(নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জীবন এবং সিরাত বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক এক আলাপচারিতা জমিয়েছিলেন ফাতেহের সম্পাদক ইফতেখার জামিল ও সহযোগী সম্পাদক তুহিন খান। ইসলামের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে নবিজির গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতার ওপর দীর্ঘ এ আলাপে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় উঠে এসেছে। ফাতেহের পাঠকদের জন্য সেই আলাপচারিতাই মজলিসি ঢংয়ে উপস্থাপিত হলো আজকের ফাতেহ সাপ্তাহিকীতে। -হামমাদ রাগিব)
জামিল : আচ্ছা, আলাপটা শুরু করি। আমাদের আলাপের প্রথম টপিক এই যে, মৃত্যুর এত বছর পরেও, আজও কেন রাসূল (স.) এত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব? একজনমাত্র ব্যক্তি—নবী, রাজনীতিবিদ, শাসক এবং আরো অনেক কিছু….
তুহিন: এবং তার এই প্রত্যেকটা পরিচয়ই এখনও আলাদা আলাদাভাবে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ; এমন না যে, রাজনীতিবিদ মুহাম্মদ (স.)-রে নিয়া এখন আর আলাপ নাই। এইটা গুরুত্বপূর্ণ।
জামিল : হ্যাঁ। তো, এই যে, একক ব্যক্তির এত বিপুল পরিচয় ও প্রভাব, আজ এত বছর পরেও বিদ্যমান এইটা কিন্তু চিন্তার ব্যাপার। পশ্চিমা সভ্যতায় কিন্তু ঈসা (আ.) এত সামগ্রিক এবং প্রাসঙ্গিক না।
তুহিন: হুম্ম। বরং গ্রীক মিথের একটা বড় প্রভাব আছে তাদের উপরে…আবার ইওরোপে জুইশ-ক্রিশ্চান একটা দ্বন্দ তো ছিলোই, ইওরোপীয় সভ্যতাত জুইশদের অবদান অনেক, ফলে, একক ব্যক্তি হিশাবে ঈসা (আ.) সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের মর্যাদা পান নাই…..
জামিল : যাহোক, রাসূল (স.) এতটা কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ইসলামে, অন্য কোন সভ্যতায় এইটা কিন্তু ভাবা যায় না। অন্য কোন মতাদর্শ বা সভ্যতায় এত কেন্দ্রীয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তি নাই বললেই চলো। ধরা যাক, মার্কসের কথা, মার্কসও কি এতটা জনপ্রিয়? না কিন্তু! তার ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে অনেকেই কিছুই জানে না। কিন্তু রাসূল (স.)-এর ব্যক্তিগত জীবনও অনেক গুরুত্বের সাথে আলোচিত। যেমন, স্ত্রীর সাথে সহবাসের ব্যাপারেও রাসূলের যে কথা, এইটা এখনও চর্চিত, যে—এইটা হইলো সদকা! তো এই যে, রাসূল (স.) এত প্রভাবশালী, কেন্দ্রীয় এবং প্রধান ব্যক্তিত্ব, সারা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ইসলামি সভ্যতায় এই যে ওনার এতটা গুরুত্ব, এইটা কেন? এর কারণটা কী?
তুহিন: অ্যাজ আ পার্সন, রাসূল (স.)-এর এই গুরুত্বের ক্ষেত্রে আমার কয়েকটা ব্যাপার মনে হয়। প্রথমত এই যে, রাসূল (স.)-এর যাবতীয় কিছু—কথা, কাজ এমনকি চুপ থাকা—এই সবকিছুই, টেক্সট ও কনটেক্সটসহ, তার সময় থেকে এই পর্যন্তও খুব ভালোভাবে সংরক্ষিত। আপনি দেখেন, হযরত ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুর পরেপরেই কিন্তু ক্রিশ্চানদের বাইবেল বিকৃত হয়ে গেলো, এই কিছুদিন আগে বার্নাবাসের ইনজিল পাইছেন গবেষকরা, এই ইনজিল এই দাবির পক্ষে অনেক মজবুত দলিল। তো, রাসূল (স.) এর ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা তো ঘটে নাই।
জামিল : আচ্ছা, আমাদের যে মাযহাব, বা নানান ফেরকা, এইটারেও অনেকে, বিশেষত সেক্যুলাররা, ক্রিশ্চানদের ওই অবস্থার সাথে মিলায় যে, কোরানে এই ছিল না, ওই ছিল না, এইটা বিকৃত হইছে, বা ইসলামে এইটা ছিল না, পরে আলেমরা এড করছে বা ব্যাখ্যা পাল্টায়ে দিছে….এরকম তো বলে!
