Friday, October 29, 2021

মুহাম্মদ উদ্দিন ফওক্বের লেখালেখি ও কাশ্মীরপ্রেম

আব্দুল্লাহ আল মুনীর:

ভূস্বর্গ কাশ্মীর নিয়ে যুগের পর যুগ কথা হতে থাকবে। যতদিন কাশ্মীর মানুষের মুখে উচ্চারিত হবে, ততদিন নিজের প্রাসঙ্গিকতা জানান দিতে থাকবেন মুহাম্মদ উদ্দিন ফওক্ব। কাশ্মীরকে ধারণ করেছেন তিনি তার বর্ণাঢ্য জীবনে, অবিরত সচল কলমে, ইশকমাখা কবিতায়, সৃষ্টিশীল গদ্যে, বৈরী বাতাসের বিরুদ্ধে ঝড়তোলা সাংবাদিকতায়। তিনি এ-সবের মারফত দেখিয়েছেন কাশ্মীরকে এভাবেও উচ্চকিত যায়। পরের প্রজন্মের জন্য তিনি কাশ্মীর নিয়ে গর্ব করার, পাঠ করার এবং উজ্জীবিত হওয়ার জন্য রেখে গেছেন অজস্র উপাদান।

উনিশ শতকের হিন্দুস্তানে জাগরণ-তোলা সংবাদপত্রগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখি ফওক্বকে। একইসময়ে তাকে দেখা যায় আল্লামা ইকবালের শের-মজলিসে। কাশ্মীরের ইতিহাস নিয়ে সমৃদ্ধ কোনো কাজ প্রথমবারের মত করলেনও তিনি। কবিতা কী পত্রিকার সম্পাদকীয়! গদ্য কী পদ্য! সবখানে তার বুকজুড়ে কাশ্মীর আর কাশ্মীর। কাশ্মীরের অপরুপ মায়াময় পল্লীতে জন্মাবার সৌভাগ্যে যে ঋণ তৈরী হয়, তা কেবল ফওক্ব জীবনের ক্ষণে ক্ষণে পরিশোধ করেছেন।

২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে শিয়ালকোট শহরের নিকটে— বর্তমান পাকিস্তানশাসিত আজাদ কাশ্মীরের কোটলি জেলার হরনারায়ন এলাকায় মুন্সি লুধা খানের ঘরে মুন্সি মুহাম্মদ উদ্দিন ফওক্বের জন্ম। ঘড়তল প্রাইমারি স্কুলে সূচিত হয় তার শিক্ষাযাত্রা। উর্দু মিডল পাশ করেছেন শিয়ালকোট থেকে। সেখানেই কাব্যপ্রীতির সূচনা— জানিয়েছেন তিনি নিজেই। ১৮৯৬ এ ইংরেজি মিডল পাশ করেন। সেসময় আল্লামা ইকবাল পড়েন লাহোর গভর্মেন্ট কলেজে। আঞ্জুমানে ইত্তিহাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সাপ্তাহিক কবিতা আবৃত্তিসভা বা মুশাআরা অনুষ্ঠান হতো। সেখানেই সময়ের দুই শ্রেষ্ঠকবির মিলন। সেসময়ে ফওক্ব গজল, কাসিদা, রুবাঈয়্যাত, পদ্য লিখতেন দু’হাতভরে।

আল্লামা ইকবাল ও ফওক্ব

মুনশী ফওক্ব ছিলেন আল্লামা ইকবালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। উভয়ই দিওয়ানা ছিলেন নিজেদের মাতৃভমি কাশ্মীরের ইশকে। ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দে আল্লামা ইকবাল ও ফওক্ব বুলবুলে হিন্দ খ্যাত নওয়াব মির্জা দাগ দেহলভীর শাগরিদ বনে যান। তাঁর আসরে গজল গাওয়া শুরু করেন। লাহোরের শের-মজলিসে দু’জনের উপস্থিতি থাকতো একত্রে। উভয়ে বুঝতেন উভয়ের মেজাজ। এরপর ইতিহাসে ইকবাল আর ফওক্বের কথা এলে আসবে কাশ্মীরের মধ্যস্ততায়। উভয়ে জন্মেছেন শিয়ালকোটে। লাহোরের মাটিতে বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বল তারকা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন উভয়ে। কাশ্মীর নিয়ে এই দু’জনের চিন্তাজগত ছিলো অভিন্ন। কাশ্মীর নিয়ে যখন ফওক্ব বলেছেন, তখন তাতে অনুভূত হয়েছে ইকবালকে। তাদের লেখায় অন্যের কব্জায় থাকা মাতৃভমি কাশ্মীর ব্যাথাতুর ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। ইকবাল বলেন:

পরিশ্রমী হস্তদ্বয় দাও ভেঙে ইয়া রব
পদদলিত করেছে যারা কাশ্মীরের আত্মাকে

আর ফওক্বের কন্ঠে বেজে উঠে,

নিঃসঙ্গ ব্যক্তিরও তো বন্ধু রয়েছে
কাশ্মীরিদের হালহাকিকত জিজ্ঞাসার নেই কেউ!

আল্লামা ইকবাল তাকে ডাকতো ‘মুজাদ্দিদে কাশামিরা’ বলে। পরে এই লকব জড়িয়ে যায় ফওক্বের সাথে। এরপর ইতিহাসে অনেকেই ফওক্বের নামের লিখবেন মহান এই লকব। ইকবালের জীবন নিয়ে সর্বপ্রথম কলম ধরেন ফওক্ব। ‘হালাতে ইকবাল’ শিরোনামে কাশ্মীরি ম্যাগাজিন ১৯০৯ সালের এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এরপর বইও বের হয়। ফওক্ব বলেন, ‘ডক্টর ইকবালের সংক্ষিপ্ত জীবন ও তাঁর কিছু গজলের সংকলন এক মলাটে তার অনুমতিক্রমে আমিই সর্বপ্রথম ‘বাহারে গুলশান’ নামে প্রকাশ করি। এটা সেই ১৮৯৮ এর কথা।’

ফওক্ব ছিলেন ‘আঞ্জুমানে কাশ্মীরি মুসলমান’র সেক্রেটারি। আল্লামা ইকবাল ছিলেন একই সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি। কাশ্মীরি মুসলমানদের জন্য তাদের দৌঁড়ঝাপও হতো এক পতাকাতলে। আল্লামা ইকবাল তার কয়েকটি কিতাবের ভূমিকাও লিখেছেন। ফওক্বের নামে ইকবালের পক্ষ থেকে প্রেরিত বাইশটি পত্রের সন্ধান মিলে। যা “রূহে মাকাতিবে ইকবালে” প্রকাশিত হয়েছে। ফওক্ব তার গ্রন্থগুলোতে আল্লামা ইকবালের ব্যাপারে বিভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন, যাতে ইকবালও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ইকবালপুত্র জাস্টিস জাভেদ ইকবাল তার লিখিত ‘জিন্দা রওয়াদ’ এ ফওক্বের সেই লেখাগুলো থেকে উপকৃত হবার কথা জানিয়েছেন এবং ইকবালকে নিয়ে পড়তে হলে ফওক্বের লেখাগুলো পড়ার গুরুত্বের কথা ব্যক্ত করেছেন।

উভয়ের বন্ধুত্ব নিয়ে কালিম আখতার ‘ইকবাল আওর মাশাহিরে কাশ্মীর’ গ্রন্থে সুন্দর মন্তব্য করেছেন। আখতার লিখেছেন –‘আল্লামা ইকবাল আর ফওক্ব সাহেবকে যদি জনম জনমের সঙ্গী বলা যায়, অতিরঞ্জিত হবে না মোটেও। এক মাটি থেকেই তৈরী হয়েছিলো এই দু’জন। ইকবাল— সাইয়েদ নজির নিয়াজি ও সুলাইমান নদভীর পর যাকে সবচেয়ে বেশি পত্র লিখেছেন, তিনি হলেন এই ফওক্ব।

কাশ্মীরি সাংবাদিক হিসেবে ফওক্ব.

