অতনু দাশ গুপ্ত:
আসেন, আসেন… হাউসবিল্ডিং, হাউসবিল্ডিং, ওই আসেন,
আসেন… অহন ই যামুগা, অহন ই যামুগা,
ভাই আসেন, এই গেল হাউসবিল্ডিং, এই গেল
হাউসবিল্ডিং, এই আপু, যাইবেন ??
…আসেন !!
সুনামগঞ্জের এক ছোট্ট গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে দেশের কেন্দ্রস্থলে ছুটে আসা কাসেম আলীর ছেলে সুলতান। কাসেম আলি পরিবহন শ্রমিক ছিল। এক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারানোর পর দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া সুলতানের লেখাপড়ার স্বপ্নও হারিয়ে যায়। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় সরাসরি বাসে হেলপার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সম্ভব না দেখে আপাতত লেগুনার সহকারী হিসেবে কাজ দিল মোহর সাহেব, কাসেমের মালিক। জন্মের সময়েই মাকে হারানো সুলতান এখন এতিম। তাই মালিকের গ্যারেজে অন্যান্য সবার সাথে তারও ঠিকানা ওটাই।
প্রতিদিন সকালটা একইভাবে আরম্ভ হয় সুলতানের। চোখ কচলাতে কচলাতে শার্টটা গায়ে দিয়ে লেগুনার পেছনের পাদানিতে উঠে পড়ে ডাকতে থাকে যাত্রীদের। বসার সীটের নিচে বালটিতে রাখা পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক গিলে নেয়। পেটের বাঁপাশে অল্প অল্প ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়ার কোন বালাই নেই। প্রথম প্রথম খিদে পেলে আধ একটু চ্যাঁচামেচি করতো, পরে একদিন ওস্তাদের এক সজোর চপেটাঘাত বেমালুম সব ভুলিয়ে দেয়। এরপর থেকে আর কোন শব্দ করে না খিদে পেলেও। এখানে সোহেল, রাসেল, মাহবুব, মাইল্লা, রসুল, আরও অনেকে সবাই ওর মত লেগুনার হেলপার। রাসেল বয়সে কিছুটা বড়। ওর দাপটও কিছুটা বেশি।
সুলতান যাত্রীদের ডেকে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে লেগুনাতে যাত্রীরা উঠছে। দিয়াবাড়ি লেগুনা স্ট্যান্ড থেকে খালপাড় আসতে আসতে কিছু যাত্রী থাকলেও প্রায় সময়ই এখান থেকেই গাড়িতে আর বসার জায়গা থাকে না। পেছনে দুপাশে পাঁচজন করে দশজন বসার জায়গা থাকলেও চাপাচাপি করে বারজন উঠানো হয়। সামনে ড্রাইভারের পাশে একজনের জায়গায় দুইজন আঁটসাঁটভাবে বসান হয়। সকালবেলা খালপাড়ে যাত্রীদের ভিড় থাকে আর বিকেলে একই দৃশ্য দেখা যায় হাউসবিল্ডিংয়ে। এই দুই সময়েই তীব্র চাপ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। গাড়িগুলোও এলোমেলোভাবে চলতে থাকে। সুলতান চেয়ে টাকা নিচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। আকারে ছোট হওয়ায় অতিসহজেই বাইরের পাদানি থেকে লেগুনার ভেতরে ঢুকে যাত্রীদের মাঝের জায়গা দিয়ে দিব্যি হেঁটে ভাড়া উসুল করে নেয় সে। কিছু যাত্রী আছে যারা সবসময়ই দুএক টাকার জন্য তর্কাতর্কি করে।
