Friday, September 4, 2020

ধর্ম বনাম নাস্তিকতা : সহিংসতার স্বরূপ সন্ধানে

ইফতেখার জামিল:

আদিকাল থেকেই মানুষ শান্তিপূর্ণ জীবনের স্বপ্ন দেখে এসেছে। স্বপ্নপূরণে সবচেয়ে বড় বাঁধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে সহিংসতা। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ কখনোই সহিংসতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সহিংসতা ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী। আধুনিক যোগাযোগ, তথ্য ও প্রযুক্তি মানুষের জীবনে এনেছে স্বাচ্ছন্দ্য— তবে মানুষকে বিভেদ-বিভক্তি-সহিংসতার ভয় থেকে মুক্তি দিতে পারেনি, অদূর ভবিষ্যতেও এই আশঙ্কা থেকে মুক্তি মিলবে বলে আশা করা যায় না।

কেন মিলছে না এই আশঙ্কা থেকে মুক্তি— অনেকে অনেকভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করেন। এর মধ্যে নাস্তিক ও নব্যনাস্তিক ধারায় সহিংসতার জন্য ধর্মকে দায়ী করার বিশেষ প্রবণতা দেখা যায়। তাদের ব্যাখ্যা মতে, ধর্মের কারণেই পৃথিবীতে যত অশান্তি ও বিভক্তি। মানুষ যদি ধর্মমুক্ত হয়ে যায়, তবে মানুষের জাগতিক জীবন হয়ে উঠবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ; থাকবে না রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা।

যেহেতু নাস্তিকদের কাছে ইহজাগতিক জীবনই সবকিছুর শুরু ও শেষ, নাস্তিকতায় কোন পুনর্জন্ম বা পরকালীন জীবনের প্রতিশ্রুতি নেই, তাই নাস্তিকদের দিক থেকে সহিংসতার প্রশ্ন সমাধান করাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সহিংসতা প্রশ্নের সমাধান না করতে পারলে ইহকালীন জীবনে কোনভাবে শান্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নাস্তিকতা মানুষের সামনে উপস্থিত করতে পারছে না বিকল্প প্রস্তাব।

সহিংসতায় ধর্মীয় দায়

ধর্মই প্রধানত সহিংসতার জন্য দায়ী— এই বক্তব্যের মূল ভিত্তি হচ্ছে, মানুষ স্বভাবগতভাবেই শান্তিপূর্ণ ; স্বাভাবিকভাবে শান্তি ও সৌহার্দ রক্ষা করাই তার মৌলিক প্রবণতা। বিদ্বেষ, বিরোধ ও বিভক্তি মানুষের মৌলিক চরিত্রের অংশ নয়। ধর্মই মানবসমাজে কৃত্তিম হিংসা-বিদ্বেষ তৈরি করছে, মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছে রক্তপিপাসা। এভাবে এই বক্তব্য মতে ধর্মই প্রধানত সহিংসতার জন্য দায়ী।

নব্যনাস্তিকদের মধ্যে স্পষ্টভাবে ও সেকুলার ‘মানবতাবাদী’দের মধ্যে অস্পষ্টভাবে এই বক্তব্য পাওয়া যায়। নব্যনাস্তিকদের অন্যতম প্রধান পুরুষ স্যাম হ্যারিসের মতে ধর্ম হচ্ছে ”the most prolific source of violence in our history” অর্থাৎ আমাদের ইতিহাসে ধর্মই সহিংসতার সবচেয়ে বড় সূত্র।

আরেক প্রবক্তা রিচার্ড ডকিন্সের মতে, ”I do say all religions are bad, but it’s a worse temptation to say all religions are equally bad because they’re not, , , ,”If you look at the actual impact that different religions have on the world, it’s quite apparent that at present the most evil religion in the world has to be Islam.” অর্থাৎ তার মতে সব ধর্ম খারাপ হলেও সবচেয়ে বেশী খারাপ হচ্ছে ইসলাম।

ইসলামে সহিংসতার স্বরূপ

আল্লাহ পৃথিবীতে আদমসন্তান পাঠানোর সংকল্প প্রকাশ করলে ফেরেশতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, মানব সম্প্রদায় পৃথিবীতে রক্তপাত, সহিংসতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করবে— তারা পৃথিবীতে আদমসন্তান পাঠানোর বিরোধিতা করেন। আল্লাহ ফেরেশতাদের এই দাবী না মেনে নিলেও তাদের যুক্তি খণ্ডন করেননি। মানবসম্প্রদায়ের চরিত্র ও প্রবণতা নির্ধারণে এই বর্ণনা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