সে যুগের বিখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন ফওক্ব। হিন্দুস্তানে সাংবাদিকতার শুরুর দিকে সাহিত্যিকরাই সাংবাদিকতা করতো। এই তালিকায় আছেন আব্দুল হালিম শরর ও জাফর আলী খান প্রমুখ। ফওক্ব সাহেব বিক্ষিপ্ত সময়ে বেশ কয়েকটি পত্রিকা বের করেছেন। যার মধ্যে পাঞ্জায়ে ফওলাদ, কাশ্মীরি ম্যাগাজিন, আখবারে কাশ্মীরি, কাশ্মীরে জাদিদ, তরিকত, নেজাম অন্যতম। এছাড়া ‘পেসাহ আখবার’সহ বিভিন্ন পত্রিকায় চাকুরি করেছেন ফওক্ব। তৎকালীন সময়ে সাংবাদিকতায় অবদান রাখা ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লিখিত গ্রন্থগুলোতে ফওক্বের নাম অবশ্যই থাকবে। তার পত্রিকাগুলোর প্রশংসা করেছেন দাগ দেহলভী ও আল্লামা ইকবালের মত ব্যক্তিগণ।

উনিশ শতকের হিন্দুস্তানে দু’টি পত্রিকা মশহুর ছিলো। প্রথমটি ‘আখবারে আম’। ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে লাহোর থেকে এই পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকলো। সেই পত্রিকার সাথে সংযুক্ত হলেন ফওক্ব। এই পত্রিকার মালিক ছিলো কাশ্মীরি। তাই এর মাধ্যমে উঠে আসতো কাশ্মীরের হালহাকিকত। ফওক্বের তামান্নাও তো ছিলো তাই। ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দে লাহোর থেকে আরেক বিখ্যাত পত্রিকা ‘পেসাহ আখবার’ প্রকাশিত হয়। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে ফওক্ব যুক্ত হলেন সেই পত্রিকায়ও। এই পত্রিকাগুলো উনিশ শতকের শেষভাগ ও বিশ শতকে ব্যাপক প্রভাব তৈরী করেছিলো।

১৯০১ খৃষ্টাব্দে অক্টোবরে পেসাহ আখবারের চাকুরি ছেড়ে ফওক্ব নভেম্বর মাসেই নিজের পত্রিকা ‘পাঞ্জায়ে ফওলাদ’ চালু করেন, যার প্রথম সংখ্যাই চারদিক নাড়িয়ে দেয়। সূচনাসংখ্যা ছিলো বড় চমৎকার শিরোনামে ‘আল্লাহর ঘর সরকারের কব্জায়’। কাহিনিটা এমন ছিলো– লাহোর রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী শাহজাহানী আমলের একটি মসজিদ ছিলো। ইংরেজরা সেই মসজিদ কব্জা করে ট্রাফিক সুপারেন্টেন্ডেন্ট অফিস বানালো। লোকেরা বলতো টিএস অফিস। ফওক্ব সাহেব সেই মসজিদের ইতিহাস তুলে ধরে পত্রিকায় দাবি জানালেন, ইংরেজদের হস্তক্ষেপ থেকে যেন মসজিদ মুক্ত হয়। এই সংখ্যা অন্যন্য সংবাদপত্র পেলে তারাও সরব হয় এই ইস্যুতে। অবশেষে ১৯০৩ খৃষ্টাব্দে লর্ড কার্জন ঐ মসজিদকে মুক্ত ঘোষণা করে। ফওক্ব তার যাত্রার প্রথম পদক্ষেপেই বিজয়ী হলেন। পাঞ্জায়ে ফওলাদের এই দুর্দান্ত সূচনার পর আল্লামা ইকবাল লিখেন:

একটি কাগজ আছে— পাঞ্জায়ে ফওলাদ নামে
নিজগুণে তা পরিচিত হলো হিন্দুস্তানে
সাধারণ লোকজন আর বিশেষ— সবার পছন্দ
বাহ! বাহ! কাগজটি পূর্ণ কী ন্যায়-নীতিতে
কে এই পত্রিকার দায়িত্বে?
এ কথাটিও তো প্রকাশের উপযুক্ত নাকি!
তার নাম মুহাম্মদ উদ্দিন ফওক্ব
কমবয়সী ছেলে— তবে হুশিয়ার

ইতিহাসের চর্চা ও রচনায় ফওক্ব.

