Friday, October 29, 2021

লেভ তলস্তয়ের ‘শয়তান’ গল্পের পাঠপ্রতিক্রিয়া

মওলবি আশরাফ:

আমি হেঁটে গেছি মৃত্যু উপত্যকায়

‘এমনকি যদি আমি মৃত্যু উপত্যকা দিয়ে হেঁটে যাই, তখনও ভয়ে আমি হবো না বিহ্বল, কারণ আমার সঙ্গে রয়েছেন আপনি প্রভু— আপনার শাসনদণ্ড আমাকে স্বস্তি দেয়, নিরাপদে রাখে।’ (বুক অফ সাম, ২৩ : ৪)

বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক লেভ তলস্তয়ের জন্ম ১৮২৮ সালে, রাশিয়ার তুলা রাজ্যের য়াসনায়া পলয়ানা নামক স্থানে, এক প্রাচীন অভিজাত পরিবারে। জন্মের দু’বছর পরেই তলস্তয়ের মা মারা যান আর নয় বছর বয়সে বাবার ছায়া চিরকালের জন্য মাথা থেকে সরে যায়। ভাই ও আত্মীয়স্বজনদের হাতেই তিনি প্রতিপালিত হন। তাতিয়ানা নামে তার এক ফুফু ছিলেন, যিনি স্বচ্ছল হয়েও সরল ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন— তার জীবন কিশোর তলস্তয়কে বেশ প্রভাবিত করেছিল। এবং তার সাহচর্য বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। বয়স ১৮ হওয়ার পর নিজের পৈতৃক সম্পত্তির অংশ হিসেবে জন্মস্থান য়াসনা পলয়ানার বিশাল জমিদারি এবং প্রায় ৩৫০ জন ভূমিদাসের মালিকানা পান। এসময় মদ, জুয়া আর নারীদের নিয়ে নিজেকে এক লক্ষ্যহীন উচ্ছৃঙ্খল জীবনে ঠেলে দেন। এরই মধ্যে বড় ভাই তাকে ভর্তি করিয়ে দেন রুশ সেনাবাহিনীতে, তারপর তিনি চলে যান ক্রিমিয়ার যুদ্ধে গোলন্দাজ অফিসার হিসাবে। কিন্তু এই যুদ্ধের ভয়াবহতা তাকে এতটাই আহত করেছিল যে তিনি যুদ্ধ শেষে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। আর এই অভিজ্ঞতাই তার ব্যক্তিদর্শন নির্মাণে সহায়ক হয়েছিল।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মোতাবেক তলস্তয়ের জীবনীশক্তি ও কর্মোদ্যম ছিল প্রচণ্ড দানবীয় রকমের। ভালো শিকারি ছিলেন এবং ভয়ংকর একগুঁয়ে স্বভাবের ছিলেন। একবার ভালুক শিকারে গিয়েছিলেন, একটা ভালুক থাবা মেরে চোখের নীচে থেকে বাঁ-দিকের গাল ছিঁড়ে নামিয়ে দেয়; দুই সপ্তাহ পরে ভালো হয়ে তিনি ফের শিকারে যান এবং ওই ভালুকটিকে বধ করেন। বন্ধু-বান্ধব বা সমাজ কী বলবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজে যা উচিত এবং ন্যায্য বলে ভেবেছেন তাই করেছেন সবসময়। শান্ত-সুবোধ প্রকৃতির ছিলেন না, যৌবনে প্রচুর ধার-দেনা করেছেন এবং বিষয় সম্পত্তি নষ্ট করেছেন। পাদ্রি-পুরুতদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের সমালোচনা করেছেন, এবং তার শাস্তিস্বরূপ যাজক সম্প্রদায় ঘোষণা করেন যে, তলস্তয়কে খ্রিস্টধর্ম থেকে বহিষ্কার করা হলো। এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, যারা ঈশ্বর ও যীশুকে নিয়ে ব্যবসা করে তাদের চেয়ে তিনি হাজার গুণ বেশি ধার্মিক ও সাচ্চা খ্রিস্টান।

