ইবরাহীম জামিল:
আজ বুধবার। আগুনখেয়া থেকে ত্রিশ মাইল দূরে রুমা বাজারে হাট বসছে। মহিত শেখের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পাঁচটা জুতসই মুরগীর খাঁচা বানিয়েছে সে । হাটে বেচতে হবে। তাছাড়া ইংরেজ সাহেবও রুমা বাজারে তার সাথে দেখা করতে বলে গেছে । মহিতের জন্য সে অপেক্ষা করবে।
বাজার টাজার করে দেবে হয়তো, সেই বা কম কি?
মহিত শেখ দ্রুত স্নান করে, আচ্ছামতো বুকে পিঠে সরিষার তেল ঘসে, কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে, মাথায় পাঁচটা মুরগির ঝুড়ি নিয়ে বার্ধক্যের দুর্বলতাকে গালাগাল করতে করতে বাজারের পথ ধরলো। সাথে সেবাগী ও শঙ্কু ওঝা।
রুমা হাট মানে শঙ্কু ওঝার পোয়া বারো। সে কী-সব লতাপাতা উত্তরের ঝোপ থেকে তুলে এনে তামার মাদুলিতে ভরেছে। মাদুলিগুলো আবার এক এক হাত তাগিতে বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েছে। ওর ঝাকড়া চুলের নিচে ঝুলতে থাকা তাবিজগুলোকে ওরই বাবরী চুলের বর্ধিত অংশ বলেভ্রম হয়। দুই হাতে মোট সাতটা লাল নীল বেগুনি রঙ্গের পাথরের আংটি। আঙটিময় হাতে বিভিন্ন সাইজের পাঁচটা সাপের বাক্স। দু’টোতে আছে ইয়া বড়া দু’টো কালবড়া সাপ। একটায় পদ্মগোখরা। বাকি দু’টোর একটাতে ক্ষুদে একটা দুধরাজের বাচ্চা, আরেকটায় বুড়োমতো একটা ঢোঁড়া সাপ। ঢোঁড়াসাপ দিয়ে খেলা দেখানো নিরাপদ। আর সাপের লেজ ধরে ছেড়ে দিলে লোকজন এমনিই আঁতকে উঠে পিছনে সরে যায়। তখন ঢোঁড়া সাপও যা, অজগর সাপও তাই।
তিন তিনটে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, পরনের কাপড় মাথায় তুলে, দু’দুটো নদী ঝাঁপিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে যখন তারা বাজারে পৌঁছলো, তখন খাঁ-খাঁ দুপুর। সবে বাজার বসছে।
শঙ্কু ওঝা শতবর্ষী বটগাছটার তলে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ঝাকড়া দেয়া বটগাছের নিচে বাবরি চুলের শঙ্কু ওঝা দাঁড়ালে এমনিতেই ঐশ্বরিক একটি ভাব চলে আসে, মানুষ সাপের খেলাকে জাদুর মতো অলৌকিক কিছু ভাবতে শুরু করে, মনে হয় যেন শঙ্কু ওঝার ডালা থেকে নয়, বরং শতবর্ষী বটগাছের শিকড়ের ফাঁক গলে বেরিয়ে এসেছে কতগুলো ইচ্ছেধারী নাগিন। এমন পরিবেশে এমনিতেই মানুষ ভীড় করে ফেলে। শঙ্কু ওঝাকে আলাদা কসরৎ করে লোক জমাতে হয় না।
শঙ্কু ওঝা মাটিতে বৃত্তাকারে একটা দাগ কেটে উচ্চস্বরে মন্ত্র পড়তে পড়তে সাপের ডালা খুললো। কয়েকজন ব্যাপারী আলু তরকারী ফেলে শঙ্কু ওঝার বৃত্তের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বাজার জমলে ওঝার মজমাও জমে উঠবে।
মহিত শেখ মাথা থেকে ঝুড়ি ক’টা নামিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো, ইংরেজ সাহেব কি এসেছে?
শেবাগী শক্ত করে দাদার গামছার প্রান্ত ধরে রেখেছে। এমনিতে সে ভিতু নয়, কিন্তু বাজারে এতো এতো মানুষ, এতো হৈ চৈ দেখে ওর ভয় লাগে। দাদার গামছা আকড়ে ধরে সে অবাক চোখে সবকিছু দেখতে থাকে।
শঙ্কু ওঝা বেশ জমিয়ে নিয়েছিলো, কিন্তু বাজারের ওপাশে আরো একটা জটলা বেঁধেছে। তাই দেখে শঙ্কুর সাপ খেলা ছেড়ে সবাই ওদিকে ছুট লাগিয়েছে। শঙ্কুর কাছ থেকে লোক কেড়ে নিয়ে যায়, এই পার্বত্যাঞ্চলে এতো বড় ওঝা আর কে আছে! মহিত শেখ ভীষণ অবাক হলো। সেবাগীকে মুরগির ঝুড়ির কাছে দাঁড় করিয়ে রেখে মহিত ভীড় ঠেলে জটলার ভেতরে ঢুকলো। সেই ইংরেজ সাহেব দাঁড়িয়ে আছে গরুর দড়ি হাতে নিয়ে। লোকেরা ভীড় করে তাই দেখছে। দড়ির অপরপ্রান্তে যে গরুটি বাঁধা সেটা বেশ নাদুস নুদুস তাগড়া গাভী। দেখলেই পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। পলকে বিষয়টা দেখে নিয়ে মহিত শেখ ইংরেজ সাহেবকে লম্বা একটা আদাপ ঠুকলো। অমায়িক হাসি দিয়ে বললো, অনেক্ষণ ধরে আপনাকে খুঁজছি।
ইংরেজ সাহেবের মুখে স্নেহপূর্ণ হাসি।
গরুর রশিটি মহিত শেখের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বললো, এটা তোমার মায়ার চেয়ে নিশ্চয়ই খারাপ নয়?
