Wednesday, September 23, 2020

আল্লামা আহমদ শফী : দুর্দিনের দিশারী

আবুল কাসেম আদিল:

আল্লামা আহমদ শফী অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পূর্ব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও বার্ধক্য জনিত অসুস্থতার মধ্যে তিনি অভিভাবক সুলভ ভূমিকা পালন করেছেন। জাতির দুর্দিনে দিশারীর ভূমিকা পালন করেছেন। অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে যখন পরলোকগত ও জীবিতরা দিশেহারা, তখন তিনি নিজেই নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। আমাদের দেখা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঘটনা হেফাজতে ইসলামের উত্থান। হেফাজত বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে পেরেছে। কারণ, এর মূলে ছিলেন আহমদ শফী।

এটা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, আমাদের সময়ের সবচে বড় ইসলামী আন্দোলন হয়ে গেল শুধু আহমদ শফীর নামের ওপর দিয়ে। হেফাজতের শক্ত সাংগঠনিক কাঠামো না থাকা সত্ত্বেও এত বড় আন্দোলন হতে পেরেছে, কারণ মূলে ছিলেন আল্লামা আহমদ শফী। আহমদ শফী মানেই হেফাজত। হাফেজ্জী হুজুরের পরে আহমদ শফীই একমাত্র, যিনি আলেম সমাজের বিতর্কমুক্ত অভিভাবক হতে পেরেছেন। এই দেশে আহমদ শফীর চেয়ে যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তি ঢের ছিলেন, এখনো আছেন; কিন্তু বিতর্কমুক্ত ছিলেন খুব কমই। এই জায়গায়ই আহমদ শফী অন্যদের চেয়ে ভিন্ন ও অনন্য।

আল্লামা আহমদ শফী ব্যক্তিমানুষ হিসেবে খুবই সাধারণ, অত্যন্ত সাধাসিধে, চাতুর্যমুক্ত কিন্তু কৌশলী। তাঁর ছাত্র হিসেবে তাঁকে এমনটাই দেখেছি। একাধারে তিনি একজন শিক্ষক, মাদরাসার পরিচালক, সামাজিক আন্দোলনের নেতাসহ বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী।

মাদরাসা-পরিচালক 

সবকিছুর আগে আল্লামা আহমদ শফী দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার পরিচালক। ১৪০৭ হিজরীতে শূরা তাঁকে দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার পরিচালক হিসেবে নিয়োগদান করে। অদ্যাবধি তিনি এই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাঁর পরিচালনার আমলে হাটহাজারী মাদরাসার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। পরবর্তীতে তিনি যা কিছু করেছেন, মাদরাসা-পরিচালনার পাশাপাশি করেছেন। তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল হাটহাজারী মাদরাসা। এজন্য তিনি সবকিছুর ওপর হাটহাজারী মাদরাসাকে প্রাধান্য দিতেন। যদি বলি যে, হাটহাজারী মাদরাসার পরিচালক বলেই তিনি আর সবকিছু হতে পেরেছেন, সবকিছু করতে পেরেছেন— ধারণা করি, ভুল হবে না।

বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বাংলাদেশ কওমী মাদরসা শিক্ষাবোর্ড)-এর চেয়ারম্যান হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান বলেই হতে পেরেছেন। বেফাক-সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ আলেমরা ব্যক্তি আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান মনোনীত করেন নি, হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান মনোনীত করেছেন। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ও দেশের আলেম সমাজের অবিকল্প অভিভাবক হয়েছেন, হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান বলেই। অবশ্য কালক্রমে ধর্মীয় অঙ্গনে তিনি ব্যক্তি হিসেবেও অবিকল্প হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এর শুরুটা হয়েছিল হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান হিসেবে। এর সঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠতারও অনেকাংশে ভূমিকা আছে।