অভিজ্ঞতা তলস্তয়ের মধ্যে এই অনুভূতি জন্ম দিয়েছিল যে জীবনের আনন্দ কেবল ভালোবাসায়, হিংসাবিদ্বেষে নয়, আর ভালোবাসারই অপর নাম ধর্ম। ধর্ম ও ধর্মের সঠিক ব্যবহারই মানুষকে শান্তিময় পথে চালিত করে। তলস্তয় তাই খ্রিস্টের বাণী কার্যত বাস্তবায়নের নির্দেশ করতেন, প্রথাগত খ্রিষ্টান হতে বলতেন না। তলস্তয়ের এই শিক্ষা উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী গ্রহণ করেছিলেন, এবং বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করেছিলেন। জওহরলাল নেহেরু তাই মন্তব্য করেছিলেন— ইউরোপের লক্ষ লক্ষ যাজকের চেয়ে গান্ধীজি যিশুখ্রিস্টের বাণী বেশি বুঝতেন।

শিল্প সম্পর্কে তলস্তয়ের ভাবনা আমাদের আল্লামা ইকবালের মতোই ছিল— শিল্প কেবল শিল্পের জন্য নয়, বরং শিল্পের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ সমাজের পরিবর্তন :

ওহে দৃষ্টিধর
তোমার দৃষ্টির জাল অভেদ্য বটে
কিন্তু হাকিকতই যদি ধরা না পড়ে জালে
তা তুমি কেমন জেলে বাহে!

শিল্পের জীয়নকাঠি
জাগিয়ে তোলে জীবনের মননে
উদ্দেশ্য পরম।
শিল্প তো নয় আতশবাজি
কেবল দু’দণ্ড ঝলমলিয়ে
লীন হয়ে যাবে আকাশে!

ঠিক এই কথাই যেন তলস্তয়ের কথা। অ্যালান দ্যো বোতোঁ বলেন, ‘তলস্তয় বিশ্বাস করতেন উপন্যাসের কাজ শুধু আনন্দ দেওয়া নয় বরং এটি মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা আর সংস্কার করারও একটি উপকরণ। … তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন কোনো ভালো শিল্পকলার উচিৎ আমাদের নৈতিকতার ওপর কম জাজমেন্টাল করে তোলা। আর এটি ধর্মের একটি সংযুক্তি হওয়া উচিৎ, যা আমাদের নৈতিকতা আর দয়াশীলতার একটি মজুদ গড়ে তুলবে।’

প্রথম জীবনের উচ্ছৃঙ্খলতা জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে তার মধ্যে গভীর অনুশোচনার জন্ম দেয়। সমাজের অর্থনৈতিক অন্যায্যতার বিপরীতে তার জমিদারি জীবন ভীষণ পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। তাই তিনি সব ছেড়েছুঁড়ে গরিব কৃষকদের মতো জীবনযাপন করতে শুরু করেন। মহল ছেড়ে তাদের সাথেই বেশিক্ষণ থাকতেন। এমনকি চেয়েছিলেন তার সব সম্পত্তি গরিব-অভাবীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে, কিন্তু স্ত্রী রাজি না হওয়ায় পারেননি। এরপর স্ত্রীর সাথে তার সম্পর্ক শীতল হতে থাকে।

তার প্রভাব পড়ে লেখনীতেও— যৌনতা আর ভালোবাসার মতো সমাজের চোখে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। ব্যক্তিজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কলমে চিত্রায়িত করতে থাকেন। কবি-সাহিত্যিকদের মতো রঙচঙে বানানোর পরিবর্তে বিয়ে বহির্ভূত ভালোবাসার নামে বুজরুকির প্রকৃত পরিণতি ফাঁস করে দেন। ক্রয়টজার সোনাটা গল্পে স্ত্রীর হত্যাকারী নায়ক পজদনিশেভের মুখ দিয়ে বলেন, ‘বিয়ের আগে থাকতাম অন্য সবার মতো, তার মানে উচ্ছৃঙ্খলতায় সময় কাটত, এ ধরনের জীবনযাপন যে যথোচিত সে বিষয়ে আমাদের শ্রেণির সকলের মতো আমারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। নিজেকে ভালো মানুষ বা পুরোপুরি নৈতিক লোক ভাবতাম। মেয়ে-পটানো লোক আমি ছিলাম না; কোনো বিকৃত রুচি আমার ছিল না, লাম্পট্যকেই আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যে করে নিইনি, আমার বয়সের অনেকে যেটা করে। শুধু স্বাস্থ্যের খাতিরে, মর্যাদা বজায় রেখে সুষ্ঠুভাবে কামচর্চা করতাম। বাচ্চা পয়দা করে বা আমার প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে বোঝার মতো হতে পারে এমন মেয়েদের এড়িয়ে চলতাম। বাস্তবিক হয়তো বাচ্চা ও আসক্তি হয়েছিল কয়েকজনের, কিন্তু আমি এমন ভাব দেখাতাম যে ওসব কিছু হয়নি। এটাকে নীতিসম্মত শুধু মনে করতাম না, গর্ববোধ করতাম এমনকি।… অথচ এটাই হলো সবচেয়ে নোংরা জিনিস।’

