রাকিবুল হাসান:
১৪ মার্চ, ১৯৭২।
বাচ্চাটির বয়স আজ দুইদিন। পৃথিবীতে আসার পর প্রতি মুহূর্তে তার সৌন্দর্য যেন বেড়েই চলছে। গ্লাসে ভেজানো মুক্তার মতো দুটি চোখ, আঙুলগুলো ফুলের মতো কোমল, ধরলে আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না। দুধের জন্য কান্না করলে চোখ দিয়ে গলগল করে জল পড়ে। জল মুছতে মুছতে বাচ্চাটির মা আফরোজা বলে, এত জল কেন চোখে। কানলে হইবো? হইবো না। এখন কান্না শুরু করলে সারা জীবন কী করবি? দুঃখের কপাল নিয়া দুনিয়ায় আইছোস।
বাচ্চার কান্না তখন আরও বেড়ে যায়। ছোট ছোট হাতগুলো নাড়িয়ে সে তার মাকে ধরতে চায়। মা ধরা দেয় না; মুখ বাকিয়ে বলে, ইশ। দুইদিন হয় নাই পৃথিবীতে আসছে, এখনই কী ন্যাকামো শুরু করে দিছে।
দরজায় দাঁড়িয়ে আফরোজার বাবা মেহের আলী মেয়ের কাণ্ড দেখে বুকের কোথায় যেন একটা গভীর ব্যথা অনুভব করেন। এই দুদিনে বাচ্চাটিকে কয়েকবার কোলে নিতে চেয়েছিলেন তিনি, আফরোজা দেয়নি। কোলে নিলে নাকি মায়া বেড়ে যাবে। মেহের আলীও তা বুঝেন। কিন্তু মন তো সবসময় যুক্তি মানে না। বরং যুক্তি ভেঙেচুরে মায়ায় পড়তে চায়। মায়ায় জড়িয়ে গেলে মানুষ খানিকটা পাগলের মতো হয়ে যায়। মেহের আলী বাচ্চাটিকে কোলে না নিয়েও অদ্ভুত এক মায়ায় পড়ে গেছেন।
মেহের আলী বললেন, বাচ্চাটির কি নাম রাখবি?
আফরোজা বাচ্চাটির গায়ে একটা কাঁথা তুলে দিতে দিতে বললো, তুমি বড্ড বাড়াবাড়ি করছো।
‘নাম ছাড়া ডাকবো কী করে?’
‘আর ডাকতে হবে না।’
‘মা, তুই আরেকবার ভেবে দেখ। আমরা কিন্তু তোকে সাপোর্ট করছি।’
‘দীর্ঘ নয়মাস তো ভাবলাম। কখনো ভাবতে গিয়ে বমি চলে এসেছে। নিজের ওপর নিজের ঘৃণা হয়েছে; কতজনই তো পাক বাহিনীর সন্তান পেটে নেবে না বলে আত্মহত্যা করেছে। আমিই কেবল পারিনি।’
নিজের দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে মেহের আলী বললেন, বাচ্চাটির প্রতি মায়া পড়ে গেছে রে মা!
‘নিজের মেয়ের প্রতি মায়া নেই?’
‘এটা কেমন কথা বলিস?’
‘একবারও কি ভেবেছো, তোমার মেয়ের বিয়ে হয়নি। কিন্তু কোলে তার বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষ কী বলবে?’
মেহের আলী কিছু বললেন না।
‘মানুষ বলবে দেখ, মেহেরের মাইয়া পাকিস্তানি কুকুরের বাচ্চা নিয়া কেমনে ঢংঢং কইরা হাইটা যায়। তোমার সহ্য হইবো বলো?’