আল্লামা আহমদ শফী যে প্রথমত ও প্রধানত দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার পরিচালক, ধারণা করি এ-ব্যাপারে তিনি সবসময় সচেতন ছিলেন। এজন্য তিনি হাটহাজারী মাদারাসার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়কে সবকিছুর ওপর প্রধান্য দিতেন। ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনার শিকার হবেন জেনেও হাটহাজারী মাদরাসার কল্যাণে কাজ করতেন। প্রসঙ্গক্রমে রেলের জমির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি হাটহাজারী মাদরাসার স্বার্থে জমিটা গ্রহণ করেছেন। যদিও জমিটা তিনি ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেন নি, এতে তাঁর মোটেই ব্যক্তিস্বার্থ নেই; তবু তিনি ব্যক্তি-আক্রমণের শিকার হয়েছেন। আল্লামা আহমদ শফী সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তাঁর সমালোচনা হওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু রেলের জমি কেন্দ্রিক তাঁকে নিয়ে যত সমালোচনা, সব তাঁর প্রতি অবিচার। না জেনেই, অথবা জেনেও তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে দোষী সাব্যস্ত করা অবিচার বৈকি!

শিক্ষক 

আল্লামা আহমদ শফীর অন্যতম একটি পরিচয়, তিনি একজন শিক্ষক। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পর্যায়ক্রমে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এই দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শাইখুল হাদীসের পদও অলংকৃত করেন। শিক্ষকতার প্রতি তাঁর পূর্ণ মনযোগের কথা সুবিদিত। হাটহাজারী মাদরাসার মতো এত বড় প্রতিষ্ঠনের পরিচালনা, কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন, হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বদানের মতো কাজ করা সত্ত্বেও বিদেশ গমন বা প্রবল অসুস্থতা ছাড়া তাঁকে কখনো সময়মত নির্ধারিত ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে দেখা যায় নি।

শিক্ষকতার ‌‘হক’ আদায়ের প্রতি তিনি কতটুকু মনযোগী ছিলেন, এর জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট। ২০১৩ সালের উত্তাল দিনগুলোতেও তিনি নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন। এমন কি ৫ই মে বাংলাদেশের ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পরে চট্টগ্রামে ফেরার পরদিনও তিনি নির্ধারিত ক্লাসে উপস্থিত হয়েছেন। ক্লাসের পর সবাইকে নিয়ে দোয়া করেছেন। আমি নিজে এর একজন সাক্ষী।

ধর্মীয় বক্তা 

আল্লামা আহমদ শফী একজন ধর্মীয় বক্তা। এখনকার মতো তথাকথিত ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তা’ তিনি নন। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে ও ঘরে ঘরে ধর্মীয় ওয়াযের ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ধারণা করা হয়, সুন্নাতের প্রসার ও বিদয়াত দূরিকরণের আন্দোলন ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার নিমিত্তে এই ধারা মুফতী ফয়যুল্লাহ রহ. (হাটহাজারী মাদরসার শিক্ষক ও চট্টগ্রামের বিশেষায়িত দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেখল হামিউস সুন্নাহ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা) চালু করেছেন। ব্যাপারটা ফলপ্রসূ হলে সেখানকার অনেক আলেম রীতিটা ধরে রাখেন। আল্লামা আহমদ শফীও তাঁদের একজন।

মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে তিনি ওয়ায-নসীহত করতেন। কালক্রমে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হওয়ার পরও এই ধারাটি পুরোপুরি ছেড়ে দেন নি। একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত ব্যক্তি রিকশায় চড়ে একটি ঘরোয়া মাহফিলে উপস্থিত হয়ে অল্প সংখ্যক মানুষের সামনে আঞ্চলিক ভাষায় ওয়ায করছেন, এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য খুব কম আছে। আল্লামা আহমদ শফীর ব্যক্তিত্বের অসাধারণ দিকগুলোর এটিও একটি। অনেক বড় হয়েও ব্যক্তিগতভাবে ছোট থাকতে পারা অনেক বড় গুণ।

লেখক 

আল্লামা আহমদ শফী লেখক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করতে না পারলেও তিনি লেখালিখির ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য ভূমিকা আছে। হাটহাজারী মাদরাসার মুখপাত্র মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর সম্পাদক তিনি। তাঁর রচনাগুলোতে তাঁর চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো—

উর্দু 

আল-ফায়যুল জারী (বুখারীর ব্যাখ্যা)
আল-বায়ানুল ফাসিল বাইয়ানুল-হাক্কি ওয়াল-বাতিল
ইসলাম ও সিয়াসাত
ইযহারে হাকীকাত