তলস্তয়ের ‘শয়তান’ গল্পে সেই একই অনুভূতির ছায়া পাই— শরীর রক্ষার নামে, স্বাস্থ্যের খাতিরে প্রাগ-বৈবাহিক সম্পর্ক ও তার পরিণতি। পুরো গল্প জুড়ে যেন যীশুখ্রিস্টের এই বাণী বলার চেষ্টা করা হয়েছে : ‘তোমরা শুনেছ এই কথা বলা হয়েছে— “ব্যভিচার কোরো না”, কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, যে কেউ কোনো মেয়েলোকের প্রতি কামভাবে দৃষ্টিপাত করে, সে তখনই মনে মনে তার সাথে ব্যভিচার করল।’ (মথি ৫ : ২৭ ও ২৮)

উপড়ে ফেলো তোমার নরকবাসী চোখ

আলোচনার সুবিধার্থে গল্পের সারাংশ এখানে উল্লেখ করছি, যেন কোনো অস্পষ্টতা না থাকে—

‘ইভগেনে ইর্তেনেভের সামনে ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।’ সে ছিল রাশিয়ার এক জমিদার পরিবারের ছোট ছেলে। বড় ভাই আন্দ্রেই। সম্প্রতি তাদের বাবা মারা গেলে দুই ভাই যখন বাবার বিস্তর দেনার দায় দেখলেন, পারিবারিক উকিল জানালেন— আপনাদের উত্তরাধিকার অস্বীকার করে সম্পত্তি ছেড়ে দেওয়াই ভালো। কিন্তু ইভগেনে জমিদারি বহাল রেখে সব দেনা শোধ করাকেই ভালো মনে করল। বড় ভাই আন্দ্রেইকে বছরে চার হাজার রুবল দেওয়ার শর্তে পুরো জমিদারি গ্রহণ ইভগেনে তাদের মাকে নিয়ে এখানেই বসবাস করতে শুরু করে।

বুদ্ধিমত্তা আর অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে ইভগেনে একেএকে বন্ধকি জমিগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে দেনা শোধ করছিল। ধীরেধীরে সফলতার দিকে এগুচ্ছিল। কাজকর্ম ও চিন্তায় খুব ব্যস্ত, এমন সময় এক অস্বস্তিকর অনুভূতি তার মনে খচখচ করছিল। যৌনকামনা— এক দুর্দমনীয় আগ্রহ তাকে বারবার মনোযোগ থেকে সরিয়ে দিচ্ছিল।

‘বয়েস যখন কাঁচা ছিল, ইভগেনের জীবন আর দশজন সাধারণ যুবকের মতোই চলেছিল। অর্থাৎ স্বাস্থ্যবান যুবকরা সাধারণত যেভাবে জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে থাকে, ইভগেনও সেইভাবে স্বাস্থ্যরক্ষার খাতিরে চালিয়ে এসেছে। নানা ধরনের স্ত্রীলোকের সঙ্গে ইতিপূর্বে তার যৌনসম্পর্ক ঘটেছে। ইভগেনে উচ্ছৃঙ্খল বা কামুক প্রকৃতির লোক নয়। কিন্তু তাই বলে সাধু-সন্ন্যাসীর মতো জিতেন্দ্রিয় পুরুষও নয়। স্ত্রীলোকের প্রতি তার যে আকর্ষণ, অর্থাৎ যে কারণে ইভগেনে মেয়েদের প্রতি ঝুঁকেছে, সেটা একান্তই জৈব আকর্ষণ। স্বাস্থ্যরক্ষার খাতিরে, আর তার নিজের ধারণা— মনটাকে খোলা ও পরিষ্কার রাখতে হলে স্ত্রীলোকের দৈহিক সম্পর্ক অপরিহার্য পুরুষের পক্ষে। বয়েস যখন তার বছর ষোলো, তখন থেকে তার যৌনজীবন শুরু হয় এবং এতদিন চলেছে বেশ সন্তোষজনকভাবেই। বিশেষ কোনো গোলমালে পড়তে হয়নি দৈহিক প্রয়োজনের তাগিদে। কোনো হাঙ্গামা যে পোহাতে হয়নি ইভগেনেকে তার প্রথম কারণ হলো ইভগেনের দৃঢ় মন ও সংযম। কোনো দিনই সে ইন্দ্রিয়ভোগের দাস হয়নি দেহের ও মনের লাগাম বেশ কড়া হাতেই সে ধরতে জানে।… ব্যক্তিগত জীবনের এই পর্যায়টি মোটামুটি বেশ মসৃণভাবেই গড়িয়ে এসেছে। এ যাবৎ তা নিয়ে ইভগেনেকে বিশেষ কোনো বেগ পেতে হয়নি।