মেহের আলী স্কুলের সাধারণ এক মাস্টার। এইটুকু কথা তার সহ্য হবে না সত্যি। কিন্তু এই বাচ্চাটি একাত্তরে পাকিস্তানি ধর্ষকদের বিরুদ্ধে একটি প্রমাণ। কোনোদিন বিচারের সুযোগ এলে তিনি তার মেয়েকে ধর্ষণের বিচার চাইবেন। প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরবেন এই বাচ্চাটিকে। বাচ্চাটিকে টিকিয়ে রাখা আর যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ টিকিয়ে রাখা একই কথা। কিন্তু তিনি পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। মেয়ের বয়স এখানো আঠারো পেরুয়নি। তারও একটা জীবন আছে। সেই জীবনে না জানি কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা ছিলো তার। যুদ্ধ এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে।
যুদ্ধ শেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরে গেছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়নি সেসব মায়েদের, যাদের গর্ভে এখনো পাকিস্তানি ধর্ষকদের সন্তান। পত্রিকায় মেহের আলী দেখেছেন, ইতালি এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে এসব মায়েদের গর্ভপাত ঘটানোর জন্য চিকিৎসক দল ঢাকায় এসেছেন। হাজার হাজার মা তাদের গর্ভপাত ঘটাতে উপস্থিত হচ্ছেন হাসপাতালে। মাদার তেরেসা শিশু সদনে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, যেখানে যুদ্ধে এত মহিলা ধর্ষিত হয়ে গর্ভধারণ করেছে? যুদ্ধ শেষ হলে তাদের গর্ভপাত ঘটানোর জন্য হাসপাতালে ভীড় লেগেছে?
বাচ্চাটিকে মাদার তেরেসা শিশু সদনে দিয়ে আসা হবে। আফরোজা ছোট একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে; এতে বাচ্চার লোলদানি, গেঞ্জি, লাল একটি সুয়েটার। শিশু সদনেই বড় হবে বাচ্চাটি। শুনেছে বাইরের দেশ থেকে এসব যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে বিভিন্ন মানুষ আসে। ভাগ্য ভালো হলে সে-ও তেমন কারো কোলে চড়ে পাড়ি জমাবে বিদেশে। মেহের আলী বললেন, মা বেঁচে থেকেও বাচ্চা মেয়েটি আজ থেকে এতিম হয়ে যাবে। বড় হয়ে জানবে তার মা তাকে শিশু সদনে ফেলে গেছে।
আফরোজা কোনো কথা বললো না। বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো। আজই বাচ্চাটিকে ওখানে রেখে না আসলে বড্ড মায়া পড়ে যাবে।
মেহের আলী পথ আটকে বললেন, তার কোনো নাম দিবি না?
মুখ ঘুরিয়ে আফরোজা বললো, না।
মেহের আলী তার মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, কেন?
আফরোজা কর্কশ কণ্ঠে বললো, কলঙ্কের কোনো নাম দিতে নেই। একাত্তরজুড়ে মেয়েদের ওপর পাকিস্তানিরা এঁকে দিয়ে গেছে যে কলঙ্ক, তার নাম আমি দিতে পারবো না।
মেহের আলী পথ ছেড়ে দাঁড়ান। মেয়ের যুক্তির সামনে তিনি হেরে যান। তার বলতে ইচ্ছে করে, ফুলের মতো বাচ্চা মেয়েটি তোকে ছাড়া থাকবে কী করে। তাকে যদি দত্তক নেয় কোনো খৃস্টান, তাহলে সে তো খৃস্টান হয়ে যাবে। হতে পারে সে জারজ, তার তো ধর্ম আছে। সে কি কোনোদিন জানতে পারবে, তার মা ছিল মুসলমান? কথাগুলো বলতে গিয়েও বলতে পারেন না মেহের আলী। বিভৎস বাস্তবতার সামনে হারিয়ে যায় তার যাবতীয় কথা বলার শক্তি।
শিশু সদনে এসে চমকে গেলো আফরোজা। সে একা নয় এই জার্নিতে; তার সঙ্গে তার মতো আরও আনেকেই আছে। বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে তার মতো এমন ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার মেয়েদের দেখছে। আচ্ছা, সবাই কি আমার মতো তার বাচ্চাটাকে রেখে যাবে এখানে? প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগেই তার কাঁধে হাত রাখলো সিস্টার মার্গারেট মেরী। মুখে বিস্তীর্ণ হাসি।
‘এত সুন্দর মেয়ে। কী নাম রেখেছো?’
‘এখনো নাম রাখিনি।’
‘জন্ম কবে?’
