রাকিবুল হাসান:
সদর দরজা খোলাই ছিল। নাবীলের পেছন পেছন ভারী পর্দা ঠেলে আমিও ঢুকলাম ছোট্ট একটি রুমে। কাঁচের জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। মেঘে মেঘে মন খারাপ আকাশের। আসরের নামাজ পড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় আসতে আসতে মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল রহমতুল্লাহ আলায়হি’র ছোটছেলে নাবীলকে বলছিলাম, ‘ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর তোমার আব্বুকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা করতে চায়।’ নাবীল করুণ একটা হাসি ঠোঁটে টেনে বললো, ‘বাসায় আব্বুর বইপত্র সব৷ বাসায় বসে কথা বললে কোনো ডকুমেন্ট দরকার হলে দেখাতে পারব। তাই বাসায় গেলে ভালো হয়।’ সেই সুবাদে তার পেছন পেছন তাদের বাসায় আসা।
রুমে নাবীলের বড়ভাই লাবীব বসে আছে। তার সঙ্গেও ফোনে কথা হয়েছিল। লাবীব শ্যামলী, কল্যাণপুর মাদরাসাতুল কাউসার আল ইসলামিয়া মাদরাসায় জালালাইন জামাতে পড়ছে। নাবীল জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসায় হেদায়াতুন নাহু জামাতে পড়ছে। তাদের বাবাকে নিয়ে গল্প উঠতেই আবেগাপ্লুত ও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল দুজন। লাবীবের চেয়ে নাবীল কথা বলল বেশি।
নাবীল বলল, যতদিন মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. বেঁচে ছিলেন, আব্বু ছিলেন তার পিএস। তার নিজের কোনো জীবন ছিল না তখন। আমিনী সাহেবের সঙ্গে থাকতেন, মাহফিলে যেতেন, পত্রিকায় বিবৃতি দিতেন। আমিনী সাহেব হুজুর যখন মারা গেলেন, আব্বু রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। কিন্তু তখন নিজেকে মেলে ধরতে চাইলেন আপন সীমানায়, আপন প্রতীভায় ৷ শুরু করলেন বই লেখা, বই অনুবাদ। টুকটাক মাহফিলেও যেতে শুরু করলেন তখন।’
আমি বললাম, হুজুর আপনাদেরকে কখনো লেখালেখি করতে বলতেন না? লাবীব মুচকি হেসে বলল, প্রায়ই বলতেন। লেখার চর্চা করো, বই পড়ো। কথা কেড়ে নিয়ে নাবীল বলল, আমার নানা যখন মারা যান, আব্বু আমাদের কয়েকবার বলেছেন তোমাদের নানার জীবনীটা তোমরা লেখো। লেখালেখি চর্চার কথা যেমন বলতেন, বক্তৃতার কথাও বলতেন।
ফিরে এলাম আগের কথায়। জানতে চাইলাম—আমিনী সাহেব রহ. মারা যাবার পর পুরোদমে লেখালেখিতে নিযুক্ত হলেন। তার কয়টি বই বেরিয়েছে? লাবীব বলল, দুটি। মাকতাবাতুল আযহার থেকে ‘রাসূল সা. এর মুজেযা’ এবং এমদাদিয়া লাইব্রেরি থেকে দুই খণ্ডের ‘স্বপ্নের বিবরণ’। নাবীল ইচ্ছে করেই বলল, কিছু অপূর্ণ পাণ্ডুলিপি আছে, পূর্ণ করে যেতে পারেননি।
পাণ্ডুলিপির কথা শুনে আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। পাণ্ডুলিপিগুলো কোথায় জিজ্ঞেস করতেই নাবীল খাটের নীচ থেকে টেনে বের করল একটি ট্রাংক। ট্রাংকের ভেতরে সারি সারি করে সাজানো ফাইল। একটা কাগজও অগোছালো নেই। নাবীল বলল, এখানে আব্বুর পাণ্ডুলিপি। টুকরো লেখা। আমি একটা ফাইল খুলে দেখলাম, তাতে উর্দু একটা বইয়ের অনুবাদ চলছে। উর্দু বইটার নাম দেখা যাচ্ছে না। তবে ফেরেশতাদের বিষয়ে আলোচনা, তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা ইত্যাদি শিরোনাম দেখলাম বইটিতে। আরেকটি ফাইলে অপূর্ণ আরেকটি পাণ্ডুলিপি। এমন কয়েকটি ফাইলে কয়েকটি পাণ্ডুলিপি। এ ফোর সাইজের কাগজে কী সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরের অনুবাদ। আহলুল্লাহ ওয়াসেল সাহেব হুজুরকে কখনো দেখিনি, এখন তার পাণ্ডুলিপি ছুঁয়ে তাকে অনুভব করার চেষ্টা করলাম। লাবীব আক্ষেপ নিয়ে বলল, শেষ পর্যায়ে গিয়েও কাজগুলো অপূর্ণ রয়ে গেলো। কাউকে দিয়ে শেষ করাব, তারও উপায় নেই।’
নাবীল বলল, মৃত্যুর আগে আব্বু শিশুদের জন্য কিছু লিখতে চেয়েছিলেন। এর প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে মিশরে থাকেন মাহদি ভাই, তাকে মিশর থেকে শিশুদের বিভিন্ন বই পাঠাতে বলেছিলেন।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করব, এর আগেই নাবীল আবার বলল, আব্বু নিজস্ব বই আরও লিখতে পারতেন। তিনি অনেক বই সম্পাদনা করেছেন, অনেক বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন, অনেক স্মারকে লেখা দিয়েছেন। এগুলোতেও অনেক সময় গেছে তার।
ট্রাংকে খুঁজতে খুঁজতে পেলাম পত্রিকার কাটিংয়ের ইয়া বড় ফাইল। আহা! কত স্মৃতি! শাইখুল হাদিস আজিজুল হক রহ., খতিব উবায়দুল হক রহ., চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব রহ.-সহ আরও অনেক মহান মনীষীর রাজনীতির কর্মতৎপরতার এক দুর্লভ প্রতিচ্ছবি। ইতিহাসের অনন্য এক দলীল হতে পারে এইসব পত্রিকা কাটিং।
