Wednesday, September 23, 2020

আল্লামা আহমদ শফী রহ.-এর চিন্তাধারা

আবদুল্লাহিল বাকি:

আল্লামা আহমদ শফী রহ. দীর্ঘ একটা জীবন লাভ করেছেন। অর্জন করেছেন বিপুল অভিজ্ঞতা। সঞ্চয় করেছেন বহুমুখি চিন্তা। তিনি পড়াশোনা করেছেন পটিয়ার জিরি মাদ্রাসা, হাটহাজারী মাদ্রাসা ও দেওবন্দের মত বিদ্যাপীঠে। ভারতে গিয়ে সংস্পর্শ পেয়েছেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তৎকালিন নেতা ও আধ্যাত্মিক মুরুব্বী হুসাইন আহমদ মাদানীর। তার কাছ থেকে দীক্ষা লাভ করেছেন তাসাউফের।

দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতা করেন হাটহাজারী মাদ্রাসায়। পরবর্তীতে সেখানের মহাপরিচালক ও শাইখুল হাদিসের দায়িত্ব পান। এছাড়াও একাধারে তিনি ছিলেন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার চেয়ারম্যান, হেফাজতের ইসলামের ১৩ দফা আন্দোলনের আমির, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সভাপতি। তাই এই দীর্ঘ জীবনে তিনি একটা চিন্তাগত কেন্দ্রিকতায় আশ্রয় নিয়েছেন। আর কোন সন্দেহ নেই, সেটা হল দেওবন্দের চিন্তাধারা। তবে দেওবন্দের চিন্তাধারার ক্ষেত্রেও আনুষাঙ্গিক বিভিন্ন ধারা বিদ্যমান। সেখানে তাকেও ধারাগত বিভক্তিতে আনা যায়। আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে মাদানী ধারার হওয়ার দরুণ তার মাঝে এই ধারার প্রভাব বিদ্যমান। তবে হাঁ.. কিছু কিছু বিষয়ে এই ধারায় জাগতিক বিষয়ে যেমন সচেতনতা ও বৈষয়িকতার প্রকট উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়, সেখানে আহমাদ শফী রহ.-এর আগ্রহ গৌণ।

শিক্ষা-ভাবনা

দেওবন্দ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে সময়, স্থান ও প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনে এই ধারার শিক্ষা-ভাবনা বিভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। দেওবন্দ আন্দোলনের শুরুর দিকে ফতোয়া দেয়া হয়েছিল, ইংরেজি শিক্ষা করা হারাম। এই ফতোয়াকে বুঝতে হলে তখনকার প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে। তখন ইসলামের সঠিক শিক্ষা জেনারেল লাইনে না থাকার দরুণ ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে নাস্তিকতার বিষবাস্প সমাজে ছড়িয়ে পড়ছিল। তাছাড়া ব্রিটিশদেরকে জাতীয়ভাবে বয়কট করার দিকটাও উল্লেখযোগ্য। আর উসুলুল ফিকহ মতে, যা কিছু আবশ্যিকভাবে হারামের দিকে নিয়ে যায়, তাও হারাম।

এই ফতোয়া দেয়া হত দেওবন্দের প্রায় শুরুর দিকে, যখন কাসেম নানুতবী রহ.-এর যামানা। কিন্তু তখনও আধুনিক ও জাগতিক শিক্ষার গুরুত্বকে অস্বীকার করা হত না। মানাজির আহসান গিলানী ‘সাওয়ানেহে কাসেমী’ গ্রন্থে (২/ ২৮০) লিখেছেন, “তখনকার যুগে মাওলানা নানুতবী রহ. দারুল উলুমের শিক্ষা-ব্যবস্থায় আরবি, ফারসি, কোরান, হাদিস, ফিকহ ও অন্যান্য শরয়ী বিদ্যাকে স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। পাশাপাশি প্রাচীন মুসলিম স্বর্ণযুগের গণিত, জ্যামিতি, ফিজিওলজিও পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়াও অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের চর্চা ছিল সেখানে। যেমন, বিখ্যাত গ্রিক গণিতজ্ঞ ইউক্লিডের বীজগণিত নিয়ে লেখা বই পড়ানো হত। এসব পড়ার কারণে মেধাবীরা ভাল তাত্ত্বিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারত। যদিও ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জিত হত না এখান থেকে। কিন্তু এসব শেখার একটা ইতিবাচক দিক ছিল, এই পাঠ্যক্রম থেকে ফারেগ ছাত্রদের মাঝে আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন অর্জনের দক্ষতা বিকশিত হয়ে উঠত। কেউ চাইলে বাইরে গিয়ে পড়ে এই যোগ্যতার বিকাশ ঘটাতে পারত।”

ইংরেজি শিক্ষার মধ্যে আদর্শগত যেই দেওলিয়াত্ব তৈরি হচ্ছিল, সেটাকে তুলে ধরেছেন, মরহুম কবি আকবর ইলাহাবাদী। তিনি দেওবন্দে শিক্ষা লাভ না করলেও, তার কবিতা দেওবন্দের চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি বলেছেন-

দেওবন্দ হল জাগ্রত হৃদয়ের উপমা
নাদওয়া হল একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষা
এবার দিচ্ছি আলিগড়ের উদাহরণ
এটা খাদ্যরসিক উদর ছাড়া আর কিছুই নয়।

এরপর আরো সময় গিয়েছে। জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে কাসেম নানুতবী রহ. প্রায়ই একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতেন। সেটা হল, যুগের পরিবর্তনেও কেন নেসাবের সংস্কার করা হয় না এবং আধুনিক বিষয়াদি অন্তর্ভূক্ত করা হয় না? সেই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমরা ছাত্রকে আধাআধি যোগ্য বানাতে চাই না। যদি দুই ধারার শিক্ষাই নেসাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়, তাহলে সে যেমনিভাবে পুরোপুরি ধর্মীয় শিক্ষায় প্রাজ্ঞ হতে পারবে না, তেমনি আধুনিক শিক্ষায়ও কোন গ্রহণযোগ্য স্থান তার থাকবে না।” (মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবী: হায়াত আওর কারনামে, আসির আদরভী, পৃ. ১৪২)

রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ. ইংরেজি শিক্ষা আর মানতেক শিক্ষা সম্পর্কে ভিন্ন অবস্থানে চলে গেলেন। এ বিষয়ে কাসেম নানুতবীর সাথে তার মতপার্থক্য ছিল। তিনি বলতেন, “এই যুগে তো মানতেক-ফালসাফার চেয়ে ইংরেজি শেখা উত্তম৷” (তাযকেরাতুর রশীদ) শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি রহ. প্রত্যক্ষ রাজনীতি যাওয়ার পর আধুনিক যুগের স্বার্থ ও কল্যান-কেন্দ্রিক অনেক বিষয়ে ঐতিহ্যবাহী চিন্তা-কাঠামোর বদলে নতুনভাবে ভাবতে থাকেন। শিক্ষা-চিন্তায়ও পরিবর্তন আসে তার। ১৯২০ সালে তার তত্ত্বাবধানেই ভারতের প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় জামেয়া মিল্লিয়া প্রতিষ্ঠিত করেন আলি ভ্রাতৃদ্বয়। হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. তার চিন্তায় প্রভাবিত হন। তাই তার আধ্যাত্মিক ধারার আওলাদ, খলিফা ও মুরিদদের মাঝে এই চিন্তাধারার ছাপ পাওয়া যায়। তার আওলাদ ও খলিফাগণ সাধারণত মত দেন, আধুনিক শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষা– দুইটাই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এই ক্ষেত্রে উভয়ের প্রয়োজন আছে সমাজে। এক দল আরেক দলের মুখাপেক্ষী। যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তারা দীনি প্রয়োজনে মাদ্রাসার মুখাপেক্ষী। আর যারা মাদ্রাসায় পড়ে, তারা জাগতিক ক্ষেত্রে আধুনিক শিক্ষিতদের মুখাপেক্ষী। তাই এ ধারায় দেখা যায়, আধুনিক শিক্ষিতদের সাথে সাধারণত অন্তরঙ্গ সম্পর্কের উপর জোর দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে মানতেক ফালসাফা সম্পর্কে আশরাফ আলী থানবী রহ. রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহীর অবস্থান সমর্থন করেন। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা বিষয়ে কাসেম নানতুবীর অবস্থানেই থাকেন। তার অনেক মুরিদও এই চিন্তায় প্রভাবিত হন।

কিন্তু পাকিস্তান গঠনের পর, মুফতি শফী সাহেব পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে আমূল পরিবর্তন করে ফেলেন তার শিক্ষাকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা। তিনি বলেন, দেওবন্দ, নদওয়া, আলিগড়– তিনটাই যুগের প্রয়োজন ও দ্বন্দ্বমুখর অস্থিতিশীল ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে তৈরি। ভারতের পরিস্থিতির সাথে পাকিস্তানের পরিস্থিতি মিলবে না। তাই এই তিন ব্যবস্থার কোনটাকেই আমরা পাকিস্তানে হুবুহু কপি করতে পারি না। আমাদের লাগবে চতুর্থ শিক্ষা-ব্যবস্থা।”

পাকিস্তানে তাকী উসমানী সাহেবও এই চিন্তাধারা গ্রহণ করে নিয়েছেন। এবং তিনি বলেছেন, “আমাদের মূলত দরকার মুসলমানদের সর্বপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় জামেয়া কারভীন-এর মত একটা বিদ্যানিকেতন। যেখানে ইবনে রূশদের মত দার্শনিক পড়েছেন। অন্যদিকে কাজী ইয়াজের মত ফকিহও ফিকহ শিখেছেন। ইবনে খালদুনের মত ধর্মীয় ও জাগতিক জ্ঞানের সমন্বিত শিক্ষিত ব্যক্তিও জ্ঞানলাভ করেছেন এখান থেকে।”

শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. থানবী সিলসিলার খলিফা হলেও মাদানী রহ.-এর সমাজ-সংস্কারমূলক চিন্তাভাবনাকে গভীরভাবে সমর্থন করতেন। মুহিউদ্দিন খান সাহেবের ‘হায়াতে মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী ও দেওবন্দ আন্দোলন’ বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন শামসুল হক ফরিদপুরী। সেই ভূমিকার ভাষ্য থেকে এই বিষয়টা প্রতিভাত হয়। শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.-ও সমাজের দ্বিমুখী শিক্ষার সংকট বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বলেছেন, “ধর্মহীন কর্মশিক্ষা, কর্মহীন ধর্ম শিক্ষা জাতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে- এটি জাতির জন্য অভিশাপ।”

শিক্ষার ক্ষেত্রে দেওবন্দের যে অবস্থান দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, তা এককেন্দ্রিক কোন ভাবনা নয়। তাতে যুগ, রাষ্ট্র ও পরিবেশের প্রভাব আছে। তাই ব্রিটিশ ভারতে ধর্মরক্ষার জন্য যেই মতামত দিয়েছিলেন কাসেম নানুতবী, তা রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহির ব্যাখ্যা থেকে ভিন্ন। পরাধীন ভারতের শিক্ষাভাবনা থেকে স্বাধীন ভারতের শিক্ষা-দর্শন ভিন্ন। ভারতের শিক্ষা-ভাবনা থেকে ভিন্ন পূর্ব পাকিস্তানের ফরিদপুরী ও পশ্চিম পাকিস্তানের তকী উসমানীর ভাবনা।

এই পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট আল্লামা আহমাদ শফীর শিক্ষাভাবনায়ও প্রভাব ফেলেছে। তিনি তার সময়ের বাংলাদেশে সেক্যুলার রাজনীতি ও শিক্ষার নামে নাস্তিক্যবাদ ও ইসলামফোবিয়ার চর্চা দেখেছেন। দেখেছেন, এই সেক্যুলার শিক্ষার নেতৃত্ব দিচ্ছে জাফর ইকবালের মত ইসলামফোবিক ব্যক্তিত্বগণ। এই শিক্ষা থেকে বের হচ্ছে তাসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন, শামসুর রহমান। এই পরিস্থিতি তার চিন্তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শিক্ষা-ভাবনায় তিনি ফিরে গিয়েছেন হুবুহু কাসেম নানুতবীর মতামতের প্রেক্ষাপটে।