‘১২ মার্চ, ১৯৭২।’
‘মেয়েটা আগুনের মতো সুন্দর। আমি তার নাম রাখলাম শিখা।’
সিস্টার জানেন, এখানে যারা বাচ্চা নিয়ে আসে তাদের আধিকাংশই আসে বাচ্চাদের রেখে যেতে। একাত্তরের কলঙ্ক তারা কেউ নিজেদের সঙ্গে রাখতে চায় না। কিন্তু একাত্তরে ধর্ষণ পরবর্তী গর্ভধারণে এত বাচ্চার জন্ম, তাদেরকে আগলে রাখতে তো কাউকে না কাউকে আসতে হবে। এখন শিশু সদনগুলোই তাদের একমাত্র আশ্রয় হয়ে উঠেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে।
সিস্টার একটা রেজিস্টারে লিখলেন, শিখা। জন্ম ১২ মার্চ, ১৯৭১। আফরোজা নিজের নাম দিতে রাজি হয়নি। তাই লেখা হলো মায়ের নাম অজ্ঞাত। মাদার তেরেসা শিশু সদন।
বাচ্চা জেগে থাকলে রেখে যাওয়া কঠিন। তাই আফরোজা চেষ্টা করলো তাকে ঘুম পাড়াতে। মায়ের আদর পেয়ে মুহুর্তেই ঘুমিয়ে পড়লো শিখা। আফরোজা তাকে কোল থেকে নামাতে গিয়ে দেখলো, তার আঁচল কোমল হাতে আকড়ে ধরে রেখেছে শিখা। হঠাৎ করেই তার মনটা কেমন করে উঠলো। মাতৃত্বের অদ্ভুত এক মায়া তাকে ছুঁতে গিয়েও যেন ছুঁতে পারলো না। বারবার পাকিস্তানি কুকুরের মুখটা তার মনে বজ্রাঘাতের মতো কেঁপে কেঁপে উঠলো। কিন্তু তবুও জীবনে এই প্রথম আফরোজা অনুভব করলো, একটা নরম হাতের মুষ্ঠি থেকে সামান্য একটা আঁচল ছাড়াতে গিয়ে বুঝি তার কলজেটাই ছিড়ে যাচ্ছে। কী সূত্রহীন সমীকরণে বাঁধা মানুষের মন। নয়মাস গর্ভে ধারণ করেও যে মায়াটা জন্মায়নি, আচল থেকে ঘুমন্ত শিখার কোমল হাতটা ছাড়াতে গিয়ে তারচে বেশি মায়া জন্মে যাচ্ছে। মায়ার যাদুর আঠায় জোড়া লেগে থাকে পৃথিবীর যাবতীয় সম্পর্ক। মায়া কেটে গেলে সম্পর্কগুলোগ ঝুরঝুরে মাটির মতো ভেঙে পড়ে। এজন্যই প্রতিনিয়ত আমাদের মায়া বাড়ানোর চেষ্টা করতে হয়। একটু আদর, একটু যত্ন, মূলত ওই মায়ার যাদুর আঠাকেই শক্তিশালী করে তুুলে।
শিশু সদনে শিখাকে রেখে আসার পর থেকেই আফরোজার নিজেকে হালকা লাগার পরিবর্তে আরও ভারী ভারী লাগছে। হাঁটতে গিয়ে কেবল মনে হচ্ছে কেউ আঁচল টেনে ধরছে। একলা হলেই মনে হচ্ছে দূর থেকে কেউ আম্মু আম্মু বলে ডাকছে। এখন মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে খুব নিঃসঙ্গতা অনুভব হয়। কেমন একটা হাহাকার তার গলা চেপে ধরে। শিখার মায়াবি দুটি চোখের তাকিয়ে থাকা কিছুতেই চোখের সামনে থেকে যাচ্ছে না। এটা মায়া নাকি ঘোর। ঘোর আর মায়ার মধ্যে তফাৎ কোথায়। ঘোরের মত মায়াও কি কেটে যায়? ঘোর হলে এতদিনে তা কেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু উলটো বাড়ছে কেন।
একদিন সকালে দৈনিক ইত্তেফাকের একটি সংখ্যা নিয়ে এলেন মেহের আলী। এসেই ডাকতে লাগলেন, কই গো আফরোজা, কই। এদিকে আসো।
আফরোজা তাড়াতাড়ি করে বাইরে বেরিয়ে আসে। মেহের আলী হাসতে হাসতে বললেন, খুশির সংবাদ। এই দেখ কী লেখছে পত্রিকা।
আফরোজা পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখলো বড় হেডলাইনে লেখা-’১৫ যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিলো কানাডা।’ শিখাকে চিনতে একটুও ভুল হলো না তার। এই কয়েকদিনে শিখা যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে। পত্রিকার ছবিতে নিজের অজান্তেই চুমু খেয়ে ফেললো সে। তারপর পত্রিকাটি নিয়ে ঘরে গিয়ে দরজার খিল আটকে দিলো আফরোজা।
The post দত্তক appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%a6%e0%a6%a4%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%95/
No comments:
Post a Comment