অপূর্ণ পাণ্ডুলিপির গল্প শুনতে শুনতে ভারী হয়ে আসে মন। আহলুল্লাহ ওয়াসেল সাহেব কাজ কম করেননি জীবনে। কিন্তু এই লেখালেখির ময়দানে তিনি যতটুকু দিতে পারতেন, তার সময়টুকু তিনি পাননি। শেষদিকে এসে যদিও শুরু করেছিলেন অপূর্ণ রয়ে গেলো সেইসব পাণ্ডুলিপি। কেউ যদি কখনো পূর্ণ করে সেসব, তাহলে জাতি উপকৃত হবে অনেক।
গল্পের মোড় ঘুরিয়ে আরেক অপূর্ণতার গল্প শুরু করল নাবীল। বললো, মনোহরদী শেখেরগাও আমাদের বাড়ি। সেখানে আমাদের বংশের আলাদা একটা মর্যাদা আছে। আমার দাদা-পরদাদারা ছিলেন আলেম। গ্রামে সবাই তাদের মান্য করত। আব্বু তো ছোট থেকেই ঢাকায় চলে এসেছেন। পড়াশুনা শেষ করে থেকে গেছেন ঢাকায়। রাজনীতিতে জড়িয়ে গ্রামে ফিরে যাবার সুযোগই পাননি। আমিনী সাহেব মারা যাবার পর গ্রামে আব্বু একটি মাদরাসা করেন। এমনিতেই আমাদের বংশের একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল গ্রামে। আব্বু যখন মাদরাসা দিলেন, গ্রামের সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। গ্রামের মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনা দেখে আব্বু বলতেন, ‘আমি যদি জানতাম এরা আমাকে এমনভাবে গ্রহণ করবে এবং এমনভাবে চাইবে, আমি আরও আগেই এখানে মাদরাসা করতাম।’ আরও আগে মাদরাসা করলে হয়ত মাদরাসাকে আরও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে যেতে পারতেন।
এক অপূর্ণ জীবন যেন আমার সামনেই বসা। নাবীল, লাবীব কর্মক্ষম হয়নি এখনো। পড়ালেখা শেষ হতে আরো অনেকদূর। এই ঢাকা শহরে যে পরিবারে কর্মক্ষম অভিভাবক নেই, তাকে কোনো যুক্তিতেই পূর্ণ বলা যায় না। হঠাৎ অপূর্ণ এই জীবন রেখে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি কেউ। আহলুল্লাহ ওয়াসেল সাহেবের কথা বলতে গিয়ে লালবাগ মাদরাসার মাওলানা আবুল কাশেম সাহেব হুজুরের চোখটা ছলছল করে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, দীর্ঘ ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর একসঙ্গে কাটিয়েছি আমি, মুফতি তৈয়ব সাহেব, ফয়জুল্লাহ সাহেব। পনেরো বছরের উপর তার বাসার লাগোয়া ছিল আমার বাসা। তার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে এখনো কষ্ট হয়।
আমি জানতে চেয়েছিলাম, শুনেছি তার পরিবারের জন্য ফান্ড তোলা হচ্ছে। হুজুর বলেছিলেন, যেহেতু তার পরিবারে কর্মক্ষম কেউ নেই, তাই চাচ্ছিলাম এমন কোনো ব্যবস্থা করে দিতে, যেন মাসিক একটা এমাউন্ট তাদের হাতে আসে। সেটা কোনো বিজনেসে যুক্ত করে দেয়া কিংবা ফ্লাট কিনে দেয়ার মাধ্যমে হোক। মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেবের উদ্যোগ এবং আমাদের ইচ্ছায় ফান্ড তুলতে শুরু করি। বাইরের কারো কাছে না; আমাদের বন্ধু এবং সহকর্মীদের মধ্যেই। লালবাগ মাদরাসার শিক্ষকগণও এতে শরীক হয়েছেন। কিন্তু টার্গেট পর্যন্ত যেতে পারিনি এখনো। প্রায় সাড়ে বারো লাখ ব্যাংকে জমা রেখেছি, পরিবারের হাতে হ্যান্ডওভার করিনি। যদি ত্রিশ চল্লিশ লাখ করা যায়, তাহলে স্থায়ী আয়ের একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারব। চেষ্টা করছি, দেখা যাক কতদূর যেতে পারি।
নাবীল বড় হবে, লাবীব বড় হবে। তাদের বাবার পাণ্ডুলিপিগুলো পূর্ণ করতে হবে তাদেরই। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমারও উঠবার প্রয়োজন। ট্রাংক বন্ধ করে এক স্মৃতির দুনিয়া থেকে আমি আবার বেরিয়ে পড়লাম পথে। মাগরীবের আজানের ধ্বনি ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কণায় কণায় মধুর গুঞ্জরণ তুলছে। আমি হেঁটে যাচ্ছি, হেঁটে যাচ্ছি, ওই আজানের ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই এখন আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
The post আহলুল্লাহ ওয়াসেল : অসমাপ্ত জীবন, অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি appeared first on Fateh24.
source https://fateh24.com/%e0%a6%86%e0%a6%b9%e0%a6%b2%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b9-%e0%a6%93%e0%a7%9f%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%b2-%e0%a6%85%e0%a6%b8%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%aa%e0%a7%8d-2/
No comments:
Post a Comment