ইবরাহীম জামিল:
ঝোপঝাড়ে ঠাসা অন্ধকার বন। অযত্নে অবহেলায় বেড়ে ওঠা বালকের মতো যত্রতত্র জন্মে উঠেছে ক্যাকটাস। ব্যথায় মাঝে মাঝে কঁকিয়ে উঠছে হেলেন।অন্ধকারে দেখা না গেলেও ঠাহর করা যায়, ক্যাকটাসের কাঁটার আঘাতে রক্তে লাল হয়েছে ডেভিডের সাদা পা-জামা। সেবাগী অদ্ভূত কারণে কোনো আঘাতেই ব্যথা পাচ্ছে না।
ডেভিড দুজনের হাত ধরে অন্ধকার বেয়ে এগিয়ে চলেছে। ওদের কোনো গন্তব্য নেই। কোথায় চলেছে ওরা জানে না। আপতত একটু দাঁড়ানোর জায়গা পেলেই হয়। অন্ধকার হাতড়ে পাতড়ে আগুনখেয়া পাহাড় থেকে নেমেছে ওরা অনেক আগে। মাঝে মাঝে ঝুঁকে পড়া গাছের ডাল সজোরে বাড়ি দিচ্ছে মুখে এসে। রাতদুপুরে বনের মধ্যে মানুষের আনাগোনায় পাখিরা বিরক্ত হয়ে ডানা ঝাপটে উঠছে। ডেভিড খেয়াল করলো, আগুনখেয়া থেকে এখনও গুলির শব্দ আসছে থেমে থেমে।
আগুনখেয়ার উঠোনে অনেকগুলো রক্তাক্ত মানুষ পড়ে আছে। কে বেঁচে আছে আর কে মরে গেছে বোঝার উপায় নেই। মাঝে মাঝে কেউ কেশে উঠলে তীব্র গুলির শব্দ তাকে থামিয়ে দিচ্ছে। কাজটা করছে পরেশের দুই সঙ্গী। বেশির ভাগ মানুষ পালাতে পেরেছে। অমাবশ্যার অন্ধকার তাদেরকে পালাতে সাহায্য করেছে। আর যারা পরেশের হাতে বন্দি হয়েছে তাদের বেঁধে রাখা হয়েছে গাছের সাথে। এই বন্দিদের মধ্যে মিনিরওজা নামের মেয়েটিও আছে। তাকে দেখে পরেশের ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে ক্রুর হাসি ফুটে উঠেছে।
পরেশ তার পিছু পিছু কত ঘুরেছে! কতভাবে প্রেম নিবেদনের চেষ্টা করেছে!! মেয়েটি পাত্তা দেয়নি। প্রথম যেদিন তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল পরেশ, মেয়েটি একদলা থু থু ছুড়ে দিয়ে বলেছিল, ‘তোর মতো মাতাল যদি আমার পিছু লাগে তাহলে আমি সর্বনাশ করে ছাড়বো’। তবু মেয়েটিকে পরেশ ভুলতে পারেনি। একদিন পাহাড়ের ঢালুপথে মিনিরওজাকে একা পেয়ে পাহাড়ের গায়ে চেপে ধরেছিল শুধু এতোটুকু বলার জন্য যে, তোকে ছাড়া আমার চলবে না। মিনিরওজা তার হাত কামড়ে রক্তাক্ত করে দিয়ে বলেছিলো, আরেকবার কাছে এলে খুন করে ফেলবো!
পরেশ ভেবেছিল এবারও বিষয়টা কেউ জানবে না। কিন্তু মিনিরওজা ঘটনাটা সবাইকে বলে দেয়ায় পরেশকে বিচারের মুখোমুখি হতে হল। রমেশ ও রমেশের বন্ধুরা পরেশকে বলে দিল, আরেকবার মিনিরওজাকে বিরক্ত করলে সত্যি ওরা তাকে খুন করে ফেলবে। পরেশ ভালো করেই জানে, পাহাড়ের মানুষেরা পাহাড়ের নির্মল বাতাসের মতো নরম, কিন্তু ক্ষেপে গেলে পাহাড়ের মাটির মতোই শক্ত হয়ে ওঠে ওরা। একবার যদি কাউকে বলে দেয় যে, খুন করবে তাহলে খুন করেই ছাড়বে।। ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই।
এরপর আর মিনিরওজাকে উত্যক্ত করার সাহস হয়নি পরেশের। কিন্তু যে প্রেম সিসার গুলির মতো বুকে বিঁধে আছে, আলতো ছোঁয়ায় কি তাকে সরানো যায়?
মেয়েটি ভালোবাসে রমেশকে। রমেশও বন্দিদের মধ্যে আছে। সে দৌড়াতে গিয়ে শুকরের মাংসে পা পিছলে ধরা পড়েছে। পরেশ চোখ বন্ধ করে মনে করতে চেষ্টা করলো, এই রমেশই তার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিল সেদিন রাতে, যেদিন পরেশ আগুনখেয়ার কারবারি হতে চেয়েছিল। পরেশের ইচ্ছে হল ব্রাশফায়ার করে রমেশকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে। কিন্তু সে নিজেকে সামলাল। সে মিনিরওজার কাছে গিয়ে নাটুকে গলায় বললো, আমি আগুনখেয়ার রাজা হবো, তুই হবি রাণী। রাজি থাকলে আজই বাসর হবে এই আগুনখেয়ায়! কী বলিস? বাসর হওয়ার জন্য আজকের আবহাওয়াটা দারুণ না?
মিনিরওজার শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠল। সে চিৎকার করে বললো, আমি তোকে বলেছিলাম আরেকবার আমার কাছে এলে খুন করে ফেলবো!
পরেশ হো হো করে হেসে উঠল। কাছে গিয়ে বললো, এই যে কাছে এলাম। নে খুন কর!
মিনিরওজা একদলা থু থু ছুড়ে দিল পরেশের মুখ লক্ষ্য করে। পরেশের মুখ শয়তানের আকার ধারণ করেছে। সে বাঁ হাতে মুখ মুছে বললো, আমাকে খুন করবে কে? তোর প্রেমিকেরা? ওই রমেশ? দেখ রমেশকেই আমি নেই করে দিচ্ছি!
রমেশের দিকে পরেশের বন্দুকের নল ঘুরে এলে রমেশ ভয়ে অসাড় হয়ে গেল। ভয়ার্ত গলায় মাথা নেড়ে বলল, না! না!
পরেশ জিজ্ঞাসা করলো, কী না?
আমি ওর প্রেমিক না।
তুই ওর প্রেমিক।
না, আমি ওর প্রেমিক না।
ওর কাছে জিজ্ঞাসা করে দেখ তুই-ই ওর প্রেমিক। তোর প্রেমে ও দেওয়ানা হয়েছে বলেই আমার দিকে ওর মনোযোগ নেই।
রমেশ কাতর গলায় বললো, সত্যি আমি ওর প্রেমিক নই। আমি ওকে ভালোবাসি না। কখনো ভালোবাসিনি।
পরেশ আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করে বললো, কখনো ভালোবাসিসনি? কেন ভালোবাসিসনি? ওর নাক খারাপ? মুখ খারাপ? দেখতে খারাপ? সবাই ওর প্রেমে হাবুডুবু খায়। তুই কেন ওর প্রেমে পড়লি না? তোর তো বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তোকে গুলি করে মেরে ফেলা উচিৎ!
রমেশের কপাল বরাবর বন্দুক তুলে পরেশ শীতল গলায় বললো, তুই ওকে ভালোবাসিসনি?
রমেশ আতঙ্কে খেই হারিয়েছে। সে মাথা নেড়ে সায় দিলো, হ্যা, ভালোবেসেছে।
পরেশ বললো, মুখে বল তুই ওকে ভালোবেসেছিস?
রমেশ নিভে যাওয়া গলায় বললো, ভালোবেসেছি।
বল, এখনো ভালোবাসিস!
রমেশ বললো, এখনো ভালোবাসি।
পরেশের বন্দুক গর্জে উঠল। মিনিরওজা চিৎকার করে জ্ঞান হারালো। আর রমেশের দেহ ঝুঁলে রইল বাঁধা দড়ির সাথে।
গুলির শব্দে হুড়মুড় করে পড়ে গেল ডেভিড, তার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ল সেবাগী। হেলেন কেঁদে উঠল হাউ মাউ করে। কী এক দুঃস্বপ্নের রাত নেমে এল তাদের জীবনে! গতকাল বিকেলেও ওরা ভাবতে পারেনি যে, এমন দুঃসময় আসতে পারে। ডেভিড মনে মনে সবকিছু গুছিয়ে রেখেছিল। দুটি শুকর মেরে আগুনখেয়ায় তার পথচলা মসৃণ করে তুলেছিল। সে কারবারি না হলেও কারবারির চেয়ে ক্ষমতাধর হিসেবে আগুনখেয়ার মানুষ তাকে সমীহ করতে শুরু করেছিল । কিন্তু সুখ-স্বপ্নের মাঝখানে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার মতো হঠাৎই সবকিছু ভেঙ্গে গেল।
ডেভিড ভেবেছিল আগুনখেয়ার একদম চূড়ায় একটি দৃষ্টিনন্দন গির্জা তৈরি করবে সে। বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়ার বিস্ময় হয়ে উঠবে এ গির্জা। বাংলাদেশের খ্রিস্টানদের কেন্দ্র হয়ে উঠবে আগুনখেয়ার চূড়া। খ্রিস্টানদের পদভারে মুখরিত হবে আগুনখেয়া।
প্রায় দশ বছর আগে ডেভিডের চোখ পড়েছিল আগুনখেয়ার উপর। দারুণ একটা জায়গা! চারপাশে এতো উঁচু আর কোনো পাহাড় নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আড়াই হাজার ফুট উপরে আগুনখেয়ার চূড়ায় ধবধবে সাদা মার্বেল পাথরের বিরাট গির্জা তৈরির স্বপ্ন সেই দশ বছর আগের এক সন্ধ্যায় টুপ করে তার মনে গেঁথে গিয়েছিল।
বাংলাদেশে ডেভিড এসেছে বড় একটি লক্ষ্য নিয়ে, বরং ডেভিডকে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশে ডেভিডের কার্যক্রম দেখে বিশ্ব খ্রিস্টান মিশনের নেতারা যার পর নাই আনন্দিত। দক্ষিণ এশিয়ায় একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন ডেভিডের হাত ধরে অনেক দূর এগিয়েছে। ডেভিডের হাত ধরে পার্বত্যাঞ্চলে এতো ধর্মান্তর হয়েছে, খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এতো বেড়েছে যে, পূর্ব তিমুরের মতো গণভোট হলে এখনই তারা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়ে যায়। কিন্তু সময় এখনো আসেনি। বিশ্ব খ্রিস্টান মিশন ডেভিডকে বলে দিয়েছে যে, মিশনের কল্যাণে যে কোনো পদক্ষেপ সে নিতে পারবে। দুনিয়ার তাবৎ খ্রিস্টানেরা তাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করবে। টাকার জন্য ডেভিডের কাজ থেমে থাকবে না।
আগুনখেয়া দেখে ডেভিডের মনে স্বপ্ন জেগেছে, আয়া সোফিয়ার মতো আরেকটি গির্জা সে গড়ে তুলবে বাংলাদেশে, আগুনখেয়ার চূড়ায়। সারা দুনিয়ার খ্রিস্টানদের অর্থায়নে সংগোপনে কাজটা করবে সে। তবে সেই কাঙ্খিত সময়টি এলে পুরো দুনিয়াকে জানিয়ে দেবে সে কী করেছে। সারা দুনিয়ার খ্রিস্টানদের আগমন নির্গমন শুরু হবে আগুনখেয়ায়। চিন্তাটা মাথায় আসার পর থেকে লক্ষ্যে অলক্ষ্যে আগুনখেয়ায় আসে ডেভিড। দূর থেকে দৃষ্টি রাখে আগুনখেয়ার উপর। একটু একটু এগোতে এগোতে একদম আগুনখেয়ার ভিতরে ঢুকে পড়েছিল সে আজ সন্ধ্যায়। ছোট্ট একটা গির্জার অনুমোদনও করিয়ে নিয়েছিল। অর্থাৎ আগুনখেয়ায় সে পা রেখে ফেলেছিল, কিন্তু হঠাৎ কী এক দুঃসপ্ন এসে সবকিছু ওলটপালট করে দিল!
ডেভিড হাত দিয়ে দেখার চেষ্টা করল পা থেকে এখনও রক্ত ঝরছে কিনা। না, রক্ত ঝরছে না। ক্যাকটাসের বন তারা পার হয়ে এসেছে। পুরোনো রক্ত পায়ের উপর জমাট বেঁধে আছে। তারা প্রায় ফাঁকা একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে। এ জায়গাটা বনভূমি নয়, সম্ভবত লোকালয়ের কাছাকাছি কোনো জায়গা হবে। এখানে একটু বিশ্রাম নেয়া যায়। ডেভিড সেবাগী আর হেলেনের পা হাতড়ে দেখল, সেবাগীর পা প্রায় ক্ষত-বিক্ষত। হেলেনের অবস্থা একই রকম। সেবাগী চুপ করে আছে, হেলেন ফোঁপাচ্ছে। ডেভিড হেলেনের মাথায় হাত রাখতেই সে জোরে কেঁদে উঠে বললো, বাবা! তুমি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলে?
তুই তো বললি সেবাগীর কাছে যাবি। ওর সাথে বন্ধুত্ব করবি।
হেলেন কান্না থামিয়ে বললো, সেবাগীর দাদা কী মরে গেছে?
হ্যা মরে গেছে। থমথমে গলায় সেবাগী উত্তর দিল ।
তাহলে তোমার কেউ আর বেঁচে নেই?
আমি জানি না।
ডেভিড বললো, সেবাগী! তোমার সবকিছু আছে। কিছুই হারায়নি। তোমার দাদা আমার বন্ধু ছিল। এখন আমাকেই মনে করবে মহিত শেখ। আমিই তোমার অভিভাবক। তোমার দাদার পয়সা ছিল না। আমার পয়সা আছে। তুমি আনন্দে থাকবে।
হেলেন আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। বিভীষকাময় রাত্রির কষ্ট যেন ভুলে গেছে সে।
সেবাগী বললো, আমি পয়সা দিয়ে কী করবো?
ডেভিড বললো, বড় হলে বুঝবে, পয়সা দিয়েই দুনিয়ায় সবকিছু হয়।
পয়সা দিয়ে কি আমার দাদাকে ফেরৎ পাওয়া যাবে?
ডেভিড এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। সে নিরব হয়ে গেল।
গভীর রাতে আগুনখেয়ার মিতালী পনেরো মাইল হেঁটে রুমার আরমি ক্যাম্পের সামনে এসে ক্লান্তিতে ধপাস করে বসে পড়ল।
মিনিরওজার জ্ঞান ফিরেছে। সে শরীরে ও মনে অব্যক্ত ব্যথা অনুভব করল। রমেশকে সে সত্যি সত্যি ভালোবাসতো। মুখ ফুটে বলেনি কখনো, কিন্তু ভেবে রেখেছিল, কোনো এক সুসময়ে সবাইকে জানিয়ে রমেশের সাথে থিতু হয়ে যাবে।
হ্যাজাকের তেল ফুরিয়ে আলো নিভু নিভু হতে চলেছে। হ্যাজাকের নিচে কতগুলো মৃত পতঙ্গ জমেছে। ওরা আগুনের প্রেমে আত্মহুতি দিয়েছে। মিনিরওজার কিছুক্ষণের জন্য আগুনে আত্মহুতি দেয়া একটি পতঙ্গ হয়ে যেতে ইচ্ছে হল। মিনিরওজা মাথা তুলে রমেশের লাশ দেখার চেষ্টা করল। ওভাবেই পড়ে আছে। পরেশ তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে গাছের গুড়িতে বসে মদ খাচ্ছে। মদ নয়, পঁচানো পান্তা ভাত। সাথে মাটি থেকে তুলে নেয়া কেজিখানেক শুকরের মাংস।
মিনিরওজাকে রমেশের লাশের দিকে তাকাতে দেখে মাতাল পরেশ খেকিয়ে উঠলো, এখনো তোর ক্যারা নামেনি? ওদিকেই চোখ যায়? আমার দিকে এখনো চোখ আসে না?
মিনিরওজা বললো, আমি নিজ হাতে তোকে খুন করবো!
পরেশ বললো, আমাকে খুন করবি? তাহলে তো তোকে বাঁচিয়ে রাখা উচিৎ না। পরেশ বন্দুক উঁচু করেছিল, কিন্তু মিনিরওজার ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠতে দেখে থেমে গেল। মিনিরওজা মরতে চায়।
পরেশের হঠাৎ মনে হল, রমেশ মরেছে বলেই কি মিনিরওজা বেঁচে থাকতে চায় না? ওর জীবন মরণ সবকিছু রমেশের জন্য? পরেশ উত্তেজিত হয়ে হাতে থাকা মদের হাড়িটা আছড়ে ভাঙল। চিৎকার করে বললো, তোকে আমি এতো সহজে মারবো না। তোকে কুকুরের মতো করে মারবো। যন্ত্রণা দিয়ে মারবো।
পাশের দুজন উৎসাহী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পরেশ আঙুল উঁচিয়ে বলল, খবরদার!
ওরা অসহিষ্ণু গলায় বলল, আমাদের প্রয়োজন!
‘ওদিকে যাও!’ পরেশ দড়িতে বাঁধা অন্য নারীদের দিকে ইশারা করল।
দুই মাতাল টলতে টলতে বন্দিদের দিকে পা বাড়াল।
পরেশ নিজেকে শুধরে নিয়ে মিনিরওজার উদ্দেশ্যে কাতর গলায় বললো, তোকে আমি ভালোবাসি, তুই আমার সাথে থাকতে রাজি হলে আমি তোর গায়ে ফুলের টোকেও পড়তে দেবো না। আমি তোকে রাণীর মতো করে রাখবো!
মিনিরওজার চেহারায় ঘৃণা ফুটে উঠতে দেখে সে নিজের কথা সংশোধন করে বললো, আমি তোকে যন্ত্রণা দিয়ে মারবো!
ঠিক তখনই আগুনখেয়ার বাইরে থেকে দ্রিম দ্রিম গুলির শব্দ শোনা গেল। নারীদের দিকে হেঁটে যাওয়া লোকদুটো থমকে দাঁড়িয়েছে। পরেশের দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরা। পরেশও হতভম্ব হয়ে গেছে।
ওরা তিনজন পরস্পরের বন্দুকের দিকে তাকাতে লাগল। আর কারো কাছে তো বন্দুক থাকার কথা নয়!
পরেশ মুহূর্তেই ঘটনাটি বুঝে ফেললো, সর্বনাশ হয়ে গেছে!
একজন প্রশ্ন করলো, কী হয়েছে?
পরেশ বললো, আর্মি এসে গেছে!
ওদের তিনজনের চেহারা থেকেই রক্ত সরে গেল। এতক্ষণ যে আতঙ্ক ওরা আগুনখেয়ায় সৃষ্টি করেছিল সে আতঙ্ক এখন ওদের চেহারায় ভর করেছে। ওরা দৌড়ে পূব দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই পূব দিক থেকে গুলি শুরু হল।
পরেশ আতঙ্কিত গলায় বললো, আমাদেরকে ঘীরে ফেলেছে! ওদের হাতে ধরা পরলে মেরে ফেলবে! লড়াই করে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই!
পরেশের দুইসঙ্গী হাঁটু গেড়ে বসে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। ওরা পার্বত্যাঞ্চলের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য। আর্মির সাথে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে ওদের। পরেশও ওদের সাথে গুলি করার ভান করেছিল প্রথমে। তারপর ওদের মনোযোগ লড়াইয়ের দিকে বুঝতে পেরে আস্তে করে পশ্চিমে সরে গেল সে।
পশ্চিম থেকে পাহাড়টি খাড়াভাবে আড়াইশো ফিট নিচে নেমে গেছে। এদিকে শুধু পাহাড়ের গা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। এ পাশ থেকে আর্মি আসার সুযোগ নেই। পরেশ ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে পড়তে যাচ্ছিল, মিনিরওজা পাশে এসে বললো, তুমি যদি আমাকে বাঁচাও, আমি তোমার হবো! আমার যাওয়ার কোনো যায়গা নেই। তুমি না বাঁচালে আমি হয়তো আর্মির ব্রাশ ফায়ারে মারা পড়বো!
পরেশ মিনিরওজার মুখে একদলা থুথু মেরে বলল, আয় আমার সাথে!
ঝোঁপের মধ্যে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে আর্মিদের ছোঁড়া এলোপাথাড়ি গুলির একটি এসে পরেশের পায়ে বিঁধল। হাত থেকে বন্দুক ছিটকে গেছে। পরেশ আতঙ্কে যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে। এই মুহূর্তটির সুযোগ নিল মিনিরওজা। সে বন্দুক তুলে নিয়ে পরেশের দিকে তাক করে বললো, আমি বলেছিলাম না, নিজ হাতে তোকে খুন করবো? আমি বলেছিলাম না, তোর সর্বনাশ করে ছাড়বো?
আতঙ্কে পরেশের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে পড়ার দশা। সে বললো, তুই আমার সাথে গাদ্দারী করেছিস!
তোর সাথে গাদ্দারী না করার কি কোনো কারণ আছে? মিনিরওজার শ্লেষ মেশানো প্রশ্ন।
তুই গুলি করতে পারিস?
দ্যাখ পারি কিনা!
বিপদ বুঝতে পেরে পরেশ পশ্চিমের খাঁদে ঝাঁপ দিল। মিনিরওজার গুলিও ঠিক সেই সময় বন্দুকের নল অতিক্রম করল।
পরদিন সকাল।
সূর্যের আলো যখন ফুটছে তখন তিনজনই পেটের মধ্যে ছুচোর নাচুনি অনুভব করল। গতকাল দুপুরবেলা খাওয়া হয়েছে। এরপর থেকে পেটে আর দানাপানি পড়েনি। তারপর মাইলের পর মাইল পথ হাঁটা। আতঙ্কে এতক্ষণ ক্ষুধার কথা মনে পড়েনি। এখন যখন পূর্ব দিগন্তে অভয়-বার্তা নিয়ে সূর্য উঠছে, তখন পেটের ক্ষুধাটাও নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
হেলেন বলে ফেললো, বাবা! ক্ষুধা আর সহ্য হচ্ছে না। সেবাগীর মুখটাও শুকনো হয়ে আছে। ডেভিড নিজের মুখটা দেখতে পাচ্ছে না। দেখলে বুঝতে পারতো সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে তারই।
পা-জামায় রক্তের দাগ। জামায় বনকাটা লেগে আছে। ওদের তিনজনকে বড্ড অদ্ভ‚তুড়ে লাগছে। এ অবস্থায় মানুষের সামনে পড়লে বিপদ আরও বাড়বে। মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে হবে। কাছেই একটা ঝিরি। ঝরণার নিটোল জল বয়ে চলেছে ঝিরিতে। ডেভিড হাতে করে জল তুলে ওদের দুজনকে খাওয়ালো। কৃষক টাইপের এক লোক ভোর সকালেই ঘর থেকে বেরিয়েছে। এরকম অদ্ভূত টাইপের তিনটি মানুষ দেখে তার মুখ একদম হা হয়ে গেছে। ডেভিড তাকে ডেকে বললো, কাছাকাছি কোথাও চার্চ আছে?
আপনাদের কি…? লোকটি কথা শেষ করতে পারল না। ডেভিড তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমরা শুধু চার্চে যেতে চাই।
The post আগুনখেয়া (৬ষ্ঠ পর্ব) appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%97%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a6%96%e0%a7%87%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a7%ac%e0%a6%b7%e0%a7%8d%e0%a6%a0-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac/
No comments:
Post a Comment