ফওক্বের ইতিহাসচর্চা নানাদিক নিয়ে। তিনি কাশ্মীরের সন্তান, থেকেছেন লাহোরে। লাহোরের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন। তবে তার সত্তাজুড়ে ছিলো কেবল কাশ্মীর। তিনি পরিচিত ছিলেন কাশ্মীরের প্রথম নওজোয়ান সাংবাদিক হিসেবে। গদ্য-সাহিত্য, গল্প-উপন্যাস, সাংবাদিকতাসহ নানাদিকে দক্ষতা থাকলেও তার ঐতিহাসিকসত্তা ছিলো প্রখর এবং অসামান্য। ফওক্বের আগে উর্দু ইতিহাসসাহিত্যে যদি কারও নাম আসে, তিনি শিবলী নোমানী রহ.। তিন খণ্ডে তিনি রচনা করেছেন তারিখে কাশ্মীর, তার আগে কাশ্মীর নিয়ে উর্দুভাষায় কেবল দুয়েকটি অপুর্ণাঙ্গ বই পাওয়া যেত। কাজি জহুরুল হাসান নাজেম সিওহারুভী তার ‘নিগারিস্তানে কাশ্মীর’ এ লিখেন, ‘এখন পর্যন্ত উর্দু, ফার্সী, ইংরেজিতে কাশ্মীরের ইতিহাস নিয়ে যতগুলো বই রচিত হয়েছে, তারিখে কাশ্মীর তার মাঝে সর্বাধিক বিশুদ্ধ।’ পৃথিবীর সব মানুষ নিজের গোষ্ঠীর দিকে নিজেকে সম্বোধিত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সবাই উঁচু করে ধরতে চায় নিজের সম্প্রদায়কে। ফওক্ব সাহেব এমন এক সম্প্রদায়ের ছিলেন, যা পাহাড়ে ঘেরা, ফুলেল বন-বনানীসমৃদ্ধ, কাঁচা আঙুরের ঘ্রাণে যার বাতাস সুভাসিত, লাল-নীল ফুলে দিগন্ত ছুঁয়ে যাওয়া যার উপত্যকা। সেখানের মানুষগুলো বিভিন্ন সংস্কারচ্ছন্ন হয়েও ‘মিলঝুল’ রেখে এক ও অভিন্ন। ইকবাল বলেছেন, ‘মিলেমিশে থাকো ভুবনে ‘কাশ্মীর’ শব্দটির মত’। এই নামও যেন প্রমাণ বহন করে একতার। আরবরা নিজেদের বংশপরিক্রমা সংরক্ষণে তৎপর। নিজেদের ঘোড়া, উটের বংশতালিকাও তারা অনায়েসে বলে যেতে পারতো। ফওক্ব সাহেব তার প্রিয় ‘ওয়াদি’ কাশ্মীরের হক আদায় করেছেন ‘তারিখে আকওয়ামে কাশ্মীর’ রচনা করে। পাহাড়ে ঘেরা অনিন্দ্য সুন্দর কাশ্মীরের হরেক রঙের মানুষ, সভ্যতা, আর তাদের একতা বর্নণায় অনবদ্য ও সমৃদ্ধ বই এটি। এতে এসেছে কাশ্মীরের প্রাচীন বাসিন্দাদের কথা, ব্রাক্ষ্মণ-পণ্ডিত কিংবা মুসলমানদের ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী আর সমাজের কথা।

কাশ্মীরের বিখ্যাতদের নিয়ে রচনা করেছেন ‘মাশাহিরে কাশ্মীর’ ও ‘খাওয়াতিনে কাশ্মীর’। এই ইতিহাসকর্মের মাধ্যমে তিনি কাশ্মীরের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে পৃথিবীর সামনে এনেছেন। কাশ্মীরের রোডঘাট নিয়েও তিনি লিখেছেন ‘রাহনুমায়ে কাশ্মীর’। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘হিকায়াতে কাশ্মীর’। এসব ছাড়াও তিনি লিখেছেন তারিখে আঙ্গুরা, তারিখে হুররিয়্যাতে ইসলাম, তারিখ কা রওশন পেহলু। লিখেছেন তারিখে লাহোর। সুফীদের নিয়ে রচনা করেছেন ‘ইয়াদরফতগার’।