মহিত শেখের চোখে পানি এসে গেছে।
ভরা বাজারে দাঁড়িয়ে একজন বুড়ো মানুষ কাঁদলে লোকে কী বলবে, গামছার মুড়ো দিয়ে কপাল মোছার ভান করে মহিত শেখ খুবই সন্তর্পণে চোখের পানি মুছে ফেললো।
রুদ্ধ গলায় বললো, না, এটা অনেক স্বাস্থ্যবতী। তবে মায়ার উপর মায়া পড়ে গেছে, তাই ওর সাথে কিছুর তুলনা করবো না।
ইংরেজ সাহেব বললো, উপরেও মায়া পড়বে।
মহিত বললো, তা পড়বে বৈকি, মায়ার মতো যত্ন করেই তো ওকে পুষবো। কিন্তু আপনার কাছে অনেক ঋণী হয়ে গেলাম।
ইংরেজ সাহেব মুচকি হাসলেন। হাসি মুখেই বললেন, কখনো যদি তোমার কাছে আমার ঋণী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে সেদিন কী করবে?
মহিত শেখ বললো, কী অলুক্ষুণে কথা বলছেন! আমার কাছে আপনি ঋণী হতে যাবেন কেন?
ইংরেজ সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। তাহলে তুমি আমাকে কখনোই সাহায্য করতে চাও না?
মহিত শেখ জিবে কামড় দিল, তা নয়, আমি বলতে চাচ্ছিলাম, আমার মতো অনাথের কাছে আপনার কী প্রয়োজনই বা থাকতে পারে? কিন্তু যদি কোনোদিন প্রয়োজন পড়ে সেদিন অবশ্যই আমি আপনার পাশে দাঁড়াবো।
ইংরেজ সাহেব খুশি হল। মহিতের পিঠে হাত রেখে বলল, মানুষের জন্য মানুষ। আমি তোমার প্রয়োজনে পাশে থাকবো, তুমি আমার প্রয়োজনে পাশে থাকবে। তাহলেই না মানবতা টিকে থাকবে, পৃথিবী এগিয়ে যাবে।
মহিত শেখ এসব দার্শনিক কথা খুব একটা বুঝল না। মানুষ তো টিকেই আছে, পৃথিবী তো এগিয়েই যাচ্ছে। কেউ কাউকে সাহায্য না করলেই যে, সূর্যটা দাঁড়িয়ে যাবে, পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে যাবে এমন তো নয়। তবে সে মনে মনে ভাবল, সত্যিই যদি কোনোদিন ইংরেজ সাহেবকে সাহায্য করার প্রয়োজন পড়ে সে প্রাণ দিয়ে হলেও সাহায্য করবে।
সূর্যটা পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। মহিত শেখ কপালে হাত ঠেকিয়ে পাহাড়ের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা সূর্যটার দিকে তাকালো। বাড়ি ফিরতে হবে।
শঙ্কু ওঝার সাপের খেলা আজ জমেনি। তবু তার মন ভালো; ইংরেজ সাহেব মহিতকে গরু দিয়েছে। তাকে দিয়েছে দুই হাজার টাকা। আগামী চার হাটে সাপের খেলা না দেখালেও তার চলে যাবে। শঙ্কু ওঝা দুই হাত পিছনে নিয়ে তার বাবরী দোলানো চুল বাঁধলো। তারপর সাপগুলো ডালায় পুরে মহিত শেখকে বললো, খুড়ো! চলো বাড়ি ফিরি।
মহিত শেখও বাড়ি ফেরার জন্য উসখুস করছিলো। তাকে গরু হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কয়েকজন দামাদামি করে গেছে। মহিত শেখের রাগ ধরে গিয়েছিলো— ব্যাটা গরু বেঁচতে এসেছি নাকি? এসেছি মুরগীর ডালা বেঁচতে, তাই কিনলে বল? মুখে অবশ্য কিছু বলেনি। কেউ দাম জিজ্ঞাসা করলে ব্যস্ত হয়ে সে গরুর পিঠে হাত ডলতে শুরু করেছে।
এতক্ষণ সে শঙ্কুর অপেক্ষা করছিলো। শঙ্কু ডাক দিতেই সাড়া দিয়ে বললো, চল বাড়ি ফিরি।
শেবাগী পশ্চিম আকাশে কী যেন দেখছিলো, মহিত শেখ হাঁটা ধরতেই সে গামছার প্রান্ত টেনে ধরে পশ্চিম আকাশে আঙুল দেখিয়ে বললো, দাদা! সূর্যটা ওই পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। মহিত শেখ তাকিয়ে দেখলো, সূর্যটা দাঁড়িয়ে নেই, তড়িঘড়ি পাহাড়ের পিঠে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।
দ্রুত শেবাগীর হাতে টান দিয়ে বললো, সময় নেই রে… বড্ড দেরি হয়ে গেল বাড়ি ফিরতে।
আগুনখেয়ার পাদদেশে এসে যখন তারা পৌঁছলো, ততক্ষণে সূর্যটা একেবারে লাল টকটকা হয়ে গেছে। অনেক উপরে উঠতে হবে। উপরে ওঠার এই পথটা ঝোঁপঝাড়ে ঠাসা। ঝোঁপঝাড় ঠেলে বেশ খানিকটা উপরে ওরা উঠে এসেছিলো, হঠাৎ গরুটা কী মনে করে ডেকে উঠে ঝোপের দিকে দৌঁড় দিলো।