ভাংতি টাকা যাত্রীদের না দেওয়ার চক্করে মাইল্লা, রাসেল, সোহেলরা বেশ টাকা জমিয়ে নিয়েছে। পাঁচ টাকা না দিয়ে দুটো দুই টাকার নোট দিয়ে পকেটভর্তি ভাংতি টাকা থাকলেও সবসময়ই বলে, “ভাংতি নাই”। আর যে যাত্রীকে প্রথম থেকেই সুবিধাজনক মনে হয় না, তার সাথে কোন চালাকি না। আপু, আন্টিদের কাছ থেকে মাঝে-সাজে দু চার টাকা মেরেও দেয়। আবার কিছু ভদ্রলোক বেশধারী লোক লেগুনাতে উঠে চুপটি মেরে বসে থেকে বেমালুম ভাড়া না দিয়ে নেমে যায়! এক লোককে সুলতান তাড়াও করেছিল, ড্রাইভার ওকে ফেলে রেখেই চলে গেল। না পেল ভাড়া, না পেল ওই ধোঁকাবাজের নাগাল। পরের লেগুনায় সোহেলের সাথে ঝুলতে ঝুলতে ফিরলো সে। ড্রাইভারকেও বললো না। উলটো যদি বলে বসে, ‘উঠার সাথে সাথে ভাড়া নেস নাই ক্যান?’ সোহেল বলছিলো, একদিন এরকম এক ভদ্রলোক থাপ্পড় মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে গেলে কোথায় ভাড়া ? কোথায় কি ? তাই যাত্রীরা এভাবে সটকে পড়লেও সুলতানের আর দুঃসাহস হয় না পিছু ছোটার।
সকালে খালপাড় থেকে যাত্রীর ভিড় লেগেই থাকে। গাড়ি হাউসবিল্ডিংয়ে পৌঁছার পর সকাল বেলা যাত্রীর ভিড় না থাকায় চৌদ্দজন না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি ছাড়ে না ড্রাইভাররা। এভাবে খালপাড় থেকে গাড়ি তো ভর্তি হয়েই এদিকে আসে আর সব গাড়ি এদিকে চলে আসে, খালপাড় গাড়ি শূন্য হয়ে দেখা দেয় যানবাহন সংকট। প্রতিদিন দেখে সুলতানের এসব চোখ সওয়া হয়ে গেছে। ও ভাবে, ‘কি রে? ওস্তাদ এরকম করে ক্যান? হগলের আগে পৌঁছাইলে তো আগেই এহানে আসতে পারবো। আরেক টিপ মারতে পারবো, দাঁড়াইয়া থাহে ক্যান।’ সকালে ১০-১১ টার দিকে যাত্রীর চাপ কমে যায়। তখন লেগুনা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে পাঁচ -দশ টাকার মুড়ি/ চানাচুর খেয়ে নেয় সুলতানরা। এটাই সকালের নাস্তা। মাঝে মাঝে এর ব্যত্যয় ঘটে।
দুপুর ১২- ১ টার দিকে দিয়াবাড়ি থেকে যাত্রীর চাপ বাড়ে। ওইদিকে একটা কলেজ আছে। ছুটি হওয়ার পর ছাত্রছাত্রীরা সব দল বেঁধে বের হয়। অবশ্য এ গ্রুপের কাছ থেকে সুলতান কখনও ঠকেনি। এরা ভাইয়া বা আপু— যে ই হোক না কেন, ভাড়া যা চাওয়া হয়, তা-ই দেয়। এ সময় থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত বেশ ভাল রোজগার হয়। গলা শুকিয়ে আসছে ওর। দিয়াবাড়ি গোলচক্করের লেগুনা স্ট্যান্ডের পাশেই এক হোটেলে খেতে বসে ওর ওস্তাদ ড্রাইভার শওকত। প্রায় সময়ই ভাত—ডিম বা ভাত-আলুভর্তা, ডাল, সবজি এসব দিয়েই হয় ভুরিভোজ। শওকত মাছ/ মাংস সবসময় না খেলেও প্রায়ই খায়। সুলতানের ভাগ্য ভাল থাকলে মাঝে মধ্যে ওর ভাগ্যেও জুটে যায় এক টুকরা মাছ। আজকেও ডিমের ঝোল আর ভাত। গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছিল ও। পানি খেতে ভুলে যাওয়ায় হঠাৎ হেচকি উঠলো। পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে হিক্কা সামলে নিল। খাওয়া শেষ হলে খুব ইচ্ছে হয় ড্রাইভারের সিটের পেছনে একটা নরম গদি আছে, ওটাতে যদি একটু মাথা রেখে কিছুক্ষণ ভাত ঘুম দেওয়া যেত! যা হোক, সে অবসর কখনই পাওয়া যায় না। কী রোদ, কী বৃষ্টি, কী শীত, সবদিনই ওর কাছে একই রঙের। বিকেল ৩-৪ টার এ সময়ে যাত্রীর তেমন একটা চাপ না থাকলেও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আর বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত যাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকে। পেছনের দাঁড়ানোর ছোট্ট পাদানিতেও দুই তিনজন