সাইফুল্লাহ সুবহান:
১.
আগুনখেয়ার ছয়টি পর্বই পড়লাম। আরো লেখা হবে, আরো পড়তে পারব সে আকাঙ্ক্ষার উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম।
এখন পর্যন্ত ‘আগুনখেয়া’র যেটুকু লেখা হয়েছে তাতে একে ‘থ্রিলারধর্মী সামাজিক উপন্যাস’ বলা যায়। যদিও প্রথম পর্ব পড়ে একে নিরেট সামাজিক উপন্যাস বলেই মনে হয়েছিল।
উপন্যাসের কাহিনীটা ভীষণ চমৎকার। পাহাড়ি জীবনধারাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা। যেখানে জীবন নিত্যই এডভেঞ্চার, প্রত্যহই অভিযাত্রা।
আশপাশের পাহাড়গুলোর মধ্যে যে পাহাড়টি সবচেয়ে উঁচু, তার নাম ‘আগুনখেয়া’। এ পাহাড়ের যিনি প্রধান নেতা, স্থানীয় শব্দে যাকে বলে কারবারি, তার নাম মহিত শেখ। মহিত শেখের দাদাই একদিন আবাদ করেছিলেন এ পাহাড়। এ বৃদ্ধ মহিত শেখই পাহাড়ি জীবনের প্রতিভূ। তার জীবনসূত্র ধরেই উপন্যাসের প্রথম ভিতটি রচিত। এরপর তার জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠে আসতে শুরু করে আগুনখেয়ার অন্যান্য বাসিন্দাদের এমনকি সকল পাহাড়িদের জীবন; এক উন্মুক্ত চলমান চিত্রের মতো।
নিদারুণ দারিদ্র পাহাড়ি জীবনচিত্রের প্রধান রং। নিত্য অভাব ও শ্বাপদের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকাই সেখানে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। একদল নষ্ট মগজের নষ্ট লোক মুখোশের আড়ালে এ অভাবের সুযোগকে পুঁজি করে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিনষ্টের এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ ষড়যন্ত্র এখন পাহাড়ি জীবনের নিত্য অনুষঙ্গ। গরীব অসহায় পাহাড়িরা এ নীল-নকশায় ব্যবহৃত নির্বাক কাঁচামাল। লেখক সম্ভবত তাদের এ ‘নির্বাক কাঁচামাল’ হওয়ার অমানবিক দিকটি নিরাভরণ করতেই মানবিক কলম হাতে এক বিশাল উপন্যাস রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। ‘সম্ভবত’ বললাম কারণ, এখন পর্যন্ত উপন্যাস শেষ হয়নি। অসমাপ্ত রচনায় চোখ রেখে লেখকের নিশ্চিত মনোভাব ব্যক্ত করার প্রচেষ্টা বাতুলতা বৈ কিছু নয়। তবে পর্ব ছয়ে গিয়ে নষ্ট মগজের লোকদের প্রতিভূ ডেভিডের আকাঙ্ক্ষার কথা যেখানে ব্যক্ত হয়েছে সেখানে লেখকের মনোবৃত্তিটিও যেন প্রায় নিরাভরণ হয়ে ফুটে ওঠেছে। এটা ভালো দিক। লেখকের সোজা সাপটা মনোভাব পাঠককে বিভ্রান্তি থেকে বাঁচায়।
২.
কাহিনী নির্মাণ, চরিত্র চিত্রন, সংলাপ সংযোজন ইত্যাদিতে লেখকের মুন্সিয়ানার পরিচয় সুস্পষ্ট। শব্দ চয়ন, বাক্যের গঠন ও বুনন বেশ চমৎকার এবং সাবলীল। লেখায় একটা স্রোত আছে, একটা গতি আছে। আর কাহিনীতে আছে আকর্ষণ করার বেশ কিছু চিত্তাকর্ষক উপাদান। একটা উপন্যাস পাঠকপ্রিয়তা লাভের ক্ষেত্রে এসবের মূল্য নেহাত সামান্য নয়!
