সাবের চৌধুরী :
একটা মতাদর্শকে বুঝার জন্য, বরং তার অস্তিত্বের জন্য সে মতাদর্শের নিজস্ব পরিভাষাগুলো অত্যন্ত জরুরী। একটা পরিভাষা একটি চিন্তা ও সিদ্ধান্তকে ধারণ করে। তার সাথে জড়িয়ে থাকে আরো অনেকগুলো প্রাসঙ্গিক ক্ষুদ্র সিদ্ধান্ত। ফলে একটা পরিভাষাকে যখন নষ্ট করে ফেলা হয়, তখন সে মতাদর্শের বিশেষ একটি পরিসরের বুঝাবুঝিতে গোলযোগ তৈরী হয়, এবং এর সাথে জড়িত মূল সিদ্ধান্ত ও প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্তগুলোর অপপ্রয়োগ ঘটার অশংকা সৃষ্টি হয়। এভাবে পরিভাষাগুলো নষ্ট হয়ে তার জায়গায় নতুন মর্ম প্রতিষ্ঠিত হতে থাকলে ধীরে ধীরে সে মতাদর্শের খোলনলচে পরিবর্তিত হয়ে নতুন একটি মতাদর্শের রূপ লাভ করে। এ জন্য ইসলামের পরিভাষাগুলোকে যথাযথ সংরক্ষণ করা ও এসবের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার প্রতি আমাদের মনোযোগ দেওয়া একান্ত দরকার। অন্যথায়, ইসলাম তো কখনো বিলুপ্ত হবে না, কিন্তু বিশেষ অঞ্চল থেকে শুদ্ধ ইসলামের বিলুপ্তি ঘটতে পারে, অস্বাভাবিক নয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে আজকে আমরা নাস্তিক-মুরতাদ এই শব্দদুটো নিয়ে আলোচনা করব। শব্দ দুটো আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এগুলোর সাথে জড়িত সিদ্ধান্তগুলো গুরুতর ও তাই একজন মানুষের অস্তিত্বভেদী।
আদর্শগত দিক থেকে ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে ভাগ মূলত দুইটি : মুসলিম ও অমুসলিম বা মুসলিম ও কাফের। এটা খুবই সাধারণ কথা যে, মুসলমান হওয়া মানে শুধু কালেমায় বিশ্বাসী হওয়া নয়; বরং, আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মানার পাশাপাশি কুরআন ও সুন্নাহ এর বিষয়গুলো থেকে যে বিষয়গুলো অকাট্যভাবে প্রমাণিত, সেগুলোর প্রত্যেকটি বিষয়ে বিশ্বাস রাখা এবং যে কাজগুলো করলে শরীয়াহ এর আলোকে কাফের হয়ে যেতে হয়, সেগুলো থেকে বেঁচে থাকা।
এর ব্যতিক্রম হলে একজন মানুষ অমুসলিম ও কাফের বলে বিবেচিত হয়। বিশ্বাস ও কুফুরিকর্মের ধরণের ভিত্তিতে অমুসলিমদের মধ্যে নানা রকমের ভাগ রয়েছে। এর মধ্য থেকে আমাদের আলোচ্য দুটো বিষয় হলো—নাস্তিক ও মুরতাদ। মুরতাদ শব্দটি আরবি ইরতিদাদ শব্দ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। ইরতিদাদ মানে হলো ফিরে যাওয়া। ফলে, মুরতাদ অর্থ হলো যে ফিরে যায়। পরিভাষায় মুরতাদ বলা হয়, যে মুসলিম হওয়ার পর ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে অ-ইসলামে প্রত্যাবর্তন করে। মানে, অমুসলিম হয়ে যায়। একজন মুসলিম অ-মুসলিম হয় কখন ও কীভাবে? এর উত্তরটা একটু বিস্তারিতভাবে দেওয়া প্রয়োজন। এবং তারও আগে প্রয়োজন হলো ইসলামের বিধান ও বিষায়বলীর ধরণ নিয়ে অল্প একটু আলোচনা করা।