কিন্তু আজ প্রায় দু’মাস হতে চলল ইউজিন মফস্বলে এসে বাস করছে। এ সম্বন্ধে কী যে করা যায় সে বিষয়ে এখনও কিছু ঠিক করে উঠতে পারেনি। অবস্থান্তরে তাকে আজ অনেকদিন দেহকে উপবাসী, নিরুদ্ধ করে রাখতে হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে বাধ্যতামূলক আত্মদমনের ফলে শরীর ও মনের ওপর টান পড়তে শুরু হয়েছে তা হলে কী করা যায়? শেষ পর্যস্ত কি তা হলে দেহের ক্ষুন্নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে শহরেই ছুটতে হবে? তাই যদি যেতেই হয়— কোথায় কেমন করে তা সম্ভব হবে? এইসব চিন্তাই গত কয়দিন ধরে ইভগেনেকে উত্তপ্ত ও বিব্রত করে তুলেছে। ইভগেনের বিশ্বাস এবং ধারণা যে, শরীরের ধর্মকে বহুদিন দাবিয়ে রাখা চলে না আর তার নিজের ক্ষেত্রে সে প্রয়োজনের তাগিদ অনুভব করছে। তা হলে বর্তমান অবস্থায় সেই প্রয়োজনের খাতিরেই তাকে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হয়! কিন্তু ইভগেনের এ-ও মনে হলো যে, এখন সে তো স্বাধীন নয়, কাজের ও দায়িত্বের চারদিকের বাঁধন তাকে শক্তভাবেই বেঁধে ফেলেছে। তাই আপনার অজ্ঞাতসারেই আশেপাশে প্রতিটি যুবতী নারীর পিছু পিছু তার স্বাধীন দৃষ্টি ঘুরতে লাগল। নিজের গ্রামে বসে কোনো নিন্দনীয় ব্যাপার বা কেলেঙ্কারি করার পক্ষপাতী নয়।’

মনে মনে এবিষয়ের কোনো হিল্লে খুঁজছিলেন, এমন সময় একদিন জঙ্গলমহালের এক চৌকিদার— বুড়ো দানিয়েলের সাথে আলাপ হয়। দানিয়েল বেশ পুরোনো লোক, তার বাবার শিকারসঙ্গী। আলাপে আলাপে বুড়োকে ইঙ্গিত দেয়। বুড়ো তার জন্যে হাঙ্গাম-হুজ্জুৎ ছাড়াই এক কিষাণী মেয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। নাম স্তেপানিদা, পেশনিকভের বউ, এখনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি— ‘আঁটসাঁট গড়ন আর সুঠাম দেহশ্রী নিয়ে একটি সতেজ ফুটন্ত দেহবল্লরী।’ তো তার সাথে ইভগেনে সম্পর্ক স্থাপন করে, কেবলই মিনিট বিশেকের মামলা। ইভগেনের মনে হলো— ‘মফস্বলে পল্লিজীবনের যেটা এতদিন ধরে ছিল সবচেয়ে বড় অন্তরায় এবং অসুবিধা,— অর্থাৎ বাধ্য হয়ে জোর করা আত্মসংযমের অভ্যাস, সেটার প্রয়োজন আর রইল না। মনে এখন আর কোনো উদ্বেগ নেই। মনের সূর্যে এবং স্বাধীন চিন্তায় এখন আর কোনো ব্যাঘাতই ঘটছে না। সহজ এবং সুস্থভাবে এখন আবার নিজের সমস্ত কাজকর্মে মন দেওয়া সম্ভব হয়েছে।’ কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার সেই একই রকম খচখচানি। ইভগেনে কখনো কামুক প্রকৃতির মানুষ ছিল না, তারপরেও এক দুর্বার আকর্ষণ— সে যাকে ভেবেছিল মানসিক তৃপ্তি বা ‘এই-ই শেষ’, বরং উলটো তার মধ্যে আরও অস্বস্তি ও অতৃপ্তি আচ্ছন্ন করে তুলল, নিজেকে সামাল দিতে পারল না।