‘ইয়াদরফতগার’ ফওক্ব লিখেছিলেন ১৯০৪ খৃষ্টাব্দে। লাহোরের সুফিরা উল্লেখ হয়েছে এই গ্রন্থে। এতে এসেছে হজরত শাহ আবুল মাআলি, শাহচেরাগ, মওজে দরয়া, শাহ মুহাম্মদ গাওস, শাহ জামাল, সাইয়্যেদ জান মুহাম্মদ হুজুরি, হজরত ঈশান, হজরত লাল হুসাইন, দাতা গঞ্জবখশ, হজরত মিয়া মির, প্রমূখ। এই বই পড়ার পর আল্লামা ইকবাল পত্র লিখলেন ফওক্বের কাছে– ‘আল্লাহওয়ালাদের হালাত’ সম্পর্কে ‘ইয়াদরফতগার’ নামে আপনি যে গ্রন্থ রচনা করেছেন, তা আমাকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেছে। ছোট এই পুস্তকের কিছু কিছু কথা পড়ে তো আমি এতটা কেঁদেছি যে ‘বেখুদ’ হয়ে গেছি। আল্লাহ আপনার দৃষ্টিকে এদিকে পুনরুজ্জীবিত করার মাঝেই রেখেছেন। ভাই ফওক! আপনি নিজেও এই দুর্লভ রত্নের তালাশে থাকুন, যা বাদশাহের ধনভান্ডারে নয় বরং কোন চাদরাবৃত্তের পদধূলিতে মিলে যায়।’

এমনকি এই বই থেকে প্রভাবিত হয়ে আল্লামা ইকবাল রচনা করেন তার বিখ্যাত পঙক্তি:

তামান্না দরদে দিল কি হো তু কর খিদমাত ফকিরু কি,
নেহি মিলতা ইয়ে গাওহার বাদশাহুঁ কে খজিনু মে

তিনি লিখেছেন অসংখ্য মানুষের জীবনচরিত নিয়ে। জীবনীকার আর ঐতিহাসিক— এই দুই সত্তাকে খুব আলাদা করেও দেখতেন না তিনি। লাহোরের ওলামা মাশায়েখদের নিয়ে লিখেছেন ‘তাযকিরাতুল ওলামা ওয়াল মাশায়েখ লাহোর’। কেবল ওলামাসমাজ নয়, এই বইয়ে এসেছে লাহোরের প্রাচীন দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিবরণও। মোল্লা শাহ খাজা শাহজাহানী’র দরসগাহ থেকে নিয়ে সমকালীন বিখ্যাত ইলমী সংগঠন ‘আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলাম’ সবই উল্লেখিত হয়েছে এই বইয়ে। লিখেছেন তারিখে শালামার, লাহোর আহদে মোগলিয়া মে, মাসিরে লাহোর। তার লেখায় এসেছে শামসে তাবরীজ, ইবরাহীম বিন আদহাম, মাওলানা রূমী, মুজাদ্দিদে আলফে সানী, খাজা হাসান বসরী, আব্দুল হাকিম শিয়ালকোটি রহ. এর মত বিখ্যাত মনীষীদের জীবন। ‘সর গুজাশতে ফওক্ব’ নামে তার একটি অপ্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। যাতে আল্লামা ইকবাল, মাওলানা আব্দুল হালিম শরর, মাওলানা হালি, দাগ দেহলভি, মুহাম্মদ হুসাইন আজাদ, আকবর ইলাহাবাদী, আবুল কালাম আজাদ, জফর আলী খান, খাজা হাসান নিজামী, আগা হাশর কাশ্মীরীসহ আরও অনেক আহলে ইলম ও আহলে কলমের সাথে ফওকের সম্পর্ক, পত্রবিনিময় সহ নানা বিষয় উঠে এসেছে।

আজাদ কাশ্মীরের শায়ের ফওক্ব.

