Friday, September 4, 2020

কীভাবে নাস্তিকতার সূচনা ঘটে?

রাকিবুল হাসান:

নাস্তিক্যবাদের প্রবক্তারা দাবি করেন—নাস্তিকতা নিতান্তই বৈজ্ঞানিক এবং সুচিন্তিত বুদ্ধিবৃত্তিক পছন্দ। এখানে আদর্শ এবং রাজনীতির কোনো দখল নেই। পক্ষান্তরে ধর্ম হচ্ছে অযৌক্তিক কাজ; এটা মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক এবং আদর্শিক রীতিনীতির ওপর নির্ভরশীল। এই দলটির নেতৃত্বে আছেন ‘দ্য ইলিউশন অব গড’ এর লেখক রিচার্ড ডকিন্স। কিন্তু এই দাবি কতটুকু সত্য? নাস্তিকতার উৎপত্তি কোথায় হয়? এটা কি নিতান্তই যৌক্তিক মতবাদ নাকি এর সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক এবং আদর্শিক দিকগুলোও জড়িত আছে?

নব্য নাস্তিকতার সূচনা

আমেরিকান মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক পল ফিৎজ তার ‘নাস্তিকতার মনস্তত্ত্ব’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি আমার ১৮ বছর বয়স থেকে ৩৮ বছর বয়স পর্যন্ত নাস্তিক ছিলাম। এই সময়ে যে বিষয়গুলো আমাকে নাস্তিকতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে, ধর্মের প্রতি সন্দিহান করে তুলেছে, সেগুলো ছিলো নিতান্তই অযৌক্তিক, বাড়াবাড়ি, বৌদ্ধিক এবং নৈতিক সততামুক্ত। আমি নিশ্চিত—বর্তমানের নাস্তিকদের মধ্যে এই বিষয়গুলোই প্রচলিত।’

তাই নব্য নাস্তিকতার উদ্দেশ্য জানতে হলে আগে জানতে হবে কোথায় তার উৎস। ইতিহাসের কোন ক্ষণে নাস্তিক্যবাদী চিন্তাধারা বিস্ফারিত হতে শুরু করে।

রামসেস আওদ তার ‘পশ্চিমা চিন্তায় নাস্তিকতা’ বইয়ে নাস্তিকতার সূচনা নিয়ে কথা বলেছেন। তার মতে, আসলে ইতিহাসের নির্দিষ্ট কোন ক্ষণে নাস্তিকতার জন্ম, তা নির্ধারণ করা কঠিন। তবে আধুনিক যুগের পূর্বে নাস্তিকতা কখনও এত সংগঠিতভাবে আবির্ভূত হয়নি। তখন নাস্তিকতা মানে ছিল ধর্মবিরোধী এবং প্রচলিত ধর্মীয় রীতি থেকে নিজেকে মুক্তকরণ। স্রষ্টাকে অস্বীকার করা নয়। মধ্যযুগে ইউরোপীয় সমাজে রোমান ক্যাথলিক চার্চের আধিপত্য ছিলো। খৃস্টান পাদ্রীরা ধর্মের নামে কৃষক ও নিম্নবিত্তদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের মাশুল ও কর আদায় করতো। খৃস্টধর্মের বিলিভ ও বিশ্বাস বিরোধী কিছু করলেই তাকে আখ্যায়িত করা হতো ধর্মদ্রোহী নামে। চালানো হতো কঠিন নির্যাতন। গীর্জার নানা ধরণের জুলুম ও অত্যাচারের প্রভাব পড়তে শুরু করে জনমনে। তখন নাস্তিকতা তথা ধর্মের বিরোধিতা এসব নির্যাতিত জনগণের বিকল্প হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু নির্যাতনের ভয়ে কেউ তার দ্রোহ প্রকাশ করতো না। তখন ব্যারন ডলবাচ এবং ডেনিস দিদারোর মতো বড় বড় নাস্তিকগণ ছদ্মনামে নাস্তিকতার প্রচারের জন্য সাহিত্য রচনা করতেন।

