Friday, August 27, 2021

কিশোরগঞ্জে দুইদিন : ভাটি অঞ্চলের জলজীবন

ইফতেখার জামিল:

অনেকদিন ধরেই কিশোরগঞ্জ যাবো ভাবছি। গতকয়েক বছরে কিশোরগঞ্জ হয়ে ওঠেছে হাওর-পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র। বর্ষায় বৃহত্তর ভাটি অঞ্চলে মেঘালয় পাহাড়ের পানি নেমে আসে, মৌসুমী বন্যায় প্লাবিত হয় বিস্তৃত নিন্মাঞ্চল। ধর্মীয় দিক থেকেও কিশোরগঞ্জ বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। প্রখ্যাত আলেম আতাহার আলীর বসবাস ছিল এই জেলাতে, জামিয়া ইমদাদিয়া ও নেজামে ইসলাম পার্টির সূচনা তার হাত ধরেই। কিশোরগঞ্জ যাওয়ার আরেকটি বড় উদ্দেশ্য সাহিবে দিল শফিকুল ইসলাম জালালাবাদীর সাথে সাক্ষাৎ।

কাফেলার সাথে : ভাটি অঞ্চলে

লালমাটিয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা মামুন আবদুল্লাহ কাসেমি সপ্তাহখানেক আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন, ‘কিশোরগঞ্জ সফরে যেতে চাই।’ আগ্রহীদের যোগাযোগ করার কথাও বললেন। জল-জঙ্গলে ঘুরাঘুরির পাশাপাশি কাফেলা আঞ্চলিক ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোও যেয়ারত করবে। ইসলামে প্রাকৃতিক ও ধর্মীয় পর্যটনে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয় : ‘মানুষ চিনুক আল্লাহকে, জানুক তার নেয়ামত। ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক ভ্রমণে লাভ করুক শিক্ষা।’ ইমরান রাইহানের সূত্রে মামুন কাসেমির সাথে পরিচয়, তিনি তার মাদরাসাতেও একবার দাওয়াত করেছিলেন। ইমরান রাইহানই যোগাযোগ-আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলেন। আমরা কিশোরগঞ্জ যাবো এগারোই আগস্ট, রোজ বুধবার।

বাসা থেকে বের হলাম খুব সকালে, ফজরের পরপর। নাস্তা করবো কিনা ভাবছিলাম, শেষে ফুটপাথ থেকে মাঠা-ছানা কিনে খেলাম। ইমরান রাইহান ফোন ধরছিলেন না। আট-দশবার চেষ্টার পরে জানালেন, নামাজের পর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আধা ঘন্টার মধ্যে গাড়ি আসবে পলাশির মোড়ে। সাড়ে ছয়টার দিকে গাড়িতে উঠলাম। দশ সিটের হাইয়েস, যাত্রীসংখ্যা নয়জন। কিশোরগঞ্জে আমাদের সাথে যোগ দিবেন খোবাইব কাসেমি। বাকিদের কাউকেই চিনি না, বেলায়েতকে ফেসবুকে দেখেছি, লেখালেখি-সাংবাদিকতা করেন।

গাড়ি চলছে। চানখারপোল, ফ্লাইওভার, গুলিস্থান, যাত্রাবাড়ি, ডেমরা ধরে ক্রমশ নরসিংদী রোডে। গাড়ির নয়জনের সবাই কওমি মাদরাসার। আমাদের কল্পনা-কাহিনীর জগত প্রায় এক। যেসব ঘটনা আমাদেরকে আলোড়িত করে, যেসব স্মৃতি ও ইতিহাস আমাদেরকে ছুঁয়ে যায়, সেগুলোতেও আছে বিশেষ মিল। আগে একটা সময় আমার মনে হত, আমাকে গোত্রীয় কল্পনা-কাহিনী থেকে বের হতে হবে, খুঁজতে হবে সার্বজনীনতার সন্ধান। ইদানীং বিভিন্ন গল্প-জীবনকথায় দেখি সবার অভিজ্ঞতাই আসলে গোত্রীয় সীমারেখায় পরিচালিত হয়।

জীবন কখনো সার্বজনীন হয় না। বিশেষ ঘটনা, গল্প, স্মৃতি ও কল্পনা থেকেই খুঁজে নিতে হয় পরমার্থ, দিব্যজ্ঞান। নিজস্বতা হারালে গল্পে মৌলিকতা থাকে না, থাকে না কাহিনীর আবেদন : আমি আমার জীবনের গল্পটাই বলতে পারবো। বলতে পারবো আমার জটিলতা, সংগ্রাম। আপনি হয়তো আমার জটিলতার সাথে আপনার সংগ্রামের মিল খুঁজবেন, সংগ্রহ করতে চাইবেন বিকল্প উপাদান। কাজটা আপনার; আপনার জীবনের গল্প ও ব্যাখ্যাটা আপনিই ভালো বলতে পারবেন, নিজের গল্পটা অন্য কারো জবানে-বয়ানে উঠে আসে না।

গাড়িতে আমরা বিভিন্ন বিষয়েই কথা বলছিলাম। মাদরাসা কবে খুলবে, সে নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। মামুন কাসেমি দেওবন্দের গল্প বলছিলেন, ‘ছয় বছরের ইলমি অভিযাত্রা : দাওরা, আদব, হাদিস, ইফতা। বাংলাদেশে এমন অভিজ্ঞতা খুবই বিরল। দেওবন্দে বাংলাদেশী পরিচয়ে বিশেষায়িত বিভাগগুলোতে পড়া প্রায় অসম্ভব। পরিচয় গোপন করতে হয়, এই কঠিন কাজটা অনেকেই করতে পারে না। ভাষাগত অদক্ষতা বা আচার-আচরণে ধরা খেয়ে যায়। আমি গম্ভীরতা ধরে রেখেছি সবসময়। উস্তাদদের ছেলেদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। কেউ কেউ মনে করতেন, আমার বাবাও বোধহয় দেওবন্দের শিক্ষক।’