কবিতাকে ছেড়ে ফওক্বকে ব্যাখ্যা করা অন্যায় হবে। একটি মানুষের কতগুলো প্রতিভা থাকতে পারে? অসম্ভব ছিলো না হয়তো তাদের জন্য। ফওক্ব ছিলো সেই পর্যায়ের কবি, যিনি আল্লামা ইকবালের সাথে কবিতার আসর জমাতেন। এটুকু ছাড়া আর অতিরিক্ত বিশেষণের প্রয়োজন নেই বোধহয়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ‘কালামে ফওক্ব’ নামে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। যার একেকটি কবিতায় প্রিয় মাতৃভূমির মুহাব্বাত আর ইসলামের প্রতি দিলের দরদ উপচে পড়ছে। ফওক্ব সাহেবই প্রথম কবি, যিনি কাশ্মীরের মজলুম মুসলমানদের প্রাণের কণ্ঠস্বর হয়ে তাদের অন্তরের ব্যথাগুলো কবিতাকারে সচেতন মহলের কানে পৌঁছিয়েছিলেন। কাশ্মীরের মজলুমরা তার কবিতায় পেতো আস্থা আর ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গীকার ও আহ্বান, আর অন্যরা পেতো জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও একতাবদ্ধতার শ্লোগান।

ফওক্ব শের ছাড়াও লিখতেন গজল। তার শের ও গজলে বিভাসিত হতো ওয়াদিয়ে কাশ্মীরের সৌন্দর্য, মজলুমদের সকরুণ অভিব্যক্তি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারণ। কালামে ফওক্ব ছাড়াও তিনি লিখেছেন ‘সিকাওটু কে গিত ও নগমা ওয়া গুলজার।’

বস্তুত, ফওক্ব ছিলেন নানাগুণে পারদর্শী এক ব্যক্তিত্ব। কবিতা, গজল ছাড়াও তিনি লিখেছেন উপন্যাস-গল্প ও ড্রামা। লিখেছেন আনারকলি, আকবর, নিমে হাকিম খতরায়ে জান, নাকাম, খানা বরবাদি, ইসমত আরা, গম নসীব, মহরুম তামান্না, গরীবুদ্দিয়ার, স্টুডেন্টস লাইফের মতো বিখ্যাত উপন্যাস।

শতাধিক গ্রন্থ লিখে গেছেন মুন্সি মুহাম্মদ উদ্দিন ফওক্ব। যার অধিকাংশ সুবিশাল কলেবরের। ইতিহাস লিখতে গিয়ে ঘুরেছেন হিন্দুস্তানের অলিতে গলিতে। পুরোনো কিতাবের স্তুপে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। সাংবাদিকতা করেছেন বহু পত্রিকায়। কাশ্মীর নিয়ে যতটুকু তিনি লিখেছেন, আজও বা কয়জন এর ততটুকু পেরেছেন? বরেণ্য ঐতিহাসিক আকবর শাহ খান নজিবাবাদী বলেন, ‘আমার বন্ধু আর ইতিহাসচর্চায় প্রচুর পাঠাগ্রহী সমমনা ব্যক্তি হলেন মৌলভী ফওক্ব। যে নীরবে নিভৃতে উম্মাহর বিপুল খিদমাতের জন্য পাঞ্জাব ও কাশ্মীরে গর্বের ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।’

১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে ফওক্ব গেলেন কাশ্মীর। সেখানেই অসুস্থ হলেন। চিকিৎসার জন্য চলে এলেন লাহোরে। অসুস্থতা বেড়েই চলছিলো। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে জুমআর দিন তিনি ইন্তিকাল করেন। লাহোরেই দাফন হয়। কাশ্মীর তার প্রিয় আপন কাউকে হারিয়ে হয়তো নীরবে কাঁদে এখনও।

সহায়কগ্রন্থ–

ফওকুল কাশমির : ডা. মুহাম্মদ আজমল খান নিয়াজি
ইকবাল আওর মাশাহিরে কাশ্মীর : কালিম আখতার
কালামে ফওক্ব : মুহাম্মদ উদ্দিন ফওক্ব
রেখতা : ওয়েব

লেখক— অধ্যায়নরত, সেন্টার ফর ইসলামিক থট এন্ড স্টাডিজ

The post মুহাম্মদ উদ্দিন ফওক্বের লেখালেখি ও কাশ্মীরপ্রেম appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%a6-%e0%a6%89%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%a8-%e0%a6%ab%e0%a6%93%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%b0/

No comments:

Post a Comment