মুজিব হাসান:
ফজরের পর হাঁটতে বেরুলাম। অনেকদিন হলো সকাল দেখা হয় না। ঘুমের ঘোরে গড়িয়ে যায় কর্মব্যস্ত দিনের সকাল। গভীর রাত করে ঘুমাতে যাওয়ার কুফল এটা। ঘুমের কাছে সকালকে সমর্পণের পর থেকে ভুলে গেছি প্রাণোচ্ছল হাঁটাহাঁটির কথা। আজ অনেকদিন পর সেই সুযোগটা মিলল। শীতের আমেজমাখা সকালের স্নিগ্ধতায় নিজেকে বিকশিত করতে পেরে বেশ প্রাণবন্ত লাগল।
নরসুন্দাপাড়ের ওয়াকওয়ে ধরে জামিয়ায় ফিরছি। ভেতরে প্রচণ্ড তাড়া কাজ করছে। শাহনামার লেখাটি এখনো তৈরি হয়নি। রাকিব ভাইকে কথা দিয়েছিলাম, রাতের মধ্যে লেখা তৈরি করে সকালবেলায় পাকাপাকিভাবে দেখে পাঠিয়ে দেবো। শিরোনামও পাঠিয়ে দিয়েছি। শাহরিয়ার ভাই প্রচ্ছদ করে ফেলেছে কি-না! এখন গিয়ে জলদি কাজটি সারতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে দ্রুত পা চালাচ্ছি।
গৌরাঙ্গবাজার মোড়ে এসে স্টেশন রোডে বাঁক নেবো, দেখি কয়েকজন অটো ড্রাইভার জটলা বেঁধে হাসাহাসি করছে। তাদের সঙ্গে পথচারীদের অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছে। ব্যাপারটা আমার কাছে কৌতূহলজনক লাগল। একটু দাঁড়ালাম। খেয়াল করে দেখলাম, পাঁচ-ছয়জন বালক বয়সী মাদরাসার ছাত্র—আন্দাজ করতে পারলাম, ওরা হিফজখানার ছাত্র হবে—দুই “পাগল”কে ঘিরে “চোটপাট” দেখাচ্ছে। অটো ড্রাইভার আর পথচারীরা এটা দেখে হাসির খোরাক পাচ্ছে।
মাদরাসার ছাত্ররা পাগল মানুষের সঙ্গে এভাবে চোটপাট দেখাচ্ছে আর এটা নিয়ে সাধারণ মানুষজন হাসাহাসি করছে—বিষয়টা আমার কাছে খুবই খারাপ লাগল। আমি যেহেতু ঘটনার পরম্পরায় যুক্ত ছিলাম না—মানে শুরু থেকে ঘটনাটি দেখিনি আর আগাগোড়া কিছু বুঝতেও পারছি না—তাই একটু দাঁড়িয়ে থেকে এটাকে “তামাশা” মনে করে চলে যেতে চাইলাম। মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা দিতেই পেছন থেকে শুনলাম লোকজন চিৎকার করছে। কান খাড়া করে পেছনে তাকালাম। দেখলাম, দুই পাগলের পুরুষ লোকটিকে মাদরাসার ছাত্রগুলো মিলে “গণপিটুনি” দিচ্ছে আর বুড়ো মহিলাটি তাদের আশপাশে ছোটাছুটি করে চিল্লাচিল্লি করছে। এইটুকুন ছেলেপিলে, পূর্ণ বয়স্ক একটি লোককে “প্রকাশ্য দিবালোকে লাঠি হাতে গণপিটুনি” দিচ্ছে, ব্যাপারটা আমাকে নিদারুণ ক্ষুব্ধ করে তুলল। আমি ভেবে নিলাম, ওরা প্রকৃত মাদরাসার ছাত্র নয়; ছাত্র নামের “কলঙ্ক”। ঘটনাটি নিজের জন্য লজ্জাজনক মনে করে সেখানে আর দাঁড়ালাম না। পাছে কোনো লোক আমাকে দেখে ইয়ার্কি করে না বসে—‘হুজুর, আফনেরার জাইত্তে ভাইরা ত হেব্বি ফাওয়ার দেহাইতাছে।’ এই ভেবে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম।
হোটেল ময়নামতিতে ঢুকলাম। ঘুমের কারণে প্রায়দিনই সকালের খাবার খাওয়া হয় না। প্রতিটি দিন শুরু হয় চোরা খিদে নিয়ে। ভাবলাম, আজ যেহেতু সকাল সকাল উঠে পড়েছি, তাহলে নাশতা করেই যাই। বেসিনে মুখ ধুয়ে টেবিলে বসলাম। ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করল, ‘হুজুর, কী খাইবেন?’ ভুনা খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। এটার অর্ডার দিলাম। খেতে খেতে শুনলাম, ওয়েটাররাও এটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে আর হাসাহাসি করছে। হঠাৎ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘হুজুর, ঘটনাডা দেখছইননি?’ আমি একটু অবাক হওয়ার ভান করে তার দিকে তাকালাম। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিতা অইছে?’ ওয়েটার বলতে লাগল, ‘এক হিরোইনখোর ওই বুড়া বেডির টেহা লইয়া গেসিন গা। মাদরাসার ছাত্ররা এইডা দেইক্কে হেরে গিয়া ধরছে। ওই বেডির টেহা লইতে গিয়াই ছাত্ররা হিরোইনখোরটারে প্যাঁদানি দিছে।’