শঙ্কু ওঝা ঝোঁপের মধ্যে ঢুকল গরুটাকে টেনে বের করে আনার জন্য। ঝোঁপের মধ্যে পা দিয়েই “বাবা গো!” বলে ছিটকে বেরিয়ে এল সে। শঙ্কুর চিৎকারে সেবাগী ভয় পেয়ে গেছে। মহিত শেখ চেচিয়ে বললো, কী হল শঙ্কু? কী হল তা বলতে গিয়ে মুখ হা করেও শঙ্কু বলতে পারল না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মুখে ফেনা উঠে এসেছে তার। মহিত শেখ শঙ্কুর কাছে ছুটে গেল। শঙ্কুকে ছুতে গিয়েই মহিত শেখ বুঝতে পারল কী ভুলটা সে করেছে।
শঙ্কু ওঝা তড়পাতে তড়পাতে দুই মিনিটের মাথায় মরে গেলো। কিন্তু মহিত ও তার নাতি উৎকণ্ঠায় বৃক্ষের মতো স্থীর হয়ে রইলো। সময় যেন চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছে। মাত্র দুই হাত দূরে ভয়ংকর বিষধর একটি দাড়াস সাপ ফনা তুলে জ্বলজ্বলে চোখে মহিতের দিকে তাকিয়ে আছে। সাপটি এগিয়ে আসুক অথবা ফিরে যাক— সে কিছুই করছে না। সবকিছু যেন স্থির দাঁড়িয়ে গেছে। শুধু মহিত শেখের মাথার ভিতরে একটি ঝনঝন শব্দ বাজছে। মাথার ভিতরের ঝনঝন শব্দটা হঠাৎ থেমে গেলো। মহিত খেয়াল করলো, সাপটি ফনা নামিয়ে ঝোঁপের মধ্যে চলে যাচ্ছে। এখন দ্রুত এ স্থান ত্যাগ করা উচিৎ। কিন্তু মহিত শেখ তা করলো না। ভয় কেটে যাওয়ার পর একটি সর্বগ্রাসী লোভ মহিত শেখকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সে একপা দুইপা করে শঙ্কু ওঝার দিকে এগিয়ে গেলো। সাপে কাটা শরীরের হাত দেয়া যাবে না। শরীর বিষ হয়ে গেছে। মহিত সন্তর্পণে শঙ্কুর লুঙ্গির ভাঁজ থেকে দুই হাজার টাকা বের করে আনলো। সাথে আরো কিছু খুচরো পয়সা। শঙ্কুর আজকের কামাই। টাকাগুলো নেয়ার পর মহিত শেখ তার গামছায় পেঁচিয়ে শঙ্কুর লাশটি গভীর ঝোপের মধ্যে ছুড়ে মারলো। শ্বাপদের একবেলার আহার জুটুক। এই পাহাড়ে এর চেয়ে বেশি আর কীইবা করার আছে। পার্বত্যাঞ্চল মানে শ্বাপদের অরণ্য, এখানে মানুষ নয়, পশুরাই সুখে থাকবে। আর পশুসম যে মানুষগুলো সমতলে থাকে, ওরা কোনদিন পাহাড়ী মানুষের দুঃখের খোঁজ নিতে আসবে না। মহিত শেখের চোখ থেকে দুইফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে জানে, সমগ্র আগুনখেয়ায় শঙ্কুর জন্য এ দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরানোরও কেউ নেই।
গরুটাকে জঙ্গল থেকে ডেকে ডেকে বের করতে প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেল।
শঙ্কুর সাপের বাক্সগুলো পিঠে নিয়ে যখন মহিত শেখ আগুনখেয়ায় এসে পৌঁছলো তখন অনেক রাত। শেবাগীর মুখের উপর চোখ পড়তেই মহিত শেখ আঁতকে উঠলো— চোখ নয়, মুখের উপর দু’টি আগুনের ফুলকি জ্বলজ্বল করছে। শঙ্কু ওঝাকে সাপে কাটার পর থেকে সে কোন কথা বলেনি। এই ভর রাত্তিরেও সে মহিত শেখের সাথে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে হাঁটছে। এখন চোখ কেমন জ্বলজ্বল করছে। মুখ থমথমে। শঙ্কু ওঝার ভূতে তাকে আসর করেনিতো! মহিত শেখ শঙ্কিত হয়ে উঠলো। এমন জোসনার রাতে কেবল সাপ-খোপ নয়, দেও দানোও ঘুরে বেড়ায়। মহিত শেখ দ্রুত ঘরে গিয়ে এক ঘটি জলে সর্পমন্তুর পড়ে শেবাগীর গায়ে ছিটিয়ে দিলো।