তাদের গোপন সম্পর্ক চলতে থাকে। একদিন ইভগেনে স্তেপানিদাকে তার স্বামীর সাথে দেখে। বলিষ্ঠ শরীর আর একদম স্মার্ট। অভিসারে স্তেপানিদাকে ওর স্বামীর বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে গর্বিত সুরে বলে— ‘সারা গ্রামে ওর জুড়ি নাই।’ আশ্চর্য হয়ে জানতে চায় ইভগেনে— ‘তাহলে? তবে কিসের জন্যে?…’ এই প্রশ্নের উত্তর পায় না। ইভগেনের মাথায় এই ভাবনা চলতে থাকে।

কিছুদিন পর ইভগেনে বিয়ে করে। লিজা অ্যানস্কায়া নামের এক মেয়েকে। স্ত্রী হিসেবে লিজার মতো দুষ্প্রাপ্য— এমন স্ত্রী সাত রাজার ভাগ্যেও মিলে না। সুখে শান্তিতে দিন যায় মাস যায়, পেরিয়ে যায় বছর। একদিন হঠাৎ ইভগেনের চোখে স্তেপানিদা পড়ে যায়। কোলে একটি শিশু। উৎকণ্ঠায় পড়ে যায় ইভগেনে— ‘বাচ্চাটা আমার না তো!’ আবার আপন মনেই বলে, আমার হবে কেন, ওর স্বামী সবসময় ছিল, এখনও আছে। শরীরের জন্য, স্বাস্থ্যের খাতিরে ওর প্রয়োজন ঘটেছিল একদিন, টাকা দিয়ে তা মিটিয়ে দিয়েছি। কোনো পিছুটান রাখিনি।

কিন্তু, একটা ‘কিন্তু’ রয়ে যায়…

ফের আবার একদিন দেখা। আবার ভেতরের দানব জেগে ওঠা। কিছুতেই তাকে মাথা থেকে নামানো যাচ্ছে না, যেন রাজা বিক্রমের ঘাড়ে চেপে বসা বেতাল ভূত।

‘বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকে ইভগেনের ধারণা জন্মেছিল যে, মন তার কু-ভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। অন্য স্ত্রীলোকঘটিত কোনো চিন্তাই তার মনে আর ছায়াপাত করতে পারবে না। নিজে থেকে প্রশ্রয় দেওয়া তো দূরের কথা। কিন্তু আজ এ কী হলো? কামনার দুষ্ট ক্ষত তাহলে কি এতদিন চাপা পড়ে ছিল? সুবিধা-সুযোগ বুঝে আবার আত্মপ্রকাশ করেছে? যে অস্বস্তিকর ব্যাপার তার জীবন থেকে ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলে সে ইতিমধ্যে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছিল, সেই ব্যাপারের অপ্রত্যাশিত পুনরাবির্ভাবে ইভগেনে রীতিমতো সন্ত্রস্ত, আতঙ্কিত হয়ে উঠল।