এর থেকে বুঝা যায়, রক্তপাত, সহিংসতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীতে মানুষের উপস্থিতি অর্থহীন হয়ে যাবে না। সহিংসতা মাত্রই খারাপ বলা যায় না, সহিংসতা হক-বাতিলের দ্বন্ধের প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া। ‘আল্লাহ যদি মানব সম্প্রদায়ের একাংশকে অপর অংশের মাধ্যমে প্রতিহত না করতেন, তবে অবশ্যই পৃথিবী বিশৃঙ্খলাপূর্ণ হয়ে যেত ( সূরা বাকারা, ২৫১)। ‘ ‘আল্লাহ যদি মানব সম্প্রদায়ের একাংশকে অপর অংশের মাধ্যমে প্রতিহত না করতেন, তবে খৃস্টানদের গির্জা, ইবাদতখানা, ইহুদী ধর্মশালা ও মুসলমানদের মসজিদ— সব ধ্বংস করে ফেলা হত ( সূরা হজ্ব, ৪০ ) ।

মানুষ মৌলিকভাবে সহিংস বা শান্তিপূর্ণ কোনটাই নয়। মানুষ ইচ্ছা, বুদ্ধি ও শারীরিক ক্ষমতার অধিকারী ; এর ভিত্তিতে মানবমন কখনো অকল্যাণ ও সহিংসতা করতে আহ্বান করে। ‘মানুষের মন তো মন্দ কাজপ্রবণ’ ( সূরা ইউসুফ, ৫৪ )। আবার কখনো কল্যাণপ্রবণ হয়ে যায়। ‘যারা ঈমান আনে, যাদের মন আল্লাহর জিকিরে প্রশান্ত হয়। নিশ্চয় আল্লাহর জিকিরেই মন প্রশান্ত হতে পারে’ ( সূরা রা’দ, ২৮)। আবার কখনো দুলতে থাকে কল্যাণ ও অকল্যাণের মাঝে। ‘আমি কসম করি তিরস্কারকারী মনের’ ( সূরা কিয়ামাহ, ২)।

মোটকথা মানুষের মধ্যেই কল্যাণ-অকল্যাণ ও শান্তি-সহিংসতার বীজ লুকিয়ে আছে। এ দু’টির কোনটিই তার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। পরবর্তীতে শয়তান তাকে অকল্যাণ-সহিংসতায় প্ররোচিত করে। নবী-রসূল-আলেমগণ প্রণোদিত করেন কল্যাণ-শান্তিপূর্ণতায়। তবে আমরা আগেই দেখেছি, মানব ইতিহাস একরৈখিক নয় ; কখনো বাতিলপন্থীরা ক্ষমতা পেয়ে যায়, তাদের দমন করতে হকপন্থীদের সহিংসতা করতে হয়। সেই সক্ষমতা না থাকলে হকপন্থীদের বাতিলপন্থী পরীক্ষায় ধৈর্য ধরতে হয়।

‘আমি সময়কে মানুষের মধ্যে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। যাতে আল্লাহ নিশ্চিত করতে পারেন কারা প্রকৃত ঈমানদার, পাশাপাশি তিনি তোমাদের একাংশকে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে চান— নিশ্চয় আল্লাহ জালেমদের পছন্দ করেন না। তিনি মুমিনদের পরীক্ষার মাধ্যমে পবিত্র করতে চান, পাশাপাশি কাফেরদেরকে করতে চান নিশ্চিহ্ন। তোমরা কি মনে করো, তোমরা সহজেই জান্নাতে প্রবেশ করবে—অথচ এর আগে আল্লাহ মুজাহিদ ও ধৈর্যশীলদের চিনে নিবেন না?’ ( সূরা আলে ইমরান, ১৪০-৪২)

আলবেয়ার ক্যামুর দোহাইয়ে বলা যায়, ‘আমরা সাধারণত প্রশ্ন করি, যুদ্ধ কোথায় থাকে ; যুদ্ধ কেন এত জঘন্য—তবে আমরা এখন জানি, যুদ্ধ কোথায় বাস করে ; যুদ্ধ বাস করে আমাদেরই মনের ভেতরে।’

‘কাফেরদের হত্যা করো’

কোরআনের একটি আয়াত নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়— সূরা তাওবার পঞ্চম আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা মুশরিক পেলেই হত্যা করো। ইসলামের সহিংসতা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যা কী— ইসলাম কি নির্বিচারে সহিংস হয়ে উঠার নির্দেশনা প্রদান করে?

প্রেক্ষাপট ও প্রসঙ্গ বর্ণনা না করে উল্লেখিত আয়াত বললে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হবেই। এই আয়াতের সাথেই দু’টি ব্যতিক্রম বর্ণিত হয়েছে : কেউ মুসলমান হয়ে গেলে পূর্ণ নিরাপত্তা পাবে, পাশাপাশি নিরাপত্তা প্রার্থনা করলেও পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করা হবে। পরবর্তীতে চাইলে তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছিয়ে দেওয়া হবে। এ ছাড়াও এই আয়াতের তিন পৃষ্ঠা আগেই বর্ণিত হয়েছে, ‘ যদি তারা সন্ধিগ্রহণ করতে আগ্রহী হয়, তবে আপনিও সন্ধিগ্রহণ করুন সূরা আনফাল, ৬১) । যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি ও দেশ থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের সাথে সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ বাধাপ্রদান করেননি। বরং আল্লাহ তো ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন ( সূরা মুমতাহিনাহ, ৮) ।

