Wednesday, September 23, 2020

আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সংক্ষিপ্ত জীবনী

ফাতেহ ডেস্ক:

উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেমে দ্বীন, বাংলাদেশের ইসলামি শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের একজন ছিলেন শাহ আহমদ শফী; যিনি আল্লামা শাহ আহমদ শফী বা আল্লামা শফী নামেও পরিচিত। একাধারে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা সমূহের শীর্ষ সংগঠন আল হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া এর চেয়ারম্যান, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি, হেফাজতে ইসলামের আমির, আল-জামিয়াতুল আহলিয়া মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী চট্টগ্রাম মাদ্রাসার দীর্ঘ দিনের সম্মানিত মহাপরিচালক। তিনি ১৯১৫ সালে, মাতান্তরে আনুমানিক ১৯২০ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বরকত আলী ও মায়ের নাম মেহেরুন্নেছা।

শিক্ষা

শাহ আহমদ শফী রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায় তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এরপর পটিয়ার আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া জিরি মাদ্রাসায় কিছুদিন লেখাপড়া করেন। তারপর তিনি হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে দীর্ঘদিন অধ্যয়ন করার পর ১৯৪১ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হন এবং চার বছর অধ্যয়ন করেন। এ সময় তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসাইন আহমদ মাদানির সংস্পর্শে আসেন এবং তার কাছে আধ্যাত্মিক শিক্ষালাভ করেন।

দারুল উলুম দেওবন্দে তিনি শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ. কাছে বুখারি, শায়েখ ইবরাহীম বেলওয়াবি রহ. এর কাছে মুসলিম, শায়েখ এজাজ আলী রহ. এর কাছে আবু দাউদ, শায়েখ ফখরুল হাসান রহ. এর কাছে নাসায়ী, জহুরুল হক দেওবন্দী রহ. এর কাছে মুয়াত্তায়ে মালেক এবং শায়েখ আব্দুজ জলিল রহ. এর কাছে মুয়াত্তায়ে মুহাম্মাদ এর দরস গ্রহণ করেন।

কর্মজীবন

আল্লামা আহমদ শফী ১৯৪৬ সালে দেওবন্দ থেকে ফিরে বাড়িতে যাননি। সরাসররি এসে উপস্থিত হন দারুল উলুম হাটহাজারীতে। মাদরাসার তৎকালীন মুহতামীম শাহ আবদুল ওহহাব সাহেব রহ. তাকে বললেন, ‘হাটহাজারী থাকবে?’ আহমদ শফী বললেন, ‘আপনি বললে থাকবো।’ তারপর তিনি দারুল উলুম হাটহাজারীতে শিক্ষকতা শুরু করেন। হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম ছিল–পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কাউকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হতো। আগে কোথাও শিক্ষকতা করেছে এমন। কিন্তু আহমদ শফী ছিলেন একমাত্র শিক্ষক, যার পূর্ব অভিজ্ঞতা তালাশ করা হয়নি। শিক্ষা শেষ করার পর সরাসরি নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

১৪০৭ হি./১৯৮৬ সালে মাদরাসার মজলিশে শুরা তাকে মহাপরিচালক বা মুহতামিম নিযুক্ত করে। পরবর্তীতে তিনি মাদরাসাটির শায়খুল হাদিসের দায়িত্বও পান। তার পরিচালনার সময়ে তরতর করে উন্নতি হয় মাদরাসার। শিক্ষাগত এবং কাঠামোগত–দুটো ক্ষেত্রেই। তার পরিচালনার সময়েই মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষাচুক্তি হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী হাটহাজারী মাদরাসার সার্টিফিকেট দিয়ে কেউ চাইলে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে।

২০০৮ সালে শাহ আহমদ শফী কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাক-এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি কওমি মাদরাসাগুলোর সরকারি স্বীকৃতির দাবিতে অনুষ্ঠিত আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এর প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল সুদীর্ঘকালের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের (আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ) সমমান ঘোষণা করেন। তখন আইন অনুসারে কওমি মাদরাসার ৬টি বোর্ডের সমন্বয়ে আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ গঠন করা হয়। এ বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও আহমদ শফীর উপর ন্যস্ত করা হয়।

২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আহমদ শফীর পদত্যাগ এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে মাদরাসা থেকে বহিষ্কারসহ ৫ দফা দাবি নিয়ে দারুল উলুম হাটহাজারীর ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। দুপুর থেকে এ আন্দোলন শুরু হয়, রাত্রে আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করা হয় এবং পরদিন আহমদ শফী পদত্যাগ করেন।