বিয়ের পর থেকে এ ভাবটা এতদিন তার হয়নি। অবদমিত ক্ষুধার অছিলা ছিল না কিছুই। নিজের স্ত্রীকে ছাড়া এ ধরনের দেহাসক্তি বা যৌনআকর্ষণ ইভগেনেকে টানতে পারেনি। না স্তেপানিদা— যে স্ত্রীলোকের সঙ্গে প্রাগ-বিবাহিত জীবনে ঘটেছিল একটা অবৈধ মিলন, না অন্য কোনো তৃতীয় রমণী। বিয়ের আগে দেহের যে চাঞ্চল্য, মনের গভীর অপ্রসাদ থেকে থেকে নাড়া দিয়ে যেত, লিজাকে কাছে পাওয়ার পর থেকে সে ধরনের মনোভাব ইভগেনেকে আর পীড়িত করেনি ।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বেঁচেছিল ইভগেনে। ভেবেছিল— এতদিনে তার মুক্তি হলো। দেহানুরক্তির প্রচণ্ড জাদুমন্ত্র কেটে গিয়েছে ভেবে তার আনন্দের সীমা ছিল না।
কিন্তু আজ? হঠাৎ এই যে দেখা হয়ে গেল দু’জনের, ঘটনার ফেরে, হয়তো এর কোনো অর্থ নেই, পিছনে নেই সুবিদিত পরিকল্পনা। নিতান্ত তুচ্ছ ব্যাপার উভয়ের এই আকস্মিক সাক্ষাৎ। আপাতদৃষ্টিতে এটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ হয়তো নয়, অন্তত গুরুত্ব আরোপ করা চলে না। তবু… তবু ইভগেনে বুঝতে পারল, তাকে বুঝতে হলো স্থির মুহূর্তে আত্মবিশ্লেষণ করে— সে আজও মুক্ত নয়। দেহ-আবেদনের ঊর্ধ্বে সে উঠতে পারেনি।’

নানা রকমের ফন্দিফিকির করে, নানা জিনিসকে আশ্রয় বানিয়েও ইভগেনে রক্ষা পায় না। তার এই জঘন্য কামনা, নীচ প্রবৃত্তি তার বিবেকবুদ্ধির টুঁটি চেপে ধরে, সে হাঁসফাঁস করতে থাকে। সে ভাবে :

‘ভেবেছিলুম— দরকার শেষ হলেই, বাঁধন কেটে বেরিয়ে আসব। প্রয়োজন ঘটেছিল স্বাস্থ্যরক্ষার খাতিরে… একটি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন নীরোগ মেয়ের! প্রয়োজন তো মিটে গেছে বহুদিন, তবে…? তা হলে দেখা যাচ্ছে, এসব ব্যাপার নিজের করতলগত নয়, নইলে কিসের জন্যে এই দীন লোলুপতা?’

অনেকটা সুস্থ ও স্থির মনেই ইভগেনে বিচার করতে বসে আপনাকে।

“নাহ্— দেখছি, এইভাবে আর চালানো অসম্ভব, অন্তত ওইরকম স্ত্রীলোকের সঙ্গে! আগুন নিয়ে খেলা চলে না। ভেবেছিলুম— আমিই বুঝি ওকে গ্রহণ করেছি, রেখেছি। এখন দেখছি— ওই আমায় পেয়ে বসেছে, বেঁধে রেখেছে… ওর হাত থেকে ছুটি-ছাড়ান নেই।”’

কোনোই কি পথ নাই? একেবারে জাহান্নাম? ‘হে ঈশ্বর…’ বলতে গিয়ে ইভগেনের কথা আটকে যায় যেন। ইভগেনে ভাবে :

“না না, ঈশ্বর এখানে নেই… আছে কেবল শয়তান… প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে দাড়িয়ে আছে এক নিদারুণ মায়াবী… সে স্তেপানিদার কবল থেকে উদ্ধার নেই আমার। ও আমাকে পেয়েছে— কাঁধে চেপে বসেছে। কিন্তু নাহ— আমি করব না, আমি পারব না। হ্যাঁ, শয়তানই তো—”’

তলস্তয় গল্পের দুটো উপসংহার টেনেছেন, দুটোই করুণ আর ট্রাজিক। এক উপসংহারে ইভগেনে আত্মহত্যা করে এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়, আর অন্যটায় ইভগেনে স্তেপানিদাকে খুন করে জেলে যায়। পাঠক হিসেবে আমরা এর কোনোটাকেই মেনে নিতে পারি না। আমরা দুটানায় পড়ে যাই— কখনো মনে হয় মুক্তির কোনো উপায় ছিল না আবার কখনো মনে হয় ছিল। যদি ইভগেনে কখনোই স্তেপানিদার কাছে না যেত, যদি তার দিকে চোখ না দিত, যদি… আমাদের বারবার মনে পড়ে যায় যীশুর বাণী : ‘তোমার ডান চোখ যদি তোমাকে পাপের পথে ডাকে তবে তা উপড়ে দূরে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত শরীর নরকে যাওয়ার চেয়ে বরং তার একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভালো।’ (মথি, ব্যভিচার বিষয়ে শিক্ষা ৫ : ২৯)

সে কি তবে গোলাম আপন ইচ্ছার?