তাছাড়া দক্ষিণের পাহাড়ি জেলাগুলো তো বাংলাদেশেরই অংশ। অথচ সেখানের জীবন ও জীবনধারা নিয়ে লেখাজোখার পরিমাণ নিতান্তই কম। যাওবা কিছু আছে, তার অধিকাংশই বাস্তব বিরোধী সত্যের বিপরীত। আবার কোনো কোনোটি ‘পুঁজির’ প্রলোভনে লেখা নির্জলা মিথ্যার বেসাতি। সেদিক থেকে ‘আগুনখেয়া’ বিরল না হলেও একটি ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা বটে। বাস্তবতাকে চিত্রায়িত করার এক বিস্তৃত ক্যানভাস।
একজন ইবরাহীম জামিলের উৎকর্ষ চেতনার সুস্পষ্ট আভাস।
৩.
লেখার একটা ছন্দ থাকে। ভাষার ছন্দ এবং ভাষায় বর্ণিত গল্পের ছন্দ। যে গল্পটা বলা হচ্ছে তার সংঘটনে বাস্তবতায় যে ছন্দ (বাস্তবধর্মীতা), তার পতনে অনেক সময় উপন্যাসের কমনীয়তা কমে আসে। এই ছয় পর্বের কোথাও কোথাও কাহিনী বেশ দ্রুত লয়ে এগিয়ে গেছে। নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না, তবে কাহিনী আরেকটু প্রলম্বিত হতে পারত বলে মনে করি। তাছাড়া পাহাড়ে যাদের জীবন , তাদের কাছে পাহাড় হয়ত রূপ-শ্রীহীন। কিন্তু পাঠকের কাছে তো পাহাড় কম বিস্ময়ের নয়। এ বিস্ময় নিবৃত্তির একটা চেষ্টা হতে পারত কাহিনী বর্ণনার পরতে পরতে পাহাড়ি প্রকৃতির আরেকটু বিস্তৃত বর্ণনার মাধ্যমে।
মহিত শেখের জীবনসূত্র ধরে উপন্যাসের সূচনা হলেও সে যে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নয়, তার মৃত পুত্র কংকার ছেলে সেবাগির আলোচনার সূত্রপাতে প্রথম সে ইঙ্গিত কিছুটা ধরা পড়েছে। ছয় পর্বের শেষে এসে যখন একে একে পূর্বের পরিচিত চরিত্রগুলো প্রায় সবই বিদায় নিয়েছে, তখন যেন বিষয়টা একেবারে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। প্রথম থেকে পঞ্চম পর্ব পর্যন্ত মনে হয়েছিল মহিত শেখের জীবনই বুঝি উপন্যাসের কাহিনীর বাহক হবে। এখন মনে হচ্ছে ভিন্ন কিছু। সেবাগিকেই মনে হচ্ছে মূল প্রোটাগনিস্ট। উপন্যাস দীর্ঘায়িত হবে মনে হচ্ছে।
সংলাপের ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও অপ্রজনীয় প্রগলভতা লক্ষণীয়। বিশেষত সেবাগি ও হেলেনের সংলাপ। যেন চরিত্ররা কথাবার্তায় তাদের বয়সের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রম্য রচনায় বিষয়টা মানানসই হলেও সামাজিক উপন্যাসে মনে হয় খুবই বেমানান। সংলাপে শিথীলতা বা প্রগলভতা অনেক সময় উপন্যাসের গাম্ভীর্য নষ্ট করে। পাঠকের বিরক্তিরও কারণ হয়।
যা কিছু লেখা হলো সবই আমার একান্ত ব্যক্তিগত মত। লেখক এটা মানবেন বা এর প্রভাব গ্রহণ করবেন এমন কোন কথা নেই। কেননা, সৃজনশীল ব্যক্তি মাত্রেরই নিজস্ব চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আছে সে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাক্ত করার নিজস্ব সাধনা ও কৌশল। এসবের বেলায় সৃজনশীল মানুষেরা অন্যের মতের দ্বারা প্রভাবিত হননা। এবং প্রভাবিত হননা বলেই তারা সৃজনশীল।
বিদ্র: ফাতেহের সাহিত্য সাময়িকী শাহনামায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ইবরাহীম জামিলের উপন্যাস ‘আগুনখেয়া’।
The post ‘আগুনখেয়া’: পাহাড়ি জীবনের বর্ণিল ক্যানভাস appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%97%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a6%96%e0%a7%87%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%a1%e0%a6%bc%e0%a6%bf-%e0%a6%9c%e0%a7%80%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a7%87/
No comments:
Post a Comment