দ্বীনি আন্দোলন

বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রভাব রাখা আলেমদের একজন ধরা হয় আল্লামা শফীকে। দেশে অনসৈলামিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ও নাস্তিকদের শাস্তির দাবিতে তাঁর ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রভাব তৈরি করে। তিনি ১৯ জানুয়ারি ২০১০ সালে হাটহাজারী মাদরাসার এক সম্মেলনে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩ সালে দেশে নাস্তিক্যবাদী তৎপরতায় মুসলিম জনসাধারণের উদ্বেগ বৃদ্ধি পেলে একটি খোলা চিঠি লিখে জাগরণ সৃষ্টি করেন আল্লামা আহমদ শফী । ৬ এপ্রিল ২০১৩ সালে তাঁর নেতৃত্বে ইসলাম ও মহানবী সা.-এর কটূক্তিকারীদের বিচারের দাবিতে ঢাকায় বৃহত্তম সমাবেশ হয়। অতঃপর ৫ মে ঢাকাসহ পুরো দেশ অবরোধ করা হয়।

এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকদিন। ভারতে বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ, ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের প্রতিবাদ, তাসলিমা নাসরীন খেদাও আন্দোলনসহ সরকারের ফতোয়া বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলনে তৎকালীন সময়ে আল্লামা শফি ছিলেন প্রথম সারিতে।

পরিবার

স্ত্রী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে পারিবারিক জীবন গড়েন আল্লামা আহমদ শফী। দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক তিনি। বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ পাখিয়ারটিলার মাদরাসার পরিচালক। ছোট ছেলে মাওলানা আনাস হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক। মেয়েদের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে পাত্রস্থ করেছেন।

লেখালেখি

আল্লামা শফী ছিলেন ঊর্দু, ফার্সি, আরবি ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষায় একজন সুদক্ষ পণ্ডিত। তিনি বাংলায় ১৩টি এবং উদুর্তে ৯টি বই রচনা করেছেন।

তার রচিত বাংলা বইগুলো হলো–হক্ব ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব, ইসলামী অর্থব্যবস্থা, ইসলাম ও রাজনীতি, ইজহারে হাকিকত, মুসলমানকে কাফির বলার পরিণাম, সত্যের দিকে করুণ আহ্বান, ধূমপান কি আশীর্বাদ না অভিশাপ, একটি সন্দেহের অবসান, একটি গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া, তাবলিগ একটি অন্যতম জিহাদ, ইছমতে আম্বিয়া ও মিয়ারে হক, সুন্নাত-বিদআতের সঠিক পরিচয়, বায়আতের হাকিকত।

তার রচিত উর্দু বইগুলো হলো–আল বয়ানুল ফাসিল বাইনাল হককে ওয়াল বাতিল, আল হুজাজুল ক্বাতিয়াহ লিদাফয়িন নাহজিল খাতেয়াহ, আল খায়রুল কাসির ফি উসুলিত তাফসির, ইসলাম ওয়া ছিয়াছত, তাকফিরে মুসলিম, চান্দ রাওয়েজাঁ, ফয়ুজাতে আহমদিয়া, সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফয়জুল জারি ও মিশকাতুল মাসাবিহের ব্যাখ্যাগ্রন্থ।

সম্মাননা ও পুরস্কার

১৯ আগস্ট ২০০১ সালে ওমরা পালনকালে হারামাইন শরিফাইনের মহাপরিচালক শায়খ সালেহ বিন আল হুমাইদ পবিত্র কাবার গিলাফের একটি অংশ উপহার প্রদান করেন। ২০০৫ সালে জাতীয় সিরাত কমিটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘শ্রেষ্ঠ ইসলামী ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে সম্মাননা ও স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। এ ছাড়া দেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তাঁকে নানা সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

মৃত্যু

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে শাহ আহমদ শফী বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন।

পরদিন হাটহাজারী মাদ্রাসায় তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় ইমামতি করেন তার বড় ছেলে ইউছুফ মাদানি। স্থান সংকুলান না হওয়ায় তার লাশ ডাকবাংলোতে নিয়ে আসা হয়। পুরো হাটহাজারীর সব প্রবেশ পথে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দিতে প্রশাসন বাধ্য হয়। ৪ উপজেলায় ১০ প্লাটুন বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ এবং ৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করা হয়। জানাযা শেষে তাকে হাটহাজারী মাদ্রাসা ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে বায়তুল আতিক জামে মসজিদের সামনের কবরস্থানে দাফন করা হয়। মিডিয়া এটিকে বাংলাদেশের স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জানাযা বলে অবহিত করে।

The post আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সংক্ষিপ্ত জীবনী appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be-%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b9-%e0%a6%86%e0%a6%b9%e0%a6%ae%e0%a6%a6-%e0%a6%b6%e0%a6%ab%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95/

No comments:

Post a Comment