উঠে পড়ে, সুলতান ওখান থেকে সরে গাড়ির ভেতরেই দাঁড়িয়ে থাকে। ওর অবশ্য সুবিধাই হয়, গাড়ি ছাড়ার পর চৌরাস্তা পর্যন্ত আসতেই ওইটুকু পথের ভাড়া খুব তাড়াতাড়িই উসুল হয়ে যায়। এ সময়ে অনেক ঝুলন্ত যাত্রীই ভাড়া না দিয়ে ভেগে পড়ে। ছোট্ট সুলতানের গলার আওয়াজ অতদুর পৌছায় না! “ভাড়া দিয়া যান … ভাড়া দিয়া যান” কয়েকবার বলার পর ও আপনাআপনিই থেমে যায়। দৈহিক গড়ন ছোট হওয়ায় কোন যাত্রীই খুব একটা পাত্তা দেয় না ওকে। ভেতরে বসা যাত্রীরা অবশ্য মাঝে মাঝে টাকার হিসাব জিজ্ঞেস করে, টাকা সঠিকভাবে গুনে হিসাব করতে পারে কিনা সেটা দেখে। কেউ বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করে। এটা সেটা করতে করতে দশটা বেজে যায়। এরপর ১১ টা। রাতের খাবার খেয়ে আজকের মত ছুটি। দুপুরে ডিম খেলে রাতে ভর্তা আর ডাল। কোনদিন রাতে চলে যায় কারেন্ট। কয়েল জ্বালিয়ে না নিলে মশার কামড়ে টেকা দায়। তবে কয়েকবার মশার কামড় খাওয়ার পর একবার ঘুমিয়ে পড়লেই হল। এসবের মাঝে ক্লাস থ্রি তে উঠবে এমন স্বপ্ন দেখার কি কোন সময় পাবে ও কখনো ?? হয়তো ওই স্বপ্ন দেখাও বারণ!
২
একদিন লেগুনায় এক তরুণীর চোখ পড়ে সুলতানের উপর। ওর চেহারাটা খুব পরিচিত ঠেকে ওর কাছে।
জিজ্ঞেস করে বসে, ‘এই পিচ্ছি! কি যেন নাম তোমার?’
ও গোমড়া মুখে বলে, ‘সুলতান’
‘চিনতে পেরেছ? আমি তোমাদের অংক করাতাম। তন্দ্রা ম্যাডাম!’
মুখে কোন কথা নেই, শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে সে। ম্যাম জিজ্ঞেস করলেন, কেন সে আর স্কুলে আসে না? উনার চেহারা বেমালুম ভুলে গেলেও কারণ বললো। তরুণী সুলতানের লেখাপড়ার খবর জানতে চাইল। সুলতান কোন জবাব দেয় না। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে তন্দ্রা নেমে গেল।
আজকের মত ডিউটি শেষ করে বের হয় তন্দ্রা। ভাবছে, ছোট্ট সুলতানের কথা। আজ কি ওর দেখা পাবে? তাহলে কী করবে? আচ্ছা! ওকে বলার দরকার কি? সরাসরি ওর মালিকের সাথে কথা বললেই তো হয়। কিন্তু বলবে কি ? ওকে স্কুলে পড়তে দিন। না, ও লেখাপড়া আরও করুক এটা চাই। না ! আপনি কি চান না ওর একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ হোক? না! না! বেশি ন্যাকামি হয়ে যাচ্ছে !! আমি চাই ও আরও পড়ালেখা করুক। একজনের কথা বলবো কি করে? হ্যাঁ ! সবার কথাই বলবো। তাহলে প্রস্তাবটা আরও যুক্তিসঙ্গত হবে। আর খরচের অজুহাতে পড়ানো সম্ভব নয় এটা বলে পার পাওয়ার কোন উপায় নেই। খরচের সকল প্রকার ব্যবস্থা আমি কুসুমকলি স্কুল থেকে পেতে পারি।। ওখানকার শিক্ষিকা হওয়ার সুবাধে এটা সহজেই সম্ভব। এখন শুধু প্রধান শিক্ষিকা ফৌজিয়া ম্যামকে রাজি করাতে পারলেই হল। তবে হয়ত আরও অনেক নিয়মকানুন আছে যা নিয়ে তার সাথে বিস্তারিত আলাপেরও দরকার আছে। কালই উনার সাথে কথা বলবে এমনটাই মনস্থির করলো।
পরের সপ্তাহে রবিবারের দুপুর। আকাশে মেঘের আনাগোনা। সকাল থেকেই আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। নিশ্চয়ই কোথাও ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যায় হয়তো এক পশলা ঝড়বে, তারই পূর্ব প্রুস্তুতি এটা। তন্দ্রা লেগুনা স্ট্যান্ডে সুলতানদের দেখতে পেল।