‘সমস্ত রকমের ব্যভিচার থেকে পালিয়ে যাও। মানুষ অন্য যে সব পাপ করে তা তার শরীরের বাইরে করে, কিন্তু যে ব্যভিচার করে সে নিজের শরীরের বিরুদ্ধেই পাপ করে।’ (১ করিন্থীয়, ৬ : ১৮)

পাঠক, উপরোল্লিখিত শয়তান গল্পের সারাংশ ও উদ্ধৃতি থেকে আমরা যতটুকুই-বা বুঝতে পারি, তাতে একটি প্রশ্ন তৈরি হয় : শয়তানটা আসলে কে— নারী নাকি যৌনতা? আমি মনে করি এর উত্তর তৃতীয় আরেকটি জিনিস, একটু কাছে গিয়ে যাকে দেখতে হয়, সেটি হলো ‘যুক্তি’। গল্পের শুরুতে আমরা দেখতে পাই ইভগেনে কীভাবে স্তেপানিদার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে— তার মনে হয়েছিল শরীর ও স্বাস্থ্য রক্ষার খাতিরে ‘স্বল্পকালীন’ অবৈধ এই সম্পর্কে জড়াতে ক্ষতি কী। তার খাহেশ তাকে গোলামির শিকলে বন্দি করে ফেলেছিল। সে সেই খাহেশ পূরণে দফায় দফায় যুক্তির অবতারণা ঘটিয়েছিল, ভেবেছিল যুক্তিতে মুক্তি— কিন্তু পরিণতি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে যুক্তি আদতে পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত, মুক্তির মানদণ্ড নয়।

তলস্তয়ের এই গল্পে খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের সাথে খুব প্রচ্ছন্নভাবে যার মতদর্শনের উপস্থিতি পাওয়া যায়, তিনি বিখ্যাত দুঃখবাদী জার্মান দার্শনিক আর্টুর শোপেনহাওয়ার। ব্যতিক্রমহীনভাবে পশ্চিমের প্রায় সব দার্শনিকই যুক্তিকে জ্ঞানতত্ত্বে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, এবং মানুষকে বলাও হয় ‘যুক্তিবাদী জীব’। শোপেনহাওয়ার বলেন— ‘কোনো কিছু সম্বন্ধে যুক্তি খুঁজে পেয়েছি বলেই যে আমরা তা গ্রহণ করি এমন নয়, বরং আমরা ওটা পেতে চাই বলেই ওর সপক্ষে যুক্তি দিয়ে থাকি— এমনকি আমাদের কামনাকে ঢাকবার জন্য আমরা দর্শন আর ধর্মশাস্ত্রের দরাজ ব্যাখ্যা দিয়ে থাকি।’ একারণে শোপেনহাওয়ার মানুষকে ‘তত্ত্বজ্ঞানীজীব’ আখ্যা দিয়েছেন— অন্য জীবেরাও কামনা করে থাকে কিন্তু তত্ত্ব-বিদ্যার দোহাই দেয় না।

আমরা যত যা-ই বলি না কেন, আমরা ইচ্ছার গোলামি করি। এমনকি আমাদের শরীরও। শোপেনহাওয়ারের জবানিতে— ‘সমস্ত দেহটাই ইচ্ছার কর্মময় রূপ’। আমরা মোটেও স্বাধীন নই, বরং প্রয়োজনের দাস। সবরকমের সংকল্প আর চিন্তাভাবনা সত্ত্বেও আমরা আমাদের স্বভাব বদলাতে পারি না— আমাদের কেবল একটা চরিত্রে অভিনয় করে যেতে হয়। ইচ্ছা আমাদের অন্ধের মতো টেনে নিয়ে যায়।

