Friday, September 24, 2021

এক টুকরো কানাডা

অতনু দাশ গুপ্ত:

দস্তানা

আজ শীতের হাড়কাঁপানো ঠান্ডার সাথে পাল্লা দিতে অনেক শখ করে অ্যামাজন থেকে অর্ডার দিয়ে আনা কালো চামড়ার দস্তানা জোড়া পড়েছি। এর আগের জোড়া গত সপ্তাহেই অফিস থেকে উধাও হয়েছে! কোন সৌভাগ্যবান এটা বগলদাবা করেছেন তার একবার যদি হদিস পেতাম!

বাসের জন্য অপেক্ষারত আছি আর সামনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধকে দেখছি। মুখে মাস্ক পরার কথা থাকলেও এই শীতের মধ্যেও ওটা থুতনির নীচে চলে গেছে। আর কি যেন বিড়বিড় করে বকে চলেছেন আপনমনে! দু ব্যাগ ভর্তি বাজার করেছেন। আমার হাত মাইনাস আটের তীব্র কামড় সইতে পারছে না! যদিও হাতে পরে রয়েছি অ্যামাজানের কালো রঙের দস্তানা। এখন বুঝতে পারছি হয়তো জাঁকিয়ে শীত পড়লে এর উপশম দিতে পারবে না এ দস্তানা জোড়া। কিন্তু সখের জিনিস কি কেউ হেলাফেলা করতে পারে? তাই যেটাই হোক, নাই মামার চেয়ে কানা মামা অনেক ভালো!!

পৌঁছে গেলাম কাজে যথা সময়ে। কাজ শেষ করে যখন ফিরছি তখন সময় সন্ধ্যা সাতটা বেজে বিশ। বাস নাম্বার পাঁচ।

পুরো বাসে যাত্রী আমি একাই। হয়তো এর পরবর্তী স্টপেজে পৌঁছলে কিছু যাত্রী চড়ে বসবেন। যেতে যেতে বেশ একনিষ্ঠ পাঠক হয়ে পড়ছিলাম “ভারতবর্ষের বৃহত্তর পরিচয়”। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ডরচেস্টার বাস স্টপেজ, এরপর পরবর্তী বাসে চেপে বসলাম। যখন বাসার খুব কাছাকাছি এসে পৌছেছি, নামার ঠিক আগমুহূর্তে খুঁজতে গিয়ে দেখি, দস্তানা জোড়া উধাও! কোথায় গেল, তন্নতন্ন করে খুঁজেও ইয়ত্তা নেই। ব্যাগের ভেতরে, সামনের পকেটে, বাজারের ব্যাগে রাখার কথা না থাকলেও খুঁজতে লাগলাম! তাহলে কি খুইয়ে গেল আমার সখের দস্তানা? নামার আগে ড্রাইভারকে জানালাম, আমার দস্তানাজোড়া হারিয়ে গেছে। মনে হয় আগের বাসে ফেলে এসেছি। কি করবো? বেশ সখ করে কেনা ওই দস্তানা জোড়া কারও হাতে পড়লে ফেরত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে অনেককেই দেখেছি বাসে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস ফেরত দিতে। কে জানে কি আছে ভবিতব্যে! এর আগের জোড়া চুরি হয়ে গেল আর এটা নিজেই নিজের অবহেলায় হারালাম হয়তো! এত অল্প সময়ের মধ্যে দু’জোড়া দস্তানা হারানো আর কিছুই না, পয়সা অপচয়ের শ্রাদ্ধ ছাড়া।

ওদিকে বাসের ড্রাইভার জানালো, বাসের গ্যারেজে গিয়ে দেখতে, কারণ কোন হারিয়ে যাওয়া বা বাসে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস ওখানকার অফিসে জমা দেওয়া হয়। আমিও বাস থেকে নেমে সোজা হাঁটতে লাগলাম ওদিকের রাস্তায়। গিয়ে দেখি কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। এমনিতেও সুনসান জায়গা। মানুষজন আগেও দেখা যায় না। আর এখন তো এই অতিমারীর কারণে একেবারেই দেখার কথা না। কোন বাসও দেখতে পাচ্ছি না। রাতে তাপমাত্রা ক্রমে আরও কমে আসছে। নাক ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যদিও কাপড়ের মাস্ক পড়ে আছি। তবে এটা শীতকালের মাস্ক না!