২০১২ সালে জামেয়া মাদানিয়া বিশ্বনাথের দস্তারবন্দি স্মারকে তার একটা সাক্ষাতকার ছাপা হয়। সাক্ষাতকার নিয়েছেন প্রখ্যাত আলেম লেখক ও চিন্তক মুসা আল হাফিজ। সেই সাক্ষাতকারে আহমাদ শফী সাহেবকে প্রশ্ন করা হয়, “কওমি মাদ্রাসা ও প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য কী?” উত্তরে তিনি বলেন, “কওমি মাদ্রাসা যেরকম নযরিয়্যা ও জীবনবোধ তৈরি করে এর সারমর্ম হলো- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আর ব্রিটিশ প্রবর্তিত প্রচলিত দুনিয়াবী শিক্ষা যে ধ্যান-ধারণা তৈরি করে এর সারমর্ম হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল বাতনু ওয়াল খাহেশাত’ (প্রবৃত্তি আর উদরকেন্দ্রিকতা ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই)। একটার সাথে আরেকটা পার্থক্য ততটুকু, মাশরিক ও মাগরিবের মধ্যে পার্থক্য যতটুকু। একটা থেকে জন্ম নেয় আলেম-ওলামা। আরেকটা থেকে তৈরি হয় দুনিয়া উপার্জনের পন্ডিত।”

তার এই বক্তব্য থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ইসলামের দৃষ্টিতে পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাধ্যমে দুনিয়াবী উপার্জন কি দূষণীয়? এরকম আপত্তি করা হলে, এর উত্তরে তিনি বলেন, “আল্লাহকে বাদ দিয়ে দুনিয়া উপার্জনের চেয়ে দুষণীয় জিনিস আর নেই। দুনিয়া উপার্জন খারাপ, আবার ভালো। দ্বীনকে রাহবর বানিয়ে দুনিয়া উপার্জনের পথে এগুলে সেটা ভালো। আর দ্বীনকে দুনিয়ার তাবে (অনুগত) বানিয়ে নিলে দুনিয়া উপার্জন ক্ষতিকর।” এখান থেকে বোঝা যায়, জেনারেল লাইনে পড়ালেখা করে পার্থিব উপার্জন দূষণীয় বিষয় নয় আহমাদ শফী রহ.-এর মতে। তবে মৌলিক কেন্দ্রিকতায় ইসলাম থাকতে হবে। কিন্তু বিশেষভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে পর্দা-লঙ্ঘনের দরুণ ২০১৩ সালে হাটহাজারীতে এক বক্তৃতায় নারীদেরকে চতুর্থ শ্রেণীর বেশি পড়াতে নিষেধ করেন। এখানে লক্ষ্যণীয়, তার বক্তব্যটা যদিও নেতিবাচক ছিল, কিন্তু এখানে পর্দাহীনতাকেই তিনি মূলত সমালোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে সকল আলেমই তার সাথে একমত হবেন। কারণ, হিজাব নারীদের জন্য ইসলামে আবশ্যকীয় একটা বিষয়। আর ক্লাস ফোরের আগে সাধারণত মেয়েরা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছায় না। তাদের উপর পর্দাও ফরজ হয় না। আহমদ শফী রহ. কখনো বলেননি যে, পর্দা রক্ষা করেও নারীরা শিক্ষা লাভ করতে পারবে না। অথচ তার বক্তব্যকে সেক্যুলাররা নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে বলে চালিয়ে দিয়েছে।

জেনারেল শিক্ষার প্রসঙ্গ গেল। কিন্তু শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর শিক্ষা-ভাবনার উপর ভিত্তি করে মাদ্রাসা-শিক্ষার উপরও আপত্তি আসে। সেই আপত্তি প্রশ্নকারী তুলে ধরেন, “মাদ্রাসায় তো দুনিয়াবিহীন দ্বীন…”

সেটার উত্তরে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। বলেন, “দ্বীন মানেই তো ইসলাম। ইসলাম কখনো দুনিয়াবিহীন নয়। দুনিয়ার সমস্ত প্রয়োজন ইসলাম পূরণ করে। জীবনের কোন দিক‌ই ইসলামে অনুপস্থিত নয়‌। মাদ্রাসায় ইসলাম শেখানো হয়। আখলাক শেখানো হয়। মুআমালাত-মুয়াশারাত ইত্যাদি শেখানো হয়। এগুলো তো সবই দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। শরীয়তের অধিকাংশ বিষয়‌ই তো দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। দুনিয়া বাদ দিয়ে তো শরীয়তই পুরা হয় না। অতএব ইসলাম শিক্ষা মানেই দ্বীন-দুনিয়া উভয়ই শিক্ষা। মাদ্রাসায় উভয়টিই আছে। তবে সেখানে দুনিয়া দ্বীনের তাবে।” এই ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যাচ্ছে, শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. মাদ্রাসায় আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষার যেই সংকটটা লক্ষ্য করেছিলেন, সেটা আহমাদ শফী রহ.-এর নিকট মৌলিক সংকট নয়। পার্থিব শিক্ষার চর্চা মাদ্রাসার জন্য ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যা তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়। কারণ, ইসলাম যেই দুনিয়া-বিমুখতাকে নিষিদ্ধ করেছে, তা হল রাহবানিয়াত বা বৈরাগ্যবাদ। আর আহমদ শফী সাহেবের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি মাদ্রাসায় দুনিয়া শিক্ষা সম্পর্কে বোঝাতেন– দুনিয়ার বিভিন্ন বিষয়ের শরয়ী আহকাম ও আদব জানা। এর বেশি কিছু নয়।

বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের চর্চা সম্পর্কেও তার মতামত দেওবন্দের গঠনকালীন সময়ের সাথে অধিক খাপ খায়। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “সমকালীন বিভিন্ন পশ্চিমা মতাদর্শ ও দর্শন সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের প্রশিক্ষিত হওয়া কি জরুরী মনে করেন?”

তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমরা তো দর্শন পড়েছি। পড়াচ্ছি। মায়বুজি, সুল্লামা, উকলিদস, মোল্লা মোবারক, ইসাগুজি, চুগমুনী এগুলো কী? এগুলো তো দর্শনই।”

পশ্চিমা দর্শনের বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলার ক্ষেত্রে তিনি প্রাচীন ইলমে কালামের ব্যবহারের পক্ষপাতী। আধুনিক যুক্তিপদ্ধতির ব্যবহারে তার আগ্রহ কম। এর কারণ হতে পারে, যেটা বলেছেন আশরাফ আলি থানবী রহ. যে, ইসলামের ব্যপারে যতই নতুন নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক আপত্তি আসুক না কেন, সেগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক জওয়াব খোঁজ করলে প্রাচীন ইলমে কালামের গ্রন্থগুলোতেই পাওয়া যায়। আর প্রাচ্যবিদদের তাফসির, হাদিস আর ইতিহাসভিত্তিক যে আক্রমণ আছে, সেগুলো তো উৎসগ্রন্থ ঘাটলেই স্পষ্ট হয়ে যায়।

এজন্যই ইলহাদ-ইরতেদাদের মোকাবেলায় পশ্চিমা দর্শন নিয়ে পড়াশোনা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “ইলহাদ-ইরতেদাদের বিরুদ্ধে নতুন করে পাঠের কী আছে? সেটা তো আমরা পড়ছিই। ইমাম গাযালী রহ. ফখরুদ্দনি রাজী রহ. শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভী রহ. কাসিম নানুতুবী রহ. যে সিলসিলা রেখে গেছেন, সেটা তো জারি আছেই। এগুলো তো কম নয়।”

এসব বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলা ছাড়া তিনি মূলত নাস্তিক মুরতাদদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দমন করার পক্ষপাতী ছিলেন, যেটার প্রভাব হেফাজতে ইসলামের পুরো আন্দোলন-জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এজন্যই তিনি বলেছেন, “নাস্তিক-মুরতাদদের বিরুদ্ধে তো আমরা চুপ হয়ে বসে নেই। তসলিমা নাসরিনকে তো দেশ থেকে তাড়ানো হয়েছে।”

রাজনৈতিক চিন্তাধারা

রাজনীতির আরবি শব্দ সিয়াসাত। এর অর্থ যেমন নেতৃত্ব দেওয়া, তেমনিভাবে এর আরো অর্থ আছে। ইবনুল আসির ‘আন-নিহায়া ফী গারিবিল হাদিসি ওয়াল আসার’ গ্রন্থে (২/ ৪২১) লিখেছেন, “সিয়াসত মানে কোন কাজের কল্যান ও স্বার্থ বিবেচনায় কাজটা সুচারুরূপে সম্পন্ন করা।” হানাফী মাজহাবের ফকিহ ইবনে নুজাইম ‘আল-বাহরুর রায়েক’ গ্রন্থে (৫/ ১১) লিখেছেন, “রাজনীতি মানে স্বার্থ ও কল্যানভিত্তিক শাসক ও নেতার কর্ম, সেক্ষেত্রে কোন বর্ণনা থাকা শর্ত নয়।” ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থভিত্তিকই ছিল শুরু থেকে দেওবন্দের রাজনৈতিক চিন্তাধারা।

দেওবন্দ হল কওমি মাদ্রাসা। অর্থাৎ যেখানে আম মুসলমানদের একটা সমর্থনগত অংশগ্রহণ আছে। কওম বলতে যদিও ব্যপকভাবে সকল মুসলমানকে বোঝানো হয়, কিন্তু দেওবন্দের ব্যবহারিক দিক থেকে কওম বলতে কেবল সাধারণ মুসলমানদেরকে বোঝানো হত, যেসব জেনারেল শিক্ষিতরা সেক্যুলার ধারায় শিক্ষিত হত, কিন্তু মাদ্রাসা ও আলেমদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক রক্ষা করে চলত, তারাও এই কওমের ব্যবহারিক অর্থে চলে আসত। সাধারণত দেওবন্দের আকিদা ও ফিকহী দৃষ্টিকোণের সাথে যাদের দূরত্ব ছিল, তারা এই ধারায় অন্তর্ভূক্ত হত না। যেমন, শিআ, বেরেলভী, আহলে হাদিস ও জামায়াতে ইসলামী। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে এই বিভক্তিটা স্পষ্ট ফুটে উঠত। কিন্তু বহিঃশত্রুর মোকাবেলা ও জাতীয় বৃহৎ স্বার্থে সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়াস ছিল। যেটা, ইংরেজ বিতাড়ন ও পাকিস্তান গঠনের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে।

ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ-কল্যান বিবেচনায় ইংরেজদের সময় দেওবন্দের যেই ভাষা ও বক্তব্য ছিল, পরবর্তীতে সেটা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ইংরেজদের সময়ে দেওবন্দের রাজনৈতিক আন্দোলন ও চিন্তাধারার ক্ষেত্রে শাহ আবদুল আজিজ রহ.-এর দারুল হরব-কেন্দ্রিক ফতোয়াটা মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। তিনি ফতওয়ায়ে আজিজীতে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, “এখানে (ভারতে) অবাধে খৃস্টান অফিসারদের শাসন চলছে, আর তাদের শাসন চলার অর্থই হল, তারা দেশরক্ষা, জননিয়ন্ত্রণ বিধি, রাজস্ব, খেরাজ, ট্যাক্স, ওশর, ব্যবসায়পণ্য, চোর-ডাকাত-দমনবিধি, মকদ্দমার বিচার, অপরাধমূলক সাজা প্রকৃতিতে (যেমন- সিভিল ফৌজ, পুলিশ বিভাগ, দীওয়ানী ও ফৌজদারী, কাস্টমস ডিউটি ইত্যাদিতে) নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। এ সকল ব্যাপারে ভারতীয়দের কোনই অধিকার নেই। অবশ্য এটা ঠিক যে, জুমার নামাজ, ঈদের নামাজ, আজান, গরু জবাই- এসব ক্ষেত্রে ইসলামের কতিপয় বিধানে তারা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে না। কিন্তু এগুলো তো হচ্ছে শাখা-প্রশাখা; কিন্তু উল্লিখিত বিষয়সমূহ এবং স্বাধীনতার মূল (যেমন- মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার) তার প্রত্যেকটিই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং পদদলিত করা হয়েছে। মসজিদসমূহ বেপরোয়াভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, জনগণের নাগরিক স্বাধীনতা খতম করে দেয়া হয়েছে। এমন কি মুসলমান হোক কি হিন্দু, পাসপোর্ট ও পারমিট ব্যতীত কাউকে শহরে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। সাধারণ প্রবাসী ও ব্যবসায়ীদেরকে শহরে আসা-যাওয়ার অনুমতি দানও দেশের স্বার্থে কিংবা জনগনের নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে না দিয়ে নিজেদের স্বার্থেই দেওয়া হচ্ছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেমন সুজাউল মুলক, বেলায়েতী বেগম প্রমুখ ইংরেজদের অনুমতি ছাড়া বাইর থেকে প্রবেশ করতে পারছেন না। দিল্লী থেকে কলকাতা পর্যন্ত তাদেরই আমলদারী চলছে। অবশ্য হায়দ্রাবাদ; লক্ষ্ণৌ ও রামপুরের শাসনকর্তাগণ ইংরেজদের আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ায় সরাসরি নাছারাদের আইন সেখানে চালু নেই। কিন্তু এতেও গোটা দেশের উপরই দারুল হরবেরই হুকুম বর্তায়।”