ইসলামের সকল বিষয়—সে চিন্তাগত হোক বা কর্মগত বিধান হোক, কিংবা হোক শব্দগত—দুই রকমের : এক. অকাট্যভাবে প্রমাণিত, দুই. প্রমাণিত, কিন্তু অকাট্যভাবে নয়। অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয়গুলোর মধ্যে কিছু আছে—জরুরিয়্যাতে দীন বা স্বভাবত আবশ্যকীয়ভাবে মুসলমানমাত্রই জ্ঞাত বিষয়াবলী। অর্থাৎ, দীনের সেইসব সুনিশ্চিত বিষয়সমূহ যেগুলোর দীনের অংশ হওয়ার ব্যাপারটি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত হয়েছে এবং তা প্রজন্ম পরম্পরা ও প্রশিদ্ধি লাভ করেছে; পাশাপাশি সাধারণ মুসলমানগণও এসবের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। দীনের ব্যাপারে আগ্রহ রাখে এমন সাধারণ মুসলমানের সকল স্তরে এ সবের সংবাদটি পোঁছে গেছে। এমনটি হলেই বিষয়গুলো জরুরিয়্যাতে দীন বা “স্বভাবত আবশ্যকীয়ভাবে মুসলমানমাত্রই জ্ঞাত” বলে প্রমাণিত হবে। অবশ্য, প্রত্যেকেই জানতে হবে—এমনটি জরুরী নয়। এমনিভাবে সাধারণ মুসলমানের যে স্তর দীনের ব্যাপারে আগ্রহ রাখে না, তাদের মধ্যে পোঁছাও জরুরী নয়। যেমন তাওহিদ, নবুওয়াত, কুরআন, খতমে নবুওয়াত, পুনরুত্থান, শাস্তি ও প্রতিদান, নামাজ ও জাকাত ওয়াজিব হওয়া, মদ হারাম হওয়া ইত্যাদি।
আর কিছু আছে প্রমাণিত হয়েছে এরকম অকাট্যভাবেই, কিন্তু সাধারণ মুসলমানের মাঝে উপরেরটির মত করে প্রসিদ্ধি লাভ করেনি।
এবার আমরা আমাদের মূল আলোচনাটিতে প্রবেশ করছি। কোন মুসলমান যদি অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়, এমন কোন বিষয়কে অস্বীকার করে, তাহলে সে নিতান্ত খারাপ কাজ করলো বটে, তবে এর দ্বারা সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায় না। কিন্তু সে যদি পুরো ইসলামকে অস্বীকার করে বসে, বা জরুরিয়্যাতে দীনৈর কোন কিছুকে অস্বীকার করে, বা এ পর্যায়ের প্রমাণিত কোন মর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা করে কিংবা এমন কোন কর্ম করে, যা অকাট্যভাবে কুফুরিকর্ম বলে প্রমাণিত, তাহলে এ সকল অবস্থায় সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে মুরতাদ বলে গণ্য হবে। এমনিভাবে জরুরিয়্যাতে দীনের অন্তর্ভুক্ত নয়, এমন অকাট্য কোন বিষয়কে অস্বীকার করলে, বা বিকৃত করলেও এর দ্বারা মুরতাদ হয়ে যায়। তবে এর জন্য শর্ত হলো বিষয়টি এ পর্যায়ের অকাট্য হওয়ার ব্যাপারে তার জানা থাকতে হবে। যদি পূর্ব থেকে জ্ঞাত থাকে তাহলে তখনও মুরতাদ হবে। কিন্তু জানা না থাকলে মুরতাদ হবে না, যতক্ষণ না সে তা জানার পরও অস্বীকারের উপর বহাল থাকে।
একজন মুসলমান মুরতাদ হওয়ার পর তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়া, মীরাসের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়াসহ নানা গুরুতর বিধান তার উপর আরোপিত হয় এবং পুরুষ হলে রাষ্ট্র তার উপর হত্যার বিধান জারি করে।
এদিকে নাস্তিক মানে হলো যে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের অস্বীকারকারী। নাস্তিকের কাছাকাছি আরো দুটো শব্দ হলো সংশয়বাদী ও অজ্ঞেয়বাদী। সংশয়বাদী মানে হলো যে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বে সংশয়ী বা সন্দেহপোষণকারী এবং অজ্ঞেয়বাদী মানে হলো যে আল্লাহ তাআলা আছেন কি না সে ব্যাপারে অজ্ঞ। এ তিনটি অবস্থার যেটিই ঘটুক, এর অর্থ হলো আল্রাহ তাআলার উপর থেকে তার বিশ্বাস সরে গেছে। একজন মুসলমান নাস্তিক হোক, সংশয়বাদী হোক, বা অজ্ঞেয়বাদী হোক—সে মূলত মুরতাদ। এই টার্মগুলো মুরতাদ হওয়ারই বিশেষ রকমের প্রকাশ।