অফিসে গিয়ে কলিংবেল চাপ দেওয়ার আগেই দেখি একটা সাদা রঙের ট্রাক এসে হাজির। এ ট্রাক মাল টেনে নেওয়ার বিশাল আকারের ট্রাক না, এটা আকারে ছোট আর পিক আপ ভ্যানের মতো যার পেছনে মালামালও নেওয়া যায়। সাদা রঙের ট্রাক থেকে ওয়্যারলেস ফোন হাতে নেমে এলো এক কর্মকর্তা। বা হাতে টিম হর্টনসের কফি। আমাকে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলো। জানালাম, খুব সম্ভবত দস্তানা জোড়া পাঁচ নাম্বার বাসে ফেলে এসেছি। বিস্তারিত জিজ্ঞেস করলো – কি রঙের, লেদার না কাপড়ের তৈরি। সবকিছু সবিস্তারে বললাম। বেশ তড়িৎকর্মা গতিতেই ফোন চলে গেল ওই বাসের ড্রাইভারের কাছে। ও তখন ড্রাইভ করছিল। তাই জানালো কোন স্টেশনে পৌঁছে দেখে তারপর জানাবে।

নাম জিজ্ঞেস করলে ওই কর্মকর্তা জানালো ওর নাম জেফ্রি। তারপর আমরা কথা বলছিলাম। কাজ কি করি, বাসা কোথায়।

এর মধ্যে অন্য বাসের ড্রাইভারের ম্যাসেজ এলো। জানানো হলো, দস্তানা জোড়া বহাল তবিয়তে সুরক্ষিত আছে। বাস এখানে এসে পৌঁছাবে রাত আটটার দিকে। এখন ঘড়ির কাটায় সাড়ে ছয়। তখন জেফ্রি আমাকে দুটো অপশন দিল – এখন বাসায় গিয়ে আটটার দিকে এখানে ফেরত আসা অথবা কাল এসে নিয়ে যাওয়া। আমি বললাম কাল কাজে যাওয়ার সময় এখানে আমার বাস আসবে তখন নেওয়া যাবে। জেফ্রিকে ওর কাজের জন্য মনের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। কিন্তু বাসায় আসার পর উসখুস করতে লাগলাম। মনে অনেক প্রশ্ন কিন্তু কোনটার সঠিক সদুত্তর না পেয়ে তখনই সিদ্ধান্ত বদলালাম।

ঘড়ির সময় সাতটা পয়তাল্লিশ হতেই বেরিয়ে পড়লাম গ্যারেজের উদ্দেশ্যে। যেতে মিনিট দশেকের মতো লাগবে। মনে অনেক উৎকণ্ঠা! আদৌ জেফ্রি আসবে তো? কারণ আমি তো ওকে বলেছি কাল আসবো। যাক! যা থাকে কপালে!

পৌঁছে গেলাম আটটার মিনিট পাঁচেক আগেই। কিছুটা অধৈর্য, কিছুটা দুশ্চিন্তা আর বাকিটা সময়ের উপর ছেড়ে দিলাম। সেটা সুসময় না দুঃসময় তা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পাবো।

সময় রাত আটটা বেজে তিন। হ্যাঁ, জেফ্রির ট্রাক দেখতে পাচ্ছি। এর আগেরবার ওর গাড়িটা বামদিকের গেইট দিয়ে গ্যারেজে এসেছিল। আমি জানতাম এবার ও বাস স্টপেজ থেকে আসছে। তাই ডানদিক থেকে আসবে। এসেই গাড়ি থেকে নেমে এলো। আর আমাকে দেখেই হাসি মুখে এগিয়ে দিল দস্তানা জোড়া। বলতে লাগলো, ‘প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, রেখেছি!’

আমার এত আনন্দ হয়েছিল মনে হচ্ছিল বোধ হয় নোবেল পুরষ্কার পেয়ে গেছি! ওকে ধন্যবাদ বলার ভাষা খুঁজে না পাচ্ছিলাম না! ভালো মানুষ, কথা দিয়ে কথা রাখার মানুষ জেফ্রি!

ঘরে ফিরে আসছি আর মনে মনে ভাবছি, ওর মতো মানুষ যদি সব জায়গায় একজন করেও পাওয়া যেত, তাহলে পৃথিবীটা কত নির্ঝঞ্ঝাট হতো!