বাংলা

হক ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব
ইসলামী অর্থব্যবস্থা
ইসলাম ও রাজনীতি
সত্যের দিকে করুণ আহবান
সুন্নাত ও বিদ‌‘আতের সঠিক পরিচয়

কওমী মাদরসাসমূহের অভিভাবক

বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষবোর্ড)-এর চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাসমূহের অভিভাবকের আসনে অধিষ্ঠিত। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে বেফাকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আল্লামা নূরুদ্দীন আহমদ গহরপুরী মৃত্যুবরণ করলে আল্লামা আহমদ শফী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। অদ্যাবধি তিনি এই দায়িত্বে অধিষ্ঠিত আছেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন সময়েই কওমী মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদ মাস্টার্সের সমমান অর্জন করে। যদিও এর কার্যকারিতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কওমী সনদের সরকারি স্বীকৃতি দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে আল্লামা আহমদ শফীর ব্যক্তিগত চেষ্টা অবিস্মরণীয়।

রাজনৈতিক দলের দলনিরপেক্ষ উপদেষ্টা 

যদিও আল্লামা আহমদ শফীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, তবু কওমী ধারার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্য ছিল। অরাজনৈতিক হওয়ার কারণে কোনো ইসলামিক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ছিল না। এজন্য দীর্ঘ সময় ধরে তিনি সবার আস্থার জায়গায় অবস্থান করেছেন। ফলে তিনি আলেমদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নিরসনে ভূমিকা রাখতে পেরেছেন। সমকালীন ইসলামী রাজনীতিকদের তিনি পরামর্শ দিতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে দলনিরপেক্ষ হলেও সামগ্রিকভাবে ইসলামী রাজনীতির পক্ষে তাঁর স্পষ্ট অবস্থান রয়েছে। তিনি সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখতেন। দীর্ঘ জীবনে তাঁকে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের মালিন্য স্পর্শ করে নি। এজন্যই তিনি পরবর্তীতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলে কেউ আপত্তি করে নি। একবাক্যে সবাই তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন। অবশ্য দেশের আলেম সমাজ সময়ের দাবি বুঝতে দেরি করেন নি, আহমদ শফীর নিরঙ্কুশ নেতৃত্বের পক্ষে এটাও সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

সামাজিক আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম 

যদিও তিনি সরাসরি রাজনীতি করতেন না, তবু দ্বীনি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন সময় তাঁকে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, মুফতী ফজলুল হক আমিনী ও মাওলানা ফজলুল করীম রহ.-এর সঙ্গে এক মঞ্চে দেখা গেছে। তখনও তিনি বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের সর্বপ্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত হন নি। তৎকালীন জাতীয় নেতাদের সঙ্গে যুগপৎভাবে ভারতের বাবরী মসজিদ ধ্বংসের ইস্যু, ফারাক্কা বাঁধ ও ফতোয়া-বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন।

হেফাজতে ইসলাম আল্লামা আহমদ শফীর হাতে গড়া প্রথম সংগঠন নয়। আহমদ শফী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যানারে কাজ করেছেন। হেফাজতে ইসলাম গঠনের আগে সর্বশেষ ‘ইসলামী আইন বাস্তবায়ন পরিষদ’-এর ব্যানারে কাজ করেছেন। এই পরিষদ মূলত চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিত। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের জরুরি আইনের সরকার-কর্তৃক গৃহীত ‘জাতীয় নারী উন্নননীতি ২০০৮’-এর বিরুদ্ধে সরব ভূমিকা পালন করে।

হেফাজতে ইসলাম তথাকথিক গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধেও গঠিত নয়। গণজাগরণ মঞ্চ গঠিত হয় ২০১৩ সালে, জামায়াত-নেতা কাদের মোল্লার ব্যাপারে আওয়ামীলীগ সরকার-কর্তৃক গঠিত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল’ যে রায় দেয়, তার বিরুদ্ধে। নজিরবিহীনভাবে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন শুরু হওয়ারও দু’ বছর আগে হেফাজতে ইসলাম গঠিত হয়। গণজাগরণ মঞ্চ গঠিত হওয়ার আগে আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক গৃহীত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ ও ‘জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি ২০১১’-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। যদিও হেফাজতে ইসলামের সেসব আন্দোলন চট্টগ্রামেই সীমাবদ্ধ ছিল। আঞ্চলিকতার সীমা অতিক্রম করতে পারে নি।