নিয়মিত গতিতে গাড়ি চলছিল। নরসিংদী ফলের জন্য বিখ্যাত। রাস্তার পাশে ফলবাজারের ব্যস্ততা। লটকন, পেয়ারা, আমড়া, আম। মৌসুম প্রায় শেষ, তবু রাস্তার পাশে কাঠালের বিশাল বিশাল স্তূপ। কিশোরগঞ্জ কয়েকভাবে যাওয়া যায়। টঙ্গী, তিনশো ফিট, ডেমরা ও সাইনবোর্ড। আমরা ধরেছিলাম ডেমরা রোড। জ্যাম পড়েনি একদম। রাস্তার প্রশস্ততা কম, চালক ও গাড়ির বিষয়টা ঠিক বলতে পারবো না। গাড়ি চলছিল ঘন্টায় পঞ্চাশ থেকে ষাট কিলো বেগে। গতি হওয়া উচিত ছিল ঘণ্টায় সত্তর থেকে আশি কিলোমিটার। যেতে যেতে দুপুর হয়ে যাবে।

রাস্তার পাশে আদিগন্ত ধানক্ষেত। বাতাসে দোলতে থাকা কাঁচা-পাকা ধানগাছে জুড়িয়ে আসে চোখ। আমরা কিশোরগঞ্জ পৌঁছলাম বারোটার দিকে। শহরের খানিকটা আগেই হাওরের শুরু। স্থানীয় রাহবার খোবাইব কাসেমিকে পিক করতে কিশোরগঞ্জ শহরে যেতে হবে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন বিখ্যাত গুরুদয়াল সরকারি কলেজের সামনে। গাড়িতে উঠে খোবাইব জানালেন, পয়তাল্লিশ মিনিটে যাওয়া যাবে নিকলি, দূরত্ব ছাব্বিশ-সাতাশ কিলোমিটার। আধা ঘণ্টা চলতেই রাস্তার দু পাশে দেখা মিলল আদিগন্ত জলরাশি। আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম, থামবো নিকলি বেড়িবাঁধের শেষমাথায়।

নিকলি হাওর : আদিগন্ত জলাধার

বেলা একটার দিকে নিকলি বেড়ীবাঁধের শেষপ্রান্তে পৌঁছলাম। দুই পাশে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। প্রচণ্ড বাতাস। জলরাশির বিশালতায় আমরা মুগ্ধ, বিস্মিত। ঠিক হল জোহরের নামাজ পড়ে আমরা রওনা দিব। লকডাউন শেষ হয়েছে গতকাল, পর্যটনের ব্যস্ততা এখনো শুরু হয়নি। ট্রলার-চালকরা আমাদের ঘিরে ধরছিলেন। পর্যটক নেই, দীর্ঘ লকডাউন, মাঝিরা যাত্রী পেতে তাই অত্যন্ত মরিয়া। আবহাওয়া ভালো নয়, গত কয়েক বছর ধরে হাওরে নৌকাডুবির ঘটনা বাড়ছে। গতবছর শিক্ষা সফরে মারা যায় সতেরজন মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক। তাই ট্রলারে লাইফ জ্যাকেট আছে কিনা জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছিলাম। অথই জলরাশিতে সাতার জানলেও বিশেষ লাভ হবে না। সমতলে পৌঁছতে পৌঁছতে লেগে যাবে ঘণ্টা পাঁচেক। আঠারো শো টাকায় সারাদিনের জন্য ট্রলার ঠিক করলাম।

আমরা প্রথমে যাবো ছাতিরচর, নিকলি থেকে পৌনে এক ঘণ্টা দূরত্বে ধনু নদীর তীরে অবস্থিত জল-জঙ্গল। শুরুতে সবাই লাইফ জ্যাকেট পড়ে নিলাম। বৃষ্টি-বাতাসে হাওর এখন অশান্ত। প্রচণ্ড ঢেউয়ে ট্রলার দুলছে ছোট নৌকার মতো। সাধারণত ছোট-মাঝারি নদীতেও এত ঢেউ থাকে না। এমন বিশালতা-রুক্ষতাই হাওরের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দশ মিনিটের মধ্যেই আমরা বিশাল সমুদ্রে গিয়ে পড়লাম, চারদিকে পানি আর পানি, বহুদূরে সমতলের রেখা দেখা যায়। কখনো সেটাও হারিয়ে যায় দূরদিগন্তে। ভাটিঅ ঞ্চলের মানুষরা বছরে তিন-চার মাস পানিবন্দি থাকেন। হাওর জনপদ হয়ে উঠে অত্যন্ত দুর্গম। কর্মহীন মানুষ অলসতায় মগ্ন হন গান-কবিতায়। গ্রামে গ্রামে বাউলগান-মাহফিলের আয়োজন করা হয়। ভাটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বাংলা গানের বিশেষ জনরা গড়ে উঠেছে, যেটি ভাটিয়ালি গান নামে পরিচিত।

বাউল শাহ আবদুল করিমের জবানে উঠে এসেছে এর বিবরণ :

আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম।
বর্ষা যখন হইত,
গাজির গান আইত,
রংগে ঢংগে গাইত
আনন্দ পাইতাম
কে হবে মেম্বার,
কে বা সরকার
আমরা কি তার খবরও লইতাম
হায়রে আমরা কি তার খবরও লইতাম।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।

একাকী ও কাফেলাভুক্ত সফরের মধ্যে পার্থক্য অনেক। একাকী সফরে সাধারণত মনস্তাত্ত্বিক উপভোগের উপকরণ থাকে বেশী, মানুষ নিজের অতীত-ভবিষ্যতের সামনে এসে দাঁড়ায়। জীবনের মর্ম ও অর্থ নিয়ে প্রশ্ন করতে চায়। হয়তো সমুদ্র-নদীর বিশালতা, নিমগ্ন রাত বা নির্জন ভোরে সে খুঁজে পায় দিব্য ইশারা, বড় কাজের উৎসাহ। কাফেলাভুক্ত সফরে সামাজিক উপকরণ থাকে বেশী। অপরিচিত-আধা পরিচিত মানুষদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় বিভিন্ন জটিলতা-অনিশ্চয়তার। অপরিচিত বিশ্বাস, আচরণ ও গল্পে মুখ মেলাতে হয়। এটি অনেকের জন্য সহজ কাজ নয়। অনেক সিদ্ধান্ত-বিকল্প বাছাই করতে হয়, কীভাবে একমত ও দ্বিমত প্রকাশ করবেন, কীভাবে মিশবেন আরও দশজনের সাথে, কাফেলাভুক্ত সফরে এসব শেখা যায়। খরচও কমে আসে অনেক।