প্রসঙ্গ সারমেয়

প্রতিদিনের মতো আজকেও কাজে যাচ্ছি। বহুদিনের স্বভাববশত আগেভাগে বাসা থেকে বেরিয়েছি। দুটো বাস পালটে গন্তব্যস্থলে পৌঁছবো। পুরো এক ঘণ্টার বাস ভ্রমণ তবে সম্পূর্ণ যানজট মুক্ত! বাসা থেকে বেরিয়ে কয়েক পা এগুতেই পরিচিত ঘেউ ঘেউ শব্দ কানে ভেসে আসছে। গত কয়েকদিনে সকালবেলায় এ সময়ে শব্দটা শুনতে পেলেও খুব একটা গা করিনি। ভেবেছি, ও আর কি ? হয়তো বাসার ভেতর থেকেই শব্দ আসছে। কিন্তু পেছন ফিরে এক পলক তাকাতেই দেখি প্রকাণ্ড একটা গ্রেট ডেইন আমার দিকে তেড়ে আসছে! খুব একটা ভাববার অবকাশই পেলাম না! চোখের পলকেই খুব কাছে চলে আসার আগেই ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে লাগালাম এক ভোঁ দৌড়! কথায় আছে, ‘বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি! আমি কয়েক পা দৌড়াতেই ওটা খুব কাছাকাছি এসে ডাক হাঁকতে লাগলো। আমি কিছুদূর দৌড়ে ওটা গায়ের কাছাকাছি ঘেঁষে আসছে দেখে পেছন দিকে সরতে গিয়ে শুকনো বরফের ধারালো খণ্ডের উপর পড়লাম। হাত ছিঁড়ে ফুঁড়ে গিয়ে সে এক রক্তাক্ত অবস্থা! বুঝলাম, এগুলো গায়ের কাছেই শুধু এসে ভয় দেখাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি এদের ছোঁবেন না, এরাও কিছু করবে না! চাইলেই আমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে কেটে দিতে পারতো। যে বেগে ডাকতে ডাকতে তেড়ে এসেছিল, ঠিক সে বেগেই আবার ঘরের দিকে ছুটে চললো। আমি উঠে হাত পা ঝেরে আবার গন্তব্যস্থলের দিকে এগুচ্ছি আর একবার আড়চোখে লক্ষ্য করলাম ওটা আবার দৌড় লাগিয়েছে! তবে এবার বেশিদূর এগুনোর আগেই ওটার মালিক আচমকা গাড়ি নিয়ে এসে নাম ধরে ডাকতেই বেশ লক্ষী বালকের মত গাড়িতে উঠে বসে পড়লো। আমি ততক্ষণে বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গেছি। বাস স্টপে পৌঁছে ব্যাগের মধ্যে রাখা ফাস্ট এইড ব্যান্ডেজগুলো হাতিয়ে দেখছি। বেশ কয়েকটা লাগিয়ে নিলাম। ওইদিন আমার আট ঘণ্টার কাজ ছিল। ফেরার পথে ভাবছিলাম, ওটা যদি একটা কামড় বসাত, তাহলে এখন হাসপাতালের কয় নাম্বার বেডে পড়ে থাকতাম তা বিধাতাই জানেন !!

এ গেল মালিকের নাছোড়বান্দা কুকুরের নমুনা।

ঠিক এর পরের সপ্তাহে ডিম কিনতে গেছি শপারস ড্রাগমার্টে। ফিরে আসার পথে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি এক মহিলার সাথে একটা কাল ল্যাব্রেডর বসে আছে। এখন এটাকে নিয়েই উনি বাসে উঠতে চলেছেন! আমার তো ওটাকে দেখার পর থেকেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা! গত সপ্তাহের লোমহর্ষক ঘটনার পর আবার কুকুরের মুখোমুখি। আজকে এ শহরে আছি তিন বছর, কখনও কাউকে এ বিচিত্র চতুষ্পদ জন্তুটিকে নিয়ে বাসে চড়তে দেখিনি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, আজ এমন এক দিনে এ দৃশ্য দেখতে হচ্ছে যখন প্রাণীটি আর অল্পের জন্যই আমার প্রাণ হন্তারক রূপে হাজির হচ্ছিল! এ তো করুণাময়ের আশ্চর্য লীলাখেলায় বেঁচে গেছি! সময়মতো বাস এলো আর মহিলা বাসে উঠে ড্রাইভারকে নিজস্ব গন্তব্যস্থল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার আগেই দেখলাম কুকুরটা কোথায় যেন উধাও! নিজে উঠার পর লক্ষ্য করলাম মহিলার সিটের ঠিক পাশে ছোট্ট একটা খুপরির মত জায়গা আছে ওখানেই ঢুকে দিব্যি বসে পড়েছে পোষা ল্যাব্রেডর ! ওটার গলায় একটা বিশেষ ধরণের বেল্ট দেখছি যেটা শুধুমাত্র বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরের গলায় ঝুলতে দেখা যাবে। এতক্ষণ মহিলাকে স্বাভাবিক মনে হলেও দেখলাম নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে রাখা কার্ডগুলো হাতে পরখ করে বুঝে নিচ্ছেন কোনটা ব্যবহার করবেন। উনার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ! আর তাই সার্বক্ষণিক সঙ্গী সারমেয়। এদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যখন মাঝপথে বাসটা ব্রেক কষে ড্রাইভার দাঁড় করালো, ওটা আপনাআপনি পেছন দিকে বেরিয়ে আসতে চাইছে আর ভদ্রমহিলা মুখে বলে হাতের আলতো ধাক্কায় ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন ওটাকে। অর্থাৎ ল্যাব্রেডর বুঝে গেছে বাস গন্তব্যে পৌঁছেছে। যতবারই বাস ব্রেক কষেছে, ওটা নিজে থেকেই বের হয়ে আসছে আর মহিলা একইভাবে ওকে বসতে বলছেন।

পুরো দৃশ্যাবলী দেখে উপলব্ধি হল, কেন কুকুরকে বলা হয় মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রভুভক্ত প্রাণী! তবে আমার মত অতি সৌভাগ্যবান হলে এর বিপরীত পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে পারেন!

The post এক টুকরো কানাডা appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%8f%e0%a6%95-%e0%a6%9f%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a7%8b-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a1%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment