Friday, October 29, 2021

কাঁচ ও কাঞ্চন

সাইফুল্লাহ সুবহান:

রফিক সাহেব বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন। লতীফ এক পেয়ালা চা আর আজকের পত্রিকা দিয়ে গেল।

লতীফ বাসার কাজের লোক। বয়স সতেরো-আঠারো হবে। ঘরের ছোটখাটো কাজ করে। সুযোগ পেলে কাজে ফাঁকি দেয়। গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে রফিক সাহেব পত্রিকায় চোখ বুলাতে লাগলেন। পত্রিকা ভরা নানা খবর। খবরে খবরে সয়লাব। রফিক সাহেব তবু খুঁটিয়ে পড়ার মতো কিছু পেলেন না। পত্রিকা থেকে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকালেন। শহরতলীর সরু পথ। পথের ওপাশে একটা টিনশেড বাড়ি। বাড়িটার সদর দরজা হাট করে খোলা। বাড়ি ভরা লোক। লোক আসছে। লোক যাচ্ছে। ঘরের লোক। বাইরের লোক। সবাই হাসছে। কথা বলছে। চারপাশ কেমন একটা উৎসবের আমেজে ভাসছে।

বাড়িটা অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর আজমল সাহেবের। তিনি শিক্ষিত মানুষ। নানান মানুষের আসা যাওয়া তার কাছে। এসব মানুষেরা রোজই আসে। রোজই বাড়ির সদর দরজা হাট করে খোলা থাকে। কেন আসে এত লোক ! কী আছে এই মধ্যবিত্ত প্রাক্তন প্রফেসরের কাছে! রফিক সাহেব বুঝতে পারেন না। শুধু তাকিয়ে থাকেন। মানুষের আসা যাওয়া দেখেন। দেখতে তার ভালো লাগে। একধরনের পুলক অনুভব করেন। মানুষ দেখার পুলক।

এই পুলক পেতে পেতে একসময় তার পিপাসা বাড়ে। মানুষের সঙ্গ লাভের পিপাসা! মানুষের সাথে মন খুলে দুটো কথা কইবার পিপাসা! একটু কথা কইবার লোকও তিনি পান না! অথচ আজমল সাহেবের ওখানে মানুষের ভিড় লেগেই আছে। রফিক সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়। আজমল সাহেবের উপর রাগ চড়তে থাকে। তাকে আচ্ছা মতো গালাগাল দিতে ইচ্ছে করে। তখন তিনি বারান্দা ছেড়ে রুমে চলে আসেন। দেয়ালে টানানো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে তোলা ছবিগুলোর সামনে দাঁড়ান। বহুদিন ধরে এটাই  হয়ে দাঁড়িয়েছে তার রোজকার নিয়ম ।

রফিক সাহেব আর আজমল সাহেব ছোটবেলার বন্ধু। সেই ছোটবেলার, যখন তারা সাহেব ছিলেন না। কেবল রফিক আর আজমল ছিলেন। মুখোমুখি বাড়ি তাদের। দু’বাড়ির মাঝ দিয়ে শহরতলীর প্রায় নির্জন পথ। পথটা বহুদূর অবধি গিয়ে মিশে গেছে বড় রাস্তায়।

এই বড় রাস্তা ধরে পুবদিকে কিছু দূর এগোলে শোভনপুর হাইস্কুল। এই স্কুলেই পড়তেন তারা দুজন। এসএসসি পড়তে পড়তে পড়ালেখা ছেড়ে দেয় রফিক। তার বাবা তখন শহরতলীর বেশ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সেও নেমে পড়ে ব্যবসায়। আজমল পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকে। মাঝেসাঝে রফীকের সাথে কথা হয়। রফিক তার উন্নতির গল্প শুনায়। পড়াশুনা যে নেহাৎ সময় নষ্ট বৈ কিছু নয় নানাভাবে বুঝায় সে কথা।