আমরা ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটের মধ্যে ছাতির চর পৌঁছলাম। ধনু নদীর তীরবর্তী জল-জঙ্গল। হাঁটু পানিতে ডুবে আছে গাছের বাগান। দূর থেকে কম মনে হলেও কাছে গেলে বুঝা যায় গাছের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। লাইফ জ্যাকেট পরে নামলাম জলজঙ্গলে। হাতের ওপর ভর করে পানিতে ভাসতে ভাসতে ঘুরলাম জঙ্গলের ভেতরে। সবাই নদীতে গোসল করছে। জঙ্গলের ভেতরে তেমন কেউ নেই, অদ্ভুত রকমের নির্জনতা। একপাশে খাল, আরেকপাশে নদী, নদীর পরে দিগন্তবিস্তৃত হাওর। পানিরও নিজস্ব ঘ্রাণ আছে, টলটল শব্দ আছে। পানিতে পড়ে আছে সারিসারি গাছের প্রতিবিম্ব। ভাসতে ভাসতে কথা জমালাম ইমরান রাইহানের সাথে।

নৌকায় চা বিক্রি হচ্ছিল। পানিতে বসে চা খাবার আনন্দের কোন তুলনা হয় না। নদীতে নামলাম ভেসে ভেসে। জলজঙ্গল পরিষ্কার করার দোহাই দিয়ে প্রতি ট্রলার থেকে বিশ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। অংকটা বড় নয়, তবে এর কোন রকমের বৈধতা নেই। একটু দূরে বিক্রি হচ্ছে গ্রামীণ আখ। মামুন কাসেমি সবার জন্য আখ কিনলেন। মাঝি শুরু করলেন তাড়াহুড়া। আমরা ছাতিরচর থেকে যাবো অনেক দূরে, মিঠামইন। ছাতিরচর থেকে উঠতে মন চাচ্ছিল না। গোসলে এত আনন্দ পেয়েছি খুব কম জায়গায়। যাত্রাবিরতির ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমাদের ট্রলার আবার চলতে শুরু করল।

কাফুলাভুক্ত প্রত্যেক সফরেই অনেক রকম আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। এটি কাফেলাভুক্ত সফরের বাড়তি প্রাপ্তি, পারস্পরিক অভিজ্ঞতা-মতামত-সম্পর্ক বিনিময় ও বিনির্মিত হয়। আমরা কথা বলছিলাম ধর্মীয় সাংবাদিকতা নিয়ে। আমি দীর্ঘদিন ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের দায়িত্বে ছিলাম। মামুন কাসেমি জানতে চাইলেন ধর্মীয় সাংবাদিকতার সম্ভাবনা-জটিলতা সম্পর্কে। আমি বলছিলাম, সবচেয়ে বড় জটিলতা হচ্ছে এখনো অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করানো যায়নি, পাশাপাশি পেশাদারিত্বের প্রতিও পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কর্মীদের সম্মানী ও দক্ষতা বাড়াতে জোর দেওয়া হয়নি, তাই শুধু বর্তমান নয়, ধর্মীয় সাংবাদিকতার ভবিষ্যতও অন্ধকার।

যারা কাজ করছেন, আওয়ার ইসলাম, ইনসাফ ও ফাতেহ, তারা কেউই সাংবাদিকতা করছে না। প্রেসরিলিজ-বিজ্ঞপ্তি-কপিপেস্টে শেষ করছেন সাংবাদিকতার কার্যক্রম। ফাতেহে কিছু চিন্তামূলক লেখা আসলেও প্রতিবেদন-অনুসন্ধান উঠে আসেনি তেমন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ঝুঁকিও অনেক, বিগব্রাদারের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছুই প্রকাশ করা যাবে না। পাশাপাশি আমাদের ধর্মীয় সমাজ অনেকক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ও ফতোয়া বিভাগে পার্থক্য করত সক্ষম নয়। তারা সাংবাদিকদের থেকেও ফকিহের দূরদৃষ্টি-ধার্মিকতা আশা করেন। এসব কিছু মিলে সাংবাদিকতা জটিল হয়ে উঠেছে।

ট্রলার চলছে একটানা। আধা ঘণ্টার মধ্যে ট্রলারের মেশিন থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে লাগলো। বাড়তে লাগলো মেশিনের আওয়াজ। প্রথমে মাঝিরা অস্বীকার করতে চাইলেও মিনিট পনেরো পর স্বীকার করলেন ট্রলারের মেশিন ঠিকভাবে কাজ করছে না। আমি বাহিরের দিকে তাকালাম। বিস্তৃত জলরাশি। চারদিকে কোথাও সমতলের রেখা দেখা যাচ্ছে না। ভয় পেয়ে গেলাম সবাই। যদি মাঝহাওরে মেশিন বন্ধ হয়ে যায়, আমরা ফিরব কীভাবে ও কোথায়? মাঝি সিদ্ধান্ত নিলেন নিকলি ফিরবেন। ট্রলার আবার চলতে লাগলো আস্তে আস্তে। ক্রমশ সমতলের রেখা দেখা গেল। আমরা নামলাম সাড়ে চারটায়। এখন কী করবো, কী করা যায়?