ইংরেজদের রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে অকৃতকার্যতার দরুণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও তাত্ত্বিকভাবে এই চেতনাকে জিইয়ে রাখতে দেওবন্দের জন্ম হয়। ভারত থেকে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর, দেওবন্দের রাজনৈতিক বিভিন্ন ধারা ছিল স্ট্রাটেজিক দিক থেকে, আদর্শগত দিক থেকে নয়। তবে কখনো আবার স্ট্রাটেজিক বিরোধ ভিন্ন আদর্শিক বক্তব্য তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। মৌলিক আদর্শগত দিক থেকে দেওবন্দের অবস্থান হল,

এক. স্বাধীন ভারতের শরয়ী অবস্থান: মাওলানা জফর আহমাদ উসমানী রহ. ই’লাউস সুনানে (১২/ ১৬৬) বলেছেন, “মুসলমানরা যদি কাফেরদের দেশে স্বাধীনভাবে ইবাদত করতে সক্ষম হয়, তাহলে সেখান থেকে হিজরত করা তার জন্য আবশ্যক নয়। যদি স্বাধীনভাবে সে ব্যক্তিগত ইবাদতও না করতে না পারে, তাহলে তাকে হিজরত করতে হবে।

এজন্যই ইসলামী রাজনীতির অগ্রগণ্য চিন্তক মাওয়ারদি রহ. বলেছেন, মুসলমানরা যদি কোন কাফের রাষ্ট্রে ধর্ম পালন করতে পারে, তাহলে এর মাধ্যমে সেই দেশ দারুল ইসলামের হুকুমে চলে আসে। সেখান থেকে হিজরত করার চেয়ে সেখানে অবস্থান করাই শ্রেয়। কারণ, কাফের দেশে মুসলমানরা থাকলে তাদের দাওয়াতের মাধ্যমে অন্য কাফেরদের মুসলমান হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এই বক্তব্যকে ‘নাইলুল আওতার’-এ আল্লামা শাওকানী খণ্ডন করে বলেছেন, মাওয়ারদির এই কথাটা কাফের রাষ্ট্রে অবস্থানের নিষেধাজ্ঞার হাদিসগুলোর বিরোধী।

কিন্তু শাওকানীর মতামত সম্পর্কে জফর আহমাদ উসমানী বলেছেন, শাওকানী সাহেব হাদিসের খণ্ডিত মর্ম বুঝেছেন। কারণ, মদীনায় নবী সা.-এর হিজরতের আগে ও পরে হাবশা দারুল কুফর হিসেবেই পরিগণিত ছিল। কিন্তু মুসলমানদেরকে তো সেখানে অবস্থান করতে নিষেধ করা হয়নি। সে হিসেবে মাওয়ারদির মতামতই শক্তিশালী। এছাড়া আয়েশা রা. বলেছেন, হিজরতের আদেশ মূলত দেয়া হয়েছে মুসলমানদেরকে ফিতনার আশংকায়।”

দেওবন্দের আলেমগণ অবশ্য ভারতকে দারুল ইসলাম বলেননি কাঠামোগত বিভিন্ন বৈসাদৃশ্য থাকার দরুণ। কেবল পরিভাষা বদল করে তারা বলতেন ‘দারুল আমান’।

দুই: বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের ব্যপারে অবস্থান: সে ক্ষেত্রে তারা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার একটা মতামত ফলো করতেন। তিনি মিনহাজুস সুন্নাহ আন-নববিইয়াহ (৪/৫৩১) গ্রন্থে লিখেছেন, “শাসকদের যুলুম-অত্যাচারে ছবর করা, তাদের সাথে লড়াই পরিত্যাগ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা হতে বিরত থাকা– মুমিন বান্দাদের ইহকাল ও পরকালের জন্য শ্রেয়তর বিষয়। যে ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশত এ নীতি লংঘন করে, তার কাজে কখনই কল্যাণ অর্জিত হবে না, বরং কেবল ফেতনা-ফাসাদ ও বিপর্যয়ই সৃষ্টি হবে।”

সম্পূর্ণ ফৌজদারী আইনভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র তৈরি করার যে চেষ্টা বিভিন্নভাবে বিদ্যমান, সেটাকে দেওবন্দের আলেমগণ কিভাবে দেখেন?- এটাও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। আশরাফ আলী থানবী রহ. এ নিয়ে একটা গ্রন্থ লিখেছেন, ‘আর-রাওদাতুন নাযিরাহ ফিল মাসাঈলিল হাযিরাহ’ নামে। সেখানে তিনি লিখেছেন, “ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও কাফেরদেরকে ইসলামী রাষ্ট্র থেকে বিতাড়ন করা নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষত হারামাইনে। পরিস্থিতির বিবেচনায় কখনো সেটা ফরজে কেফায়া, কখনো আবার ফরজে আইন। তবে এই বিধান পালনের জন্য কিছু শর্ত বিদ্যমান, যেগুলো ফোকাহায়ে কেরাম বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। ১. পরিপূর্ণ সক্ষমতা থাকা। ২. বিদ্যমান ক্ষতির চেয়ে বড় ক্ষতির আশংকা। অর্থাৎ কাফেরদের সাথে লড়াই করতে গেলে যদি বিপুল আয়োজনে মুসলমানদের উপর আক্রমণের আশংকা থাকে। এক্ষেত্রে আক্রমণ করা যাবে না। এই সুরতে মৌলিক উদ্দেশ্য বিদ্যমান নেই। আর মৌলিক উদ্দেশ্য হল জমিন থেকে ফাসাদ দূর করা। ফাসাদ তো দূর হচ্ছেই না, বরং আরো ফাসাদ বাড়ছে। আর শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হল, কোন কিছু করার মৌলিক উদ্দেশ্য যদি কর্মের মধ্যে বিদ্যমান না থাকে, তাহলে সেই বিধান পালনের আবশ্যকীয়তা থাকে না।” (আল-ইফাদাতুল আশরাফিয়া ফিল মাসায়িলিস সিয়াসিয়্যাহ, পৃ. ১০)