দেখতে দেখতে কেটে যায় অনেক বছর। দুজনেই সাহেব হয়ে ওঠে। রফিক হয়ে যায় বিশিষ্ট শিল্পপতি রফীকুল ইসলাম সাহেব। শহরতলীর এক কলেজে নিয়োগ পেয়ে আজমল হয়ে ওঠে প্রফেসর আজমল সাহেব।

শিল্পপতি রফিক সাহেব ব্যবসার কাজে দেশ বিদেশ করে বেড়ান। শহরতলীর পৈতৃক ভিটায় বছর দু’বছরে এক আধবারের বেশি আসার সুযোগ হয় না। তবু বাড়িটা তিনি বানিয়েছেন আলিশান। অবশ্য এর কারণও আছে। বাপদাদার ভিটা ছেড়ে শহরের অভিজাত এলাকায় গিয়ে থাকতে তার বাবা কখনোই রাজি হননি। বিপত্নীক এই মানুষটি স্ত্রীর স্মৃতি বিজড়িত এ বাড়িতে থাকতেই বেশী স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। রফিক সাহেব তাই বাবার জন্য এখানেই গড়ে দিলেন প্রাসাদোপম ভিআইপি বাড়ি। শোনা যায়, এই প্রাসাদোপম বাড়িতে থেকেও তার বাবা শেষ জীবনে অসুখী ছিলেন। একমাত্র ছেলে, বউমা আর নাতিপুতির সঙ্গ লাভের জন্য হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। সে সুযোগ তার হয়নি। রফিক সাহেব মাঝে মাঝে আসলেও তার বউ ছেলেমেয়েরা কখনো এ মুখো হয়নি। তার বাবাও শহরে যেতে রাজি হননি কখনো। শেষতক এই বিশাল বাড়িতে একাকী থেকে থেকেই একদিন নিঃসঙ্গ কবরের যাত্রী হন।

পিতৃ বিয়োগের বছর তিনেকের মাথায় বিপত্নীক হন রফিক সাহেব। তখন তার বয়স পঞ্চান্ন কি ষাট হবে। ধনীদের এ বয়স তেমন কিছু না। টাকা হলো চির যৌবনা। কখনো বুড়ো হয় না। মালিককেও বুড়ো হতে দেয় না। পঞ্চান্ন-ষাটের টগবগে যুবক(!) টাকার কুমির রফিক সাহেব যেকোন সময় বিয়ে থা করে ফেলতে পারেন। হয়ত তার আচরণে বিষয়টা আঁচ করা গিয়েছিল বা তার ভেতর এ ভাবনা আদৌ ছিলই না। কিন্তু তার ছেলে-মেয়েদের মাথায় হয়তো এ ভাবনাটাই ছিল। এ বয়সে বাবার বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করার অভিজ্ঞতা হয়ত তাদের জন্য খুব একটা সুখকর হতো না। অথবা আরো কিছু শরীক বৃদ্ধির ঝুঁকি তারা নিতে চাইল না। ভাইবোনরা সবাই মিলে তাই একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো।

পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে সিদ্ধান্তের কথাটা শুনালো বড় ছেলে। বাবা! তোমার তো বয়স হয়েছে। সারাজীবন কষ্ট করেছো। আর কত! এবার তুমি বিশ্রাম নাও! ব্যবসা-পাতির ঝক্কি ঝামেলা আমরাই সামলে নেব। ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। বাকি ছেলে মেয়েরাও তাকে সমর্থন দিল। রফিক সাহেব এই উথলে ওঠা দরদের উৎসের খোঁজ ধরতে ঠিকই পারলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। বাহ্যিক স্বাগ্রহে তাদের কথাই মেনে নিলেন। একদিন সব হিসাবপত্র বুঝিয়ে দিয়ে পূর্ণ অবসর নিয়ে বাড়ির নিত্য সদস্য হয়ে ওঠলেন। নাতি নাতনিদের সাথে হেসে খেলে দিন কাটাতে লাগলেন।

কিন্তু অবসরের সুখ তার বেশিদিন সইলো না। বছর না ঘুরতেই হঠাৎ একদিন তিনি আবিষ্কার করলেন, যে লোকগুলো প্রত্যহ তাকে ফোন করে স্যার স্যার বলে মুখে ফেনা তুলত, তাদের কেউই এখন আর ফোন করেনা। ছেলে বউদের আদর আপ্যায়নও যেন কমে এসেছে। ছেলেমেয়েরাও আগের মতো আর প্রতিদিন খবর খোঁজ নেয় না। হয়ত ব্যস্ততার কারণে তাদের সময় হয়ে ওঠে না। কিন্তু রফিক সাহেবের মনে ঘুরতে লাগলো অন্য কথা। তার মনে হতে লাগলো এসবই তার প্রতি অবহেলা। এবং টাকার হাতবদলই এই অবহেলার একমাত্র কারণ। নইলে একসময়ের প্রিয়জনরা তার প্রতি এত উদাসীন হয় কী করে!

নিত্য অবহেলার কল্পনায় তিনি ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণাদগ্ধ হতে লাগলেন। দগ্ধিভূত ভেতরের উত্তাপ বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে লাগলো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেলো। আচরণের সংযতভাব কমতে লাগলো। তিনি যে অচিরেই সংসারের শান্তি বিনষ্টের কারণ হতে যাচ্ছেন এটা খুব বুঝতে পারলেন। স্থির করলেন এখানে আর থাকবেন না। বাকীটা জীবন শহরতলীর যে বাড়িটাতে তার জন্ম ও বড়ে ওঠা সেখানেই কাটিয়ে দিবেন।

নাস্তার টেবিলে তিনি কথাটা পাড়লেন। ছেলেমেয়েরা উপরে উপরে কিছুক্ষণ আমতা আমতাকরে শেষে রাজি হয়ে গেল। তারপর একদিন সাড়ম্বরে বউ ছেলেমেয়ে নাতিপুতি নিয়ে তিনি আপন জন্মভূমে নির্বাসিত হতে যাত্রা করলেন। কিছুদিন থেকে সবাই সুযোগ পেলেই আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে যার মতো চলে গেল। ডজন খানেক ঝি-চাকর নিয়ে তিনি এখানেই থেকে গেলেন। তারই বেদখল সাম্রাজ্য থেকে ছেলেরা প্রতি মাসে মাসোহারা পাঠায়। মাঝেমাঝে একটু হিসেব করে খরচ করার পরামর্শও দেয়। রফিক সাহেব হাসিমুখে সায় দেন। কিছু বলেননা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যান। ভাবেন, কী আশ্চর্য! দিনেদিনে রক্ষকরাই মালিক হয়ে ওঠেছে, মালিক হয়ে গেছে রক্ষকদের দয়ার ভিখারি।

দেয়ালে টানানো ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি তার সাফল্যের পরিমাপ করতে চান। তার ভেতরের সত্তাকে বুঝাতে চান, তিনিও আজমল সাহেবের চেয়ে কম সুখী নন। সহসাই সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। নিজেকে কতক্ষণ আর ধোকা দেয়া যায়! তুলনার প্রশ্নটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। মানুষ ও পরিবার বেষ্টিত আজমল সাহেবের জীবন কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে তার কাছে। একটা তোলপাড় শুরু হয় বুকের ভেতরে।  ভেতরটা দুমরে মুচড়ে যায়। আজ ভুল মনে হওয়া রক্তে উদ্দাম জোয়ার তোলা যৌবনের সিদ্ধান্তের আক্ষেপে দুফোঁটা তপ্ত অশ্রু নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ওঠে আসে।

The post কাঁচ ও কাঞ্চন appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%81%e0%a6%9a-%e0%a6%93-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%a8/

No comments:

Post a Comment