শঙ্কু ওঝার অন্তর্ধানে ছোট্ট করে হলেও একটা হৈ চৈ পড়বে বলে মহিত শেখ ভেবেছিলো, কিন্তু কিছুই হলো না। সে ওঝা মানুষ, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াবে এটাই স্বাভাবিক। সবাই ধরে নিয়েছে, সে কোনো এক পাহাড়ী গাঁয়ে সাপের ডালা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিংবা হয়তো তার অন্তর্ধানের বিষয়টি কারো চোখেই পড়েনি। কারো তাবিজ মাদুলির দরকার পড়লে তখন শঙ্কুর খোঁজ পড়বে। এদিকে গতকাল থেকে সেবাগী কেমন যেন করছে। চোখে শূন্য দৃষ্টি। ভ্যাবলার মতো গাছ-পালা আর দূর পাহাড়ের চূড়োর দিকে তাকিয়ে থাকে । হঠাৎ হঠাৎ হারিয়ে যায়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো— আজ অপরাহ্নে হঠাৎ সেবাগীকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজন খবর দিলো, পাহাড়ের নিচে সেবাগী বসে আছে। মহিত শেখ তড়িঘড়ি পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে তিনবার হোঁচট খেলো, চারবারের বার দেখতে পেলো, শঙ্কু যেইখানটাতে মরেছিলো, সেবাগী সেইখানে বসে আছে। মহিত শেখ নিশ্চিত, শঙ্কুর আত্মা সেবাগীর ঘাড়ে ভর করেছে। মহিতের বংশ শেষ করেই তবে ছাড়বে। মহিত শেখ শঙ্কিত হয়ে পড়লো— এখন কী উপায়? একটা উপায় যে বের করতে পারতো সেই শঙ্কুই মরে ভূত হয়ে গেছে। লাশটা এখনো গন্ধ ছড়াতে শুরু করেনি। গন্ধ ছড়ালেই হৈ চৈ শুরু হয়ে যাবে। অবশ্য বুড়ো মহিতের কী ঠেকা? সে বলে দেবে সে কিছু জানে না। হয়তো পা হড়কে পাহাড় থেকে পড়ে গেছে। কিন্তু মহিত শেখ ঠিকই ঠেকে গেলো। সেদিন দুপুর গড়াতে না গড়াতেই মাতাল পরেশ হাঁক দিতে দিতে আগুনখেয়ায় ঢুকলো। ছেলে বুড়ো সবাই তার চারপাশে জড়ো হওয়ার পর বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতেই সে বললো, সবাই শোনো! শঙ্কু ওঝাকে সাপে কেটেছে। সে ঝোপের মধ্যে মরে পড়ে আছে।
পরেশের কথা শেষ হওয়ার আগেই উপস্থিত মহিলারা বিলাপ জুড়ে দিলো। বুড়োদের কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে। লক্ষণ ভাল নয়। সর্পদেবীর কু-দৃষ্টি পড়েছে। উজাড় হয়ে যাবে এই পাড়া। একের পর এক সর্প দংশনে মরতে থাকবে পাড়ার মানুষ। শীঘ্রই পূজো দিতে হবে। পরেশ আবার বলে উঠলো, শঙ্কুর সাপে কামড়ের চেয়ে অবাক কথা বলছি শোন! মহিলারা কান্না থামিয়ে উৎকর্ণ হলো। পুরুষেরা কপালের ভাঁজ আরো শক্ত করে ফেললো। শঙ্কুর গাঁটে কোন টাকা নেই। কে যেন মেরে দিয়েছে। উপস্থিত সবাই যেন বজ্রাহত হলো, কী কথারে বাবা! বুড়োরা হায় হায় করে উঠলো- কী দুঃসময় এলোরে… এমনও কাজ মানুষ করে?
শরৎ তৈরী হয়ে নিচে গেল স্বচক্ষে শঙ্কুর লাশ দেখে আসতে। তার সাথে আরো ক’জন জুড়লো। শঙ্কুর লাশটা আনতে হবে। তার আগে কারবারিকে বিষয়টা জানানো দরকার। মহিত শেখ বারান্দায় বাঁশের পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে ছিলো। পরেশের ঘরের সামনে মানুষের জটলা দেখছিলো কৌতূহল নিয়ে। খবর তাহলে পৌঁছে গেছে! মহিতের খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো ওখানে গিয়ে বিষয়টা দেখে আসে। কিন্তু গেল না।
মহিত যেহেতু কারবারি, ওরাই মহিতের কাছে আসবে। অতি কৌতূহল বিপদ ডেকে আনতে পারে। লোকগুলো মহিতের কাছে এখনো এসে পারেনি, শরৎ চেচিয়ে উঠলো, খুড়ো! শুনেছো শঙ্কু মারা গেছে।
মহিত শেখ আঁতকে উঠলো, বলো কী? কখন? কীভাবে?
-কিভাবে তা আমরা কী করে বলবো, বেরিয়েছিল তোমার সাথে, আর তো ফেরেনি।
মহিত শেখ আঁতকে উঠল। ওরা কি তাকে সন্দেহ করছে। না, দুর্বলতা দেখানো চলবে না। সাথে সাথে মহিত নিজেকে সামলে নিল।
কৈফিয়তের সুরে বললো, আমার সাথে বেরিয়েছিল বটে। বাজারেও আমরা একসাথেই ছিলাম। কিন্তু ইংরেজ সাহেব আমাকে গরু কিনে দিলে গরু নিয়ে আমি চলে এসেছি। আমি ওর মতো রাত-বিরেতে বনে জঙ্গলে ঘোরার সাহস পাইনে!
এবার গলার স্বরে সন্দেহ ফুটিয়ে মহিত বললো, পরেশ! তুই ঠিক দেখেছিস তো? তুই তো আবার ভাংটাং খেয়ে বুদ হয়ে থাকিস। চোখে উল্টো-পাল্টা দেখিসনি তো?