‘দুলদুলন্ত হাওর’ : জলপথে মিঠামইন

দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। কথা ছিল মিঠামইনে গিয়ে পেটপূজা করবো, হাওরের খাবারে ঋদ্ধ করবো স্মৃতি। এখন প্রায় বিকেল, কী করা যায় সে নিয়ে সবাই ভাবছিলেন। মিঠামইন যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। আমি জোর দিয়ে বললাম, বেলা অনেক হয়ে গেছে, নিকলিতেই ভারী খানার কাজ শেষ করতে হবে। মাত্রই শেষ হল লকডাউন, পর্যটন হোটেলগুলো ভালোভাবে খুলেনি। মিনিট কয়েক হেঁটে শুধুমাত্র একটি হোটেল খোলা পেলাম। দিনের শেষবেলা, ‘দুপুরের খাবার প্রায় শেষ’, হোটেলের ম্যানেজার বলছিলেন। আমাদের পেটে তীব্র ক্ষুধা, হোটেলে দেশীয় মাছ ছিল কয়েক পদের। চিংড়ি, চাপিলা, কয়েক পদের মাছ চিনতেও পারলাম না। শেষে নিলাম হাসের মাংশ। মোটামুটি বলা যায় হাওরের খাবারের স্বাদ পেয়ে গেলাম। নিকলি বাঁধে দাঁড়াতেই তীব্র বাতাস লাগলো শরীরে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মাঝি তাড়া দিচ্ছিলেন, ‘যেতে হবে অনেকদূরে।’

ট্রলারে উঠার দশ মিনিটের মধ্যে বুঝলাম পরিস্থিতি ভালো নয়। হাওর অশান্ত, ক্রমশ ঢেউ বাড়ছে। আগেই বলেছি, হাওর কোন নিরীহ জলাধার নয়। পদ্মা-মেঘনায় যেতে আপনার যেমন প্রস্তুতি লাগবে, হাওরেও তার কাছাকাছি নিরাপত্তাই গ্রহণ করতে হবে। ইউটিউবে ভ্রমণভ্লগগুলো দেখলেই বিষয়টা ধরতে পারবেন। আমাদের ট্রলারের অবস্থা যদিও এখনো এত খারাপ নয়, তবে দূরে দানা বেঁধে আছে তীব্র মেঘ, মিঠামইন যেতে লাগবে আরও ঘণ্টা দেড়েক, আমরা পড়ে যেতে পারি তীব্র স্রোতে। আমার ও ইমরান রাইহানের প্রস্তুতি ছিল, আমরা উভয়েই ঢাকা থেকে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে গেছিলাম। সকালের ট্রলারেও ছিল লাইফ জ্যাকেট। এখন, তাড়াহুড়ায় এই দিকে খেয়াল করা হয়নি। ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছিল। শেষবিকেলের ফ্যাকাসে আলো, ফুঁসতে থাকা হাওর, আকাশে কালো মেঘ।

একটু দূরে যেতেই শুরু হল বজ্রপাত। চারদিকে কোন স্থাপনা না থাকায় মনে হচ্ছিল আশেপাশেই চমকাচ্ছে মেঘ, মচমচ করে ভেঙ্গে যাবার শব্দ আসে প্রথমে, পরে আলো ঝলকায়, সর্পিল আকারের ভয়ঙ্কর আলোয় চোখে ধাঁধা লেগে যায়। স্রোত কমে আসলেও বজ্রপাত কমছিল না কোনভাবেই। বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে শত শত মানুষ মারা যায়, দুই হাজার ষোল সালে সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। আমরা বসেছিলাম ট্রলারের ছাদে, কীভাবে এড়ানো যায় বজ্রাঘাত, সে নিয়ে গুগল করছিলাম। ছাদটা ছিল লোহার, তাই ভয় ছিল অনেক বেশী। একটা প্লাস্টিকের পাটিতে সবাই গোল হয়ে বসলাম। আমরা ভুলে গেছিলাম ট্রলারের নীচতলা ছিল কাঠের তৈরি, সুতরাং অনেক বেশী নিরাপদ। খোবাইব আমাদেরকে সান্ত্বনা দিতে চাইল, মাঝির থেকে আদায় করতে চাইল আশ্বাস। ‘চাচা, এদিকে বজ্রপাত কম হয়, তাই না?’ মাঝির উত্তরে আমাদের ভয় আরও বাড়ল, ‘দিনদশেক আগে কয়েকজন জেলে মারা গেছে বজ্রাঘাতে।’ আমরা কথা বলছিলাম, মাঝেমাঝে দোয়া পড়ছিলাম। ভাবছিলাম, কখন শেষ হবে অপেক্ষা, মিঠামইন কতদূর? পৌনে সাতটায় পৌঁছলাম সমতলে। নামতেই প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টি নামলো। হাওর অগ্নিমূর্তির আকার ধারণ করলো।

মিঠামইনের শেষমাথায় ছোট একটা দোকান। চা-সিগ্রেট-ঝাল ডাল-চানাচুর পাওয়া যায়। আমরা সবাই গুটিয়ে বসলাম দোকানের ভেতরে। কেউ কেউ চা খেল, কয়েকজন খেলাম কফি। দ্বিতীয়পর্যায়ে চলল চিপস ও ঝাল ডাল খাবার পালা। অন্ধকার নেমে গেছে আগেই, দোকানে হালকা পাওয়ারের লাইট জলছে। আমরা বসে আছি বিচ্ছিন্ন এক চরে, বৃষ্টি থামছে না, রাত বাড়ছে ক্রমশ। দোকানদাররাও সতর্ক করলেন, ‘এই বর্ষায় হাওরে ট্রলার চালানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।’ সবার বয়স বিশের বেশী। ছোট বিপদে ভীত হবার মত নই কেউই, আমাদের দুইজনের আছে লাইফজ্যাকেট, তাই দুশ্চিন্তা কমে এসেছে অনেক। বৃষ্টিতে দোকানদার ঝাপ ফেলে দিলেন, গ্রামীণ দোকানে বসে আছি আমরা পাঁচ-সাতজন। দোকানিরা তিনজন, বাবা, ছেলে ও চাচা। আমরা এখন আছি রাষ্ট্রপতির এলাকায়। আমরা মেতে উঠলাম আড্ডায়, জানতে চাইলাম এলাকার ইতিহাস ও গল্প।