এই কারণেই দেওবন্দের আলেমগণ বিভিন্ন দেশে সমাজের প্রতি স্বশস্ত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে খুবই সংবেদনশীল, এগুলোকে তারা মনে করেন ‘ইসলামী পরিভাষা’র মোড়কে ফিতনা। এসব কাজকে তারা উৎসাহ তো দেনই না, বরং তীব্র নিন্দা জানান। স্বশস্ত্র ধারার বই ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এই ধারায় দীক্ষিত হবার দরুণই আল্লামা আহমাদ শফী রহ. ২০০৯ সালে আজিজুল হক ও অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ ইসলামী ব্যক্তিদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন যেখানে, ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গি কার্যক্রমের নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। আহমাদ শফী সাহেব সেখানে বলেন, “দেশের প্রকৃত কওমী মাদ্রাসা জঙ্গিবাদ বা অন্য কোনও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত নয়। এতিম, অসহায় ও দরিদ্র মানুষের বাচ্চারা সেখানে আশ্রয় ও শিক্ষা লাভ করে।”

২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল এক বক্তৃতায় তিনি সেক্যুলারদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “তারা কোথায় কী স্বপ্ন দেখেছে, কওমি মাদ্রাসার মধ্যে জঙ্গি আছে। স্কুল-কলেজে তো দুই দল মারামারি-গোলাগুলি করে, জঙ্গি বললে তাদেরই বলতে হবে। বাংলাদেশের কোনো মাদ্রাসার মধ্যে দুই দল মারামারি-গোলাগুলি করেছে, এ রকম প্রমাণ দিতে পারলে আমি তাদের পুরস্কৃত করব।”

গুলশান ও শোলকিয়ার জঙ্গি-হামলার পর আল্লামা আহমাদ শফী সাহেবের সভপতিত্বে হাইয়াতু কিবারি উলামাইল ইসলাম বাংলাদেশের (সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ) পক্ষ থেকে একটা বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, “কোনো কোনো মহল সন্ত্রাসবাদকে ‘ইসলামি জঙ্গিবাদ’, ‘ধর্মীয় চরমপন্থা’ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করলেও আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, ইসলাম সন্ত্রাসবাদ সমর্থন করে না। জঙ্গিবাদ চরমপন্থা বা সন্ত্রাসের সাথে ইসলামের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। বিগত দিনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যারা যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে তারা আর যাই হোক প্রকৃত ধার্মিক নয়। যারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে, তারা কোনো ধর্মেই বিশ্বাসী হতে পারে না। আমরা সন্ত্রাসী ঘটনায় হতাহতের তীব্র নিন্দা জানাই।

সন্ত্রাসকে জাতীয় সংকট বিবেচনা করে নিজেদের গুনাহখাতা ও ভুলত্রুটির জন্য দেশের জনগণ এবং নেতৃবর্গকে খালেস অন্তরে তওবা করতে হবে। সব দলমত ও শ্রেণীর অংশগ্রহণে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলারও বিকল্প নেই। পরস্পরকে দোষারোপ ও কাঁদা ছোড়াছুড়ি না করে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান এবং জাতীয় জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা নিরাপত্তা ধরে রাখার জন্য সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারকে ইমাম খতিব পীর-মাশায়েখ ও আলেম সমাজের সাথে একযোগে কাজ করতে হবে। বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ছাত্র তরুণদের মনমস্তিষ্ক থেকে শত্রুসৃষ্ট বৈকল্য দূর করতে হবে। সমস্যার মূলে গিয়ে ব্যাপক মটিভেশন চালাতে হবে। কোনোরূপ বিদেশি হস্তক্ষেপ নয়, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য, গণপ্রতিরোধ ও দেশীয় সক্ষমতা দিয়েই সন্ত্রাসবাদ দমন করতে হবে।”

এর মানে এই নয় যে, উলামায়ে দেওবন্দ শাসকদের জুলুমের ব্যপারে নিশ্চুপ। তারা রাষ্ট্রে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ-বিরোধী কাজের ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনা করেন, বৈধ উপায়ে দাবী জানান। এটাও করে গিয়েছেন বারবার আহমাদ শফী সাহেব, যেটার ফলশ্রুতিতে অস্তিত্বে এসেছে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।

তিন: রাজনৈতিক বিষয়ে গুরুত্বের অভাব: দেওবন্দি ধারায় অনেকে রাজনীতির সাথে জড়িয়েছেন, অনেকে আবার জড়াননি। তবে তাদের কেউই রাজনীতিকে ইসলামের মৌলিক বিষয় হিসেবে দেখেননি। আশরাফ আলী থানবী রহ. এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া, বা রাজনীতি করা ইসলামের মৌলিক কোন উদ্দেশ্য নয়। বরং উদ্দেশ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। সেটা যেভাবেই হোক না কেন।” এক্ষেত্রে তারা আবু হামেদ গাজালী ও উসুলবিদ আমেদি রহ.-এর মতামত দ্বারা হয়ত প্রভাবিত হয়ে থাকবেন।

আবু হামেদ গাজালি (মৃ. ৫০৫ হি.) আল-ইকতিসাদ ফিল ই’তিকাদ গ্রন্থে (পৃ. ২৩৪) স্পষ্টভাবেই বলেছেন, “জেনে রাখ, রাজনীতির ক্ষেত্রে দৃষ্টি দেওয়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আকিদা শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত‌ও নয়। বরং এটি একটি ফিকহী বিষয়। এর মাধ্যমে অনেক দলাদলি সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে সঠিক পদ্ধতিতে ডুবে থাকার চেয়ে, এ বিষয়ের মধ্যে না ঢোকাই ভালো। আর ডুবে থেকে যদি ভুল করে, তাহলে তো তার পরিণতি নিয়ে আর কোন কথাই নেই।” উসুলবিদ আমেদী রহ. ‘গায়াতুল মারাম ফী ইলমিল কালাম’ গ্রন্থেও একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন। এ কারণেই রাজনৈতিক বিষয়ে ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে দেওবন্দের আলেমগণ সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেন। বলা যায়, রাজনৈতিক বিষয়কে প্রায় পুরোপুরিই উপেক্ষা করে যান। দারুল উলুম দেওবন্দের অফিসিয়াল ফতোয়া ওয়েবে একটা প্রশ্ন এসেছিল, “আল-কায়দা ও আইএসের কার্যক্রম কি ইসলাম সমর্থন করে? তাছাড়া তাদের যেই দল-কাঠামো, সে হিসেবে তাদের বৈধতা কতটুকু?” তখন এর উত্তরে বলা হয়েছিল, “এ দুটিই বর্তমানের দুটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক দল। আমরা রাজনৈতিক বিষয় ও দল সম্পর্কে ফতোয়া দেই না।”