মুড়িভাজা খাচ্ছে সবাই ভাগাভাগি করে। তন্দ্রা সুলতানকে ডেকে দেয়। জানতে চায় ওর মালিক কোথায়? সোজা ড্রাইভারের কাছে নিয়ে যায় ও। তন্দ্রা মালিকের সাথে দেখা করতে চাইলে ড্রাইভার জানায়, যা ব্যাপার সব তাকেই খুলে বলতে। সে-ই সুলতানের সবকিছু দেখাশোনা করে। মালিক শুধু টাকা জমা নেয়। তন্দ্রা জানাল, সুলতানসহ বাকিরা যদি একবেলা করে পড়ালেখা করার সুযোগ পেত তাহলে ওদের জন্য ভাল হত। ড্রাইভার বললো, ‘এটা কখনই সম্ভব না। ওরা পড়তে গেলে লেগুনার হেলপারগিরি কারা করবে? তখন স্কুলে পড়াতে যাবেন কেমনে আপা?’
তন্দ্রা বলে, সবাই একসাথে না গেলেও হয়, কেউ সকালে যাবে, কেউ বিকেলে। ড্রাইভার ওকে আরও হেলপার জোগাড় করে দিতে বললো। ও শেষবারের মত মালিকের সাথে দেখা করিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে ফিরে এল।
সকাল হতেই সাদা রঙের লেগুনাতে উঠে পড়লো সুলতান। আকাশী রঙের জামাটা বগলের নিচে ফাটা আর প্যান্টটা সাইজে অনেকটাই বড়। নাক দিয়ে পানি পড়ছে। সকালের গোসলের পানি একটু বেশিই ঠাণ্ডা ছিল মনে হয়। ওর ওস্তাদ প্রতিদিনের মত আজও সিগারেট ফুঁকছে। ওদিকে রাসেলরা সব একদিকে জটলা করেছে। গতকালের মুরিভাজাটা বেশ মজাই ছিল। রাসেল তো এক মুঠো মুড়ি আর এক হাতে সিগারেট ফুঁকে দেখাচ্ছিল ওর ওস্তাদ কিভাবে চা-সিগারেট খায়। সুলতানের লেগুনা দিয়াবাড়ি থেকে খালপাড় এসে পৌঁছল। ওখান থেকে তিনজন যাত্রী উঠেছে মাত্র। তবে এখনই গাড়িতে হুড়মুড় করে যাত্রীরা উঠবে। খালপাড়ের ব্রিজে আসার আগেই যাত্রীরা উঠতে থাকে। খালপাড় লেগুনা স্ট্যান্ডে পৌঁছে আর জায়গা খালি থাকে না গাড়িতে। এরপর ময়লার মোড়, বাজার পার হয়ে চৌরাস্তা; সব জায়গায় যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু সীট খালি নেই। ঘড়িতে সময় ৮ টা। সুলতানের পেটের বা পাশের নিচের দিকটায় ব্যথা করছে। একটা বনরুটি আর কলা জুটলো। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। আজকে ওস্তাদ চা-ও খাওয়াচ্ছে। চা খেতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। কার আগে কে খাবে? কিছুক্ষণ চ্যাঁচ্যাঁমিচির পর সবাই বেশ মজা করেই খেল। চা, বনরুটি খেয়ে বেশ চাঙ্গা লাগছে ওর। প্রতিদিনের মত আজও যাত্রীদের সাথে কখনো কথা কাটাকাটি, কখনো হাসি ঠাট্টা, কখনো ভাংতি নিয়ে দর কষাকষিতে সকাল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল।
হাউসবিল্ডিংয়ে মাস্কট প্লাজার সামনের রাস্তা থেকে বাঁ পাশে লেগুনাগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো আছে। একটার পর একটা লেগুনা ছেড়ে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পরেই রাস্তার লাইটগুলো জ্বলে উঠবে। কিছুক্ষণ হল তন্দ্রা ওখানটায় এসেছে। সুলতানকে খুঁজে ফিরছে ওর সন্ধানী দুই চোখ। আজকে কাজে অনেক জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল নিয়ে কয়েক ঢোক খেয়ে নিল। সুলতানের লেগুনা এসে পৌঁছল। তন্দ্রা উঠে বসলো।
‘এই পিচ্চি, কি যেন নামটা তোমার? কিছু খেয়েছ? চলো, খালপাড় গিয়ে মুড়ি ভাজা খাই !!’