তুহিন: ওকে, এই প্রশ্ন তো আসেই। এখন, এর উত্তর কী? আমি দুইভাবে বলতে পারি। শুধু উত্তর দেওয়ার জন্য না, এইটা গবেষণারও একটা বড় ক্ষেত্র।
প্রথমত, বলা যায় যে, আল্লাহ কোরানে ওয়াদা করছেন যে, এই কোরানকে তিনি নাযিল করছেন এবং তিনিই সংরক্ষণ করবেন। এইটা তো টেক্সট। আপনি দ্যাখেন, পৃথিবী থেকে কোরান বিলুপ্ত করার চেষ্টাও কিন্তু হইছে। বাট, পারে নাই কেউ। হাফেজদের ব্যাপারটা দ্যাখেন। টেক্সট প্রিজার্ভেশনের ক্ষেত্রে ইসলাম তো ইউনিক এইখানে।
দ্বিতীয়ত, আরেকভাবে ব্যাপারটা দেখা যায়। ওই টেক্সট প্রিজার্ভেশনের কথাই যদি বলি আরকি। ইসলামের টেক্সট প্রিজার্ভেশনের ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসেই একটা ইউনিক ব্যাপার। সাপোজ, আপনি দ্যাখেন, বাঙলাসাহিত্যের মধ্যযুগের আদি নিদর্শন যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, এইটাতেও টেক্সটের মতপার্থক্য আছে। কিন্তু, এইটা নিয়া নিশ্চিতভাবে কেউই বলতে পারে না যে, এইটাই সহি। কিন্তু, কোরানের সাত কেরাত বা দশ কেরাত, এইটা স্বতন্ত্র একটা জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয় আকারে ইতিহাসে আছে, এবং প্রত্যেকটা বর্ণনার রাসূল (স.) পর্যন্ত সনদ আছে। এই সনদ বা সিলসিলা, এইটাই ইসলামের ইতিহাসে সবচাইতে ইউনিক ব্যাপার। ধরেন, চার মাযহাব বা আরো যা যা আছে ফেরকা, সেগুলারও কিন্তু, সনদ আছে। তাদের সিলসিলা আছে। অর্থাৎ, কোত্থেকে কে কীভাবে আসলো, এর ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। এবং, ইতিহাসে সত্যপ্রতিষ্ঠা বিষয়ক সংগ্রামও কিন্তু আছে। সাপোজ, আমরা খৃস্টান ইতিহাসে দেখি যে, ক্যাথলিকরা প্রটেস্ট্যান্টদের উপরে অত্যাচার-নির্যাতন করতেছে। কিন্তু, ইসলামে দেখেন, মুতাযিলারা, যারা সেক্যুলারদের কাছে খুব প্রিয়, তারা কিন্তু ক্ষমতারে প্রভাবিত করছে, এবং তারাই মেইনস্ট্রিমদের উপরে অত্যাচার করতেছে। এইটা ইন্টারেস্টিং।
মোটকথা, প্রথমত, ইসলামের ভেতরে যথেষ্ট স্পেসের ব্যাপার ছিলো, আপনি দ্যাখেন, চার মাযহাব এমনকি তার বাইরে চিন্তা করা কাউরেও কিন্তু ইসলাম ‘ভণ্ড’ বলে না, একদম কোর বিশ্বাসের জায়গায় মতভিন্নতা ছাড়া। অন্যদিকে, ক্রিশ্চানদের ব্যাপারটা তো এমন না। দ্বিতীয়ত, ইসলামের ইতিহাসে টেক্সট ও কনটেক্সট প্রিজার্ভেশন, এবং এইটারে একটা জ্ঞানের শাখা হিশাবে গইড়া তোলা, এতটাই মজবুত শাখা যে, হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংসের পরেও সেই সনদ বা সিলসিলার মোটাদাগে কোন বিকৃতি বা বিলুপ্তি আসে নাই, এইটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি অন্য যেকোন ধর্মের ক্ষেত্রে এইটা পাবেন না।
জামিল : মজার ব্যাপার, ক্যাথলিকরা কিন্তু ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারে না। মানে, ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্টদের অনেকগুলা মৌলিক বিরোধের একটা বিরোধ এই যে, ক্যাথলিকরা ধর্মগ্রন্থের বা ধর্ম বিষয়ক যাবতীয় সবকিছু পাদ্রীদের হাতে দিয়া দিছে। আর প্রোটেস্ট্যান্টরা বিদ্রোহ করতে গিয়া সব নিজেদের হাতে নিয়া নিছে। এই কাজটা ভারতেও হইছে, ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যদের, বিশেষত, শুদ্রদের জ্ঞানচর্চা নিষেধ। কিন্তু, ইসলামে ‘আলেম’র ধারণাটা কিন্তু একদম আলাদা। সাধারণ মানুষের ধর্মচর্চা এবং জ্ঞানচর্চায় কোন বাধা তো নাই-ই, বরং সেইটা ফরজ। কিন্তু, তাদের আবার সুপ্রিম অথরিটিও দেওয়া হয় নাই, যাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার যে একাডেমিয়া, এইটা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এবং, এইজন্যেই কিন্তু, ইসলামের যে সনদের কথা তুমি বললা, এইটা টিকে আছে। কারণ, ধরো, সবাই যদি হাদিস নিয়া অথরিটির মত আলাপ শুরু করতো, তাইলে কি হাদিসের যে সনদ ও সিলসিলার ক্ল্যারিটি এখন আছে, এইটা থাকত!
তুহিন: হুম্মম, এইটাই।
জামিল : তো, রাসূল (স.) এর এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পেছনে তোমার পয়েন্ট মূলত দুইটা পাইলাম। এক. ইসলামে সনদ বা সিলসিলার ধারণা। আর দুই. রাসূল (স.) এর জীবনের প্রত্যেকটা বিষয়, খুব সূক্ষ্মভাবে এবং ঐতিহাসিক ধারাক্রম অনুযায়ীই সংরক্ষিত, এবং প্রমানিত….
তুহিন: বরং, ইসলামি সভ্যতায় ওনার সিরাতই একটা আলাদা জ্ঞান-শাখা…
জামিল : হ্যাঁ…আরেকটা ব্যাপার। যত ঐতিহাসিক নেতা আছে বড় বড়, সবার কিন্তু চিন্তা আর ব্যক্তিজীবনের সাথে বিরাট একটা কনফ্লিক্ট ছিলো। যেমন ধরো, মার্কস…
তুহিন: এইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। দ্যাখেন, অনেকের ব্যক্তিজীবন আবার সেইভাবে ইতিহাসে থাকেই নাই, বা আসেই নাই। যেমন, বনী ইসরাইলের অনেক নবী বা ধরা যাক, ঈসা (আ.)। কিন্তু, রাসূল (স.) এর ব্যক্তিজীবন ছিল ওনার চিন্তা ও আদর্শের অংশ, এবং এইজন্যে, ওনার কওল (কথা), ফে’ল (কাজ) এবং তাকরির (সম্মতি)—সবগুলাই ওনার চিন্তা ও আদর্শের অংশ! এইটা ওনার ব্যক্তি হিশাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পেছনে অনেক বড় কারণ।
জামিল : ইসলামে বরং, কথার চাইতে ব্যক্তিজীবনের কাজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, উসুলে হাদিসে আছে যে, কোন সাহাবির কথা আর কাজ কন্ট্রাডিকটরি হইলে, কাজ বা আমল প্রাধান্য পাবে….
তুহিন: হ্যাঁ। আপনি দ্যাখেন, হাদিস বর্ণনা এবং সহি-যয়িফ নির্ণয়েও তো এই পন্থা কাজে লাগছে। যেমন, রাবির আদালত বা বিশ্বস্ততা। এইক্ষেত্রে বড় ব্যাপার হইলো ব্যক্তিত্ব বা মুরুয়াত যেইটারে বলা হইছে। এরকম তো আছে যে, কোন আলেম, বড় আলেম, কিন্তু হয়ত টঙ দোকানে দাঁড়ায়ে চা-পান খাওয়া আর খোশগল্পের অভ্যেস আছে, তার আদালতের ব্যাপারে মুহাদ্দিসরা সতর্ক হয়ে গেছেন। মাত্র এইটুকু কারণে। এত সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করা হইছে ইসলাম এবং নবীর টেক্সট ও জীবন। এবং, যেহেতু ওনার ব্যক্তিজীবনই ছিল ওনার আদর্শের সমান্তরাল, কথাই ছিল কাজ বা কাজই ছিল কথা বা চিন্তা, ফলে, ওনার আদর্শ টিকায়ে রাখার জন্য ব্যক্তি হিশাবে ওনারে টিকায়ে রাখা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, ওনার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব এবং এত তুমুল প্রভাবশালী হওয়ার বিকল্প তো নাই!
জামিল : হ্যাঁ, মানে ‘আল ইসনাদ মিনাদ দ্বীন’-এর অর্থ অনেকে ভাবে যে, জাস্ট হাদিসের সাথে সনদ থাকবে। কিন্তু, এই বাক্যের হিডেন অর্থ এই যে, যে সনদে আপনি হাদিস বলবেন, সেই সনদটা খালি লেখায় না, কথায় না, কাজেও হইতে হবে রাসূলের অনুসারী, নইলে দ্বীন থাকবে না। এই যে, কথা আর কাজের যে মিল থাকা, কেবল লেখায় না, ব্যক্তির জীবন বিশ্লেষণ কইরা তারে গ্রহণ-বর্জন করা, এইটাই হইলো ‘আল ইসনাদ মিনাদ দ্বীন’।
তুহিন: আবার, কেবল যে টেক্সট সংরক্ষণ হইছে, তা কিন্তু না। এগুলার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হইছে। সেগুলাও একাডেমিয়ার ওয়েতেই। ধরেন, মধ্যযুগের যে মুসলিম সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার চর্চা, এর ভিত্তি তো ছিলো ইসলাম। অনেকে এর ভিত্তি হিশাবে গ্রীক দর্শনের আরবি অনুবাদের কথা বলতে চান, আমার এইটা সঠিক লাগে না। ইসলাম যে এর অন্যতম ভিত্তি ছিলো, তার অন্তত একটা প্রমান এই যে, এই মুসলিম তাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক এদের প্রায় সকলেই ‘ধার্মিক’—মানে কোট আনকোট ‘ধার্মিক’ আরকি—ছিলেন কিন্তু। অনেকে হাফেজ এবং আলেমও ছিলেন। খালদুনের ‘মুকাদ্দিমা’য় কিন্তু দেখবেন, তার প্রত্যেকটা আইডিয়ারে ইসলামের দিক থেকে দেখার একটা প্রবণতা আছে। এটা পশ্চিমে একদমই ছিলো না, তারা আরবদের সূত্রে প্রাপ্ত গ্রীক দর্শনের উপরেই তাদের সভ্যতার ভিত্তি রাখছে; যারা ধর্মীয় লাইনে চেষ্টা করছে, টিকতে পারে নাই তারা৷ অথচ দেখেন, এক গাজালি গ্রীক দর্শনের চিন্তাগুলিরে কিন্তু একদম নাই কইরা ফেলছিলো তার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। এবং শুধু ইসলামি দর্শনই না, গ্রীক দর্শনের প্রেক্ষিতেও গাজালি গুরুত্বপূর্ণ। এইটাও ইসলামের অন্তর্গত শক্তি মনে হয় যে, অ্যাজ আ রেলিজিওন, সে একটা সভ্যতা ক্রিয়েট করতে পারছে।
জামিল : খালদুনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার দুইটা। মুকাদ্দিমায় দেখবা প্রত্যেকটা পরিচ্ছেদের শেষে একটা কইরা কোরানের আয়াত আছে। সেকেন্ডলি, দেখবা যে, পুরা মুকাদ্দিমায় একটা মতেও খালদুন কোরান-হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু বলেন নাই।
তুহিন: বরং, সাহাবিদের পারস্পারিক যুদ্ধের ঘটনাগুলাও উনি খুব সাক্সেসফুলি ডিল করছেন, যেইখানে মওদুদি সাহেবের মত লোক মু’তাদিল থাকতে পারে নাই।
জামিল : মওদুদি সাহেবের ‘জাহিলিয়াত’ তত্ত্ব আছে। যে, রাসূল (স.) এর মৃত্যু এবং চার খলিফার মৃত্যুর পরেপরেই ইসলাম তার মূল থেকে সরে গেছে। এইটা মারাত্মক। সিলসিলা না থাকলে এই অভিযোগ খণ্ডন কঠিন ছিলো।
ওকে৷ আমরা আজকে দুইটা টপিকে আলাপ করব। একটা হলো গিয়ে, রাসূল (স.) ইসলামের ইতিহাসে এতটা প্রভাবশালী কেন। এর দুইটি কারণ। এক হইলো, রাসূলের জীবন যথাযথ সংরক্ষিত এবং বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষিত। আর দুই, রাসূলের আদর্শ আর জীবনের তেমন ফারাক নাই, বরং তার জীবনই আদর্শ। সেইদিক থেকে মার্কসরে দেখলে দেখা যায়, সে তো ব্যক্তিজীবনে সৎ ছিল না। যেমন তার মিস্ট্রেস ছিলো। মজার ব্যাপার, মার্কসরে নিতে পারলেও, মজহাররে আবার ট্রোল করে সেক্যুলাররা। এইটা তাদের জীবনের দ্বৈততা।
এখনকার আলাপ এই যে, এই সময়ে আইসা রাসূল (স.) কেন প্রাসঙ্গিক?
তুহিন: হুম্মম।
জামিল : এ ব্যাপারে আমার প্রথম আলাপ হইলো, ইসলাম এবং নবীর জীবনের ভেতরে কিন্তু একটা ক্রিটিক আছে।
তুহিন: যেমন? মানে, একটা রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ?
জামিল : যেমন, কোন শহরে ব্যাপকভাবে পাপ ছড়ায়ে পড়ছে। এইখানে কিন্তু ক্রিশ্চান পাদ্রীরা খুব সুন্দরভাবে ধর্মকর্ম কইরা যাইতে পারবে। কিন্তু ইসলাম পারবে না। ইসলাম সমাজ এবং রাষ্ট্ররে খুব ইনহেরেন্টলি প্রভাবিত করতে চায় এবং করে। তার ভেতরে যে ক্রিটিক, সেই ক্রিটিকের কারণে এইটা হয়। সেইদিক থেকে, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ যে এক্সপ্রেশন এইটা কিন্তু ক্রিটিকাল। মানে, পশ্চিমে যে ‘পিস’র ধারণা, যে ‘পিস’ কায়েম করতে তারা দুনিয়াব্যাপী যুদ্ধ চালাইতেছে, এই পিস কিন্তু ইটসেলফ প্রবলেমেটিক।
তুহিন: এইটা ইয়ুভাল নোয়াহ হারারির থেকে ধার নিয়া বলি। পৃথিবীতে যেকোন সভ্যতা বা জাতি একটা স্টোরি তৈরি করে। সেই স্টোরির উপর ভিত্তি করে দুনিয়া চলে। লিবারাল এলিটদের যে স্টোরি, ‘শান্তির পৃথিবী’ বানানো, এই স্টোরি এখন ভাইঙা পড়ছে। যুদ্ধ আর শান্তি, ওয়র এন্ড পিস কী জিনিশ, লিবারাল স্টোরির সহযোগী মিডিয়া আর অন্যান্য প্রোপাগান্ডা মেশিনগুলার চরিত্র এখন সবাই জানে। ফলে লিবারেলিজমের কিউট শান্তির বার্তা মাইর খাইতেছে বাস্তবতার কাছে। তো, সেই অর্থে পৃথিবীতে, ‘শান্তিপ্রিয় জাতি’ শব্দের অর্থ নাই তেমন।
জামিল : সেই হিশাবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের একটা হিডেন বাস্তবতা এই যে, এইটা আসলে ইসলামের ইনহেরেন্ট যে প্রভাববিস্তারকারী এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সচেতনতা, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যাইহোক, বলতেছিলাম যে, রাসূল (স.) এর জীবন এবং ইসলামের ভিতরে একটা ক্রিটিক আছে কিন্তু। মানে ইসলাম সমাজ ও রাষ্ট্র প্রশ্নে প্রচলিত চিন্তা-ধ্যান-ধারণার সাথে সবসময় কন্ট্রাডিক্ট করে…
তুহিন: এইটা তো আমরা ভারত উপমহাদেশের ভাগ আর হান্টিংটনের ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন থিওরি দিয়া সহজেই বুঝি আসলে!
