও প্রান্ত থেকে জানায় আফসানা৷
—কি বলো! রাত এখন এগারোটাও তো বাজে নি! আর তোমার ওখানে তো আরও তিন ঘন্টা লেট! এখনই ঘুম কিসের!
তালহা বিরক্তি ছুঁড়ে দেয় আফসানার উদ্দেশে৷ কিন্তু তালহা দেখতে পায়—ওর বার্তা আনসিন থাকতেই আফসানার নামের পাশে জ্বলতে থাকা সবুজ বাতি দপ করে নিভে যায়৷
নিজের ওপর খুব রাগ হয় তালহার৷ ভাবে—আর না৷ যথেষ্ট হয়েছে৷ ভাবে কি ও নিজেকে! সে রাতে অনেক দেরি করে ঘুম নামে তালহার চোখে৷
৫.
কিছু সম্পর্ক এমন থাকে যার কোনো ভবিষ্যত নেই৷ তবু তাকে এড়িয়ে যাবার উপায় থাকে না; এড়িয়ে যেতে পারে না সেই অদ্ভুত সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়ে পড়া মানুষগুলো একে অপরকে৷ তালহার উপলব্ধ হয়—আফসানার সাথে ওর সম্পর্কটা হয়তো তেমনি৷ নতুবা কেন এত কিছুর পর সেই আফসানার বার্তা এসে ওর মুঠোফোনে কাঁপন ধরালে ওর হৃদয়ও কেঁপে কেঁপে উঠবে! এখনো ওর বুকের মাঝে কোথাও আফসানার কিশোরীবেলার হাসিমাখা কোন ছবি রয়ে গিয়ে থাকবে, নতুবা কেন সে এত শপথের বাক্য ভুলে রাত নামলেই মুঠোফোন হাতে নিয়ে আফসানার নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলে ওঠবার অপেক্ষাতে থাকবে!
এক সময় জ্বলে ওঠে৷ তালহা যেন প্রাণ ফিরে পায়৷ দ্রুত টাইপ করে—’কি অবস্থা!’
আফসানা এ প্রশ্নের উত্তর দেয় না৷ বরং লিখে পাঠায়—’সরি!’ সাথে “দুঃখ প্রকাশক” ইমুজি৷
—সরি কেন? জানতে চায় তালহা৷
—কাল ওভাবে চলে গেলাম!
—কোন ব্যাপার না৷ তালহা সান্ত্বনা দেয়৷
—আসলে খুব ঘুম পাচ্ছিল৷ সারাদিন যা ধকল গিয়েছিলো! আফসানা কৈফিয়ত দিচ্ছে যেন!
—কেন, এত ব্যস্ততা কিসের? তালহা জিজ্ঞেস করে বসে৷
—বাদ দাও তো! তোমার কথা বলো৷
—আমার আবার কি! চলছে৷
—তা জনাব বিয়ে শাদী করার কি কোনো ইচ্ছা আছে! না প্রেমিকা বিয়োগের শোকে চিরকুমার-ই রয়ে যাবে! হিহিহি৷
আফসানার হাসি তালহার কানে রিনিঝিনি বেজে ওঠে যেন৷
—এত মহান প্রেমিক পুরুষ আমি নই৷ হা হা হা৷ তালহাও জবাবে হাসির ইমুজি পাঠায়৷
—কি, সুন্দর না!
একটি ছবি পাঠিয়ে আফসানার মতামত জানতে চায় তালহা৷
—প্রেমিকা! আফসানা কৌতুহল প্রকাশ করে৷
—নাহ্৷
—তবে?
—মা এই কন্যাকে পছন্দ করেছেন তার পুত্রের জন্য৷
—তাহলে এই মেয়ের কপালেই ছিলে তুমি! অথচ কতজন আশায় বেঁধেছিলো বুক!
—এখনও শিওর নই৷ একবার মাত্র দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে৷
—আর দরকার নেই৷ তোমাতে ফিদা হতে এক সাক্ষাতই যথেষ্ট৷ হিহিহি৷ আবারও হেসে ওঠে আফসানা৷
—তা, নাম কি কন্যার!