পরেশ ভাং খায় ঠিক, কিন্তু ওকে কেউ একথা বললে সহজে মেনে নেয় না।
সে রেগে দিয়ে বললো, খুড়ো! আজেবাজে কথা বলবে না। একদম নিজের চোখে দুইহাত দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছি।
তারপর খানিকটা সামনে এসে সবিস্তারে বর্ণনা করলো— কিভাবে কাঠ কাটতে গিয়ে (ভাং খেতে গিয়ে) ঝোঁপের মধ্যে মহিতের লাশ দেখতে পেয়েছে। লাশ যে সাপে কাটা তাও বলতে ভুললো না। মহিত শেখ বেশ গম্ভীরভাবে পরেশের কথা শুনছিলো। পরেশ থামলে মহিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, সারা জীবন সর্পমাতার সেবা করে শেষ পর্যন্ত সাপের হাতেই মরতে হলো!
পরেশের দিকে সোজা চোখে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করল, তা শঙ্কুর কাছে যে টাকা পয়সা ছিলো তা এনেছিস? পূজো দিতে দেরি করা যাবে না। রাগ সাপের মাথায় উঠে গেছে। পূজো দিয়ে তা নামাতে হবে। জটলার পিছনে থাকা মহিলারা মহিতের কথা শেষ হতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
কেউ একজন শঙ্কিত গলায় বললো, মহিতদা! টাকা কে যেন নিয়ে গেছে। সর্পমাতার অভিশাপ আসতে আর দেরি নেই।
মহিত আৎকে উঠার ভান করে বললো, বলো কি? সর্বনাশ! সাপে কাটা মানুষের ধন চুরি হলে আমাদের আর নিস্তার নেই। পরেশ! তুই নিসনি তো!
পরেশের চোখে আগুন জ্বলে উঠল। শীতল গলায় বললো, বুড়ো! মুখ সামলে কথা বলবা। নয়তো খুনোখুনি হয়ে যেতে পারে।
সত্যিকার অর্থেই আগুনখেয়ার মানুষেরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। সাপে কাটা মানুষের টাকা চুরি হওয়া সহজ কথা নয়। কোনো একটা সমাধান করতে হবে। তার আগে শঙ্কুর লাশ আনা দরকার।
মহিত শেখের শরীরটা ভার লাগছে। সে যেতে পারলো না। জোয়ান তাজা সাত আটটা ছেলে শঙ্কুর লাশ আনতে নিচে নেমে গেলো।
যত রাত হয়ে উঠছে আগুনখেয়ার আবহাওয়া যেন একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে। ছেলেগুলো লাশ নিয়ে মহিতের বাড়ি আসেনি। পরেশের ঘরে গিয়ে উঠেছে। লাশ পঁচা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। পরেশের ঘরের কাছে বেশ হট্টগোল হচ্ছে। অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। মহিতকে ওরা ডাকেনি। কাছে পিঠে একটা মানুষও পাওয়া যাচ্ছে না যাকে বিষয়টা জিজ্ঞাসা করা যায়। দুই পা হেঁটে পরেশের ঘরে যাওয়া যায় কিন্তু মহিতের কেন যেন ভয় হচ্ছে। কে জানে, রাতের আঁধারে কী ঘট পাকিয়ে উঠছে পরেশের ঘরে! অনেক্ষণ ঘরের দাওয়ায় একলা বসে থেকে মহিত শেখ আর পারলো না, পরেশের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো।
মহিত শেখ একটু আগেও শুনেছে ঘরে বিরাট হৈ চৈ হচ্ছে। অথচ সে ঢোকার সাথে সাথে সবাই চুপ হয়ে গেছে। সবাই তার দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছে। মহিত শেখের বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। তবে কি কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে? আগুনখেয়ার অলিখিত সংবিধানে কয়েকটা আইন আছে। তার একটা হলো পূজার অর্থ আত্মসাৎকারী কখনো আগুনখেয়ার হেড হতে পারবে না। কাউকে সাপে কাটলে আগুনখেয়ার চিরাচরিত নিয়ম হলো— তার টাকা পয়সা দিয়ে সর্পমাতার নামে পূজো দিতে হবে। পূজো মানে শুকর বলি।
আগুনখেয়ার পূবে পাহাড়ী দেবতার উপাসনাগৃহের সামনে একটি সর্পমূর্তি আছে। সূর্য উদয়ের মুহূর্তে তার সামনে শুকরটি বলি দিয়ে সর্পমাতার গায়ে রক্ত ছিটিয়ে দিতে হবে। রক্তপান করিয়ে সর্পমাতাকে তৃপ্ত করতে হবে। এ পূজা না দেয়া হলে সর্পমাতা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। যেখানে যাকে পাওয়া যায় তাকেই সাপেরা দংশন করে।
এই পাহাড়ী এলাকা ছিলো সাপ ও শ্বাপদের অরণ্য। নাড়ীহারা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো সাপেদের অরণ্যে বাস করতে এসেছে। মানুষ ও সাপেদের মাঝে একটা বোঝাপড়া না থাকলে ওরা এখানে মানুষকে বসবাস করতে দেবে কেন?
মহিত শেখ এই পাহাড়ের প্রাচীন মানুষ। অনেকবার সে সাপে কাটা মানুষের অর্থ দিয়ে আগুনখেয়ায় পূজা দিয়েছে। খুব গাম্ভীর্যের সাথে। কিন্তু সে নিজে এই কুসংস্কার মানে না। পাহাড়ের সবগুলো মানুষকে একবেলা শুকরের মাংস খাওয়ানোর লোভে পূর্বপুরুষের এই রীতিটি সে পালন করতো। আজ যখন সাপে কাটা মানুষটির টাকা একান্ত সংগোপনে মহিতের পকেটে চলে এসেছে, তখন সেই কি এই নিয়মের বেড়াজালে ফেঁসে যাবে?