বৃষ্টি কমে আসলো আটটার দিকে। আমরা ট্রলারের ভেতরে গিয়ে বসলাম। ভেতরের কাঠামো কাঠের হওয়ায় বজ্রাঘাতের ভয় অনেক কম। অন্ধকারে বসে আছি দশজন মানুষ, ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছে, বাইরে গা ছমছমে অন্ধকার, আশেপাশে মাইল পাঁচেকের মধ্যেও নেই কোন জনপদ। কেউ কেউ ঘুমানো শুরু করলো, সারাদিনে ধকল গেছে অনেক। আমি লাইফ জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বাইরে এসে বসলাম, ট্রলারের অগ্রভাগে চেয়ার বসিয়ে শুরু করলাম গল্প। পাশে বসে আছে খোবাইব কাসেমি। আমাদের কিশোরগঞ্জের রাহবার। খোবাইবরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী, অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ নয়। নেত্রকোনায় তাদের নিজস্ব মাদরাসা আছে। ভাই-বোনদের বিয়ে হয়েছে কিশোরগঞ্জেই। বাবা কিশোরগঞ্জের প্রভাবশালী আলেম, হেফাজতের ঘটনায় এই বছর জেলেও ছিলেন কিছুদিন। বৃষ্টি-বজ্রপাত থেমে গেছে আগেই। আমরা হাওর-বাহিত নদী দিয়ে এগিয়ে চলছি। মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস, চারদিকে অদ্ভুত রকমের নীরবতা। খোবাইব আমাকে একে একে বলতে লাগলেন কিশোরগঞ্জের ইতিহাস, রাজনীতি ও ঐতিহ্যের কথা, টানাপোড়েন ও জটিলতা। সবকিছুই মায়াময় লাগছে, হাওর এখন শান্ত, ভাবছিলাম যদি সারারাত ট্রলারটা চলতে থাকতো!

‘মাঝি ও দোকানদার’ : ভাটি অঞ্চলের জলজীবন

হাওর শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, ভাটি অঞ্চলে বসবাস করে বিপুল পরিমাণ মানুষ। আমরা যারা সেসব অঞ্চলে ঘুরতে যাই, তারা কখনোই সেই মানুষদের কথা ভাবি না, কখনো জিজ্ঞাসা করি না তারা কেমন আছে, স্থানীয় অর্থনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ কতটুকু, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বাস্তবতাও বুঝার চেষ্টা করি না। আমার কাছে মনে হয়, স্থানীয় সংস্কৃতি ও জটিলতা জানাও পর্যটনের ধর্মীয় তাৎপর্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা শিক্ষাঅর্জনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণে উৎসাহিত করেছেন। আপনি যদি স্থানীয়দের সাথে কথা না বলেন, তাদের জীবন-জীবিকার কথা না জানতে চান, তবে কীভাবে প্রতিতুলনা করবেন, কীভাবে লাভ করবেন শিক্ষা?

আমরা স্থানীয় অনেকের সাথেই কথা বলতে চেষ্টা করি। এখানে দ্বিতীয় ট্রলারের মাঝি ও মিঠামইনের দোকানদারের বয়ান তুলে ধরতে চেষ্টা করবো। মাঝির নাম লাইল মিয়া, আগে কৃষিকাজ করতেন, করোনার প্রকোপে জীবন-জীবিকায় অন্ধকার দেখতে থাকেন, শালাসহ পঞ্চান্ন বছর বয়সে পেশা পরিবর্তন করেন। তার জমিন আছে অনেক, তবে পানি বাড়লে কিছুই করার থাকে না। নিকলিতে একশোর ওপরে ট্রলার আছে, মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় সবাই পেয়ে যান কাস্টমার। সেই হিসাব করলে প্রতিদিন গড়ে হাজার দুয়েক মানুষ নিকলিতে ঘুরতে আসেন। হাওরের পানি লিজ নিয়ে নেয় প্রভাবশালীরা, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে হাওরের পাশে বসেও লাইল মিয়ার মত সাধারণরা মাছ ধরতে পারেন না। মাটিতে মালিকানা থাকে, জলের ভোগান্তিও পোহাতে হয়, সুফলটুকু তারা পান না।

লাইল মিয়া জানালেন, তিনি স্থানীয় পীরের ওরসে যান, অষ্টগ্রামে আগামী সপ্তাহে বসবে মজমা, তিনি যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত, সেই জটিলতাও আছে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কেন দল পরিবর্তন করেন না? লাইল মিয়া এই বয়সে মতপরিবর্তন করতে চান না, ‘আমার গায়ে তো লেগে আছে দলীয় সাইনবোর্ড।’ লাইল মিয়া নিয়মিত নামাজ না পড়লেও স্ত্রীর কথায় ছোট দুই সন্তানকে দিয়েছেন মাদরাসায়, তারা থাকুক আল্লাহর রাস্তায়, শিখুক ধর্ম, এটাই লাইল মিয়ার আশা। জানালেন স্থানীয় ভাটিয়ালি সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে, গান-কবিতা-মুরসিয়ার জলসায় মানুষের আগ্রহ অনেক কমে গেছে। লাইল মিয়ার দুই ছেলে ঢাকায় জুতার কারখানায় কাজ করে, মেয়ের জামাই দুইজন বিক্রি করে জুতা। দুই মেয়ের এখনো বিয়ে হয়নি। জিজ্ঞাসা করলে জানালেন, তারা পড়াশোনা করে না। ‘পড়াশোনার খরচ অনেক। স্কুলে যদিও টাকা লাগে না, সরকার বরং কিছু টাকা দেয়, তবে সেই টাকায় কোচিং এর খরচই উঠে না।’ লাইল মিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, ‘অনেক কষ্টের মধ্যে আছি ভাই।’