কিন্তু এই ইচ্ছা আসে কোথা থেকে? শোপেনহাওয়ার বলেন— ‘আমরা যা করি নিজ ইচ্ছাতেই করি, কিন্তু কী ইচ্ছা করব তা তৈরি করতে পারি না।’ ধরুন যৌন আবেগ, এর উৎপত্তি কই? মনোবিজ্ঞান বলে মস্তিষ্কে ফিনাথাইলামিন নামের একপ্রকার পদার্থের নিঃসরণ ঘটলে মানুষের মধ্যে সবধরনের আবেগ উৎপন্ন হয়। এই ফিনাথাইলামিন কখন কিভাবে নিঃসরিত হবে তা আগেভাগে নির্ধারণ সম্ভব নয়। আমাদের মস্তিষ্ক এক শান্ত-স্থির পুকুরের মতো, কেউ যদি তাতে ঢিল ছুড়ে, তখন গিয়ে ঢেউ উঠবে। কিন্তু এই ঢিল কে ছুড়বে আর কখন ছোড়া হবে তা খোদা ছাড়া কেউ জানেন না। কেবল নারী নয়, যৌন উদ্দীপক হতে পারে যেকোনো জিনিসই— গাছের বাঁক, কাপড়, গন্ধ কিংবা রঙও যৌন উদ্দীপক হতে পারে। এ এমন শত্রু— যাকে রুখার মতো কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমাদের নাই।

গল্পে ইভগেনের পরিণতি খুবই দুঃখময়, কিন্তু সুখময় কোনো পরিণতি আছে কী? কীভাবে থাকবে, ইভগেনে তো আর দশজনের মতো সাধারণ মানুষ ছিল না। তার বিদ্যা-বুদ্ধিই তাকে আরও দুঃখী বানিয়েছে, তার ইচ্ছাকে জটিল করে তুলেছে। শোপেনহাওয়ারের মতে— ‘ইচ্ছার প্রকাশ যতই জটিল হতে থাকবে ততই যন্ত্রণাভোগও হবে স্পষ্টতর।… যে মানুষ যত বেশি জানে, তার বুদ্ধিও সেই অনুপাতে বাড়ে, ফলে তার দুঃখও বেশি৷ যে প্রতিভার অধিকারী সে-ই সবচেয়ে বেশি দুঃখ ভোগ করে।’ ইভগেনে যদি জন্তুজানোয়ারের জীবনকে উদ্দেশ্যহীন ধরে নিত, পশুর অধম অন্যান্য জমিদারদের মতো রঙতামাশায় জীবন কাটাত, তাহলে এই দুঃখ ভোগ করতে হতো না। কিন্তু তা আর হয়নি, পাকিস্তানি কবি জন এলিয়ার ‘রময’ কবিতার মতো যেন সবকিছু নির্দিষ্ট, কিছুই পরিবর্তনশীল নয়—

তুমি যখন আসবে, পাবে ছন্নছাড়া আমাকে
আমার একাকিত্বে জল্পনা-কল্পনা ছাড়া কিছুই নেই।
ঘর সাজানোর খুব ইচ্ছে তোমার
কিন্তু আমার ঘরে তো বইপত্তর ছাড়া কিছুই নেই

এই বইগুলো না বড় জুলুমবাজ— আমাকে শিখিয়েছে তাদের মাঝে থাকা এক গোপন তত্ত্ব— যে-তত্ত্ব কতল করেছে আমার দিল আমার চিত্ত :

মানুষ কখনোই পায় না আনন্দময় পরিণতির সংবাদ
না জীবন হয় কখনো সুখময়

তলস্তয়ের এই ‘শয়তান’ গল্পও গোপন তত্ত্বের সেই বইগুলোর একটি, যেগুলো মন ও মগজকে দিনেদুপুরে খুন করে, কিন্তু কোনো সমাধান বাতলায় না, কখনো ‘মসিহ’ হয়ে বাঁচিয়ে তোলে না।

সহায়ক সূত্র :

১) দর্শনের সহজ পাঠ: লিও তলস্তয়/ অ্যালান দো বোতোঁ/ অনুবাদ : কাজী মাহবুবুল হাসান
২) দর্শনের ইতিকাহিনী/ উইল ডুরান্ট/ অনুবাদ : আবুল ফজল
৩) উইকিপিডিয়া
৪) লিও তলস্তয়ের সাহিত্যজীবন/ জামিয়া রহমান খান তিশা
৫) নুকুশে ইকবাল/ সাইয়িদ আবুল হাসান আলি নদবি
৬) শায়াদ/ জন এলিয়া
৭) বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ/ জওহরলাল নেহেরু

The post লেভ তলস্তয়ের ‘শয়তান’ গল্পের পাঠপ্রতিক্রিয়া appeared first on Fateh24.



source https://fateh24.com/%e0%a6%b2%e0%a7%87%e0%a6%ad-%e0%a6%a4%e0%a6%b2%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a7%9f%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b6%e0%a7%9f%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d/

No comments:

Post a Comment