একটি চক্র ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির আন্দোলনের আড়ালে ইসলামী মূল্যবোধ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিরোধিতা শুরু করলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পর্যায়ের হেফাজত জাতীয় রূপ লাভ করে। আর এর মাধ্যমে আহমদ শফী আবির্ভূত হন সামাজিক আন্দোলনের সর্বপ্রধান নেতা রূপে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক থেকে হয়ে ওঠেন জাতির আশার আলো। এর আগে ধর্মীয় আন্দোলন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে বহুধা বিভক্ত ছিল। আহমদ শফীর ডাকে সবাই সব বিভক্তি ভুলে এক মঞ্চে উপস্থিত হন। এক্ষেত্রে আল্লামা আহমদ শফীর দীর্ঘদিনের দলনিরপেক্ষতা ও সব দলের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার পলিসি অনেক বড় ভূমিকা রাখে।

আল্লামা আহমদ শফী হেফাজতে ইসলামকে সবসময় দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। এজন্য তিনি হেফাজতের প্রধান দু’টি পদে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বেছে নিয়েছেন। একজন তিনি নিজে, চেয়ারম্যান; অন্যজন মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী, মহাসচিব। দু’জনের রাজনীতির পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু দেশের সব শ্রেণীর আলেমদের কাছে সম্মানীয়। মহাসচিব হিসেবে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে বেছে নিলে রাজনৈতিক বিভক্তির সম্ভাবনা ছিল। তবে অন্যান্য পদগুলোতে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সব ধরনের আলেমদের নিয়েছেন। এজন্যই হেফাজতে ইসলামে বিভক্তি হয় নি। মোটামুটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ নেতৃত্ব বেছে নেয়ার কৃতিত্ব পুরোটাই আল্লামা আহমদ শফীর। এটি তাঁর দূরদর্শিতারও প্রমাণ।

সার্বিক বিচারে হেফাজতে ইসলাম সফল। আমাদের শক্তি সম্পর্কে আমরা নিজেরাই জানতাম না। হেফাজতের উত্থানের মধ্য দিয়ে জানা হলো। দুর্বলতাগুলোও চিহ্নিত হলো। সামনে এই অভিজ্ঞতা অনেক কাজে লাগবে। ইসলাম-বিরোধী শক্তি যে ইসলামী শক্তির তুলনায় ভঙ্গুর, তা চেখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হলো। ইলাউ কালিমাতিল্লাহ, যা আমাদের জীবনব্যাপী প্রচেষ্টার লক্ষ্য— তা পালিত হয়েছে। এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি নেই, এরচেয়ে বড় তৃপ্তি নেই। হেফাজতের উত্থানের মাধ্যমে আমরা ইসলামী শক্তির সরব জাগরণ দেখেছি। এর পাশাপাশি এক ধরনের নীরব জাগরণও আছে। অনেক নন প্রাক্টিসিং মুসলিম আত্মপরিচয় সম্পর্ক সজাগ হয়েছে। এজন্য আমরা হেফাজতের উত্থান-পূর্ব ও উত্থান-পরবর্তী জাতীয় প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চিত্রে ভিন্নতা দেখতে পাই। অনেকের মধ্যে নিজের মুসলিম পরিচয় নিয়ে হীনন্মন্যতা পরিলক্ষিত হতো। এখনকার চিত্র তা থেকে অনেকটাই ভিন্ন। এ-কথাটা প্রমাণ করা মুশকিল। তবে দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা জাতীয় প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি লক্ষ রাখছেন, আশা করি তাঁরা এর সত্যতা পাবেন।

ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে ইসলামের প্রতি ঘৃণা ধারণকারী একদল লোক জাতিকে আদেশ-নির্দেশ দিচ্ছে, এই দৃশ্য খুবই পীড়াদায়ক। যে কোনো মূল্যে তা প্রতিহত করা জরুরি ছিল। হেফাজতে ইসলাম তা পেরেছে। অনেক রক্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে যদিও।