দোকানদার সাব্বির মিয়া রাষ্ট্রপতির এলাকার লোক। ছেলেকে দিয়েছেন মাদরাসায়, তিনি স্ত্রীর কথায় নয়, ধর্মীয় আবেগ ও চেতনা থেকেই ছেলেকে পাঠিয়েছেন মাদরাসায়। গ্রামে ধর্মীয় শিক্ষার অবস্থা সুবিধার নয়, গরীব বলে ছেলেকে শহরেও পাঠাতে পারেন না। একসময় মাদরাসায় গরিবদের অপার সুযোগ ছিল, গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে এখন স্কুলের থেকে মাদরাসার খরচ বেশী। নিন্ম মধ্যবিত্তদের অনেকে এখন মাদরাসায় সন্তান দেবার সক্ষমতাও হারিয়েছেন। যেহেতু সমাজে চাহিদা আছে, তাই প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা এখন আর অবৈতনিক নয়। আপনি যদি সন্তানকে ভালো কোন মক্তব বা হেফজখানায় পড়াতে চান, তবে অনেকক্ষেত্রেই স্কুলের থেকে বেশী খরচ করতে হবে। আবাসিক মাশুল, খোরাকি ও বেতন—এই তিনে খরচ অনেক বেড়ে যায়। দোকানদারের ছোট ভাই স্কুলে পড়েন, সেভেনে, করোনায় পড়াশোনা বন্ধ করে দিছেন। দোকানের বয়স খুব বেশী দিন নয়, আগে করতেন কাঠের ব্যবসা, এখন দুই মাস আগে মুদি দোকান দিলেন। নামলেন নতুন ভাগ্যপরীক্ষায়।

ভাটি অঞ্চলের মানুষরা ভালো নেই। গুগল করে জানতে পারলাম হাওর লিজ দেওয়া আইনত নিষিদ্ধ হবার কথা থাকলেও নানা অজুহাতে কৃষক-জেলেদের ঠকাচ্ছেন স্থানীয় রাজনীতিবিদ-প্রশাসনের লোকেরা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখেন:

‘হাওর লিজ দেন জেলা প্রশাসক, কিন্তু তাঁর মাথার ওপর থাকেন প্রভুর মতো এমপিরা। সুতরাং যেকোনো অন্যায় ও অপকর্মের দায় শুধু কর্মকর্তাদের ওপর চাপিয়ে রেহাই পাওয়া যাবে না। , , , জলমহাল ইজারা দেওয়ার যে নীতিমালা আছে, তাতে উন্মুক্ত হাওর লিজ দেওয়ার বিধান নেই, সে কথা ২৯ ধারায় বলা আছে। বঙ্গীয় ক্ষমতাবানেরা আইনের বিধান মানতে বাধ্য নন। , , , ক্ষমতাবানদের বুদ্ধির ঘাটতি আছে, সে কথা কোনো বেকুব ভোটারও মনে করেন না। বলা আছে, উন্মুক্ত জলাধার ইজারা দেওয়া যাবে না, কিন্তু যদি কোনো উন্মুক্ত জলাধারকে চারদিকে একটা বাঁধের মতো দিয়ে বদ্ধ জলাশয় বানানো যায়, তাহলে আইনও মানা হলো, ইজারাও নেওয়া গেল। এইভাবেই বাংলার নদ-নদীর পাড়, বালুচর, খাল-বিল, বনভূমি সব ক্ষমতাবানদের হাতে চলে যায়। , , , এমনিতেই তাঁদের বিপুল রোজগার এবং সুযোগ-সুবিধা সীমাহীন। জেলা প্রশাসক যখন হাওর লিজ দেন, তখন তাঁর তদন্ত করে দেখা উচিত যিনি লিজ চাইছেন, তিনি ও তাঁর পূর্বপুরুষ জেলে ছিলেন কি না? স্বাধীনতার আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো স্লোগান দিয়েছে, ‘জাল যার জলা তার’।’

জামেয়া ইমদাদিয়া, শহীদি ও পাগলা মসজিদ

ট্রলার থেকে নামলাম সোয়া নয়টার দিকে। এবার শহরে ফিরতে হবে। নিকলি কিশোরগঞ্জ শহর থেকে খানিকটা দূরে, গ্রামের হিসেবে রাতও হয়েছে অনেক। চারদিকে ঝুম নীরবতা, অন্ধকার, আমাদের হাইয়েস এগিয়ে চলছে। চলছে খুচরা আড্ডা, হাসি-বিতর্ক। পৌনে এগারোটার দিকে আমরা খোবাইবের শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছলাম। বাড়ি-ফার্নিচার দেখলেই বুঝা যায় পারিবারিক ইতিহাস, বনেদী ঐতিহ্য। খাবার খেয়ে গেলাম পাগলা মসজিদে, কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত নরসুন্দা নদীর তীরে মসজিদটি অবস্থিত। নদীর পাশে বসে ঈসা খাঁর অধস্তন পুরুষ জিলকদর পাগল ইবাদত করতেন, সেই পাগলের ইবাদতের স্থানে মসজিদ নির্মিত হয়, কালক্রমে এর নাম হয়ে যায় পাগলা মসজিদ। এখনো, স্থানীয়রা পাগলের বরকতকে ভুলতে পারে না। অনেকে এখানে মান্নত করে, বিধর্মীদেরকেও এখানে দান করতে দেখা যায়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় লাখ খানেক টাকা এখানে জমা হয়। সব বিদআত এখনো নিয়ন্ত্রণ না করা গেলেও মসজিদটি এখন আলেমদের নেতৃত্বেই পরিচালিত, নিয়ন্ত্রণে জেলাপ্রশাসন। যেহেতু অর্থবৈভবের অভাব নেই, তাই মসজিদের অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে চোখধাঁধানোর মতোই।

এবার যাবো জামিয়া ইমদাদিয়ায়, কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন নেজামে ইসলাম পার্টির সাবেক সভাপতি আতহার আলী। প্রথমে এটি শহীদী মসজিদে একটি ছোট্ট মাদ্রাসা হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কির নামানুসারে মাদ্রাসার নামকরণ করা হয়। আতাহার আলী শিক্ষাসমাপ্তির শেষে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন, তবে তাঁর মধ্যে ছিল বিশেষ উচ্চাভিলাষ। থানবির নির্দেশে কিশোরগঞ্জের একাধিক জমিদারের দাওয়াত গ্রহণ করেন, জমিদারিতে ধর্মপ্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তবে বিশেষ কিছু শরিয়ত বিরোধী কাজে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন, জমিদারির এলাকা থেকে সরে আসেন। মুর্শিদের নির্দেশে কিশোরগঞ্জের একটি ছোট মসজিদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব বুঝান, জনসাধারণের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। প্রতিষ্ঠিত হয় জামিয়া ইমদাদিয়া।

আমরা রাতে ঘুমাব জামেয়া ইমদাদিয়ার মেহমানখানায়। বিশাল হলরুম। দরজার ওপরে লেখা ‘খানকাহে আতহারিয়া ও মেহমানখানা’। মাদরাসায় আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালো মুজিব হাসান। মুজিব ফাতেহে কিছুদিন কাজ করেছিল। মুজিবের মাধ্যমে মাদরাসার প্রভাবশালী শিক্ষক শুয়াইব আব্দুর রউফের সাথেও আমার ভালো পরিচয় আছে। তিনি আমাদের সময় দিবেন বলেছিলেন, তবে ইতিমধ্যে শুয়াইব সাহেবের স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হল, তিনি সন্তানসম্ভবা। তিনি ফোনে দুঃখপ্রকাশ করলেন, পরদিন দুপুরের খানার দায়িত্ব নিলেন। শুয়াইব সাহেব আরবেও ছিলেন অনেকদিন, তাঁর হাত ধরে জামেয়া ইমদাদিয়ায় অনেক উন্নতি হয়েছে। শুধু জামেয়া ইমদাদিয়াই নয়, তাঁর হাত ধরে কিশোরগঞ্জে অনেক ধর্মীয় অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। মসজিদ-মাদরাসা-জনকল্যাণ। জামিয়া ইমদাদিয়া ও শহীদি মসজিদ এখন তাই নতুন ও পুরাতনের স্মৃতি বহন করে।

জামিয়া ইমদাদিয়ার সাথে কিশোরগঞ্জের প্রভাবশালীদের সম্পর্ক অনেক দ্বান্দ্বিক। মাওলানা আতাহার আলী মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় হস্তক্ষেপ নিয়ে আশঙ্কা পোষণ করতেন, সংগ্রামের পরে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। জেল থেকে বের হয়ে নিজের প্রিয় মসজিদ-মাদরাসা ছেড়ে তিনি ময়মনসিংহ চলে যান, জামিয়া ইসলামিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শেষজীবন কাটান সেখানেই, জামিয়া ইসলামিয়াতেই তাঁর কবর। ছেলে আযহার আলী আনোয়ার শাহকে রাজনীতিতে না জড়াতে অসিয়ত করে যান। আনোয়ার শাহ আগলে রাখেন জামিয়া ইমদাদিয়া, মাদরাসা পরিচালনায় জেলপ্রশাসনকেও যুক্ত করেন। যুক্ত হয় আওয়ামীলীগের নেতারাও। সর্বশেষ হেফাজতের মোদী বিরোধী আন্দোলনে জামিয়া ইমদাদিয়ার ছাত্ররাও অংশগ্রহণ করে, মিছিল থেকে আওয়ামি লীগের জেলা অফিসে আক্রমণ করা হয়। প্রভাবশালীরা ক্ষিপ্ত হয়ে অনেক মসজিদ-মাদরাসার শিক্ষক-ইমামদের গ্রেফতার করে। কিশোরগঞ্জে প্রায় পঞ্চাশজনের মতো ইমামকে জেলে যেতে হয়। এত ঝড়ঝাপটার মধ্যেও রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতে জামিয়া ইমদাদিয়া বিপর্যয় রেখে রক্ষা পায়। আমাদের সফরের সময়েও হেফজখানা চালু ছিল।

জামিয়া ইমদাদিয়ার পাশেই শহীদি মসজিদ। এখান থেকেই জামিয়া ইমদাদিয়া ও নেজামে ইসলাম পার্টির কার্যক্রম শুরু হয়। ঐতিহাসিক মসজিদটি জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। তাছাড়া দেশের বৃহত্তম ঈদগাহ ময়দান-ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান এই মসজিদের কাছেই অবস্থিত। দুইতলা ভবন বিশিষ্ট মসজিদটির উপরে রয়েছে ৫ তলা সমান সুউচ্চ বিশাল এক মিনার। মিনারটি নির্ধারিত ছিল আতাহার আলী রহ.- এর গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য। এখনো মিনারে সেই কথা লেখা আছে। কিশোরগঞ্জে একসময় হিন্দুরা অনেক প্রভাবশালী ছিল। একবার নামাজ চলাকালীন সময়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে মসজিদের সামনে পূজা উৎসব পালন করা হয়, তাতে স্থানীয় মুসল্লিরা বাঁধা দিলে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। হিন্দুদের/ মতান্তরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় একজন মুসুল্লি। মসজিদের ভেতরে এখনো টিকে আছে অসংখ্য গুলির দাগ।

মসজিদের দুতলায় থাকেন শফিকুল ইসলাম জালালাবাদী। জামিয়া ইমদাদিয়ায় হাদিস পড়ানোর পাশাপাশি তিনি শহীদি মসজিদে মক্তবেরও দায়িত্বশীল। শাইখুল হাদিস মক্তবেও পড়াবেন, বাংলাদেশে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। দ্বিতীয়দিন বিকেলে আমরা তাঁর সাথে দেখা করতে যাই। দেশের সার্বিক অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলেন, হাসিখুশি মানুষ, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সবার কাছে দোয়া চাইলেন, ‘কতদিন বাঁচি জানি না, ঈমানের সাথে যেন কবরে যেতে পারি।’ জালালাবাদির বিষয়ে আরও বিশদে লেখার ইচ্ছা আছে। এই সফরে সেটা সম্ভব হয়ে উঠলো না। আগামিবার চেষ্টা করবো।

‘আফটার স্কুল মাকতাব : প্রাথমিক ধর্মশিক্ষায় নতুন প্রয়াস’

ফজরের পর আমরা একটা বিশেষায়িত মক্তবে গেলাম। কিশোরগঞ্জের তরুণ আলেম আবদুল কাইয়ুম দেখছিলেন দেশে প্রচলিত মক্তব বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে। সাধারণ পড়াশোনার চাপে ছাত্ররা কুরআন শিখতে পারছে না, হালাল-হারাম-দোয়া-কালাম জানছে না। তাই তিনি দুই হাজার নয় সালে আফটার স্কুল মুনাজ্জাম মাকতাব নামে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশেষ প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় প্রাথমিক শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করেন। একই উদ্দেশ্যে তিনি ভারত ও শ্রীলংকায় সফর করেন, গবেষণা-চর্চার আলোকে নিজস্ব বিশেষ সিলেবাস দাঁড় করাতে সক্ষম হন।

আফটার স্কুল মুনাজ্জাম মাকতাবে কায়েদা-কুরআন-আকিদা-হাদিস-মাসায়েল-দোয়া শেখানো হয়। প্রতিদিন মাত্র এক ঘণ্টা সময়ে ছাত্ররা শিখে নেয় এই পাঁচ বিষয়। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে কেউ চাইলে হেফজও পড়তে পারে। কিশোরগঞ্জে তাদের দশটি শাখা আছে। এর মধ্যে আমরা তিনটি শাখায় যাই। ছাত্রদের কুরআন তিলাওয়াত সন্তোষজনক। প্রধান শাখায় চৌদ্দজনের মতো হেফজ পড়ছে। আমরা কয়েকজনকে পড়া জিজ্ঞাসা করলাম, মুখস্তের মানও খুব একটা খারাপ নয়। উদ্যোগটি অভিভূত হবার মতোই।

উদ্যোক্তা আবদুল কাইয়ুম জানালেন, তারা সারা দেশেই আফটার স্কুল মুনাজ্জাম মাকতাব চালু করতে চাচ্ছেন। জেলায় জেলায় সফর করছেন, ইমাম-খতিব-মুহতামিমদের সাথে বসছেন। কেউ চাইলে তাদের সিলেবাস-সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারে। পোস্টার-বিলবোর্ড থেকে শুরু করে সবকিছুই তারা তৈরি করে রেখেছেন। তাদের ব্র্যান্ডনেম ও প্রোডাক্ট ব্যবহার করে খুব দ্রুত আফটার স্কুল মাকতাব চালু করা সম্ভব। তারা শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রেখেছেন, ‘এই উদ্যোগে শিক্ষক অনেক বড় ভূমিকা পালন করে থাকেন, ফলে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।’ শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য সাপ্তাহিক হামদ-নাত চর্চা ও গল্পের আসরের পর্বও রেখেছেন। যুবক বয়সী মাওলানা আবদুল কাইয়ুমের ব্যক্তিত্ব-ব্যবহারও মুগ্ধ হবার মতো, কিশোরগঞ্জে তরুণদের সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখছেন।

ফিরে আসি : অসমাপ্ত সফর

আফটার স্কুল মাকতাব পরিদর্শন শেষে আমরা খোবাইবের বোনের বাসায় নাস্তা করলাম। ঘণ্টা খানেক লেগে গেল। এবার যাবো বালিখলা, কিশোরগঞ্জ শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। মাথার ওপর প্রচণ্ড রোদ। ইচ্ছে ছিল আজকেও গোসল করবো, তাপের তীব্রতায় সকল উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। চারদিকে বালি, রুক্ষ পরিবেশ। রোদের প্রচণ্ডতায় আমরা কখন বালিখোলা ছাড়বো, সেটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলাম। বালিখলা থেকে গেলাম ঈসা খাঁর জঙ্গলবাড়ি। মসনদে-আলা-বীর ঈশা খাঁ ছিলেন বাংলার বার ভূঁইয়াদের প্রধান। জঙ্গলবাড়ি প্রকৃতপক্ষে ঈশা খাঁর দ্বিতীয় রাজধানী ছিল।কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলাধীন কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের জঙ্গলবাড়ি গ্রামে নরসুন্দা নদীর তীরে দুর্গটির অবস্থান।

দুর্গটির এখন বেহালদশা, পাশেই একটি প্রাচীন মসজিদ। বাকি স্থাপত্যগুলো সংরক্ষণের কেউ নেই। কয়েকটি স্থাপত্য দখল করে রেখেছে স্থানীয়রা। আমরা ঢুকতে গিয়ে দেখলাম জেনানা মহলে এসে পড়েছি। অনেকগুলো বাড়ি এখনো টিকে আছে, প্রধান ঘরটিকে কেউ গোয়ালঘর হিসেবে ব্যবহার করছে। এভাবে অযত্নে-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে মসনদে-আলা-বীর ঈশা খাঁর স্মৃতিচিহ্নগুলো। ইমরান রাইহান বলছিলেন, ভাবতে পারেন ঈসা খাঁ ভরা বর্ষায় মানসিংহের মোঘল বাহিনীকে হাওরের দুর্গম অঞ্চলে যুদ্ধ করতে বাধ্য করছিলেন। দিল্লীর যোদ্ধাদের জন্য সে ছিল এক অসম্ভব পরীক্ষা এবং সে পরীক্ষায় তারা পরাজিত হন।

শহরে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। মুজিব জানালেন শুয়াইব সাহেব আমাদের দাওয়াত দিয়েছেন, শহরের কোন অভিজাত হোটেলে মুজিব আমাদেরকে খাওয়াতে চায়। আজকেই হোটেল খুলেছে, বিকেল বলে খানা প্রায় শেষ। এখানে আমাদের সাথে এসে যোগ দিলেন কিশোরগঞ্জের কৃতিসন্তান তানভীর এনায়েত। তিনি এসেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আমাদের হাসাতে লাগলেন। হোটেলে খানা পেতে পেতে ও খেতে খেতে অনেক দেরী হয়ে গেল। এখন আসর পড়বো। আসর বাদ রওনা দিব ঢাকার উদ্দেশ্য, সেই চিরচেনা ঠিকানায়।

The post কিশোরগঞ্জে দুইদিন : ভাটি অঞ্চলের জলজীবন appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%95%e0%a6%bf%e0%a6%b6%e0%a7%8b%e0%a6%b0%e0%a6%97%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a7%87-%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%87%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%a8-%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%9f%e0%a6%bf-%e0%a6%85/

No comments:

Post a Comment