দেওবন্দের রাজনৈতিক স্বার্থ ও কল্যানকেন্দ্রিক অবস্থানের যেই চিত্র তুলে ধরা হল, আল্লামা আহমাদ শফী সাহেবও এই চেতনার বাইরে নন। সাক্ষাতকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “জামায়াতে ইসলামীর সাথে এবং আওয়ামীলীগসহ সেক্যুলার কিংবা জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত?” উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো না করাই উচিত। আমি মনে করি, যারা বেশি সহায়ক মনে হবে, তাদেরকে প্রাধান্য দেয়া যায়।”

রাজনীতির গুরুত্ব সম্পর্কেও তার বক্তব্য দেওবন্দি অবস্থানের বাইরে নয়। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “রাজনীতি না করে কীভাবে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রক হওয়া যাবে?” উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “রাজনীতি তো করছেন উলামায়ে কেরাম। সবাই রাজনীতি করবেন, এটি তো জরুরী নয়।”

আহমাদ শফী সাহেব কখনোই প্রচলিত রাজনীতিতে জড়াননি। কিন্তু কওমী মাদ্রাসাকেন্দ্রিক বিশাল জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বের সুবাদে আলেমদের রাজনীতিতেও প্রভাবক ভূমিকা পালন করেছেন। প্রচলিত রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও, এই রাজনীতিতে আলেমদের কতটা প্রয়োজন, সেটা ‍তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। এজন্যই তিনি বলেছেন, “আলেমরা রাজনীতি করছেন বলেই এ দেশ এখনও ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে যায়নি। আলেমরা এদেশের রাজনীতির বিশাল এক প্রভাবক। আমার কথা হলো, তারা প্রভাবক থাকবেন না‌। নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবেন। সে প্রত্যাশা পূরণ করতে তারা ব্যর্থ। অথচ ইসলামী শক্তির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কি কম? এদেশে বামপন্থীগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রক হবার ছল আঁটছে। তারা দেশ-বিদেশি প্রভুদের নিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে নিজেদের নেটওয়ার্ক। এদেশে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী, মিডিয়া, সুশীল সমাজ ইত্যাদিতে তাদের যে প্রভাব ও ক্ষমতা, তার অর্ধেকও কি ইসলামী শক্তির আছে? এমতাবস্থায় আলেমরা শুধু নিজেদের গণ্ডিতে বসে বসে খোয়াব দেখলে অচিরেই তারা ব্যর্থ প্রমাণিত হবেন। তাই বলে আমরা হতাশ হচ্ছি না। এ কথাটি প্রমাণিত হয়েছে যে, আলিমদের বাদ দিয়ে এদেশে কোনো রাজনীতি চলবে না। ধর্মনিরপেক্ষ বলে যারা পরিচিত তারা আলিমদেরকে কাছে টানার জন্য চেষ্টা করছে। তারা বুঝছে আলিম-ওলামাদের বিরোধিতা করে জনগণের মন জয় করা কঠিন।”

জীবনের শেষ দিকে এসে আল্লামা আহমাদ শফী সাহেবের বিভিন্ন কথা ও কাজের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সরকারের প্রতি সমর্থনমূলক যে অবস্থান সামনে এসেছে, তাতে অনেক নেতিবাচক দিক থাকলেও ইতিবাচক কিছু দিকও ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয় দলে কার্যত সেক্যুলারিজমের সমর্থক হয়ে উঠেছিল ইসলাম ও মাদ্রাসাফোবিয়া। সেটার মাত্রা কমেছে আহমাদ শফী সাহেবের জীবনের শেষ দিকের কিছু পদক্ষেপের কারণে।

তার জীবনের শেষ দিকের পদক্ষেপগুলো তার সারা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় অবশ্য ছিল না। কারণ, অনেক আগে থেকেই রাষ্ট্রীয় সরকারের প্রতি একটা সফটকর্নার ছিল তার চিন্তায়। এটা আমরা কয়েকভাবে বুঝতে পারি।

১. তিনি কখনোই সরকারের উৎখাত চাইতেন না, সংস্কার ও সংশোধন চাইতেন। উৎখাত চাইলে তার কাছে দাবি-দাওয়া পেশ করার কোন মানে থাকত না। দাবি দাওয়া করা মানেই পুরো কাঠামোকে স্বীকার করে নিয়ে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে সংস্কার কামনা করা।

২. তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের বিরোধিতার জন্য সরকার দায়ী নয়। এর জন্য দায়ী তার আশেপাশে থাকা নাস্তিক ও বামপন্থীরা। ২০১১ সালের সাক্ষাতকারেই তিনি বলেছেন, “শেখ হাসিনা আমার কাছে ওয়াদা করেছিলেন, তিনি মাদ্রাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করবেন না। ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু করবেন না। কুরআন বিরোধী আইন করবেন না। ধর্মীয় ব্যাপারে আলেম-ওলামাদের পরামর্শ মেনে চলবেন। কিন্তু সে ওয়াদা তিনি রাখেননি। রাখতে পারেননি। কারণ তার চারপাশে একদল শয়তান বসে আছে। এরা নাস্তিক, এরা বামপন্থী। আমি শেখ হাসিনাকে বলেছিলাম এদের ব্যাপারে সতর্ক হবার জন্য। তিনি আমার কথাটিকে মন দিয়ে শুনলেও, পরে তা মানতে পারলেন না।”

৩. হেফাজতের ইসলামের উত্থানের সময় মাওলানা ফরিদুদ্দিন মাসুদের মত কয়েকজন আলেম রাজনৈতিকভাবে সরকার-পক্ষীয় হয়ে উঠেছিলেন। তাদের সমালোচনা করেছেন আহমাদ শফী সাহেব। কিন্তু সমালোচনার ক্ষেত্রে আদর্শিক সমস্যার কথা তুলে ধরেননি। তুলে ধরেছেন স্ট্রাটেজিক সংকট। তাকে প্রশ্ন করা হল, “যেসব আলিম আওয়ামীলীগের সাথে আঁতাত করছেন তাদের সম্পর্কে কী বলবেন?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “তারা ভুল পথে আছেন। তাদের উচিত কেবলা ঠিক করা। নিজেদের সমস্ত কিছু খুইয়ে তারা দেউলিয়া হচ্ছে। কারণ আওয়ামীলীগ স্বার্থ ফুরালে কেটে পড়ার দল।”