তাহলে নাস্তিকতার ছদ্মাবরণ এবং গোপনীয়তার পর্দা উন্মোচিত হলো কখন? ব্রিটিশ গবেষক জুলিয়ান প্যাগিনি ব্যাখ্যা করেছেন—১৭৮৯ সালে তৎকালীন ফ্রান্সের রাজা এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর জুলুম ও অত্যাচারে জর্জরিত জনসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে গণবিপ্লব ঘটায়। ফরাসি এই বিপ্লবই ধর্ম এবং স্রষ্টা সম্পর্কে মানবিক চিন্তার বাঁকবদলের মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত ঐতিহাসিকদের কাছে। কোনো কোনো নাস্তিক এক পা এগিয়ে বলেছেন, ‘নাস্তিকতাই ছিল ফরাসি বিপ্লবের প্রাণ।’

রাজনীতি ও নাস্তিকতা

ফরাসি সাহিত্যের অধ্যাপক জয়নব আবদেল আজিজ ‘নাস্তিকতা এবং তার কারণ : চার্চের কালো ইতিহাস’ বইয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক উল্লেখ করেছেন। তা হলো—মধ্যযুগে ইউরোপে খৃস্টান পাদ্রীদের ধর্মীয় অত্যাচার কেবল ধর্মের বিরুদ্ধেই নাস্তিকতাকে উস্কে দেয়নি, বরং নাস্তিকদেরকে ‘মানবধর্মে’র প্রতিও চালিত করেছিলো। এই মানবধর্মের লড়াই খৃস্টানদের সাথে।

জয়নব আরও লিখেছেন, তৎকালীন দার্শনিকদের মতে—তখনকার বিতর্ক স্রষ্টা নিয়ে ছিলো না। তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এমন একটা মানদণ্ড দাঁড় করানো, যা ধর্মের জুলুম ছিন্ন করে মানুষের সম্মান এবং অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবে।

এভাবেই তখন এই মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস নাস্তিকতার সমর্থক হয়ে উঠলো। যেহেতু নাস্তিকতা চার্চের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আদর্শিক প্রতিশব্দ, তাই বলা যায়, নাস্তিকতার প্রধান এবং মৌলিক কারণ ছিল রাজনৈতিক।

বৈদেশিক নীতি বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সালে কালো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর নাস্তিকদের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছিলো। সমকামি বিবাহকে বৈধতা দেয়া হয়েছিলো। আরব বিশ্বে নাস্তিকতা ছড়ানোর ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক কারণটিকে উপেক্ষা করা যায় না। আরব বসন্ত এবং সামরিক অভ্যুত্থানের পর আরব বিশ্বের যুবকদের মধ্যে হাতাশা এবং মানসিক বিষাদ বিস্তৃত আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই হতাশা তাদেরকে স্রষ্টা থেকে মুখ ফিরিয়ে নাস্তিকতার দিকে ঠেলে দেয়।

এ বিষয়ে দুটি সমীক্ষা করেছিলো আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশন। প্রথম সমীক্ষায় দেখা গেছে—৫৪ শতাংশ নাস্তিক হতাশা, বিষাদ এবং নৈরাশ্যের কারণেই নাস্তিকতায় প্রলুব্ধ হয়েছে। দ্বিতীয় সমীক্ষায় সেই সংখ্যা বেড়ে ৭২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

পরিবার এবং নাস্তিকতা

কিছু গবেষক নাস্তিকদের পারিবারিক পটভূমি অধ্যয়ন করেছিলেন। যেন একজন নাস্তিকের ধর্মত্যাগের কার্যকরণ ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করতে পারেন। যেমন পল ফিৎজ এক্ষেত্রে পিতামাতার অবহেলা তত্ত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এদের বাবা-মা আছে, তবে তারা দুর্বল। সাহসী নয়। এরা শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ফলে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে এদের বেগ পেতে হয়। তবে তাদের বাবা-মা যদি ভালো হয়, নেককার হয়, তাহলে খুব সহজেই তারা স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস আনয়ন করতে পারে। কখনও কখনও বাবার জায়গা পূরণ করতে পারে ভালো একজন শিক্ষক। তাহলেও এরা শিক্ষকের সান্নিধ্যে থেকে আলো নিতে পারে। আদর্শ নিতে পারে।’