জামিল : এখন প্রশ্ন হইলো, এই যে কন্ট্রাডিক্টরি ব্যাপারটা, এইটা কেন? আমার মনে হয়, এইখানে ইসলামে ‘আল্লাহ’র যে কনসেপ্ট, এইটা ইম্পর্ট্যান্ট। ইসলামে ‘আল্লাহ’ নিছকই প্রভু আর মনিব না। আল্লাহর যে সিফাতগুলা, অন্নদাতা, কাদের বা ক্ষমতাবান, এইগুলা গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে আল্লাহ মানুষরে নিছক তার দাস কইরা রাখে না, বরং, মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। মানে, আল্লাহ বান্দারে একটা ক্ষমতা দিয়া দিছেন। বান্দার ভিতরে সেই গুণের একটা প্রকাশ আছে…
তুহিন: মানে, খলিফা হওয়ার ব্যাপারটা। মানে নিছক আবেদ না। কাইন্ড অফ স্বায়ত্তশাসন। মানে দুনিয়ার স্বায়ত্তশাসন আল্লাহ বান্দারে দিছেন, এরকম…
জামিল : এইখানে একটা আয়াত খুব গুরুত্বপূর্ণ। আয়াতটা হলো, শুয়াইব (আ.) কে তার কওম বলতেছে যে, ‘হে শুয়াইব! তোমার নামাজ কি আমাদের দেবদেবির পুজা বাদ দিতে বা আমাদের সম্পদ আমরা যেমন ইচ্ছা খরচ করব এ থেকে বাধা দেয়?’ মানে, মুশরিকদের একটা কমন প্রশ্ন এবং বিস্ময় ছিলো যে, আমরা যা করি, তোমার কী? কিন্তু কনফ্লিক্ট বা সংঘাতের, দ্বন্দের একটা কনসেপ্ট ইসলামে আছে।
তুহিন: মানে সংঘর্ষ এই অর্থে যে, আপনার বিশেষ কিছু বলার আছে যা এক্সিস্টিং সিস্টেমরে চ্যালেঞ্জ করে।
জামিল : মানে, যেই সমাজে জাহিলিয়াত আছে, সেই সমাজে তুমি ইসলাম চাইলে সংঘর্ষ অনিবার্য…
তুহিন: এটলিস্ট ক্রিটিক অনিবার্য আরকি…
জামিল : হ্যাঁ, মানে চিন্তার সংঘর্ষ। এবং চিন্তার সংঘর্ষ, চিন্তা ও আদর্শের বৃহত্তর সংঘাতের শেষ ফয়সালা কিন্তু ক্ষমতার সংঘাতে হয়। নিছক চিন্তার সংঘাতে ফয়সালা হয় না কোন।
তুহিন: ব্যাপারটা ক্রিটিকাল। আধুনিককালে দেখা যায় যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা-দর্শনের ইতিহাস আসলে ক্ষমতারই ইতিহাস। রাজনীতির ইতিহাস। জ্ঞানের যে নিছকই একটা নান্দনিক মোরাল গ্রাউন্ড, তা নাই। জ্ঞানরে বলা হইতেছে পাওয়ার। হাহা।
জামিল : হুম্ম, গত চল্লিশ বছরে দ্যাখো, বড় বড় যুদ্ধগুলার সব আমেরিকা করছে! বরং, পুরা ইওরোপ। সাপোজ, ন্যাটো। এরসাথে তো গোটা ইওরোপ জড়িত। তো, এইসময়ে আইসা, রাসূলের জীবনের মধ্যে যে ক্রিটিক বিদ্যমান, এইটা এইসময়ের প্রেক্ষাপটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
তুহিন: হুম্মম…
জামিল : তো আমার কাছে মনে হইছে যে, এক হইলো আল্লাহর খেলাফত পাওয়ার ধারণা, আর দ্বিতীয়ত, ইসলামের ভেতরে যে ক্রিটিক বিদ্যমান, এই দুইটা জিনিশের জন্য রাসূল (স.) এই সময়ের প্রেক্ষাপটে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তোমার কী মনে হয়?
তুহিন: আমার যা মনে হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যে ‘পিস’র স্বপ্ন দেখাইছিলো ইওরোপ, এবং যে পিসের স্বপ্ন দেখাইয়া একটা লিবারাল ওয়ার্ল্ডের কথা তারা বলতো, সেইটা ভাইঙা পড়ছে। এবং নতুন কোন স্টোরি সে দিতে পারতেছে না। বরং ওয়র এন্ড টেররের মিথ এখন পষ্ট। এই যে না করতে পারা, কোন গল্প দিতে না পারা, একটা গ্রেট দুনিয়ার কল্পনা ভাইঙা পড়া, ভাইঙা টুকরা টুকরা হওয়া, এই প্রেক্ষিতেই কিন্তু পোস্ট-মডার্নিজম আসলো…
জামিল : পোস্ট-মডার্নিজমরে তোমার নৈরাজ্য মনে হয় না?
তুহিন: হ্যাঁ, নৈরাজ্য তো ঠিক আছে। নৈরাজ্য বা অ্যানার্কি তো পোস্ট-মডার্নদের একটা ফিচারও বটে। কিন্তু কেন মডার্নিজম ফল করলো, আর পোস্ট মডার্নিজমের উত্থান ঘটলো, আমি সেইটা বললাম। তো এই পোস্ট মডার্নিজম কিন্তু আসলে কোন তত্ত্ব না। এইটা হইলো কিছু না থাকার তত্ত্ব, এবং ইনভেন্টেড…
জামিল : আচ্ছা, তুমি যেইটা বললা যে, লিবারাল স্টোরি ভাইঙা পড়ছে। তাইলে নবীজি কি ইসলামের নামে একটা গল্প ইনভেন্ট করছেন, এবং এখন আমাদের, এই লিবারাল স্টোরি ফল করার কারণে নতুন একটা গ্রেটার স্টোরি তৈরি করতে হবে, এমন? ইসলাম কিন্তু গল্প বা মিথের ধারণারে সমর্থন করে না। সেই অর্থে গল্প বা ফিকশনের কী অর্থ হইতে পারে?
তুহিন: না, গল্প বলতে আসলে, গল্প মানেই যে ফিকশন বা মিথ সেরকম কিন্তু না। গল্প মানেই যে আপনার বানাইতে হবে তা কিন্তু না। ধরেন, গল্প আছে। কিন্তু মানুষ জানে না। আপনার তাদেরকে সেই গল্পটা জানাইতে হবে।
যেমন বলি, ধরেন, গল্প বা মিথ কী? এক ধরণের মোটিভেশনাল স্পিচ। ইসলাম কিন্তু মোটিভেশনাল স্পিচ দেয় না। কারণ, দুনিয়ার সফলতা-ব্যর্থতারে ব্যাখ্যা করার ইসলামের নিজস্ব ওয়ে আছে। সো, গল্প বা স্টোরি এই অর্থে না যে, মিথ তৈরি করা লাগবে, মানুষকে মোটিভেশনাল স্পিচ দেওয়া লাগবে। বরং, এর অর্থ এই যে, আপনার তারে সে যা জানে না, বা জানে কিন্তু বোঝে না, তাই জানাইতে হবে, বুঝাইতে হবে। এইটারে আপনি সূরা যারিয়াতের এই আয়াতের ব্যাখ্যায়ও নিতে পারেন—’স্মরণ করিয়ে দেও। স্মরণ করিয়ে দিলে মোমিনের ফায়দা হয়।’
জামিল : আচ্ছা, মানে গল্প বলতে আমি যেটা বুচ্ছি সেটা হলো, একটা গ্রেটার রিয়ালিটি। যেমন, তুমি দ্যাখো, বৃটিশ আমলে মুসলমানদের সামনে কিন্তু ‘গল্প’ ছিলো না। গল্প মানে কিন্তু লিগ্যাসি বা পরম্পরার জ্ঞানও। মানুষের পরম্পরা বা লিগ্যাসি লাগে, সেই ধারণা না থাকলেও মানুষ তার অস্তিত্বহীনতায় ভোগে। এই অর্থেও তখন সে ‘গল্পহীনতা’য় ভোগে। গল্প মিনস ‘আখবার’, আখবার অর্থে গল্প। যে অর্থে হাদিসও অনেক সময় গল্প। তো সেই অর্থে, তোমার কি মনে হয় না যে, ২০১৩ এর পরে, বা এই সময়ে, সারা বিশ্বেই একটা গল্প তৈয়ার হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হইছে?
তুহিন: আসলে, এইটা অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। ধরেন, বৃটিশ আমলে মুসলিম লেখকদের সামনে গল্প ছিলো না যেইটা বললেন….ধরেন, নবীজির কথাই যদি ধরি। কোলকাতার আব্দুল আজিজ আল আমান সম্ভবত প্রথম এই উদ্যোগটা নেন, নবীজিরে অ্যাজ আ হিউম্যান বিয়িং, উন্মোচন করা। ওনার ‘রৌদ্রময় ভূখণ্ড’ আর ‘মানুষের নবী’ এইক্ষেত্রে গ্রেট কাজ। এইটা কম ছিল৷ বা যা ছিল, সেইটা হয়ত সো কল্ড ‘মেইনস্ট্রিম’ ছিল না। আজকে ‘পরস্পর’-এ হাসান রোবায়েতের নবীজিরে নিয়া লেখা দীর্ঘ কবিতাটা পড়ছেন? ওইটা পড়লে দেখবেন, এইটার নবীজিরে দেখার চোখ একদমই আলাদা। নবীজির সীরাতের বইগুলার ভাব-গাম্ভীর্য বা নিছক গবেষণা ও ভক্তিধর্মিতা, অন্যদিকে সেক্যুলারদের অভক্তি, বিরক্তি বা বিদ্বেষ—এইগুলার বাইরে ব্যাপারটা। মানে, নবীজিরে হয়ত আমার গ্রামে নিয়া যাওয়া, সেই গ্রামের প্রেক্ষাপটে নবীজিরে আবিষ্কার। এইটা কিন্তু মারাত্মক….কবিতায় বা ফিকশনে এই কাজ গুরুত্বপূর্ণ। এই যে নবীজিরে মানুষ হিশাবে আবিষ্কার—এই টার্মের বিপদও আছে। মানে, নবীজি কি মানুষ ছিলেন না? হ্যাঁ, উনি তো মানুষই ছিলেন। সেই মানুষরে আবার ‘মানুষ’ বা মানবধর্মের অনুসারী মানুষ বানানোর যে পশ্চিমা সেক্যুলার প্রোজেক্ট, সেই প্রোজেক্টের আলাপ না এইটা। এইটা হইলো ধরেন, মানুষ হিশাবে আবিষ্কার, মানুষের সাথে রিলেট করা, আমাদের জীবনের সাথে রাসূলের জীবনরে রিলেট করতে পারার যে নন্দন, যে মানবীয় আবেগ, সেই আবেগের বহি:প্রকাশ। তো গল্প কিন্তু নির্মাণ শুরু হয়ে গেছে।
জামিল : আচ্ছা, তুমি আরেকটা কথা যেইটা বললা, যে একটা চিন্তাগত ক্রাইসিস তৈরি হইছে। লিবারাল বয়ান বা স্টোরি ভাইঙা পড়ছে। তো, এই সময়ে নবীজির জীবন থেকে বা আরো ব্রডার অর্থে ইসলাম থেকে কোন নতুন বয়ান আসতে পারে? মানে, প্রশ্নটা ফেকাহর না কিন্তু। ফেকাহ রাজনীতিরে ডিল করতে পারে না অনেকক্ষেত্রেই। তো ফেকাহ তো আছেই। কিন্তু নিছক ফেকাহ দিয়া কিন্তু বয়ান বানানো যায় না….
তুহিন: হ্যাঁ।
জামিল :যেমন, এই যে ঈদে মিলাদুন্নবী। এইটার মধ্যে অনেককিছুই বেদাত, ওকে। কিন্তু গল্প, সংস্কৃতি বা কালচার নির্মাণের জায়গায় এগুলার তো গুরুত্ব আছে….
তুহিন: এইটা তো আছেই। আবুল মনসুর সাহেব তার ‘বাংলাদেশের কালচার’ বইতে এইদিকে ইশারা করছেন কিছু। কালচার নির্মাণের ব্যাপার তো আছেই। আবার, এই যে গ্রেটার গল্প তৈরি, ডিসকোর্স, সেখানেও এর গুরুত্বও আছে। আপনি মুসলিম সাম্রাজ্যগুলার দিকে তাকাইলে দেখবেন যে, প্রত্যেকটা সাম্রাজ্যের ভিতরেই এই ধরণের গ্রেটার গল্প বা কালচার নির্মাণের প্রয়াস ছিলো। তো, এই ব্যাপারগুলি তো আছে….
জামিল : আরেকটা ব্যাপার, এই যে কওমির মধ্যে ‘বেদাত’, ‘গোমরা’ এই ধারণাগুলা যেভাবে জেনারেলাইজড হইছে, এইটাও কিন্তু কওমির মধ্যে এক ধরণের পপুলিজম। এর বিপরীতে কিন্তু ক্রিটিকাল অনেকেই আছেন। বিশেষত যারা গবেষক, তাত্ত্বিক। যেমন, এক মুফতি সাহেব, অনেক বড় মুফতি, উনি সেদিন আমারে বলতেছেন যে, মিলাদুন্নবী নিয়া নানান মতই তো আছে, সব বললে আমারেই এরা গোমরাহ বানায়ে ফেলবে…এই পপুলিস্ট ধর্মের ধারণাটা কিন্তু প্রবলেমেটিক…
তুহিন: এই যে ধর্মের একটা পপুলিস্ট রুপ, এইটা পাকিস্তান আমলেও যদি দেখেন, সেক্যুলারদের হাতেই তৈরি৷ বা বৃটিশদের। আলেমরা তখন তুলনামূলক অনেক কারেক্ট ছিল পলিটিকালি। পাকিস্তান আন্দোলন বা অখণ্ড ভারত আন্দোলনে এই কারণেই আপনি আলেমদের দেখবেন, তারা কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা বা ঘৃনা-দ্বেষ এইগুলারে ওভারকাম করতে পারছিলেন….
জামিল : আরেকটা ব্যাপার, গত রবিবার আমি যখন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ওইখান থেকে আসতেছি, তো ওয়াজে বলা হচ্ছে যে, এই মিলাদুন্নবী পালনকারীরা ইহুদি-নাসারাদের দালাল এবং এদের দেশ থেকে উৎখাত করতে হবে। তো এইসব কারণে, এই বিরোধ ও মতভিন্নতাগুলির ব্যাপারে কোন আলাপে না আইসা, পপুলিস্ট চর্চা ও সিদ্ধান্তের কারণে, যে গ্রেটার স্টোরির কথা আমরা বলতেছি, সেটা তো ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে….
তুহিন: হুম্ম, তা তো হইতেছেই। আসলে, অনেক গল্পের সম্ভাবনাই আছে। পোস্ট-মডার্ন যুগে আপনি একাট্টা গল্প তৈরি করা মুশকিল। ধরেন, গল্পহীনতারেই অনেকে ভাবতেছেন এই যুগের গল্প। নীতিহীনতাই নীতি। কেউ ধরেন টেকনোলজিরেই ভাবতেছে আগামীর খোদা, AI-এর কথা তারা বলতেছেন, যেমন ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি খুব বলেন এইসবের কথা। কিন্তু, এইসবের বাইরের সত্য এই যে, ভ্যাকুয়াম তৈরি হইছে। স্পেসও। ধরেন, পোস্ট-মডার্নিজমের কারণে আধুনিকতার যে গৎবাঁধা এনলাইটেনমেন্টের ধারণা, সেইটা হোঁচট খাইছে৷ যার ফলে স্পেস তৈরি হইছে। এখন, এই যে দেশে দেশে পপুলিস্টদের উত্থান, ভারত-আমেরিকা, একটা হইলো লার্জেস্ট ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি, আরেকটা হইলো ডেমোক্রেসির বাপ—এই দুই জায়গায় উগ্র ডান সরকার বসা। এইগুলি কিন্তু নিছক টেকনোলজির জয় বা অ্যানার্কি থেকে অনেক ডিফ্রেন্ট কন্ডিশন। আমেরিকা টেকনোলজিতে শীর্ষ দেশ, তো? ট্রাম্প তো সেইখানেই আছে। নোয়াহ হারারি যে দেশের প্রফেসর, সেইটা একটা থিওক্রেটিক রাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে বড় প্রবলেম। ইজরাইলের এই এক্সিস্ট্যান্স তো নিছক AI-এর উপরে বা টেকনোলজির উপরে না। একটা গ্রেটার স্টোরি আছে এর পেছনে, যে গল্প ধর্মীয় উন্মাদনা, নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হিশাবে নিজেদের কল্পনা করা এবং এই সমস্ত বিষয়ের উপরে দাঁড়ায়ে আছে। তো, ভ্যাকুয়াম আছে। এবং, আপনারে গল্প তৈরি করতে হবে। ধর্ম এই সময়ের পৃথিবীতে অবশ্যই বড় ফ্যাক্ট, এটা সত্য…
জামিল :ইওরোপের পত্রিকাগুলা যদি ধর্ম, ইসলাম, জঙ্গী এসব বাদ দেয়, তাইলে এরা তো গরীব হইয়া যাবে….