সুতরাং কোন মুসলমান মুরতাদ হওয়া বা তাকে নাস্তিক মুরতাদ বলা নিতান্ত সাধারণ কোন ব্যাপার নয়। সীমাহীন ভয়ের, স্পর্শকাতরতার এবং অনন্য উচ্চতর সাবধানতার। এই সাবধানতা অবলম্ব করতে হয় দুইদিক থেকে। সে যা অস্বীকার করলো তা নিঃসন্দেহে মুরতাদ হওয়ার মত ব্যাপার কি না? এবং তার বক্তব্য নিঃসন্দেহে অস্বীকারমূলক কি না। অনেক বিষয় তো আছে শুনলেই বুঝা যায়। যেমন, কোন মুসলমান বলে বসলো আমি আল্লাহ মানি না। বা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দিয়ে বসলো, অথবা বললো নামাজ বলতে কিছু নাই; সব ফালতু ব্যাপার। নাউযুবিল্লাহ। এটা তো সবাই বুঝবে। কিন্তু অনেক সময় এমন হবে, যখন অস্বীকারের বিষয় ও অস্বীকারমূলক বক্তব্যকে সাধারণভাবে যাচাইয়ের প্রয়োজন পড়ে, অনেক সময় খুব সূক্ষ্মভাবে তালাশের প্রয়োজন পড়ে। এবং এ যাচাই কর্মটি যার তার কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞ আলেম ও মুফতির প্রয়োজন পড়বে।
সকল কালেই চিন্তাশীল যোগ্য উলামায়ে কেরাম উপযুক্ত জায়গাগুলোতে তত্ত্ব-তালাশ করে নাস্তিক বা মুরতাদ লোকদেরকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা একটা দুঃখজনক পরিবেশের মুখোমুখি হচ্ছি। নাস্তিক ও মুরতাদের মত স্পর্শকাতর ও সঙ্গিন শব্দগুলো মানুষ সাধারণ গালি ও ক্রোধ উপশমের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হতে শুরু করেছে। বর্তমানে আমরা এমন একটা সময়ে বসবাস করছি, যখন মানুষ নিজের অজান্তেই নাস্তিক ও মুরতাদ হয়ে যেতে পারছে। ইসলামের গণ্ডি থেকে খুব সহজে বের হয়ে যাওয়ার বিচিত্র আয়োজনে সজ্জিত হয়ে আছে চারপাশ—এটা সত্য। কিন্তু তাই বলে তো সূক্ষ্ম যাচাই ছাড়া সাধারণ সাধারণ কথার জের ধরে যাকে-তাকে নাস্তিক মুরতাদ বলে দেওয়া যায় না। কিন্তু এখন তা-ই হচ্ছে। পথে-ঘাটে সাধারণ মানুষজন থেকেও এই শব্দ শোনা যাচ্ছে অহরহ। ক্ষতিকর লোকদের ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডকে অভিহিত করার জন্য এবং তাদের পরিচয় প্রকাশ করার জন্য উপযুক্ত হাজারো অভিধা আছে। সেগুলো ব্যবহার করুন। কিন্তু বিরোধিতার বিষয় ও বিরোধিতার বক্তব্যকে সূক্ষ্মভাবে যাচাই করা ছাড়া কোনভাবেই কাফের-নাস্তিক-মুরতাদ ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করা যাবে না। এর দ্বারা শব্দগুলোর প্রতাপ কমে যাচ্ছে, এর নিজস্ব পরিচয় লুপ্ত হয়ে নতুন পরিচয় গড়ে উঠছে। এটা ইসলামের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটি মুসলমানদের অন্তর্দ্বন্দ্বকে উস্কে দিচ্ছে এবং ফেতনা ও বিশৃঙ্খলাকে উত্তরোত্তর বাড়িয়েই চলছে। এই বিষয়টিতে সাধারণ মানুষকে খুব সহজে সচেতন করে তোলতে পারেন উলামায়ে কেরাম। ফলে তাদের দায় এখানে সবচেয়ে বেশি। একটা হাদীস মনে রাখি—কেউ যদি কোন মুসলমানকে কাফের বলে, আর সে প্রকৃতপক্ষে কাফের না হয়, তাহলে সে কুফুরি এসে প্রথম ব্যক্তির উপর পতিত হয়।
The post নাস্তিক-মুরতাদ : প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%a6-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a7%9f%e0%a7%8b%e0%a6%97-%e0%a6%93-%e0%a6%85-2/
No comments:
Post a Comment