‘নাস্তিকের মনস্তাত্ত্বিক প্যাটার্ন’ বইয়ে মনোবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন হালাহমি তার একটি গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেছেন। যা আমেরিকান এসোসিয়েশন অ্যাডভান্সমেন্ট অফ অ্যাথেন্সমেন্টের ৩২০ সদস্যের ওপর পরিচালিত হয়েছিলো। এই সমীক্ষায় দেখা যায়—এদের অর্ধেকই বয়স বিশের আগে নাস্তিকতা গ্রহণ করেছিলো। তারা তাদের পিতা-মাতার একজন হারিয়েছিলো বয়স বিশের আগেই। শৈশবে কৈশোরে তারা পড়েছিলো শিক্ষা সংকটেও। বেঞ্জামিন আরও বলেছেন, ‘পিতা-মাতা ধর্মপালনে যতটুকু অবহেলা করে, ঠিক ততটুকুই সন্তানের ধর্ম থেকে সরে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। যারাই ধর্ম থেকে সরে পড়েছে, যদিও ধর্মীয় পরিবারে তাদের বেড়ে উঠা, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো ছিলো না।’

তবে পল ফিৎজ শুধু বাবা-মায়ের কাউকে হারানোকেই পারিবারিক কারণ হিসেবে ধরেন না। তার সঙ্গে যুক্ত করেন সমকালীন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদেরও। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের পদস্খলনও নাস্তিকতার মাঠ তৈরীতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের তখন দিগম্বর করতে উঠেপড়ে লাগে মিডিয়াগুলো। পল ফিৎজ নিজেই স্বীকার করেছেন, মিডিয়ার কল্যানে নাস্তিকতার অযৌক্তিক কারণগুলো দীর্ঘকাল তাকেও অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছিলো। কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি আকিদার অধ্যাপক, তরুণদের নাস্তিকতা কাউন্সেলিং বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ আল আল আওদিও এক সাক্ষাৎকারে মিডিয়ার ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন।

নাস্তিকতার মানসিক কারণ

নাস্তিকতার রাজনৈতিক এবং পারিবারিক কারণ বাদ দিলেও মানসিক কারণটা বাদ দেয়া যাবে না কখনোই। এই কারণটা একান্তই নিজের, একান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এর সঙ্গে বিজ্ঞান ও যুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন আমেরিকান প্রসিদ্ধ নাস্তিক মর্তিমার অ্যাডলারের সামনে যখন আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ তুলে ধরা হলো, তিনি ঈমান আনেননি। কেন আনেননি? এর কারণ বলেছেন তিনি নিজেই—’আসলে আমি ধর্মীয় ব্যক্তি হিসেবে বাঁচতে চাইনি। কারণ এর জন্য আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।’

সুতরাং প্রতীয়মান হয়—অ্যাডলারের নাস্তিকতার কারণ বৈজ্ঞানিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক নয়। তার কারণ কেবল মানসিক চাহিদা। নাস্তিকদের মধ্যে এই কারণটি বারবার দেখতে পাওয়া যায়।

মিসর এবং আরবের কিছু নাস্তিক যুবকের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো চিকিৎসক এবং অধ্যাপক ওমর শরিফকে। তিনি যুবকদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কুরআন নিয়ে তোমাদের একটি সন্দেহ আমাকে বলো। আমি উত্তর দেবার চেষ্টা করবো।’ কিন্তু তারা কোনো সন্দেহ উপস্থাপন করতে পারেনি। তিনি যুবকদের নিয়ে তিনটি ক্লাস করেছিলেন। তৃতীয় ক্লাসে এক যুবক বলেই বসলো, ‘তিনি যেন আর ক্লাসে না আসেন। সে তার অবস্থা নিয়েই সন্তুষ্ট।’ ডা. ওমর আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একটি মোবাইল কেনার আগে তো আমরা কত পড়াশুনা করে যাই। কোন মোবাইল ভালো হবে রিসার্চ করি। অথচ ধর্মত্যাগের আগে কোনো যুবক এতটুকু পড়াশুনাও করে না। এতটুকুও না।!’

The post কীভাবে নাস্তিকতার সূচনা ঘটে? appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%95%e0%a7%80%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a7%87-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%82%e0%a6%9a%e0%a6%a8%e0%a6%be/

No comments:

Post a Comment