‘আইচ্ছা আপু, আপনে ওস্তাদরে বইলেন!’
বিকাল ৫.৩০। খালপাড় জামে মসজিদ। কিছুটা দূরে রাস্তার পাশের একটা দোকানে বসেছে তন্দ্রা আর সুলতান। চায়ের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। ওরা মুড়ি ভাজা খাচ্ছে।
তন্দ্রা বললো, আচ্ছা, সুলতান, তুমি জানো ‘সুলতান’ মানে কি?
সুলতান বললো, না!
সুলতান মানে রাজা ! তোমার সুলতান হতে ইচ্ছে করে না?
আগে করত না, তয়, অখন করবো !
বেশ, এর জন্য তোমাকে অনেক পড়ালেখা করতে হবে। স্কুলে যেতে হবে। তুমি যাবে??
হ, যামু ! আপনে ওস্তাদরে রাজি করান। আপনের কতা হুনবো ?
দুজনের চা তৈরি। চায়ে হালকা একটা চুমুক দিয়ে সুলতান দেখে নিল কতটা গরম।
তন্দ্রা বললো, জানি না রে, তবে খুব চেষ্টা করবো। তোমার জন্য নতুন জামা কাপড়, বই খাতা, কলম সব কিনতে হবে। এরপর তোমার বন্ধুদের জন্যও কিনতে হবে।
আইচ্ছা আপা ! সবাই স্কুলে গেলে লেগুনা চলবো কি কইরা ?
সবাই যাবে না। রুটিন করবো। যাতে সবাই যেতে পারে। কার আগে কে যাবে এটা ওখানে লেখা থাকবে।
চায়ের কাপ এক হাতে রেখে আরেক হাতে থাকা বিস্কুটে কামড় বসালো । নোনতা বিস্কুট। মিষ্টি চায়ের সাথে খেতে বেশ লাগে।
লুটিন ? এইডা কি আপা ??
রোজনামচা । আগে তৈরি করে নিই। তারপর তোমাকে দেখাবো। জানো সুলতান, আমার ঠিক তোমার মত দেখতে একটা ছোট্ট ভাই ছিল, ‘তপু’
হে অখন কই, আপা?
হারিয়ে গেছে!!
চা মুড়ি শেষ করে তন্দ্রা ফিরে যাওয়ার পথে আবার ড্রাইভারের সাথে দেখা করলো। উপস্থিত হলেন মোহর আলি। তাকেও অনুনয় বিনয় করে বোঝনোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। বুঝলো শুধুই সময় নষ্ট করছে সে। এরা কোন কথাই শুনবে না। অন্য কোন উপায়ে চেষ্টা করতে হবে। এরপর মিসেস এনাকে নিয়েই হাজির হবে সে। ছোট্ট সুলতানের ক্লান্ত দু-চোখে তন্দ্রা তার ছোট তপুকে খুঁজে ফেরে প্রতিদিন।
আবার সুলতানের লেগুনা ছেড়ে দিল। হাউসবিল্ডিং থেকে আবার রওয়ানা হয়ে গাড়ি যতই খালপাড়ের দিকে এগুচ্ছে, সেখানকার সুউচ্চ অট্টালিকাগুলোও আকারে ছোট হয়ে আসছে। সেই সাথে কি স্তিমিত হয়ে আসছে সুলতানকে নিয়ে দেখা তন্দ্রার স্বপ্ন? কাল থেকে আবার সুলতানের লেগুনা ছেড়ে যাবে। সময়ের কাটাও এগিয়ে চলবে নিজের গতিতে। আর হয়তো একদিন সুলতানের রোজনামচায় আমূল পরিবর্তন আসবে!
উৎসর্গ: প্রয়াত স্কুলশিক্ষিকা রত্নাকে
The post সুলতানের রোজনামচা appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%9a%e0%a6%be/
No comments:
Post a Comment