তুহিন: টিআরপির কথা আমরা মজা কইরা বললেও, পত্রিকার জন্যে টিআরপি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু…হাহা….
জামিল :মানে, সেক্যুলার মিডিয়াগুলার অস্তিত্ব অনেকটা ধর্মের উপর নির্ভরশীল…
তুহিন: মানে, আইদার ওয়ে, আপনি এইটা ভাবতে পারেন আরকি!
জামিল : আচ্ছা আমাদের আলাপটা শেষ মেবি। মানে একটা গল্পের সংকট আছে এবং একটা ক্ল্যাশের সম্ভাবনা আছে। নতুন গল্প কখনোই ক্ল্যাশ ছাড়া তৈরি হয় না, এখন এই ক্ল্যাশ নানা রকমের হইতে পারে, আমরা অবশ্যই বোম-মারা ক্ল্যাশের কথা বলতেছি না…আচ্ছা। তো, আগে এই যে গল্প তৈরির ব্যাপারটা, এইটা গণতান্ত্রিক ছিল না, এখন সোশাল মিডিয়ার কারণে কিন্তু এইটা অনেক গণতান্ত্রিক এবং সহজ, একটা নতুন সম্ভাবনা….
তুহিন: হ্যাঁ তা তো বটেই। একটা একটা নতুন অবস্থাও বটে। সোশাল মিডিয়া তো একটা নয়া রিয়ালিটি। ধরেন, লিবারেল গল্প ফল করলো কীভাবে? আগে আমরা মিডিয়ারেই ভাবতাম ঈশ্বর, রেডিওর বাঙলা অনুবাদের আয়রনিটা খেয়াল করেন—’আকাশবাণী’; হাহাহা। সোশাল মিডিয়া আসার পরে লিবারেল এলিটদের সবচাইতে বিশ্বস্ত সহযোগী মিডিয়া ধরা খাইলো। মানুষের চোখের সামনে গত কয়েকবছরে এদেশের মিডিয়াগুলি ভাইঙা পড়লো। এখন তাদের ক্ষমতা আছে খালি, বিশ্বাসযোগ্যতা নাই; এজন্যেই একাত্তর টিভি এখন তার প্যানেল মেম্বারদের পুলিশে দিতে পারে বড়জোর! তো এইটা।
আবার, বিপদও আছে। কারণ, সোশাল মিডিয়াও লিবারেল এলিটদের হাতেই। এরা এইটারে নিয়ন্ত্রণ করতে চাবে এবং চাচ্ছে, এবং আপনি দেখেন, সোশাল মিডিয়া দিয়েও মানুষের চিন্তারে ম্যানিপুলেট করার বড় চেষ্টা চলতেছে৷ এবং, এইটা বেশি কার্যকরী, কারণ সোশাল মিডিয়ারে মানুষ অনেক বেশি আপন ও নিজের ভাবে। ইতিমধ্যেই ফেসবুক থার্ড পার্টি কেলেঙ্কারিতে জড়াইছে। সো, সোশাল মিডিয়া সম্ভাবনা অবশ্যই, তবে তার চাইতেও বড় দুর্ঘটনাও সে ঘটাইতে পারে।
জামিল : যাহোক, তাইলে আমাদের দ্বিতীয় আলাপটার সাম-আপ হইলো, এই সময়ে আইসা লিবারেল স্টোরি ভাইঙা পড়ছে এবং নতুন ডিসকোর্স কেউ দিতে পারতেছে না…একটা চিন্তাগত ভ্যাকুয়াম তৈরি হইছে। এবং, ইসলাম যেহেতু আল্লাহর খেলাফতের ধারণা মানে এবং নবীর জীবনের মধ্যে একটা ক্রিটিক বা বিদ্যমান অবস্থারে প্রভাবিত করা বা তার সমালোচনার ব্যাপার আছে, সুতরাং, পৃথিবীর এই পরিস্থিতিতে নবীজির জীবনের এই ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। এবং, এই সময়ে নতুন স্টোরি বা ডিসকোর্স তৈরির ক্ষেত্রে ধর্ম অনেক বড় ফ্যাক্ট। যাহোক, শুকরিয়া।
তুহিন: শুকরিয়া।
The post ইসলামের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিশাবে রাসুলের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%87%e0%a6%b8%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%95%e0%a7%87%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a7%9f-%e0%a6%9a%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%8d-2/
No comments:
Post a Comment