ওয়েটারের মুখে ঘটনার এই বিবরণ শুনে আমি এবার সত্যি সত্যিই অবাক হলাম। তার এই বিবরণ আমার কাছে যথেষ্ট সত্যনিষ্ঠ মনে হলো। কারণ, ঘটনার পরম্পরা তারা দেখেছে। এখানে বানোয়াট কিছু বলার অবকাশ নেই। এবার এরসঙ্গে আমার নিরীক্ষণকে মিলালাম। দেখি, আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমি যে লোকটিকে পাগল ভেবেছিলাম, সে একটা চোর ও মাদকাসক্ত আর যাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলাম—বালক বয়সী মাদরাসার ছাত্ররা—তারা প্রতিবাদী এবং অসহায়ের সহায়তাকারী।
পাঠক, খেয়াল করেছেন নিশ্চয়—ওপরে উদ্ধার চিহ্ন দিয়ে কিছু শব্দকে আমি বিশেষায়িত করেছি। এবার আসুন ওই শব্দগুলোর ওপরে একটি নিরীক্ষণ চালানো যাক।
মাদরাসার ছাত্ররা যে লোকটিকে ঘিরে ধরেছিল এবং তার সঙ্গে যে বুড়ো মহিলা ছিল, তাদের দুজনকে আমি অভিহিত করেছি পাগল বলে। তাদের বেশভূষা দেখে এটা খুব সাধারণভাবে অনুমান করে নিয়েছি। ছাত্রগুলো অল্প বয়সী বলে একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের সঙ্গে যেভাবে কথাবার্তা বলছিল, সেটাকে আমি ধরে নিয়েছি চোটপাট দেখানো আর এই ঘটনার পুরোটাকে ধরে নিয়েছি তামাশা অর্থে—যা আমার মতো অনেকেই ধরে নিয়েছে এবং এটা মনে করেই সবাই হাসাহাসি করেছে। ছাত্রগুলো লোকটিকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিয়েছিল আর একজনের হাতে ছিল একটি লাঠি, একে আমি আখ্যায়িত করেছি লাঠি হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে গণপিটুনি বলে। সবশেষে এই ঘটনার জন্য আমি ছাত্রদেরকেই দায়ি করেছি এবং একজন মাদরাসা-ঘরানার লোক হিসেবে একে নিজের জন্য লজ্জাজনক মনে করে স্থান ত্যাগ করে চলে এসেছি। সেইসঙ্গে আমি এটাও স্বীকার করেছি যে, এই ঘটনার আগাগোড়া আমি কিছু দেখিনি আর আমার যা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, এটা তাৎক্ষণিক দেখা থেকেই। সবশেষে এই ঘটনার একজন চাক্ষুষ দর্শনকারীর কাছ থেকে সত্যনিষ্ঠ বিবরণ শুনে বুঝতে পেরেছি ঘটনার প্রকৃত বাস্তবতা।
এরকম একটি ঘটনা নিশ্চয় গণমাধ্যমে স্থান পাওয়ার মতো। অন্তত এই সময়ের প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ যদি ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করে আপলোড করে থাকে, তাহলে সেটি বেশ প্রচারিত হবে এবং অনেকেই একে ভাইরাল ঘটনা হিসেবে নেবে। আর এরকম হলে এর জন্য কেউ ঘটনার সত্যনিষ্ঠতা খুঁজবে না; পোস্টদাতার ক্যাপশন দেখেই যা বুঝার বুঝে নেবে। কেউ যদি একে এই ক্যাপশনে লিখে পোস্ট দেয় : “মাদরাসার ছাত্রদের হাতে গণধোলাইয়ের শিকার দুই পাগল”, তাহলে ভিডিও দেখে বুঝার উপায় নেই যে, ঘটনার প্রকৃত বাস্তবতা কী। কারণ, এখানে ঘটনাটিকে এভাবেই হাইলাইট করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের কি উচিত না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত যেকোনো ঘটনারই প্রকৃত বাস্তবতা যাচাই করা, সত্যটা জানা? হ্যাঁ, অবশ্যই উচিত। আমি মনে করি, আমাদের সমাজে এমন মনমানসিকতার লোকজনই বেশি।
আসুন, আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত প্রতিটি ঘটনারই সত্যনিষ্ঠতা যাচাই করি। তিলকে আর তালের বড়া না বানাই!
The post তিল হয়ে যায় তালের বড়া appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b2-%e0%a6%b9%e0%a7%9f%e0%a7%87-%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a7%9c%e0%a6%be/
No comments:
Post a Comment