ঘরে থাকা সব কটা মানুষ মহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মহিত সবার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। কেউ হাসির উত্তর দিলো না। পরেশের এক খুড়ো, মহিতের বাপের কাল থেকে আগুনখেয়ায় থাকছে, সে সবার মাঝখানে একটা পিঁড়ি দেখিয়ে বললো, মহিত এখানে এসে বসো। সবাই নিরব।
মহিত বসলে পরেশ বলে উঠলো, আচ্ছা মহিত খুড়ো! একটা বিষয় বুঝলাম না। শঙ্কু আর তুমি একসাথে গিয়েছিলে হাঁটে। ফিরেছো নিশ্চয় একসাথে! সে যদি রাতে সাপের কামড় খেয়ে থাকে তবে তুমি কোথায় ছিলে? মহিত শেখ সামনের দিকে তাকালো। সবার চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। ওরা উত্তর জানতে চায়। মহিত শেখ পরেশের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি আসলে কী বলতে চাও? পরেশ গলা খাকারি দিয়ে বললো, খুড়ো! ব্যাপারটা গোলমেলে লাগছে। সবাই মনে করছে, ও টাকা তুমি নিয়েছো। মহিত শেখ একটুও বিচলিত হলো না। বললো, ব্যাপারটা তা নয়, ইংরেজ সাহেব আমাকে গরু কিনে দেয়ার পর আমি গরু নিয়ে চলে আসি। শঙ্কু এসেছে পরে। তার ব্যাপারটি আমি জানি না। সবাই যেন এই কথার অপেক্ষায়ই ছিলো। ঘরের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠলো, তবে পরীক্ষা হয়ে যাক! মহিত শেখকে বসা রেখেই সবাই হৈ হৈ করে মহিতের ঘরে এসে উঠলো। মহিত এলো পিছনে পিছনে। পরেশের ছোট ভাই সমরেশ মাচার উপর থেকে টেনে নামালো শঙ্কুর সাপের বাক্সগুলো। সেবাগী ঘুমিয়ে ছিলো। এতো মানুষের কোলাহলে জেগে উঠে সে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো। জ্বর কমেনি।
পরেশের খুড়ো চেচিয়ে উঠলো, সবাই হট্টগোল থামাও!
সবাই চুপ হয়ে গেলে পরেশ সেবাগীর দিকে তাকিয়ে বললো, সেবাগী! তুই বল দিকি, শঙ্কুর লাশটা ঝোপের ভিতর কে ফেলেছিলো?
সেবাগী জ্বরের ঘোরে দাদার দিকে আঙুল তুলে দেখালো। সবাই হৈ হৈ করে উঠলো।
পরেশ তাদেরককে থামিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলো, বলতো শঙ্কুর গাঁট থেকে টাকাগুলো কে নিয়েছিলো?
সে আবারো দাদার দিকে আঙুল তুলে দেখালো।
মহিত শেখ আজ বড্ড ফাঁসা ফেঁসে গেছে। পাপ একদিন ধরে বসে পাপীকে। সেইদিন কি আজ? মহিত শেখের মাথার ভিতর একশোটা আতশবাজি ফুটতে লাগলো।
মধ্যরাত। মহিত শেখ শঙ্কুর কাছ থেকে নেয়া সবগুলো টাকা ফেরৎ দিয়েছে। তবু মামলা চুকেনি। আগুনখেয়ার শিশুরা ঘুমিয়ে পড়েছে। বড়রা হ্যাজাক জ্বালিয়ে মিটিংয়ে বসেছে। আগুনখেয়ার উত্তর দক্ষিণের খোলা মাঠটিতে। আজ সূর্যোদয়ের সময় সর্পমাতার চরণে শুকর বলি দেয়া হবে ঠিক, তার আগে আরেকটা বিষয় নিষ্পত্তি করতে হবে। মহিত শেখ আগুনখেয়ার হেড থাকবে কিনা। নিয়ম অনুযায়ী সে আগুনখেয়ার হেড থাকতে পারে না। কিন্তু সমস্যা হলো, এ পাড়া পাহাড়ের আর দশটা পাড়ার মতো নয়। এটা মহিতের দাদার পাড়া। সবাই এখানে আশ্রিত। মহিতের পূর্ব পুরুষের দয়ায় তারা এখানে এসে উঠেছে। মহিত ছাড়া এ বংশে আরেকজন লায়েক পুরুষ যদি থাকতো, কথা ছিলো না। এক আছে সেবাগী। একবার পরেশের খুড়ো সেবাগীর কথা তুলেছিলো, কিন্তু সবাই থামিয়ে দিয়েছে। অতটুকুন পুচকে ছেলে….।
পরেশ ঘুটিটা নিজের কোটে নিতে চাচ্ছে। মহিত ছাড়া কেউ যদি আগুনখেয়ার কারবারি হতে পারে, সে পরেশ। তার কিছুটা লেখাপড়া আছে। বাইরের সাথে তার যোগাযোগও ভাল। বান্দরবানের মাধ্যমিক স্কুলে কিছুদিন সে পড়েছিলো। এই কিছুদিনেই সে একটা আদিবাসী সংঘ গড়ে তুলেছিলো। তারপর বিভিন্ন অনিয়ম আর ইঁচড়েপাকামীর কারণে স্কুল তাকে টিসি দিয়ে দেয়। পরেশ ঘুটিটা নিজের কোটে নিতে চাচ্ছে কিন্তু কেউ একটিবারও তার নাম তোলেনি। এমনকি তার খুড়ো পর্যন্ত একবার পুচকে সেবাগীর কথা বললো, কিন্তু তার নামটি মুখে নিল না।
অবশেষে পরেশ নিজেই মুখ খুললো। অহেতুক সবাই হৈ হৈ করছিলো। সবাইকে থামিয়ে পরেশ বললো, এভাবে হট্টগোল চলতে থাকলে শেষরাত অবধিও কোন সমাধান হবে না। ভোর বেলা অমিমাংসিত অবস্থায় সর্পমাতার পায়ে শুকর বলি দিতে হবে। তা কি ঠিক হবে? সবাই একটু নড়ে চড়ে বসলো, আসলেই তো! এভাবে চলতে থাকলে তো সকাল হয়ে যাবে।
বড়াল বললো, তবে তুমি বাতলে দাও, কী করা?