—নুসাইরা জাহান৷
—বাহ, সুন্দর নাম তো!
—কেবল নামই! টিপ্পনি কাটে তালহা৷
এইসব রসিকতার ভেতর হঠাৎই সিরিয়াস হয়ে পড়ে যেন আফসানা৷ বেশ সময় নিয়ে লেখে—’আমি যেদিন সব কিছু ছেড়েছুড়ে তোমার বাসায় চলে এলাম সেদিন তোমার কিছুই করার ছিল না, তাই না!’
এ প্রশ্নের জবাবে কি বলবে তালহা! সত্যিই সেদিন তার করার কিছু ছিল না৷ মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে তালহা; এ সময় বাড়িতে বিয়ের কথা বলে কি করে! তার ওপরে বড় এক ভাই এবং বিবাহযোগ্য এক বোন রয়েছে, যাদের বিয়ের কথাবার্তা চলছে মাত্র৷
—না, কিছুই করার ছিল না৷ তালহা সাহস করে বলে ফেলে৷
—ভুল৷ তুমি চাইলে অনেক কিছুই হতে পারতো৷
একটু থেমে আফসানা ই আবার লেখে, তুমি আমাকে অপেক্ষার কথা বলেছিলে৷ আচ্ছা, ধরো যদি আমি অপেক্ষা করতাম, আরো তিন চার কিংবা পাঁচ বছর, আমাকেই কি বিয়ে করতে?
—এখন এইসব জিজ্ঞাসার কোনো অর্থ নেই, আফসানা৷ তালহাও ক্ষেপে ওঠে কিছুটা৷
—কিছু মনে করো না৷ মাঝে মধ্যে নিজেকে প্রশ্ন করি, উত্তর পাই না৷
—হুম৷ এখন আমি বরং তোমাকে পেসারাইজড করতে পারি৷ সে অধিকার আমার থাকার কথা৷ কেন মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে হুট করে বিয়ে করে ফেললে! কিসের এত তাড়া ছিল তোমার!
আট বছর যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তালহা চেপে রেখেছে বুকের গহীনে আচমকা হাওয়ায় তার মুখ যেন উন্মোচিত হয়ে পড়লো৷
—ভুলটা আমারই ছিল৷ আফসানা যেন হার মানছে৷
তবু দমে না তালহা৷ সবটুকু বিষ যেন আজ উগড়ে দিতে চাইছে৷ তালহা বলে চলে, আর সেই ভুল ঢাকবার জন্যই আমার ফোন ধরতে না, আমার মেসেজের রিপ্লাই দিতে না!
—কারণ আমার তখন তীব্রভাবে মনে হয়েছিলো তুমি আমাকে ভালোবাসো না৷
—তোমার এই মনে হওয়াটা ভীষণ রকমের ভুল ছিল৷
—সবাই বলতো-ও তাই!
—সবাই বলতো! কে বলতো! আর সবার কথাই শুনবে যদি আমাকে ভালবাসতে এসেছিলে কেন? কেন সব ছেড়েছুঁড়ে আমার বাসায় চলে আসার নাটক করেছিলে?
হঠাৎই তালহার বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে৷ দূরে অন্ধকারে কোথাও ডেকে ওঠে কোন রাত জাগা পাখি৷ তালহার মনে হয় পাখিটি অন্ধকারে বসে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে৷ কেবল পাখি নয়, তার মনে হতে থাকে—এই গভীর অন্ধকার, অন্ধকারের ওপাশে নিবিড়-গহীন মেহেগনি বন সবকিছু দাঁত খিচিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে৷ সেই হাসি উপেক্ষা করে আফসানার প্রোফাইলের ব্লক অপশন খুলে সে দিকে তাকিয়ে থাকে তালহা৷ সে সময়টাতে তার পাশে কেউ থাকলে সে নিশ্চিত দেখতে পেত, খুবই ক্ষীণ একটা হাসির রেখা তার দুই ঠোঁটের ফাঁকে আলো ছড়িয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে৷
The post কেন বেদনা জাগালে হায়! appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%a8-%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%87-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a7%9f/
No comments:
Post a Comment