এসবের ভিত্তিতে মুসলিম আইনবিদগণের মতে যুদ্ধ ও সহিংসতার বৈধতা শর্তাধীন। তাদের ব্যাখ্যা মতে, যুদ্ধ ও সহিংসতা বৈধতার মূল কারণ কাফেরদের শক্তি। ইসলাম কাফেরদের বাতিল শক্তি ও পন্থী বলে অভিহিত করে। তাই তারা শক্তিমান হয়ে উঠলে তাদের প্রতিরোধ করা জরুরি হয়ে উঠে। প্রতিরোধ সরাসরি চুক্তির মাধ্যমেও হতে পারে, আবার সহিংসতা ও যুদ্ধের মাধ্যমেও হতে পারে। এভাবে সাময়িক যুদ্ধ বা যুদ্ধের প্রস্তুতিই দীর্ঘমেয়াদী শান্তির নিশ্চয়তা।

সহিংসতায় নাস্তিকতার দায়

ধর্মই প্রধানত সহিংসতার জন্য দায়ী— এটি আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বড় মিথের একটি। মজার বিষয় হচ্ছে, এর প্রধান প্রবক্তারা ছিলেন সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের একনিষ্ঠ সমর্থক। যে যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েকটি কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। যে কোন বিবেচনায় একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধকেই সবচেয়ে বড় সহিংসতা বলে আখ্যা দিতে হবে।

ইতিহাসের দিকে তাকালেও এর পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা স্ট্যালিন-হিটলারের গণহত্যাকেও ধর্মীয় সহিংসতা বলা যায় না। পাশাপাশি শুধু গতশতকেই এই ধারা সীমিত নয়, প্রখ্যাত প্রফেসর নাফীদ শায়েখের গবেষণা মতে গত দুই হাজার বছরে যত সহিংসতা হয়েছে, তার মধ্যে নাস্তিকতার অবদান প্রায় বাইশ শতাংশ। অর্থাৎ গত দুই হাজার বছরে যত বড় বড় সহিংসতা হয়েছে, তার মধ্যে নাস্তিকদের ভূমিকা মুসলমানদের চাইতে প্রায় চার-পাঁচগুণ বেশী।

শান্তির জন্য যুদ্ধ, যুদ্ধের জন্য শান্তি

এখানে একটি প্রশ্ন তৈরি হতে পারে : ইসলাম ও নাস্তিকদের যুদ্ধদর্শনে মূল পার্থক্য কোথায়? নাস্তিকদের মতে তারা একটি সহিংসতামুক্ত পৃথিবী তৈরিতে আগ্রহী। পক্ষান্তরে ইসলামের ব্যাখ্যা মতে পৃথিবীতে কখনোই পরিপূর্ণ শান্তি বিরাজ করবে না। এখানে মানুষকে সহিংসতার পরীক্ষা দিতেই হবে। বাতিলপন্থীদের সহিংসতা দমনের পরীক্ষা দিতে হবে, দমন না করতে পারলে দিতে হবে ধৈর্যের পরীক্ষা : এভাবেই আল্লাহ সময়কে আবর্তিত করে থাকেন। মানবসভ্যতাকে এই আবর্তনেই টিকিয়ে রেখেছেন। আলবেয়ার ক্যামু যেমন বলেছেন, যতদিন পৃথিবীতে মানুষ ও মানুষের মন টিকে থাকবে, ততদিন থাকবে সহিংসতা।

মুসলিম তাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যা মতে শান্তির জন্যই সহিংসতা জরুরি। আপনার যদি প্রয়োজনীয় সহিংসতা সৃষ্টি ও প্রতিরোধ করার সক্ষমতা না থাকে, তবে জুলুম ও বাতিল থেকে বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। এই সহিংসতা হবে নৈতিকতা, আত্মসংযম ও উদ্দেশ্যের সাথে সংযুক্ত; উদ্দেশ্যহীন সহিংসতা কোনভাবেই কাম্য নয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, নাস্তিক ও নব্যনাস্তিকরা কেন এই ধর্মীয় বা ইসলামি সহিংসতার বিরোধিতা করে ও পাল্টা সহিংসতার আহবান করে? প্রখ্যাত গবেষক William T. Cavanaugh তার The Myth of Religious Violence: Secular Ideology and the Roots of Modern Conflict বইয়ে লেখেন, ধর্মীয় সহিংসতাকে দোষারোপ করে সেকুলার সহিংসতাকে সমর্থনের মূল কারণ হচ্ছে, বিপক্ষের সহিংসতাকে অবৈধ ঘোষণা করে পক্ষের সহিংসতার সমর্থন যোগানো।

এই দ্বিচারিতাই আধুনিক সহিংসতা প্রশ্নের মৌলিক ও প্রধান স্বরুপ।

The post ধর্ম বনাম নাস্তিকতা : সহিংসতার স্বরূপ সন্ধানে appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%a7%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae-%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%ae-%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%95%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%82/

No comments:

Post a Comment