পরেশ এতক্ষণে সুযোগ পেলো। সবাই তার দিকে মনোযোগ দিয়েছে।
সে বিজ্ঞের মতো বললো, ব্যাপারটা আসলে জটিল নয়। ধরো এই পাড়ায় মহিতদা হেড তার বাবার কারণে। তার বাবা হেড তার বাবার কারণে। এখন যেহেতু মহিতদা হেড থাকছে না, ঠ্যালা চুকে গেলো। মানে পাড়ার সবচেয়ে যোগ্য… মানে সবচেয়ে শিক্ষিত যে, তাকে হেড করলেইতো হয়ে গেলো।
এতোটুকু বলেই পরেশ সলজ্জ ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে ফেললো। প্রথমে বিষয়টা কেউ ধরতে পারেনি। পরেশের খুড়ো বুঝতে পেরেই চেচিয়ে উঠলো, হতচ্ছাড়া! মাথা তোল! পরেশ মাথা তুলতেই বাঁ হাতের তালু সমেত পাঁচ আঙুল দেখিয়ে বললো, এক থাপ্পড়ে সব ক’টা দাঁত মুখ থেকে নামিয়ে দেবো। তোর চেয়ে বাঁদর ছেলে এই পাড়ায় আরেকটা আছে? ভাঙ খেয়ে বুদ হয়ে থাকিস! দুনিয়া কোথায় গেলো তোর কি খবর থাকে?
রমেশ লাফিয়ে উঠলো, মহিতদা তো জীবনে একদিন চুরি করেছে, আর তুই চুরি করিসনি কোন্ দিন? শঙ্কুর লাশ দেখেছিস ভাল কথা, তার গাঁটে তুই হাত দিয়েছিলি কী মতলবে?
পরেশের লজ্জা পাওয়া উচিৎ। কিন্তু সে লজ্জা পেল না। রাগে তার গা জ¦লছে। এ রাগ যতটা না রমেশের উপর তারচে বেশি বুড়ো খুড়োটার উপর। বুড়োটা তার পক্ষে দু’টো কথা বললেই পারতো! তা না বলে উল্টো তার মুখ থেকে দাঁত নামিয়ে দেবে। পরেশ সবার সামনে ঝেড়ে গালাগাল করতে শুরু করলো বুড়ো খুড়োটাকে। তার স্বপ্ন ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে এই বুড়ো।
পাহাড়ের মানুষ সব সহ্য করে নেয়- বৃষ্টি-বাদলা, ঝড়-দুর্ভিক্ষ- সব। কিন্তু মুরুব্বিদের অপমান সহ্য করতে পারে না। রমেশের হাতের কাছে শুকর তাড়ানো লাঠি ছিলো, কাঠের শক্ত লাঠি। তাই দিয়ে সে পরেশের মাথায় ঠপাঠপ দুটো বাড়ি মারলো। পরেশ লুটিয়ে পড়লে তার কোমর জড়িয়ে লাথি মারলো রামাই। মুরুব্বিরা না থামালে পরেশের হেড হওয়ার খায়েশ আজ চিরতরে মিটে যেতো।
পাহাড়ের মানুষ পাহাড়ের মতো নিস্তব্ধ। ক্ষেপলে ঝড়ের মতো গতিশীল, আগুনের মতো বিনাশী। সবকিছু ভস্মিভূত করে দেয়। রামাই কিংবা রমেশ নয়, ভস্মিভূত করলো পরেশ। কপাল ফেটে দরদর করে রক্ত নামছিলো। রক্ত মোছার আগেই সে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললো। ঘরে এসে অন্ধকারে হাতড়ে পাতড়ে কেরোসিনের টবটা বের করলো। কেজি দুই কেরোসিন আছে। খুড়োর ঘরের চাল শুকিয়ে গেছে।
দুই কেজি কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতেই শুকনো খড় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। আগুনখেয়ার উত্তর-পূবের খোলা মাঠটিতে হট্টগোলরত মানুষগুলো যতক্ষণে আগুন দেখতে পেলো ততক্ষণে সবশেষ। খুড়োর ঘর দাউ দাউ করে জ্বলছে। রাত্রীর নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আগুনখেয়ায় মুলি বাঁশ পোড়ার পট পট শব্দ হতে লাগলো। ঘুমন্ত শিশুরা জেগে উঠেছে। ওদের চিৎকার করে কাঁদবার কথা কিন্তু ওরা কাঁদছে না। বিস্ময়ে থমকে আছে।
মধ্যরাতে ঘরপোড়া দাউদাউ আগুন ওরা কখনো দেখেনি। মহিলাদের অবিরাম চিৎকারে দূর পাহাড়ের বাসিন্দারা জেগে উঠেছে। সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় আকাশমুখি লেলিহান আগুনের শিখা। যেন প্রাচীন কোন আগ্নেয়গিরির মুখ হঠাৎ খুলে গেছে। দৃশ্যটি অভূতপূর্ব কিন্তু উপভোগ্য নয়। আগুনখেয়ার আশপাশের পাহাড়ের মানুষগুলো সর্বনাশা এ দৃশ্য অসহায়ের মতো কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। কারো কিছু করার নেই।