হেফাজতে ইসলাম সফল। সফল কিন্তু এই মুহূর্তে অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক। হেফাজতে ইসলাম যদি এখন বিলুপ্তও হয়ে যায়, তাহলে ধারণা করি কোনো সমস্যা হবে না। সময়ের দাবিতে হেফাজতের যা করণীয় ছিল, তা করেছে। এখন যদি হেফাজত বিলুপ্ত হয়, সময় হলে সময়ের প্রয়োজনে নতুন সংগঠন তৈরি হবে; যেভাবে হেফাজত তৈরি হয়েছিল। সুতরাং হেফাজতের বর্তমান নীরবতায় যাঁরা মনোকষ্টে আছেন, তাঁরা এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে, হেফাজতের যা করার করে ফেলেছে। হেফাজত এখন বিলুপ্ত হলে অসুবিধা নেই। সব সংগঠনই যুগ যুগ ধরে প্রাসঙ্গিক থাকে না। অরাজনৈতিক সংগঠনের যুগ যুগ ধরে প্রাসঙ্গিক থাকার ইতিহাস খুব একটা নেই।

আপোস ও আলোচনা 

আপোসহীন বলতে যা বোঝায়, আহমদ শফী তা নন। প্রয়োজন সাপেক্ষে আলোচনা ও আপোস, শুরু থেকেই আল্লামা আহমদ শফীর অবস্থান ছিল এই। হেফাজতের তুমুল আন্দোলনের মধ্যেও তিনি আলোচনার দরজা বন্ধ করেন নি। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বারবার যোগাযোগ করা হয়েছে, আহমদ শফীও সাড়া দিয়েছেন। তিনি বারবার প্রকাশ্যে বলেছেন, তিনি সরকার পতনের আন্দোলন করছেন না, দাবি আদায়ের আন্দোলন করছেন। দাবি আদায় হলেই তিনি আন্দোলন থেকে সরে আসবেন। দাবি আদায় করার জন্য তিনি আন্দোলনের পাশাপাশি আলোচনার দরজা খোলা রেখেছেন। আল্লামা আহমদ শফী চাইছিলেন, আগে দাবি বাস্তবায়ন, পরে আন্দোলন প্রত্যাহার। পক্ষান্তরে সরকার চাইছিল, আগে আন্দোলন প্রত্যাহার। ফলে আপোসরফা আর হয় নি।

প্রয়োজন সাপেক্ষে আলোচনা ও আপোস, এর অর্থ এই নয় যে, সরকারকে সার্বিক সমর্থন দেয়া ঠিক হবে। হাটহাজারী মাদরাসা ও বেফাক পরিচালনার প্রয়োজনে সরকারের সঙ্গে মতানৈক্য সত্ত্বেও নিরাপদ দূরত্বে থেকে যোগাযোগ রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু শুকরিয়া মাহফিলের নামে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে যা হলো, তা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে যোগাযোগের সংজ্ঞায় পড়ে না ; যদিও শুকরিয়া মাহফিল না হলে স্বীকৃতি দান করা হবে না এমন হুমকিও দেওয়া হয়েছিল, তবু শুকরিয়া মাহফিল আলোচনা ও যোগাযোগের সকল সীমা লঙ্ঘন করেছে। এজন্য শতবর্ষী আল্লামা আহমদ শফী কতটুকু দায়ী আর কতটুকু প্রাসঙ্গিক অনিবার্য পরিস্থিতি, সেটা বিবেচনার দাবি রাখে।

শেষ সময়ের কিছু কর্মকাণ্ড অবশ্যই প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু সার্বিক বিচারে এই জাতির ওপর আল্লামা আহমদ শফীর অবদান অনেক। আশা করি, ইতিহাস তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন করবে।

The post আল্লামা আহমদ শফী : দুর্দিনের দিশারী appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be-%e0%a6%86%e0%a6%b9%e0%a6%ae%e0%a6%a6-%e0%a6%b6%e0%a6%ab%e0%a7%80-%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%a8-2/

No comments:

Post a Comment