এর বিপরীতে জামাতে ইসলামের ক্রিটিক করার সময় তিনি আদর্শিক ও স্ট্রাটেজিক– উভয় দিক থেকেই সমস্যা তুলে ধরেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, “আর যারা জামাতে ইসলামীর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছেন…?” তাদের সম্পর্কে তিনি বললেন, “তাদের মনে রাখা উচিত, আওয়ামীলীগ স্বার্থ ফুরালে কেটে পড়ে। কিন্তু জামাত স্বার্থ ফুরালে কেটে ফেলে। মওদুদী জামাতের প্রতি ঘৃণাপোষণ করাকে আমি দ্বীনি গায়রাতের অংশ মনে করি।”

এটা মূলত দেওবন্দ ও জামাতে ইসলামির পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিহাসের সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতা (Collective memory)। জাতি কখনো কখনো তার ইতিহাসের হাতে বন্দী হয়ে যায়। পেয়ে বসে থাকে ইতিহাসের সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতা। এই স্মৃতিকাতরতায় ইতিহাসকে টেনে আনা হয় খণ্ডিতভাবে। দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ বর্তমান প্রভাব ফেলে তাতে। আহমাদ শফী সাহেব জামাত সম্পর্কে যেই দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করলেন, তাতে এ বিষয়টাই স্বক্রিয়। নিরপেক্ষভাবে যদি দেখতে চাই, তাহলে বুঝতে পারি, জামাতে ইসলামী ও দেওবন্দের চিন্তাধারায় বেশ কিছু বিষয়ে মতভেদ আছে। যেমন, রাজনীতির ব্যাখ্যা, ইতিহাস-দর্শন, তাসাউফ সম্পর্কে অবস্থান, বাহ্যিক বেশ-ভূষা ইত্যাদি। কিন্তু দুই দলই আদর্শিক কেন্দ্রিকতার প্রশ্নে একমত যে, ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়। এর বিপরীতে সেক্যুলার রাজনীতিতে কেন্দ্রিকতার প্রশ্নে দেওলিয়াত্ব বিদ্যমান। সে হিসেবে আওয়ামী রাজনীতির কেবলমাত্র স্ট্রাটেজিক সংকট তুলে ধরে আদর্শিকভাবে দায়মুক্ত হওয়া যায় না। কিন্তু আহমাদ শফী সাহেব আওয়ামী রাজনীতিকে সেভাবে ক্রিটিক করছেন না। কারণ, তাদের সাথে দেওবন্দের কোন সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতা নেই। এভাবেই ইতিহাসের সামষ্টিক স্মৃতিকাতরতা ব্যক্তি ও দলের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করে।

তবে হাঁ.. মৌলিক আদর্শিক শত্রুর মোকাবেলার প্রশ্নে তিনি সকল মুসলমানের ঐক্য চান, যেখানে জামাতে ইসলামীও আছে। সেটার প্রভাবই দেখা গেছে শাপলা চত্বরের হেফাজতের ইসলামের আন্দোলনে। উদাহরণস্বরূপ, কাদিয়ানী মতবাদ মোকাবেলার আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “এ আন্দোলন আমাদের ঈমানের অংশ। এটা কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলন নয়। আমরা খতমে নবুওত রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যারা খতমে নবুওত মানে না তারা মুসলমান নয়। আইনিভাবে এটা নিশ্চিত করতে চাই। এক্ষেত্রে প্রত্যেক মুসলমানকে আমরা সঙ্গে পাবো। এটা কোন রাজনৈতিক ইস্যু নয়। আমি আলিমদের প্রতি অনুরোধ করি, আপনারা এ আন্দোলনে কোনো ছাড় দেবেন না। জনগণকে সঙ্গে নিন। বিএনপি-আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিন। মানুষকে বোঝাতে থাকুন।… খতমে নবুওত আন্দোলনে জামায়াত থাকবে না, তা বলছি না। তারা তো আগেও ছিলো। তাদের অবদান আছে তো পাকিস্তানে।”

এখানে ব্যাখ্যামূলকভাবে তুলে ধরা হল আহমাদ শফী সাহেবের শিক্ষা ও রাজনীতি-কেন্দ্রিক চিন্তাধারা। এছাড়া আরো অনেক বিষয়ে তার চিন্তাকে বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন, তাসাউফ, ঐক্য, জ্ঞানতত্ত্ব ইত্যাদি। কিন্তু ব্যক্তির চিন্তাধারা বুঝতে হলে তার পারিপার্শিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব যেমন বুঝতে হয়, তেমনি গুরুত্ব সহকারে চিন্তার সিলসিলাকে অনুধাবন করতে হয়। তাহলেই একজন ব্যক্তির অবস্থান চিহ্নিত করতে সুবিধা হয়। দীর্ঘকাল আল্লামা আহমাদ শফী রহ. দেওবন্দি চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাংলাদেশে। নাস্তিক-মুরতাদ, কাদিয়ানী মতবাদ বিরোধী জাতীয় ইসলামী ইস্যুতে দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে তিনি প্রভাবিত করেছেন। একত্রিত করেছেন সকলকে একক প্লাটফর্মে। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন, তৈরি করেছেন অনেক ছাত্র। তাসাউফের দীক্ষা দিয়েছেন, তৈরি করেছেন অনেক মুরিদ ও খলিফা। তার ছাত্র, মুরিদ ও খলিফাগণ জাতির খেদমত করে যাচ্ছেন। জার্মান ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, তুমি যদি মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকতে চাও, তাহলে গাছ লাগাও, বই লিখো অথবা শিক্ষকতার মাধ্যমে যোগ্য ছাত্র তৈরি করো। সে হিসেবে আল্লামা আহমাদ শফী রহ. তার আন্দোলন-নেতৃত্ব, যোগ্য ছাত্র, মুরিদ ও খলিফাদের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।

The post আল্লামা আহমদ শফী রহ.-এর চিন্তাধারা appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be-%e0%a6%86%e0%a6%b9%e0%a6%ae%e0%a6%a6-%e0%a6%b6%e0%a6%ab%e0%a7%80-%e0%a6%b0%e0%a6%b9-%e0%a6%8f%e0%a6%b0-%e0%a6%9a%e0%a6%bf%e0%a6%a8/

No comments:

Post a Comment