পাহাড়ে পানির আকাল। গাইয়ের মুতের মতো ক্ষীণধারায় যে পানি পাহাড়ের গা বেয়ে নামে, তাতে আগুন নেভে না। অতটুকু পানির দখল নিয়ে বরং পাহাড়ে পাহাড়ে সংঘাতের আগুন জ্বলে। যতক্ষণ ঘরে আগুন জ্বলেছে, পরেশের খুড়ো জলশূন্য চোখে পুড়তে থাকা ঘরের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। সে নির্বিরোধী মানুষ। জীবনের উপর দিয়ে অগুনতি শোক গেছে, দুঃখ গেছে, চোখের সামনে বহু প্রিয়জনকে মরতে দেখেছে, কিন্তু এতো কষ্ট কখনো পায়নি। এই একটা ঘর তুলতে তাকে বাঁশের জন্য কত পাহাড়ে ঘুরতে হয়েছে, নাড়ার জন্য কত ভূস্মামীর কাছে হাত পাততে হয়েছে। এই একটা ঘর তার কাছে কি দেবতার চেয়ে কম? এই ঘরটাই তো তাকে ঝড়-ঝঞ্ঝা, সাপখোপ আর হিংস্র শ্বাপদের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
কারবারি বিষয়ক সমস্যার কোন মিমাংসা হলো না। পরেশের খুড়োর চোখের সামনে ঘরটি পুড়তে পুড়তে এক সময় আগুন নিভে গেলো। ঘর নয় , ঘরপোড়া একদলা ছাই সামনে নিয়ে বুড়ো উদাস চোখে বসে রইলো। আগুনখেয়ায় কেউ ঘুমায়নি, শোকার্ত খুড়োকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আগুন লাগার সাথে সাথে গনেশরা বেরিয়েছিলো পরেশকে খুঁজতে। তার টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু পরেশের কপাল থেকে নামা রক্তের ধারাটি পাহাড়ের পশ্চিমে গিয়ে থেমে গেছে। এখানেই এসেই পরেশ যেন হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। পরেশকে খোঁজা বাদ দিতে হলো। অবশ্য কেউ মন থেকে পরেশকে খুঁজে পেতে চায়নি। খুঁজে পেলেই পাহাড়ের আদিম ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। পাহাড়ে পাপ হয় অনেক। সব পাপের শাস্তি হয় না, কিন্তু যে পাপের শাস্তি হয়, তা বড্ড ভয়াবহ হয়। পরেশকে পাওয়া গেলে সেরকম কিছু একটা ঘটবে। পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়াও হতে পারে। সবকিছু ঠান্ডা হলে সে ফিরে আসুক।
খুড়োর ঘরের আগুন যেন পুব আকাশে লেগেছে। ওইদিকে আলোর ক্ষীণ আভা ধীরে ধীরে স্ফিত হয়ে উঠছে। গনেশ খুড়োর পিঠে হাত দিয়ে বললো, সর্পমাতার অভিশাপ ফলতে শুরু করেছে। আগুনখেয়া চোখের পলকে উজাড় হয়ে যাবে।
পুব আকাশে রূপালী আলোর রং ছড়িয়ে সূর্যটা যখন উঁকি দিলো, আগুনখেয়ার সবগুলো ঢোল একসাথে বেজে উঠলো, একটি ঢেমসি শুকর এক কোপে কেটে ফেলা হলো, কাটা গলা থেকে ফিনকি দিয়ে গাঢ় লাল রক্ত নেমে একটা কাসার বাটিতে জমা হলো, সেই রক্ত যখন সর্পমূর্তির গায়ে ঢেলে দেয়া হলো, আগুনখেয়া একটি উন্মাদ নগরীতে পরিণত হলো। ঢোলের ঢাক ঢাক, কাসার ঠক ঠক আর নুপুরের ঝন ঝন শব্দে আগুনখেয়ার পাহাড়চূড়ায় যেন একটি প্রলয় হয়ে গেলো। যখন সে প্রলয় থামলো, মহিত শেখ তখন নেই। কোথাও নেই। সন্ধ্যা নাগাদ তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। শেবাগী কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেললো। যখন কাউকে বলতে শুনলো— “ ওভাবে বুড়ো মানুষটাকে না ক্ষেপালেই পারতে! কে জানে পাহাড়ের কানায় গিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়েছে কিনা? তখন শেবাগীর কান্না থামার শেষ আশাটুকুও শেষ হয়ে গেলো।
উপায় না দেখে পরেশের খুড়ো সেবাগীর সাথে রাতে শুতে এলো। তার আর কোন উপায়ও ছিলো না। দুঃস্বপ্ন হয়ে একটি ভয়াল রাত তার জীবনে এসেছে এবং তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে সে রাতটি কেটেও গেছে।
The post আগুনখেয়া (পর্ব ২) appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%97%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a6%96%e0%a7%87%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a7%a8/
No comments:
Post a Comment